তাই তো সুব্রত! তুমি যে আমায় চিন্তায় ফেললে!
কেন?
কারণ বৈকালী সঙ্ঘ হচ্ছে এমন একটি সঙ্ঘ সেখানে একমাত্র সেই সঙ্ঘের মেম্বার ছাড়া প্রবেশ একেবারে strictly prohibited। একেবারে দুঃসাধ্য।
কিন্তু তার কি কোন পথ নেই?
সে আরও দুঃসাধ্য ব্যাপার।
কি রকম?
তিনজন সঙ্ঘের মেম্বারের রেকমেণ্ডেশন না পেলে কারও মেম্বারশিপ সেখানে গ্রাহ্যই করা হয় না।
তুমি তো একজন আছ। আর দুজনের রেকমেণ্ডেশন তুমি যোগাড় করে দিতে পারবে না?
কষ্টসাধ্য ব্যাপার। তবে চেষ্টা করে একবার দেখতে পারি।
দেখাদেখি নয় ভাই। যে করে থোক তোমাকে করে দিতেই হবে।
কিন্তু ভাই তোমার বেলায় আরও একটা যে মুশকিল আছে।
কেন?
এককালে তুমি পুলিসের চাকরি করতে। শুধু তাই নয়, তুমি আবার কিরীটী রায়ের সাক্ষাৎ দক্ষিণহস্ত–দুনিয়া-সমেত সকলেই জানে। তোমায় কমিটি নিতে চাইবে কিনা সেও একটা ভাববার কথা।
কিন্তু কেন নেবে না? যতদূর শুনেছি, বৈকালী সঙ্ঘ তো অভিজাত ধনিক সম্প্রদায়ের একটি মিলন-কেন্দ্র, তাহলে আমাদের যদি বর্তমানে বা অতীতে কখনও পুলিসের সঙ্গে যোগাযোগ থাকেই, সেখানে প্রবেশাধিকার পাব না কেন? তবে কি তুমি বলতে চাও সেখানে এমন কিছু ব্যাপার ঘটে থাকে যাতে ঐ দিক থেকে তাদের ভয়ের বা আশঙ্কার কারণ আছে?
সুধীরঞ্জন প্রত্যুত্তরে হেসে বললে, তা জানি না ভাই, তবে পুলিস বা পুলিস-সংক্রান্ত লোকেদের সেখানে প্রবেশাধিকার নেই।
হেতু?
হেতু আর কি! ওরা এমন কি যেখানে যাবে, সেখানেই একটা না একটা মামলা বাধা চাই। শোনা যায় স্ত্রীর সঙ্গেও নাকি মন খুলে কথা বলে না!
তাহলে উপায়? উপায় নেই?
তাই তো বলছিলাম—
আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না?
বল?
এই কথা—আসল নামে আমি যাব না। ছদ্মনাম নেব। ধর কোন জমিদারনন্দনের পরিচয়ে! কিন্তু তোমার ওই চেহারাটির সঙ্গে যে অনেকেরই পরিচয়-সৌভাগ্য আছে ভাই।
ভয় নেই। একেবারে অন্য চেহারায় ও বেশে—
বল কি! যদি ধরা পড়?
ধরা পড়ব। হুঁ! আরে তুমিই দেখে চিনতে পারবে না তো অন্যে পরে কা কথা।
সুধীরঞ্জন অতঃপর কিছুক্ষণ কি যেন ভাবল। তারপর বললে, বেশ, দিন পাঁচেক বাদে এস। আজ কি নাম নেবে সেইটেই শুধু বলে যাও। একবার চেষ্টা করে দেখব।
তুমিই বল না, কি নাম নেওয়া যায়?
ছদ্মবেশ ও নাম তুমি নেবে, আর বলব আমি!
আচ্ছা নাম বলছি। মুহূর্তকাল ভাবলাম। বললাম, সত্যসিন্ধু রায়। চক্রধরপুর কোল মাই-এর মালিক।
বেশ। নাম ও পরিচয়টা জোরালো দিয়েছ বটে।
সেদিনকার মত বিদায় নিয়ে সুধীরঞ্জনের ওখান থেকে বের হয়ে এলাম।
সুধীর কাছে গিয়ে এতটা যে সুবিধা হবে যাত্রার পূর্বমুহূর্তেও ভাবিনি।
.
সুধীরঞ্জনের চেষ্টাতেই সত্যসিন্ধু রায় বৈকালী সঙ্ঘে প্রবেশাধিকার পেল। এবং যথাসময়ে একটি গোলাকার সাদা আইভরি ডিস্কের উপরে বৈকালী সঙ্ঘের সাংকেতিক-চিহ্ন-অঙ্কিত প্রবেশপত্রও হাতে এসে পৌঁছল।
তারও দিন-পাঁচেকবাদে একদিন রাত্রি নটায় প্রথম বৈকালী সঙ্ঘের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালাম। গেটের দারোয়ান দেখলাম অত্যন্ত সজাগ ও চতুর।
আমাকে দেখেই প্রশ্ন করলে, পাস দেখলাইয়ে।
বৈকালী সঙ্ঘের প্রবেশপত্র হিসাবে যেটি আমার হস্তগত হয়েছিল, সেটি হচ্ছে ক্ষুদ্র টাকার আকৃতির একটিগোলাকার আইভরিডিস্ক। তারমধ্যে একটি লাল বৃত্তের মধ্যে অঙ্কিত অপূর্বসুন্দর একখানি নারীমুখ ও অন্য দিকে লেখা বৈকালি কথাটি। আইভরি ডিস্কটি পকেট থেকে বের করে প্রহরীর সামনে ধরলাম।
সঙ্গে সঙ্গে প্রহরী এক দীর্ঘ সেলাম দিয়ে সসম্ভ্রমে পথ ছেড়ে দিয়ে বললে, যাইয়ে সাব। মৃদু হেসে এগিয়ে গেলাম আমি। সামনেই সরু করিডোর। অল্পদূর এগিয়েই সামনে পড়ল চকচকে আলো-পিছলে-যাওয়া বম টিকের ফ্রেমে ওপেইক গ্লাস বসানো ভারি মজবুত দরজা। দরজার গায়ে একটি সাদা কাঁচের নব ও তার নীচে একটা সাদা চাকতিতে কালো ইংরাজী অক্ষরে লেখা: PULL। মুহূর্তকাল ইতস্তত করে দরজার নষ্টা ধরে টানতেই নিঃশব্দে একপাল্লাওয়ালা দরজার কপাটটা সরে এল। পাইরিথ্রাম মেনথল-ইউক্যালিপটাস-মিশ্রিত মৃদু গন্ধ নাকে এসে ঝাপটা দিল সঙ্গে সঙ্গে। প্রবেশ করলাম একটা হলঘরে। মেঝেতে পুরু রবার কার্পেট বিছানা। সমস্ত হলঘরটা মৃদু একটা নীলাভ আলোয় যেন থমথম করছে। সামনেই কার্পেট-মোড়া একটা সিঁড়ি। বুঝলাম দোতলায় ওঠবার সিঁড়ি সেটা।
হলঘরে প্রবেশ করতেই সাদা উর্দি পরিহিত একজন বেয়ারা সামনে এসে সেলাম দিয়ে দাঁড়াল। এবং মুহূর্তকাল আমার মুখের ও চেহারার দিকে তাকিয়ে বললে, কার্ড?
বুঝলাম সতর্ক প্রহরার এটি দ্বিতীয় ঘাঁটি। অপরিচিতকে এখানেও পরিচয়পত্র দাখিল করতে হবে। যথারীতি আমাকে সাংকেতিক-চিহ্ন-অঙ্কিত প্রবেশ-চাকতিটি বের করে আবার দেখাতে হল।
সঙ্গে সঙ্গে আবার সেলাম।
Upstairs please! এবারের নির্দেশ ইংরাজীতেই।
সামনেই সিঁড়ি। এগিয়ে গেলাম। কার্পেটে মোড়া সিঁড়িটা আধাআধি উঠে ডানদিকে একটু কার্ড নিয়ে আবার উপরে উঠে গিয়েছে। সিঁড়ির পথেও নীলাভ আলো।
সিঁড়ি যেখানে শেষ হয়েছে তার সামনেই আবার দরজা। এ দরজাটিও একটি পাল্লার এবং কাটগ্লাসের। পূর্ব দরজার মত এ দরজার গ্লাসেও নির্দেশ লেখা: PUSH।
দরজা ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই চোখে পড়ল বিরাট একটি হলঘর। নীচের হলঘরের প্রায় দিগুণ এবং মিশ্রিত হাসি ও মৃদু আলোকের একটা গুঞ্জরণের সঙ্গে সঙ্গে নাসারন্ধ্রে এসে প্রবেশ করল মৃদু একটা ল্যাভেণ্ডারের মিষ্টি গন্ধ। দেওয়ালের গায়ে গায়ে অদৃশ্য আলো থেকে আলোকিত ঘরটি। এবং সে আলো নীলাভ হলেও বেশী স্পষ্ট। ঘরের মধ্যে টেবিল-চেয়ার, সোফা-কাউচ পাতা। সেইসব সোফা-কাউচে বসে এবং দাঁড়িয়ে থাকতে অনেককে দেখলাম। বিভিন্ন বয়সের দশ-পনের জন নরনারী। বিভিন্ন দামী বেশভূষা গায়ে। প্রত্যেকেই তাদের মধ্যে পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে হাসি-গল্প করছে। আমি ঘরে সম্পূর্ণ একজন অপরিচিত ব্যক্তি। হঠাৎ প্রবেশ করা সত্ত্বেও কে আমার দিকে বারেকের জন্যও ফিরে তাকাল না। বুঝলাম তারা নিজেদের সম্পর্কে সেখানে কত নিশ্চিন্ত যে, আচমকা কোন অপরিচিত তৃতীয় ব্যক্তি সেখানে প্রবেশ করলেও তারা জানে সে এমন একজন কেউ যে তাদের দ্বারাই সেখানে প্রবেশধিকার পেয়েছে।