- বইয়ের নামঃ বিষকুম্ভ
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- প্রকাশনাঃ মিত্র ও ঘোষ পাবলিশার্স প্রাঃ লিঃ (ভারত)
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. তাসের ঘর
সেই তখন থেকেই লক্ষ্য করছিলাম একপাটি চকচকে তাস নিয়ে কিরীটী তার বসবার ঘরে, শিথিল অলস ভঙ্গিতে সোফাটার উপরে বসে, সামনের নিচু গোল টেবিলটার ওপরে নানা কায়দায় একটার পর একটা তাস বসিয়ে, তাসের একটা ঘর তৈরি করবার চেষ্টা করছে। কিন্তু প্রতিবারই কিছুটা গড়ে উঠবার পর ভেঙেচুরে তাসগুলো টেবিলের উপরে ছড়িয়ে পড়ছে। এবং আমি নিঃশব্দে বারংবার সেই প্রচেষ্টার একই পুনরাবৃত্তি দেখছিলাম তারই উল্টোদিকে অন্য একটা সোফার ওপরে বসে।
প্রতিবারের ভেঙেপড়া তাসের ঘরের পুনর্গঠনের মধ্যে নিজে ব্যস্ত থাকলেও কিরীটীর সমস্ত মনটাই যে কোন একটি বিশেষ চিন্তার ঘূর্ণাবর্তের মধ্যেই পাক খেয়ে ফিরছিল সেটা আমি জানতাম বলেই তার দিকে নিঃশব্দে তাকিয়ে বসেছিলাম কোনোরূপ সাড়াশব্দ না করে।
নিস্তব্ধ ঘরটার মধ্যে দেওয়াল-ঘড়ির মেটাল পেণ্ডুলামটা কেবল একঘেয়ে বিরামহীন একটা টকটক শব্দ তুলছিল।
ফাল্গুনের ঝিমিয়ে-আসা শেষ বেলা।
কলকাতা শহরে এবারে শীতটা যেমন একটু বেশ দেরিতেই এসেছিল তেমনি এখনো যাই যাই করেও যেন যাচ্ছে না।
একটা মৃদু মোলায়েম শীত-শীত ভাব যেন শেষ-হয়ে-যাওয়া গানের মিষ্টি সুরের রেশের মতই দেহ ও মনকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যে অবিশ্যি তিন-চার দফা চা পান উভয়েরই হয়ে গিয়েছে। এবং কিরীটীর শেষবারের চায়ের কাপটার অর্ধনিঃশেষিত চাটুকু তারই সামনে টেবিলের উপরে তখনো ঠাণ্ডা হচ্ছে।
প্রায় ঘণ্টাদেড়েক হবে এসেছি কিন্তু কিরীটী আমার পদশব্দে চোখ না তুলেই সেই যে, আয় সুব্রত বস, বলে তাসের ঘর তৈরিতে মেতে আছে তো আছেই। আর আমিও সেই থেকে আসা অবধি বোবা হয়ে বসে আছি তো আছিই।
ঘড়ির পেণ্ডুলামটা তেমনিই টকটক শব্দ করে চলেছে। নিচের রাস্তা দিয়ে একটা গাড়ি চলে গেল হর্ণ বাজিয়ে ইঞ্জিনের শব্দ তুলে।
শেষ পর্যন্ত বসে বসে একসময় কখন যেন কিরীটীর তাসের ঘর তৈরি দেখতে দেখতে তন্ময় হয়ে গিয়েছি নিজেই তা জানি না।
দেখছিলাম তাসের পর তাস সাজিয়ে ঘরটা এবারে কিরীটী অনেকটা গড়ে তুলেছে। হঠাৎ সব আবার ভেঙে টেবিলের উপরে ছড়িয়ে পড়ার সঙ্গে সঙ্গে কিরীটীর কণ্ঠ থেকে বের হয়ে এল, যাঃ! আবার ভেঙে গেল!
সম্পূর্ণভাবে সোফার গায়ে নিজেকে এলিয়ে দিয়ে কিরীটী বললে, জানি তাসের ঘর এমনি করেই ভেঙে যায়। বৃথা চেষ্টা।
আমিও প্রশ্ন করলাম, কি হল?
পাচ্ছি না। দাঁড়াবার মত কিছুতেই যেন একটা শক্ত ভিত পাচ্ছি না।
কেন?
কেন আর কি! টুকরো টুকরো সূত্রগুলো এমন এলোমেলো যে, একটার সঙ্গে অন্যটা কিছুতেই জোড় দিতে পাচ্ছি না।
তাসগুলো টেবিলের উপরে তেমনিই ছড়িয়ে রয়েছে।
দিনান্তের শেষ আলোটুকুও মিলিয়ে গিয়ে ঘরের মধ্যে ইতিমধ্যে কখন জানি ধূসর আবছা অন্ধকার একটু একটু করে চাপ বেঁধে উঠেছে।
বাঁ-দিকে উপবিষ্ট সোফার হাতলের উপর থেকে রক্ষিত চামড়ার সিগারকেস ও দেশলাইটা হাত বাড়িয়ে তুলে নিয়ে, তা থেকে একটা সিগার বের করে দাঁত দিয়ে চেপে ধরে সিগারে অগ্নিসংযোগ করে নিল কিরীটী। ওষ্ঠধৃত জ্বলন্ত সিগারটায় কয়েকটা মৃদু সুখটান দিয়ে ধূমোদগীরণ করেকিরীটী আবার কথা বললে, ভুজঙ্গ ডাক্তারকে কেমন লাগল আজ সুব্রত?
ভুজঙ্গ ডাক্তার। ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী, এ. আর. সি. এস. (লণ্ডন)।
মনে পড়ল মাত্র আজই সকালে তাঁর সঙ্গে আলাপ হয়েছে।
কিরীটীর প্রশ্নের সঙ্গে সঙ্গে আজকের সকালের সমস্ত দৃশ্যটাই যেন মুহূর্তে মনের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
ডাঃ ভুজঙ্গ চৌধুরী।
নামে ব্যবহারে চেহারায় কারও মধ্যে এতটা সামঞ্জস্য, আবার সেই অনুপাতে অসামঞ্জস্যও থাকতে পারে ইতিপূর্বে যেন আমার সত্যিই ধারণারও অতীত ছিল।
ভুজঙ্গ ডাক্তারের চেম্বার থেকে তার সঙ্গে আলাপ করে ফিরবার পথে ঐ কথাটাই বার বার আমার যে মনে হয়েছিল সেও মনে পড়ে ঐ সঙ্গেই।
সামঞ্জস্যটা ওর চেহারা ও নামের মধ্যে। মনে হয়েছিল শিশুকালে যিনিই ওই ভুজঙ্গ নামকরণ করে থাকুন না কেন, দূরদর্শী ছিলেন তিনি নিঃসন্দেহে। কারণ আর যাই করুক
কেন কানা ছেলের নাম পদ্মপলাশলোচন রাখেননি এটা ঠিকই। কিন্তু ব্যাপারটা প্রথম দৃষ্টিতেই নজরে পড়বে না। এবং কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলে তবে নজরে আসবে এবং বলাই বাহুল্য চোখ ফিরিয়ে নিতে হবেই। না নিয়ে উপায় নেই। সমস্ত মনটা ঘিন ঘিন করে উঠবে এবং সেই সঙ্গে মনে হবে লোকটার ঐ ভুজঙ্গ নাম ছাড়া দ্বিতীয় কোন আর নাম বুঝি হতেই পারত না।
গায়ের রঙ লোকটির সত্যিকারের কাঞ্চনবর্ণ বলতে শুদ্ধ ভাষায় যা বোঝায় ঠিক তেমনি। চোখ যেন একেবারে ঠিকরে যায়। কিন্তু মানুষের গায়ের রঙটাই তো তার রূপের সবটুকু নয়। মুখখানা চৌকো। অনেকটা ভারী চোয়ালওয়ালা দ্রাবিড়িয়ান টাইপের মূখ। টানা দীর্ঘায়ত রোমশ যুগল। তার মধ্যে দু-একটা জ্বকেশ এত দীর্ঘ যে বিস্ময়ের চিহ্নের মত যেন উঁচিয়ে আছে। তারই নীচে ক্ষুদ্র গোলাকার পিঙ্গল দুটি চক্ষুতারকা। শাণিত ছোরার ফলার মতোই সে-দুটি চোখের দৃষ্টিতে যেন অদ্ভুত একটা বুদ্ধির প্রাথর্য। শুধু কি খই, আরও কি যেন আছে সেই দুটি পিঙ্গল চক্ষুতারকার দৃষ্টির মধ্যে। এবং যেটা সে-দৃষ্টির দিকে তাকালেই তবে অনুভূত হয়, অদ্ভুত এক আকর্ষণ।