সাগ্রহে তাঁর মুখের দিকে তাকালাম আবার।
কিছুক্ষণ আবার চুপচাপ কেটে গেল। তারপরই আমি এবারে প্রশ্ন করলাম, এমনও তো হতে পারে তাঁর কোনো প্রাইভেট লোক বা কাউকে তিনি ঐ টাকাটা দিয়ে থাকেন, মানে বলছিলাম কি কোনো সৎ প্রতিষ্ঠানে হয়ত বা সাহায্য করে থাকেন।
ব্যারিস্টার আমার প্রশ্নের কোন জবাব দিলেন না। সম্মুখে টেবিলের উপরে রক্ষিত এবং ক্ষণপূর্বে নিঃশেষিত পেগ-গ্লাসটার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে রইলেন শুধু স্তব্ধ হয়ে।
কিছুক্ষণ আবার স্তব্ধভাবে কেটে গেল।
ধীরে ধীরে আবার বলতে শুরু করলেন ব্যারিস্টার, সে রকম কিছুই না। বলে একটু চুপ করে থেকে পুনরায় শুরু করলেন, কয়েকটা ব্যাপারকে জীবনে আমি নিরতিশয় ঘৃণা করে এসেছি মিঃ রায়। অন্যের চিঠি লুকিয়ে পড়া, অন্যের গতিবিধির উপরে আড়াল থেকে গোপনে গোপনে নজর রাখা ও অন্যের ব্যাপারে অকারণ মাথা ঘামানো। পর তো কথাই নেই, এমন কি নিজের স্ত্রী-পুত্রের বেলাতেও না। কিন্তু এমনই দুর্দৈব যে, অশোক, আমার নিজের সন্তানের বেলায় তাই আমাকে করতে হল। এ যে আমার পক্ষে কত বড় লজ্জা ও দুঃখের কারণ হয়েছে মিঃ রায়, তা আপনাকে আমি ঠিক বুঝিয়ে বলতে পারব না।
বেদনায় ও গ্লানিতে মনে হল ব্যারিস্টারের কণ্ঠস্বর শেষের দিকে যেন বুজে আসছে। আর কেউ না হলেও আমি বুঝেছিলাম সমস্ত ব্যাপারটা ব্যারিস্টার রায়ের পক্ষে কতখানি বেদনার কারণ হয়েছে। এবং শুধু বেদনাই নয়, তাঁকে কতখানি সেই সঙ্গে বিচলিতও করেছে।
শূন্য পেগ-গ্লাসটায় কিছুটা আবার লিকার ঢেলে এবং তাতে সোড়া মিশিয়ে একটা ছোট্ট চুমুক দিয়ে বলতে লাগলেন গ্লাসটা টেবিলের উপর নামিয়ে রেখে, এ মাসের দশ তারিখে আর নিজের কৌতূহলকে চেপে রাখতে পারলাম না। আমার এতদিনের সমস্ত শিক্ষা, রুচি ও নীতি-বোধকে একপাশে ঠেলে রেখেই বেলা দশটা বাজবার কিছু আগে একটা ট্যাক্সি নিয়ে ব্যাঙ্কের দরজার কাছে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলাম। ঠিক দশটায় দেখলাম অশোকের গাড়ি এসে ব্যাঙ্কের দরজার সামনে দাঁড়াল।
অশোক নিজেই ড্রাইভ করছিল। আর তার পাশে উপবিষ্ট দেখলাম একটি নারী।
নারী!
অর্ধস্ফুট ভাবে আপনা হতেই যেন কথাটা আমার কণ্ঠ হতে বের হয়ে এল।
হ্যাঁ। কিন্তু তার মুখ দেখতে পেলাম না। মাথায় অল্প ঘোমটা টানা। কেবল একখানা চুড়ি-পরা হাত গাড়ির দরজার উপরে ন্যস্ত দেখতে পেলাম দূর থেকে। অশোক গাড়িটা এমন ভাবে পার্ক করে রেখেছিল আর আমার ট্যাক্সি এমন জায়গায় ছিল যে সেখান থেকে গাড়ির সামনের দিকটায় নজর পড়ে না। কেবল একটা সাইড দেখা যায় মাত্র। লজ্জায় ও সংকোচে গাড়ি থেকে নামতে পারলাম না। ভূতগ্রস্তের মতই গাড়ির মধ্যে বসে রইলাম আমি। মিনিট কুড়ি বাদে ব্যাঙ্ক থেকে অশোক বের হয়ে এল এবং গাড়িতে উঠে, স্পষ্ট দেখলাম, পার্শ্বে উপবিষ্ট সেই মেয়েটির হাতে নোটের বাণ্ডিলগুলো তুলে দিল। তারপর উটো পথে গাড়িটা বের হয়ে গেল।
গাড়িটা ফলো করলেন না কেন?
না, তা করিনি। ঘটনাটা আমাকে এমন বিল ও বিমূঢ় করে ফেলেছিল যে ঠিক ঐ সময়টাতে, যখন খেয়াল হল অশোকের গাড়ি আশেপাশে কোথায়ও নেই। তারপর দুটো দিন কেবল ভাবতে লাগলাম। আমার কেস-পত্র সব কোথায় পড়ে রইল। তৃতীয় দিনে অশোক যখন সন্ধ্যার পর চেম্বারে কেস সেরে রাত সাড়ে আটটায় বের হল তাকে ফলো করলাম ট্যাক্সি নিয়ে। কানুকে দিয়ে আগেই ডাকিয়ে এনে তার মধ্যে বসে অপেক্ষা করছিলাম গেটের অদূরে। বলতে বলতে হঠাৎ থেমে গিয়ে প্রশ্ন করলেন, বৈকালী সঙ্ঘ ক্লাবটা সম্পর্কে কিছু জানেন মিঃ রায়, মানে নাম শুনেছেন ক্লাবটার কখনও?
জানি, শুনেছি। লেক টেরেসে তো?
হ্যাঁ। সেখানে গিয়ে ঢুকল অশোক। রাত সাড়ে এগারোটায় বের হল ক্লাব থেকে। আশ্চর্য হলাম যখন দেখলাম এত রাত্রে ক্লাব থেকে বের হয়ে বাড়ি না ফিরে সে চলেছে পার্ক সার্কাসের দিকে।
পার্ক সার্কাসের দিকে? প্রশ্ন করলাম এবারে আমিই।
হ্যাঁ। এবারে তার গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারের সামনে।
অত রাত্রে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারে?
হ্যাঁ। তবে বাইরের দরজা তো বন্ধ ছিল; দোতলায় চেম্বারের ঘরেওকোনো আলোজ্বলছিল। সব অন্ধকার।
ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারের সঙ্গে শুনেছি নার্সিং হোমও আছে, এমনও তো হতে পারে যে, অশোকবাবুর কোনো জানাশুনা রোগী নার্সিং হোমে ছিল, তাকেই তিনি দেখতে গিয়েছিলেন!
কি বলছেন আপনি মিঃ রায়? হতে পারে নার্সিং হোম, তাই বলে ওটা তো আর দেখা করতে যাবার সময় নয় ঐ মাঝরাত্রে! তাছাড়া সব দিক এই কদিন ধরে ভেবেচিন্তেই শেষ পর্যন্ত আপনার পরামর্শ নেওয়া স্থির করেই আপনাকে ডেকেছি মিঃ রায়। যাক শুনুন, অশোক গাড়ি থেকে নেমে এগিয়ে গিয়ে দরজার গায়ে কলিং বেলের বোতাম টিপতেই কে যেন এসে দরজা খুলে দিল। অশোক ভেতরে প্রবেশ করল এবং সঙ্গে সঙ্গে দরজাও বন্ধ হয়ে গেল।
তারপর?
আধ ঘণ্টা বাদে অশোক চেম্বার থেকে বের হয়ে এল। তারপর অবিশ্যি সে বাড়ির দিকেই গাড়ি চালাল। তারপর তিন রাত অশোককে আমি গোপনে ফলো করেছি এবং প্রত্যেক বারেই দেখেছি সে বৈকালী সঙ্ঘ ক্লাব থেকে বের হয়ে সোজা পার্ক সাকাসে ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বারেই যায়। শুধু এই নয়, আজ ছ-সাত মাস থেকেই লক্ষ্য করছি অশোকের কথায়বাতায়, তার চালচলনে, ব্যবহারে, এমন কি চেহারাতেও যেন একটা বিশেষ পরিবর্তন এসেছে। অমন চমৎকার, উজ্জ্বল চেহারা ছিল ওর; যেন একটা কালো ছায়া পড়েছে তার ওপরে। সমস্ত দিন কেমন ঝিম মেরে থাকেমনে হয় যেন খুব ক্লান্ত। চিরদিন যে হাসিখুশী হৈ-হুল্লা করে চলত, সে যেন হঠাৎ কেমন গম্ভীর হয়ে গিয়েছে। অথচ রাত্রে ফেরবার পর যতক্ষণ