অতএব দুদিন ধরে কেবল ভাবলামই। তারপর বিদ্যুৎ-চমকের মতই হঠাৎ যেন ভাবতে ভাবতে মানসপটে একখানি মুখ ভেসে উঠল।
সুধীরঞ্জন মিত্র।
হ্যাঁ, ঠিক। সুধীর ওখানে গিয়ে হানা দিতে হবে। সে হয়তো একটা পথ বাতলে দিতে পারবে। কলকাতা শহরে সত্যিকারের পুরাতন এক বনেদী ঘরের ছেলে সুধী। ওদেরই এক পূর্বপুরুষ হেস্টিংসের আমলে বেনিয়ানগিরি করে মা লক্ষ্মীকে এনে গৃহে তুলেছিলেন। তারপর দুই পুরুষ ধরে নর্তকী ও সুরার বিলাসিতায় সেই লক্ষ্মীর রস শোষণ করেও যা বাকি ছিল সুধীর জীবনে, ইচ্ছে করলে সুধী তার একটা জীবন হেসেখেলে পায়ের উপরে পা দিয়েই কাটিয়ে যেতে পারত। কিন্তু সুধী তার পূর্বপুরুদেরও যেন নারী ও সুরার ব্যাপারে ডিঙিয়ে গেল। এবং পিতার মৃত্যুর পর দশটা বছর যেতে না যেতেই হাটখোলার শেষ বসতবাটিটুকুও বন্ধক দিয়ে সে আজও নাকি পূর্বের মত না হলেও মেজাজেই দিন কাটাচ্ছে।
সুধীর আরও দুইটি বিশেষ গুণ ছিল যেটা তার বাপ-পিতামহ বা তস্য পিতা কোনদিনই আয়ত্ত করতে পারেননি। সুধী ইংরাজী সাহিত্যে এম.এ পাস করেছিল এবং সর্বাপেক্ষা বেশী নম্বর পেয়ে প্রথম শ্রেণীর প্রথম স্থানটি অধিকার করে। পড়াশুনার বাতিকও তার ছিল প্রচণ্ড। আর বেহালা বাজানোয় সে ছিল অদ্বিতীয়। এবং সেই বিশেষ গুণটির জন্যই তথাকথিত ইউরোপীয় ভাবধারায় সমৃদ্ধ নতুন দিনের কালচার্ড সোসাইটির মধ্যেও সে পেয়েছিল অনায়াস প্রবেশাধিকার। এবং আজও সে অবিবাহিত। সুধীর সঙ্গে আলাপ হয়েছিল বছর চারেক আগে এক পাটিতে।
সুধীরঞ্জনের কথা মনে হতেই পরদিন সকাল-সকালই বের হয়ে পড়লাম তার গৃহের উদ্দেশে।
সুধীর কথাই ভাবতে ভাবতে গাড়ি চালাচ্ছিলাম।
পার্টিতে সে-রাত্রে সুধীর বেহালা বাজানো শুনে মুগ্ধই হয়ে তার প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলাম। তারপর পরিচয় হয়ে তার পড়াশুনা ও জ্ঞান দেখে আরও বেশী করে মুগ্ধ হই। বেশ কিছুদিনে আলাপও জমে উঠেছিল। তারপরই তার নারী ও সুরাপ্রীতির সন্ধান পেয়ে কি জানি কেন হঠাৎ তার প্রতি মনটা আমার বিতৃষ্ণ হয়ে ওঠায় ধীরে ধীরে এক সময় তার কাছ থেকে সরে এসেছিলাম।
তারপর অবিশ্যি কালে-ভদ্রে কচিৎ কখনও যে দেখা হয়নি সুধীরঞ্জনের সঙ্গে তা নয়। তবে পূর্বের মত আর ঘনিষ্ঠ হতে পারিনি। সে-ও চায়নি হতে।
বিরাট সেকেলে প্যাটার্নের পুরাতন স্ট্রাকচারের বাড়ি। অন্দরমহলে বহু ভাড়াটে এসে বসবাস করছে। বহির্মহলেরই চারখানা ঘর নিয়ে সুধী থাকে। এখনো অবিশ্যি তার চাকর ঠাকুর দারোয়ান সোফার আছে। আর আছে আপনার জন বলতে সুধীর এক বিধবা সত্তর বৎসরের পিসী মৃন্ময়ী। ঘুম থেকে উঠে সুধী চা-পান কবতে বসেছিল, এমন সময় ভৃত্যের মুখে আমার আসার সংবাদ পেয়ে আমাকে সোজা একেবারে তার শয়নঘরেই ডেকে পাঠাল।
একটা চেয়ারের উপর বসে সুধী চা-পান করছিল। আমাকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে বললে,এস, এস সুব্রত। হঠাৎ কি মনে করে? পথ ভুলে নাকি?
না। মনে করেই এসেছি।
বটে! কি সৌভাগ্য! বলেই ভৃত্যকে চা আনতে আদেশ দিল।
সামনেই একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসলাম।
একটু পরেই ভৃত্য চা নিয়ে এল। চা-পান করতে করতে ভাবছিলাম কি ভাবে বক্তব্যটা আমার শুরু করা যায়।
সুধীই প্রথমে কথা বললে, তারপর হঠাৎ উদয় কেন বল তো?
তোমার কাছে একজনের কিছু সংবাদ পাই যদি সেই আশায়—
সংবাদ! আমি ভাই সংবাদ দিতে পারি নারীমহলের, অন্য মহলের সংবাদ—
একজন নারী সম্পর্কেই জানতে চাই।
বল কি! ভূতের মুখে রামনাম! কি ব্যাপার বল তো হেঁয়ালি রেখে?
হেঁয়ালি নয়, সত্যিই কোন এক বিশেষ নারী সম্পর্কেই—
সত্যি বলছ? Are you serious?
নিশ্চয়ই।
হুঁ। বল শোনা যাক।
মিত্রা সেনকে চেনো?
নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই যেন চমকে সুধীরঞ্জন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষণকাল নিষ্পলক হয়ে রইল।
কি? চেনো নাকি?
এককালে চিনতাম।
এখন?
দেখাশুনা হয় এইমাত্র। কিন্তু বন্ধু, সাবধান! ও হচ্ছে বহ্নি-পতঙ্গ। ও পতঙ্গের দিকে হাত বাড়ালে হাতই পুড়বে, পতঙ্গ ধরা দেবে না।
সুধীরঞ্জনের কণ্ঠস্বরে শেষের দিকে কেমন যেন একটা চাপা বেদনার আভাস পেলাম বলে মনে হল। চমকে তাকালাম ওর মুখের দিকে। মেঘে ঢাকা আলোর মত কি একটা বিষণ্ণতা যেন ওর চোখে-মুখে ক্ষণেকের জন্য ছায়া ফেলে গেল।
এখন দেখাশুনা হয় বললে তো, সেটা কিরকম?
বৈকালী সঙ্ঘের নাম শুনেছ?
চমকে উঠলাম আবার সুধীরের কথায়। বললাম, হ্যাঁ, সেইখানেই নাকি?
হ্যাঁ। বলতে পার বৈকালী সঙ্ঘের তিনিই মক্ষীরাণী!
.
সুধীরঞ্জনের শেষের কথায় বেশ যেন একটু ঔৎসুক্যই অনুভব করি। নড়েচড়ে সোজা হয়ে বসলাম। তারপর ওর মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলাম, তোমার তাহলে বৈকালী সঙ্ঘে যাতায়াত আছে বল?
এককালে খুবই ছিল। তবে এখন কখনও-সখনও গিয়ে থাকি।
শেষ কবে গিয়েছিলে?
এই তো গত পরশুই গিয়েছিলাম।
হুঁ। আচ্ছা ব্যারিস্টার অশোক রায়ের নাম—
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে এবারে সুধীরঞ্জন আমার মুখের দিকে তাকিয়ে বললে, ব্যাপারটা সত্যি করে কি বল তো সুব্রত? প্রথমেই করলে মিত্রা সেনের নাম, তারপরই করছ অশোক রায়ের নাম! রহস্যের যেন একটা গন্ধ পাচ্ছি!
ব্যাপারটা তাহলে তোমাকে খুলেই বলি সুধী। আমি বিশেষ করে ঐ দুজনের সম্পর্কে ও বৈকালী সংঘ সম্পর্কে কিছু জানতে চাই। আর তোমার কাছে সে ব্যাপারেই কিছু সাহায্য চাই।