ঘুমোয় পাশের ঘর থেকে শুনি কখনও গুনগুন করে গান গাইছে বা শিস দিচ্ছে। একেবারে অন্য প্রকৃতির। কতবার ভেবেছে ওকে ডেকে খোলাখুলি সব জিজ্ঞাসা করব। কিন্তু লজ্জা ও সংকোচ এসে বাধা দিয়েছে। ভেবে ভেবে যখন কোনো আর কূল-কিনারা পাচ্ছি না, হঠাৎ মনে পড়ল আপনার কথা। I am sure মিঃ রায়, এর পেছনে কোন একটা গোলমাল আছে। Somewhere something wrong! অশোক my only son। একমাত্র ছেলে ওই আমার। যেমন করে যে উপায়েই হোক এই দুশ্চিন্তা থেকে আপনি আমায় বাঁচান, মিঃ রায়। বলতে বলতে ব্যারিস্টার কিরীটীর একটা হাত চেপে ধরলেন। আবেগে ও উত্তেজনায় তাঁর ধৃত মুষ্টিটা যেন কাঁপছে থরথর করে তখন। চোখের কোলে অশ্রু।
ব্যস্ত হবেন না ব্যারিস্টার। কয়েক দিন সময় দিন; আর আমাকে একটু ভাবতে দিন।
কিন্তু একটা কথা, ও যেন ঘুণাক্ষরেও না কিছু সন্দেহ করে।
ভয় নেই আপনার। নিশ্চিন্ত থাকুন। দু-পাঁচ দিনের মধ্যেই আপনার সঙ্গে আমি দেখা করব।
০৪. সে রাত্রের মত আশ্বাস দিয়ে
সে রাত্রের মত আশ্বাস দিয়ে ডিনার শেষ করে তো ফিরে এলাম। কিন্তু তারপর পর পর চার-পাঁচদিন সর্বদা দিনে রাত্রে অশোক রায়কে ছায়ার মত অনুসরণ করেও মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারলাম না। কিরীটী বলতে লাগল, এদিকে খোঁজ নিতে গিয়ে জানলাম শুধু গত বৎসরখানেক ধরে মিত্রা সেনের সঙ্গে নাকি অশোক রায়ের একটু বিশেষ করে ঘনিষ্ঠতা চলেছে এবং বৈকালীতে মিত্রা সেনই অশোকের আসল আকর্ষণ। যতক্ষণ বৈকালীতে ও থাকে মিত্রা ও অশোক কাছাকাছিই থাকে। কিন্তু রাত এগারোটা বাজবার পর থেকেই অশোক যেন কেমন চঞ্চল হয়ে উঠতে থাকে। ঘন ঘন ঘড়ির দিকে তাকাতে থাকে। চোখেমুখে একটা উত্তেজনা ফুটে ওঠে। রাত এগারোটায় ঠিক মিত্রা সেন চলে যায়। এবং মিত্রা সেন চলে যাবার পর থেকেই অশোকের মধ্যে চাঞ্চল্য ও উত্তেজনা দেখা দেয়। অথচ মজা এই, ঘনঘন ঘড়ির দিকে তাকালেও রাত প্রায় সাড়ে এগারোটার আগে কখনও সে বৈকালী থেকে বের হয় না। এবং রাত সাড়ে এগারোটা বাজার মিনিট পাঁচেক আগেই ঠিক বের হয়ে পড়ে—এক মিনিট এদিক ওদিক হয় না। এই তো গেল অশোকের ব্যাপার। তারপরই নজর দিলাম ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরীর ওপরে। তাঁর চেম্বারের attendance একেবারে ঘড়ির কাঁটা ধরে। এক মিনিট এদিক ওদিক হয় না। সকাল সাতটা থেকে সাড়ে আটটা; দেড় ঘণ্টা চেম্বারে বসেই চলে যান হাসপাতালে। বেলা গোটা বারো নাগাদ হাসপাতাল থেকে ফিরে বাইরের কলগুলো সেরে বেলা দেড়টায় ঠিক বাড়ি পৌঁছন। বিকেলে পাঁচটা থেকে রাত সাড়ে আটটা চেম্বার অ্যাটেনডেন্স। ঠিক রাত সাড়ে আটটায় চেম্বার থেকে বের হয়ে এসেন গাড়িতে চাপেন এবং সোজা চলে আসেন আমির আলী অ্যাভিতে নিজের বাড়িতে। বাড়িতে একবার রাত্রে পৌঁছানোর পর সকলেই জানে হাজার টাকা দিলেও এবং যত সিরিয়াস সেই হোক না কেন রাত্রে কখনও ভুজঙ্গ ডাক্তারকে কেউ বাড়ির বাইরে আনতে পারবে না। এবং, নানা ভাবে খবর নিয়ে দেখেছি, কথাটা মিথ্যে বা অত্যুক্তি নয়। রাত্রে চেম্বার থেকে ফেরবার পর সত্যিই আর তিনি বাইরে যান না। এদিকে ভুজঙ্গ ডাক্তার চেম্বার থেকে চলে যাবার পরই তাঁর একজন অ্যাসিস্টেন্ট ডাক্তার ও একজন নার্স বাদে আধ ঘণ্টার মধ্যেই বাকি আর সব চেম্বার থেকে চলে যায়, চেম্বারের ভেতর থেকে দরজা বন্ধ হয়ে যায়। তখন ঐ চেম্বার ও নার্সিং হোমে থাকে একজন অ্যাসিস্টেন্ট ডাক্তার একজন নার্স ও প্রহরায় থাকে একজন শিখ দারোয়ান গুলজার সিং ও কুক মাধোলাল। কিন্তু মজা আছে ঐখানেই। রাত সাড়ে এগারোটার পর থেকে রাত প্রায় একটা দেড়টা পর্যন্ত মধ্যে মধ্যে এক-একখানা প্রাইভেট গাড়ি এসে চেম্বারের সামনে দাঁড়ায়—কখনও কোন পুরুষ, আবার কখনও কোনো মহিলা গাড়ি থেকে নেমে দরজার কলিংবেলের বোতামটা গিয়ে টেপেন। নি:শব্দে দরজা খুলে যায়। তাঁরা ভেতরে প্রবেশ করেন এবং পনের মিনিট থেকে আধ ঘণ্টার মধ্যে আবার চেম্বার থেকে বের হয়ে এসে গাড়িতে চেপে চলে যান। প্রতি রাত্রে এই একই ব্যাপার ঘটছে।
কিরীটীর কথায় বাধা না দিয়ে পারি না, বলি, এ যে রীতিমতো সিনেমা-কাহিনী হে!
তাই বটে। শোন, শেষ হয়নি এখনও। আমার next step হল যে যে গাড়ি রাত্রে চেম্বারে আসে তাদের নাম্বারগুলো টুকে অনুসন্ধান করে তাদের মালিকদের খুঁজে বের করা। শুরু করে দিলাম। এবং এইখানে এসেই ব্যাপারটা যেন আরও বিশ্রীভাবে জট পাকিয়ে গেল।
কি রকম? প্রশ্ন করলাম।
শোন হে সুব্রতচন্দ্র! কিরীটী আমার মুখের দিকে তাকিয়ে গলায় বেশ একটু আমেজ এনে বললে, চমকে উঠো না যেন এবারে নামগুলো শুনে। অশোক রায় ছাড়াও এক নম্বর সুচরিতা দেবী আর একসেলেন্সী মহারাণী অফ সোনাপুর স্টেট। দু নম্বর বিখ্যাত আর্টিস্ট বর্তমানে নব্য চিত্রকরদের মধ্যমণি সোমেশ্বর রাহা। তিন নম্বর বিখ্যাত পাল অ্যাণ্ড কোংএর তরুণ প্রোপাইটার শ্ৰীমন্ত পাল। চার নম্বর—স্বনামধন্য অভিনেত্রী সুমিতা চ্যাটার্জী। পাঁচ নম্বর বর্তমানের শ্রেষ্ঠ চিত্রতারকা নিখিল ভৌমিক। ছ নম্বর-উদীয়মান ব্যারিস্টার মনোজ ভঞ্জ। আর চাই?
বিস্ময়ে আমি সত্যিই নির্বাক হয়ে গিয়েছিলাম।
কিরীটী একে একে যে সব নামগুলো করে গেল তাদের মধ্যে যে কেবল শহরের বর্তমান নামকরা ধনী ও অভিজাত সম্প্রদায়ই আছে তাই নয়, এমন নামও করলে যাদের নাম। বাংলাদেশের ঘরে ঘরে।