এরাই রাত্রির বিভিন্ন যামে নিয়মিত ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বারে হানা দেয়।
কিন্তু কেন?
.
কিরীটীর কাহিনী শেষ হবার পর দুজনে চুপচাপ বসেছিলাম। ঘরের মধ্যে যেন হঠাৎ একটা স্তব্ধতার গুরুভার জমাট বেঁধে উঠেছে।
এবং এতক্ষণে যেন বুঝতে পারছি আজ সকালে কিরীটীর ভুজঙ্গ চৌধুরী দর্শনে গমনটা আকস্মিক বা সামান্য খেয়ালের বশে নয়। সম্পূর্ণ পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী হয়েছিল।
সদ্য কিরীটীর মুখে শোনা বিচিত্র নামগুলো ও সেই সঙ্গে সেই লোকগুলোর চেহারা ও এতদিনকার তাদের সকলের আমাদের জানিত বাইরের পরিচয়টা মনের মধ্যে বিচিত্র এক চিন্তার সৃষ্টি করেছিল।
অশোক রায়, মহারাণী সুচরিতা দেবী, আটিষ্ট সোমেশ্বর রাহা, পাল এ্যাণ্ড কোং-এর শ্ৰীমন্ত পাল, অভিনেত্রী সুমিতা চ্যাটার্জী, অভিনেতা চিত্রতারকা নিখিল ভৌমিক, উদীয়মান ব্যারিস্টার মনোজ ভঞ্জ–সমাজ বা সোসাইটিতে সকলেই এমন বিশেষ পরিচিত যে নাম করলেই সকলকে চেনা যায়।
সেই একটা দিক এবং দ্বিতীয় দিকটা হচ্ছে প্রত্যেকের অবস্থা, অর্থাৎ আর্থিক অবস্থা সচ্ছল। সকলেরই যাতায়াত আছে ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বারে। এবং যাতায়াতটা দিনের আলোয় প্রকাশ্যে নয়, রাত্রির অন্ধকারে,বলতে গেলে এক প্রকার গোপনেই এবং ভুজঙ্গ ডাক্তারের অনুপস্থিতিতে।
কিন্তু কেন?
কেন ওরা সকলেই ডাক্তার ভুজঙ্গ চৌধুরীর চেম্বারে রাত্রে যাতায়াত করে? বিশেষ করে চেম্বার যখন বন্ধ থাকে এবং তিনি যখন সেখানে থাকেন না!
হঠাৎ কিরীটীর কথায় আবার চমক ভাঙল, একটা ব্যাপার লক্ষ্য করেছিস সুব্রত?
কি?
সকলেই ভুজঙ্গ ডাক্তারের ওখানে যায় এবং রাত্রি এগারটার পর!
হ্যাঁ।
শুধু তাই নয়, সে সময় সাধারণত ডাক্তারের চেম্বার বন্ধ তো থাকেই এবং সে সময়টা ডাক্তার চৌধুরী তাঁর বাড়ি থেকে কখনও বের হন না। এর থেকে একটা কথা কি স্বতঃই মনে হয় না যে,ডাক্তারের এ সময়টায় চেম্বারে অনুপস্থিতি ও ওদের সেই সময়ে গমনাগমন, কোথায় যেন একটা রহস্য রয়েছে! হয়ত এমন কোন আকর্ষণ সেখানে আছে যার টানে–
কিন্তু তাই যদি থাকে তো সেটা কি হতে পারে? তোর কি মনে হয়?
মনে তো অনেক কিছুই হয়, কিন্তু মনে হলেই তো হয় না। ভুললে চলবে কেন আমাদের, ডাঃ চৌধুরী এবং অন্যান্য সকলেরই সোসাইটিতে আজকের দিনে একটা পরিচয় ও স্বীকৃতি আছে।
তা অবিশ্যি আছে। শুধু তাই নয়, আর একটি ব্যাপার হচ্ছে ঐ বৈকালী সঙ্ঘ।
হ্যাঁ, খোঁজ নিয়ে দেখেছি আমি, ঐ সব ব্যক্তিবিশেষের বৈকালী সঙ্ঘেও নিয়মিতযাতায়াত আছে এবং তারা প্রত্যেকেই সেখানকার মেম্বার।
তাই নাকি!
হ্যাঁ। কিন্তু আরও একটু গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার হচ্ছে যে, বিশেষ ভাবে খোঁজ নিয়ে জেনেছি, ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী কখনও আজ পর্যন্ত বৈকান্ধী সঙ্ঘে পা তো দেনইনি, এমন কি সঙ্ঘের ওপরেও নাকি তিনি মর্মান্তিক ভাবে চটা। সঙ্ঘের নাম পর্যন্ত নাকি তিনি শুনতে পারেন না।
কেন?
তাঁর ধারণা বৈকালী সঙ্ঘটা নাকি আসলে একটা যৌন ব্যভিচারের গোপন কেন্দ্র। যত সব তথাকথিত অ্যারিস্টোক্রেটিক পয়সাওয়ালা তরুণ-তরুণীরা ঐখানে সেই উদ্দেশ্যেই মিলিত হন। আর ঠিক সেই কারণেই আমি fill up the blank পূর্ণ করতে পারছি না কদিন ধরে ভেবেও। অথচ আমাদের ব্যারিস্টার রাধেশ রায়ের পুত্র তরুণ ব্যারিস্টার শ্রীমান অশোকের যাতায়াত নিয়মিত দু জায়গাতেই। সে যাক গে, তুই একটা কাজ করতে পারবি?
কি?
মিত্রা সেনের গতিবিধি সম্পর্কে একটা রিপোর্ট আমাকে এনে দিতে পারবি?
সে কি আর ঠাকুরপোর দ্বারা সম্ভব হবে? বরং আমি—
চমকে দুজনেই ফিরে তাকিয়ে দেখি বক্তা আমাদের কিরীটী-গৃহিণী শ্রীমতি কৃষ্ণা বৌদি। ইতিমধ্যে আমাদের আলোচনার ফাঁকে চায়ের ট্রে হাতে কখন যে নিঃশব্দে কৃষ্ণা বৌদির সেই ঘরে আবির্ভাব ঘটেছে দুজনের একজনও সেটা টের পাইনি। এবং বুঝতে পারা গেল শুধুআবিভাবই নয়, আমাদের শেষের আলোচনার অংশটুকুর শ্রবণেন্দ্রিয়ে প্রবেশ করেছে।
কিরীটীই বলে, কৃষ্ণা!
হাতের ট্রেটা সামনের ছোট টেবিলটার উপরে রাখতে রাখতে কৃষ্ণা বৌদি বললে, হ্যাঁ কৃষ্ণাই। সর্বাগ্রে চা-সুধার দ্বারা গলদেশ ভিজাইয়া লওয়া হউক, তারপর যাহা আমার বক্তব্য, পেশ করিতেছি।
দুজনেই আমরা হাসতে হাসতে ধূমায়িত চায়ের কাপ তুলে নিলাম হাতে।
কৃষ্ণা বৌদিও একটি কাপ হাতে নিয়ে কিরীটীর পাশের সোফায় বসল।
চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে কিরীটী কৃষ্ণার মুখের দিকে চেয়ে শুধাল, কি বলছিলে কৃষ্ণা?
বলছিলাম তোমার মিত্রা সেনের সংবাদটা ঠাকুরপোর দ্বারা ঠিক সুবিধে হবে না, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।
তুমি!
হ্যাঁ। নারীর মনোলোকের সংবাদ নারীই ঠিক যোগাড় করতে পারে।
কিন্তু—
ভাবছ চিনে ফেলবে! না, মা-ভৈষী! একটা রাত একটু আমাকে ভাবতে দাও, তারপর আমি কাজে নামব।
কৃষ্ণা জবাব দিল।
০৫. দিন দুই পরে কিরীটী
দিন দুই পরে কিরীটী আবার আমাকে ডেকে বলল, কৃষ্ণার কথা শুনে কিন্তু তুই চুপ করে বসে থাকিস না সুব্রত। মিত্রা সেনের সমস্ত সংবাদটা আমার চাই।
বললাম, তথাস্তু।
কিন্তু বললাম তো তথাস্তু। কিন্তু কেমন করে তা সম্ভব! শ্রীমতী মিত্রা সেন সম্পর্কে যতটুকু জানি বা জানবার সৌভাগ্য হয়েছে, তিনি গভীর জলের মৎস্যকন্যা! এমন একটা পরিবেশের মধ্যে তাঁর বিহার যে সেখানে আমার মত একজন নগণ্য অসামাজিক রসকষহীন ব্যক্তির পক্ষে মাথা গলানো শুধু দুঃসাধ্যই নয়, অসম্ভব। তিনি থাকেন অভিজাত পল্লীর প্রাসাদোপম পিতৃ-নিবাসের তিনতলার একটি নির্জন কক্ষে। সিঙ্গল করা মাথার চুল, কপাল কপোল ও ওষ্ঠ থেকে শুরু করে পদাঙ্গুলির নখাগ্র পর্যন্ত এমন সুচারুভাবে এনামেলিং করা যে, ত্রিশোত্তীর্ণ হয়েও আজ তিনি চিত্তবিমোহিনী, স্থিরযৌবনা, মনোলোভা।