মুহূর্তের জন্য দাঁড়িয়ে আমি ঘরের চারপাশটা তীক্ষ্ণ সজাগ দৃষ্টিতে একবার দেখে নিলাম যথাসম্ভব আড়চোখে।
হলঘরটা দৈর্ঘ্যে যতটা প্রস্থে তার অর্ধেকের কিছু বেশিই হবে। যে দরজা-পথে ঘরে প্রবেশ করেছিলাম সে দরজা ছাড়াও দুদিকে আরও চারটি অনুরূপ কাটগ্লাসেরই এক পাল্লাওয়ালা দরজা চোখে পড়ল। এবং দরজাগুলোর মাথায় ইংরাজী অক্ষরে দেখলাম লেখা আছে 1,2,3,4; ঘরের ঐ দরজা ছাড়া আরও চারটি জানালা চোখে পড়ল কিন্তু সেগুলো একটু বেশ উঁচুতেই এবং প্রত্যেক জানালায় ভারি নীল রঙের পর্দা টাঙানো। তার উপরে চারদিকে চারটি ভেনটিলেটার। এ ছাড়াও ঘরে চারটি ফ্যান আছে। তবে সেগুলি বন্ধই ছিল, মাত্র একটি ছাড়া। দেওয়ালের চারিদিকেই আলো, তবে সেগুলো অদৃশ্য। নীলাভ কাঁচের আবরণে ঢাকা। ঘরের দেওয়াল একেবারে দুধ-সাদা। সম্পূর্ণ নিরাবরণ। কোথাও একটি ক্যালেণ্ডার বা ছবি পর্যন্ত নেই।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত নর-নারীরা সকলেই যে গল্প করছিল তা নয় —দুটো টেবিলে জনাপাঁচেক বসে তাসও খেলছিল। আরও একটি জিনিস নজরে পড়ল, ঘরে একটি বিলিয়ার্ড টেবিল। কিন্তু কাউকেও বিলিয়ার্ড খেলতে দেখলাম না। সকলেই যে যার নিজেকে নিয়ে ব্যস্ত। কি করব ভাবছি, হঠাৎ এমন সময় আমার ডাইনে 2 নম্বর দরজাটা নিঃশব্দে খুলে গেল ও দীর্ঘকায় এক বৃদ্ধ, পরিধানে দামী নেভি-ব্লু ট্রপিক্যাল স্যুট-ঘরের মধ্যে এসে প্রবেশ করলেন। এবং আমার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর চাপা কণ্ঠে বললেন, আসুন সত্যসিন্ধুবাবু! নমস্কার।
আমার নামটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই দেখলাম একসঙ্গে উপস্থিত ঘরের সকলেরই অনুসন্ধানী দৃষ্টি যেন একঝাঁক তীরের মতই আমার সর্বাঙ্গে এসে বিদ্ধ করল।
আগন্তুক তখন ঘরে উপস্থিত সকলকে লক্ষ্য করে বললেন-Ladies and gentlemen! আসুন আপনাদের পরিচয় করিয়ে দিই আমাদের বৈকালী সঙ্ঘের নতুন সভ্য শ্রীযুক্ত সত্যসিন্ধু রায়ের সঙ্গে। ইনি চক্রধরপুরের একজন বিখ্যাত কোল মার্চেন্ট।
অতঃপর প্রত্যেকের সঙ্গে নাম করে করে আলাপ করিয়ে দিতে লাগলেন আগন্তুক: ইনি সলিসিটার সানু ভৌমিক, ইনি অ্যাডভোকেট নীলাম্বর মিত্র, ইনি মার্চেন্ট শ্ৰীমন্ত পাল, ইনি ব্যারিস্টার অশোক রায়, ইত্যাদি ইত্যাদি।
প্রতিবারেই আগন্তুকের মুখের দিকে তাকাচ্ছিলাম। দীর্ঘকায়, বয়স মনে হয় পঞ্চাশোত্তীর্ণ, ষাটের কাছাকাছিই হবে। মাথার চুল কোঁকড়ানো, ব্যাকব্রাশ করা এবং একেবারে সাদা। চোখে একটি কালো কাঁচের চশমা। পুরু ওষ্ঠ এবং উপরের পাটির দাঁতের সামনের দুটো দাঁত যেন একটু বেশী বড়। গাল সামান্য তোবড়ানো, বোঝা যায় মাড়ির দাঁত নেই। মুখে সাদা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি। সামান্য একটু কুঁজো হয়ে দাঁড়ান। গলাটা ভারী এবং গম্ভীর হলেও কেমন যেন একটা অদ্ভুত মিষ্টত্ব আছে কণ্ঠস্বরে।
আচ্ছা, তাহলে আমি চললাম। Make yourself comfortable Mr. Roy। বলেই বললেন, আশ্চর্য, দেখুন সবার পরিচয় দিলাম অথচ নিজের পরিচয়টাই আপনাকে দিলাম না! আমার নাম রাজেশ্বর চক্রবর্তী।
ওঃ, আপনিই তাহলে এখানকার প্রেসিডেন্ট! বললাম এবার আমিই।
তাই। আচ্ছা চলি।
রাজেশ্বর চক্রবর্তী অতঃপর যে দ্বারপথে প্রবেশ করেছিলেন সেই দ্বারপথেই প্রস্থান করলেন।
এক নম্বর দরজাটি এবারে খুলে গেল এবং একজন ওয়েটার হলঘরে প্রবেশ করল। দৃষ্টি পড়বার মত লোকটা। দৈর্ঘে ছ ফুটেরও বেশী হবে। যে অনুপাতে ঢ্যাঙা লোকটা সে অনুপাতে কিন্তু শরীর নয়। অনেকটা তাই হাড়গিলে প্যাটার্নের মনে হয়।
লোকটার পরিধানে ছিল সাদা লংস ও গলা-বন্ধ সাদা কোট। মাথার চুলগুলো ছোট ছোট করে কদম-ছাঁট দেওয়া। ছোট কপাল। বাঁশির মত ধারালো নাক। নিখুঁতভাবে কামানো গোঁফ।
লোকটা ঘরে ঢুকতেই একজন বললেন, মীরজুমলা, একটা বড় জিন অ্যাণ্ড লাইম দাও। অন্য একজন বললে, একটা হুইস্কি ছোটা পেগ। আর একজন বললে, একটা রাম অ্যাণ্ড লাইম।
সকলের নির্দেশেই মীরজুমলা মৃদু হেসে ঘাড় হেলিয়ে সম্মতি জানায়।
এমন সময় হঠাৎ একটা মিহি নারী কন্ঠের আওয়াজে চমকে সেই দিকে তাকালাম। তিন নম্বর দরজাটার পাল্লাটা ধীরে ধীরে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে আর তার গোড়ায়ই দাঁড়িয়ে অপরূপ সুন্দরী একনারীমূর্তি। তিনি মীরজুমলার দিকে তাকিয়ে বললেন, মীরজুমলা, কোল্ডলিমন-জুস।
শুধু আমিই নয়, হলঘরে সেই নারীমূর্তির আবির্ভাবের সঙ্গে সঙ্গে সেখানে উপস্থিত সকলেরই কর্ণে সে কণ্ঠস্বর প্রবেশ করায় সকলেই একসঙ্গে হর্ষোৎফুল্ল কণ্ঠে সাদর আহ্বান জানালেন তাকে এবং Hail beautious stranger of the grove বলে তাঁদের মধ্যে শ্রীমন্ত পাল এগিয়ে আসেন।
আর একটি সুবেশ প্রৌঢ় ব্যারিস্টার অমিতাভ মৈত্রও এগিয়ে যেতে যেতে বললেন, Good evening Miss Sen!
সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে পড়ল, আশ্চর্য! এ তো সেই মুখ। কত কাগজে দেখেছি। মিস মিত্রা সেন!
বৈকালী সঙ্ঘের সুধীরঞ্চন-বর্ণিত মক্ষীরানী।
০৬. অসাধারণ প্রসাধন-নৈপুণ্যে
অসাধারণ প্রসাধন-নৈপুণ্যে প্রথম দর্শনেই শ্রীমতী মিত্রা সেনকে দেখে চোখ ঝলসে গিয়েছিল সে-রাত্রে আমার। সত্যিই কালো জমিনের উপরে সাদা জরির পাড় দেওয়া বহুমূল্য ইটালীয়ান সিফন শাড়িটি যেন সে বরঅঙ্গে লেপ্টে ছিল। হাতে একগাছি হীরা-বসানো জড়োয়ার চুড়ি। কানে নীলার দুল। হীরা ও নীলার উপরে বিদ্যুতের আলো পড়ে যেন ঝিলিক দিচ্ছিল। আর অঙ্গে কোন অলঙ্কার ছিল না। কিন্তু ঐবেশভূষাতেই যেন মনে হচ্ছিল তাকে বিশ্ব-বিজয়িনী। লম্বায় পাঁচ ফুট দু-এক ইঞ্চির বেশী হবে না। রোগাটে গড়ন। গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যাম। কিন্তু প্রসাধনের রঙে সেটা বোঝবার উপায় ছিল না।