নানা জাতের নানা ধরনের লোক। স্নানের সময় এটা, তাই বেশীর ভাগ বোর্ডারই সমুদ্রস্নানে গিয়েছে। যারা ছিল তারা রেণুকা বিশ্বাসের সঙ্গে আমাদের ও পুলিসকে দোতলার সিঁড়ি বেয়ে উঠতে দেখে এদিক ওদিক থেকে কৌতূহলের সঙ্গে উঁকি দেয়।
কৌতূহলটা অবিশ্যি খুবই স্বাভাবিক।
হঠাৎ কিরীটীই প্রশ্নটা ফিসফিস করে করে রেণুকা বিশ্বাসকে, মিসেস বিশ্বাস, আপনার হোটেলের লোকেরা কি মিঃ সরকারের ব্যাপারটা জানতে পেরেছে?
পেরেছে-তবে তারা জানে ভদ্রলোক সুইসাইড করেছেন। রেণুকা বিশ্বাস জবাব দেয়।
আপনাকে এ ব্যাপারে কেউ কিছু প্রশ্ন করেছে?
না।
ইতিমধ্যে আমরা দোতলায় নির্দিষ্ট ঘরের সামনে পৌঁছে গিয়েছিলাম।
ঘরের দরজায় তালা দেওয়া ছিল, বাইরে থেকে মিসেস বিশ্বাস তালা খুলে দিল। আমরা সকলে একে একে ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকলাম।
ঘর দুটি চমৎকার। খোলা জানালা-পথে তাকালেই চোখে পড়ে সম্মুখে প্রসারিত আদিগন্ত সমুদ্র। দিগন্তবিস্তৃত নীল জলরাশি সূর্যকিরণে ঝলমল করছে-মুহূর্তে যেন সমগ্র দৃষ্টিকে গ্রাস করে। চোখের দৃষ্টি যেন আমার ফিরতে চায় না।
কিরীটীর প্রশ্নে ওর দিকে ফিরে তাকাই।
কিরীটী রেণুকা বিশ্বাসকে আবার প্রশ্ন করছিল, আপনিই বুঝি ঘরে তালা লাগিয়ে
দিয়েছিলেন মিসেস বিশ্বাস?
হ্যাঁ। ব্যাপারটা জানার পরেই তালা লাগিয়ে রাখি। ঘরে তার কি মূল্যবান জিনিস আছে-আছে কে জানে। যদি কিছু খোওয়া যায় তাই–
ভাল করেছেন।
পাশাপাশি দুটি ঘর। একটি বড় আকারের, অন্য সংলগ্ন ঘরটি অপেক্ষাকৃত ছোট। দুই ঘরের মধ্যবর্তী একটা দরজা আছে, ঘরের মধ্যে তিনটি জানালা। তিনটি জানালাই খোলা ছিল এবং জানালাগুলি সমুদ্রের দিকে। খোলা জানালা-পথে হু হু করে সমুদ্রের হাওয়া ঘরের মধ্যে ঢুকছিল। দেওয়ালে টাঙানো একটা ক্যালেণ্ডারের পাতাগুলো ফরফর শব্দে উড়ছিল।
কিরীটী ঘরের চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে দেখতে থাকে।
আমি একটা জানালার সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম।
হু হু করে সমুদ্রের হাওয়া আসছে ঘরে। সামনে যতদূর দৃষ্টি চলে-বালুবেলার পরেই আদিগন্ত সমুদ্র প্রখর সূর্যকিরণে নীল মরকত মণির মত যেন জ্বলছে। বেলা প্রায় সাড়ে এগারটা হবে। অসংখ্য মানার্থী-সমুদ্রের তটে ও জলে।
ঘরের মধ্যে আসবাবপত্র সামান্যই। একধারে একটি খাটে শয্যা বিস্তৃত। তার পাশে একটি টেবিল একটি কাঠের চেয়ার ও একটি ক্যাম্বিসের ইজচেয়ার। ইজিচেয়ারটার উপরিভাগে একটি ভোয়ালে বিছানো-মাথার তেল লাগবার ভয়ে বোধ হয়।
টেবিলের উপরে কিছু ইংরাজী, বাংলা ম্যাগাজিন ও খান-দুই মোটা মোটা হায়ার ম্যাথমেটিকসের বই। একপাশে একটা বড় চামড়ার দামী সুটকেস এবং তার উপর একটা অ্যাটাচি কেন্স।
পাশে দুজোড়া জুতো। একজোড়া কাবুলী চপ্পল। আরও একজোড়া চপ্পল আমাদের চোখে পড়ল খাটের ঠিক সামনেই। মনে হয় যেন কেউ চপ্পলজোড়া পা থেকে খুলে রেখে দিয়েছে। শয্যাটার দিকে তাকালে মনে হয়—সেটা ব্যবহৃত হয়েছে। শয্যার চাদরটা কুঁচকে রয়েছে।
মধ্যবর্তী দরজার কবাট দুটো এদিক থেকে বন্ধ-শিকল ভোলা ছিল। পাশের ঘরে গিয়ে দরজার শিকল খুলে ঢুকলাম আমরা। সে ঘরের ব্যবস্থাও ঠিক পাশের ঘরের অনুরূপ।
কেবল শয্যাটি সুজনি দিয়ে ঢাকা। এবং সেই শয্যার উপরে একটা রবারের বালিশ, একটা ৭৭৭ সিগারেটের কৌটো, একটা কাঁচের অ্যাসট্রে—অ্যাসট্রে ভর্তি সিগারেটের টুকরো ও ছাই। আর একজোড়া তাস।
সে-ঘর থেকে বেরুবার দরজাটা বন্ধই ছিল। দরজাটা খোলবার চেষ্টা করে খুলতে না পেরে কিরীটী রেণুকা বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে আবার প্রশ্ন করে, দরজাটা বুঝি বাইরে থেকে বন্ধ?
হ্যাঁ। বাইরে থেকে তালা দেওয়া। মিঃ সরকারই বলেছিলেন তালা দিয়ে দিতে। এ দরজাটা তো তিনি ব্যবহার করতেন না।
সে তালার চাবি? কিরীটী প্রশ্ন করে।
একটা মিঃ সরকারের কাছে ছিল। একটা আমাদের হোটেলের কী বোর্ডে আছে। আনব? রেণুকা বিশ্বাস কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
না, থাক এখন।
কিরীটী এদিক ওদিক তার স্বাভাবিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টি দিয়ে দেখতে দেখতে হঠাৎ খাটের দিকে এগিয়ে যায়।
তাসের প্যাকেটের পাশেই একটা সাধারণ একসারসাইজ খাতা ও একটা বল-পয়েন্ট দামী বিলিতি পেনসিল চোখে পড়ে। কিরীটী হাত বাড়িয়ে খাতাটা তুলে নিল। খাতার অনেকগুলো পাতায় নানা ধরনের হিসাব লেখা। হিসাবের অঙ্ক কষা। নানা অঙ্কের ফিগার-সবই ইংরাজীতে।
আনমনে খাতার পাতাগুলো ওলটাতে ওলটাতে হঠাৎ এক জায়গায় যেন মনে হল কিরীটীর চোখের দৃষ্টি স্থির হয়ে গেল। দুচোখে অনুসন্ধিৎসার আলো।
কৌতূহলে এগিয়ে গেলাম ওর পাশে। কিন্তু তার আগেই খাতাটা মুড়ে কিরীটী জামার পকেটে রেখে দিল। তারপরই রেণুকা বিশ্বাসের দিকে তাকিয়ে মৃদু কণ্ঠে ডাকে, মিসেস বিশ্বাস!
বলুন?
আমাদের-মানে আপনাদের স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে কি কালী সরকারের পূর্বে কোন পরিচয় ছিল? কোন সূত্রে?
হঠাৎ যেন একটু চমকে ওঠে রেণুকা বিশ্বাস কিরীটীর আকস্মিক প্রশ্নে, বলে, পরিচয়।
হ্যাঁ, পরিচয় কি ছিল?
না তো!
কখনও কোনও পরিচয় ছিল না?
না।
এই হোটেলেই তাহলে তার সঙ্গে আপনাদের প্রথম পরিচয়?
হ্যাঁ।
ওঃ! আচ্ছা চলুন। মধ্যবর্তী দরজা-পথে আবার আমরা প্রথম ঘরে ফিরে এলাম। হঠাৎ কিরীটী রেণুকা বিশ্বাসের দিকে আবার ঘুরে দাঁড়াল, মিসেস বিশ্বাস। বলুন? আপনি প্রথম কখন জানতে পারেন এবং কেমন করে জানতে পারেন দুর্ঘটনার কথাটা?