- বইয়ের নামঃ বনমরালী
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. বাড়িটা তৈরি হয়েছিল
বাড়িটা তৈরি হয়েছিল বছর তিনেক আগেই।
একেবারে সাদার্ন অ্যাভিনুর উপর বাড়িটা। তিনতলার ছাদে উঠলে লেক চোখে পড়ে। জায়গাটা গগনবিহারী কর্নেল গগনবিহারী চৌধুরী কিনেছিলেন চাকরিজীবনেই। ইচ্ছা ছিল রিটায়ার করার পর বাকি দিনগুলো কলকাতা শহরেই কাটাবেন গগনবিহারী, স্ত্রী নির্মল্যর তাই একান্ত ইচ্ছা ছিল।
ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট যখন ঐ তল্লাটে জমিগুলো বিক্রি করছিল তখনই কিনেছিলেন জমিটা। সাড়ে চার কাঠা জমি।
চাকরি যখন আর বছর ছয়েক বাকি তখন বাড়িটা শুরু করেন। তারপর ধীরে ধীরে বাড়িটা তৈরী হয়েছে প্রায় চার বছর ধরে।
দোতলা বাড়ি।
উপরে চারখানা ঘর-নীচে চারখানা ঘর। একতলা ও দোতলার ব্যবস্থা সবই পৃথক, যদি কখনও একতলাটা ভাড়া দেন সেই মতলবেই সব ব্যবস্থা আলাদা করেছিলেন গগনবিহারী।
মিলিটারি চাকরির জীবনে সারা ভারত ঘুরে ঘুরে বেড়িয়েছেন আর্মির ইনফ্যান্ট্রি অফিসার কর্নেল চৌধুরী। কিন্তু ছাত্রজীবনে কলকাতার যে স্মৃতি তাঁর মনের মধ্যে আঁকা হয়ে গিয়েছিল কোনদিন তা বুঝি ভুলতে পারেননি।
কলকাতার একটি অদ্ভুত আকর্ষণ ছিল তাঁর মনের মধ্যে চিরদিন।
প্রায়ই বলতেন গগনবিহারী, দুর দুর, শহর বলতে কলকাতা শহর। বোম্বাই মাদ্রাজ দিল্লী আবার একটা শহর নাকি? প্রাণের স্পন্দন বলতে কিছুই নেই ওসব জায়গায়!
স্ত্রী নির্মাল্য হেসেছে।
নির্মাল্য বরাবর ইউ.পি.-তেই মানুষ। সে কিন্তু বলেছে, কলকাতা আবার একটা শহর! ঘিঞ্জি, ধুলো, মানুষের ভিড়।
কর্নেল চৌধুরী জবাবে বলেছেন, তবু শহর কলকাতা-কলকাতা শহরই!
বাড়িটা মনের মত করেই তৈরী করেছিলেন গগনবিহারী—সামনে খানিকটা ভোলা জায়গা, ফুলের বাগান থাকবে, তারপর ঘোট ঘোরানো একটা গাড়িবারান্দা।
নীচে ও উপরে বড় বড় দুটো হলঘর। চওড়া সাদা পাথরের সিঁড়ি।
দোতলায় হলঘরটার সামনে খানিকটা খোলা ছাদের মত—টেরেসা নামকরা এক আর্কিটেক্টকে দিয়ে বাড়ির প্ল্যানটা করিয়েছিলেন।
কন্ট্রাক্টারকে বলেছিলেন বাড়ি তৈরী শুরুর সময় গগনবিহারী, মিঃ বোস তাড়াতাড়ি বাড়িটা কমপ্লিট করে দেবেন। যতদিন না অবসর নিই চাকরি থেকে, ছুটিটায় ওখানে গিয়ে থাকবে।
কন্ট্রাক্টার মিঃ বোসও সেই মতই অগ্রসর হচ্ছিলেন। কিন্তু বাড়ি তৈরী শুরু হবার মাস-আষ্টেক পরে হঠাৎ নির্মাল্য একটা মোটর-অ্যাক্সিডেন্টে মারা গেল।
স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালবাসতেন কর্নেল চৌধুরী। স্ত্রীর আকস্মিক দুর্ঘটনাজনিত মৃত্যুটা তাই তাঁকে খুবই আঘাত দিল। জীবনটাই যেন অতঃপর তাঁর কাছে মিথ্যে হয়ে গেল।
একমাত্র সন্তান ছেলে রাজীব বিলেতে ইঞ্জিনিয়ারিং পড়তে গিয়ে আর ফিরল না গগনবিহারীর বাড়ি তৈরী করবার ইচ্ছেটাই যেন অতঃপর কেমন ঝিমিয়ে গেল। কন্ট্রাক্টার মিঃ বোসকে তখন বললেন, তাড়াহুড়োর কিছু নেই, ধীরে-সুস্থে কমপ্লিট হোক বাড়ি।
মিঃ বোসও অতঃপর কাজে ঢিলা দিলেন। ধীরে ধীরে শম্বুকগতিতে কাজ চলতে লাগল। এবং বাড়ি শেষ হল দীর্ঘ চার বছর বাদে একদিন।
তখনও চাকরির মেয়াদ দুবছর বাকি রয়েছে। নতুন বাড়ি তালাবন্ধ হয়ে পড়ে রইল। একজন কেয়ারটেকার রইল—জানাল সিং। আরও দু বছর পরে চাকরি থেকে অবসর নেওয়ার পর গগনবিহারী মাস-চারেক এদিক ওদিক ঘুরে অবশেষে এসে উঠলেন তাঁর বাড়িতে। এক শীতের অপরাহ্নে মালপত্র সব আগেই চলে এসেছিল। ভাগ্নে আর ভাইপোসুবিনয় সান্যাল ও সুবীর চৌধুরীকে। চিঠিতে লিখে জানিয়ে দিয়েছিলেন গগনবিহারী কিছু আসবাবপত্র কিনে বাড়িটাকে সাজিয়ে পরিষ্কার করে রাখতে।
চিঠিতে ওদের আরও লিখেছেন, ওরা যেন অতঃপর তাদের মেসের বাসা তুলে দিয়ে ঐখানেই এসে থাকে।
সুবিনয় সান্যাল আর সুবীর চৌধুরী একজনে মামার ও অন্যজনে তার কাকার নির্দেশ পেয়ে মনে মনে খুশিই হয়েছিল।
বালিগঞ্জ অঞ্চলে লেকের কাছে বড় রাস্তার উপরে অমন চমৎকার বাড়ি-খুশি তত হবারই কথা।
দুজনেরই অবস্থা যাকে বলে অতি সাধারণ।
সুবিনয় বি.এস.সি পাস করে এক ওষুধ কোম্পানীতে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরি করে—মাইনে শ-দুই টাকা।
গ্রামের বাড়িতে বিধবা মা ও ছোট বছর পনেরোর একটি বোন। মীজাপুর স্ট্রীটের একটা মেসে ফোর-সিটে রুমের একটা সীটে থাকত। আর সুবীর চৌধুরী আই.এ. পাস করে শর্টহ্যান্ড টাইপরাইটিং শিখে একটা দেশী ফার্মে চাকরি করে। সে-ও থাকত হাজরা রোডের একটা বোর্ডিং হাউসে।
তার আয়ও সামান্য। মাসান্তে শ-দেড়েক টাকা মাত্র। তবে তার সংসারে কেউ ছিল না। গগনবিহারীর স্কুলমাস্টার বড় ভাই বিজনবিহারীর ছেলে ঐ সুবীর। বিজনবিহারীর অনেক দিন আগে মৃত্যু হয়েছিল।
স্বামীর মৃত্যুর বছর ছয়েকের মধ্যেই স্ত্রীরও মৃত্যু হয়েছিল।
গগনবিহারী সুবীরকে মধ্যে মধ্যে অর্থসাহায্য করতেন তবে সে সাহায্যের মধ্যে খুব একটা, আগ্রহ বা প্রাণ ছিল বলে সুবীরের কখনও মনে হয়নি।
সুবীরও তার কাকা কর্নেল চৌধুরীকে জীবনে দু-একবারের বেশী দেখেনি। দুজনকেই আলাদা আলাদা করে চিঠি দিয়েছিলেন কর্নেল চৌধুরী।
তাঁর চিঠি পেয়ে সুবীরই মিজাপুর স্ট্রীটের মেসে গিয়ে এক সন্ধ্যায় সুবিনয়ের সঙ্গে দেখা করে।
মফঃস্বল থেকে দুদিন টুর করে সেদিন সন্ধ্যার কিছু আগে সুবিনয় ফিরেছে। ফিরেই সে, মামার চিঠিটা পেয়েছে।
এক কাপ চা পান করতে করতে সুবিনয় মামার চিঠিটার কথাই ভাবছিল।
মামা বড়লোক। মিলিটারিতে বড় অফিসার। তাদের সমপর্যায়ের মানুষ নন। তাছাড়া ঐ মামার সঙ্গে তার বাবা কল্যাণ সান্যালের বিশেষ কোন একটা প্রীতির সম্পর্কও কোনদিনই ছিল না।
বরং বলা যায় বরাবর একটা মন-কষাকষিই ছিল। কারণ ছিল তার। তার বাবার সঙ্গে তার মায়ের বিয়ের ব্যাপারটা কর্নেল চৌধুরী কখনও ক্ষমার চোখে দেখেননি।
ঐ একটিমাত্র বোন তার মা বাসন্তী দুই ভাইয়ের। গগনবিহারী মিলিটারির চাকরিতে ঘুরে ঘুরে বেড়াতেন ভারতবর্ষের সর্বত্র। বড় ভাই বিজনবিহারী বর্ধমান জেলায় এক ছোট জায়গায় স্কুলের দ্বিতীয় শিক্ষক ছিলেন। সামান্য আয়।
স্ত্রী, বিধবা মা ও ছোট ঐ বোন বাসন্তী। ছোট সংসার। মা যতদিন বেঁচে ছিলেন গগনবিহারী। মধ্যে মধ্যে দুশো-একশো করে টাকা পাঠাতেন। মধ্যে মধ্যে চিঠিপত্র আসত তবে সে চিঠি গগনবিহারীর লেখা নয়, তাঁর স্ত্রী নিমাল্যের।
চাকরি-জীবনে গগনবিহারী যখন কিছুদিনের জন্য এলাহাবাদে পোস্টেড, সেই সময়ই ওখানকার এক ধনী কন্ট্রাক্টার পুরোপুরি সাহেবী ভাবাপন্ন নিমাল্যের বাবা যতীন মিত্রের সঙ্গে আলাপ হয়।
আলাপটা আরও ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে মিত্র সাহেবের একমাত্র কনভেন্টে পড়া বিদুষী কন্যা নিমাল্যকে কেন্দ্র করে। সেই ঘনিষ্ঠতার ফলেই পরবর্তীকালে বিবাহ।
বিবাহের পূর্বে কিছু জানাননি মাকে বা দাদাকে গগনবিহারী। জানানো বোধ হয় প্রয়োজন বোধ করেননি। বিবাহের পরে একটা চিঠিতে দু-লাইনে লিখে সংবাদটা দিয়েছিলেন মাত্র। মা এবং ভাই দুজনেই অবিশ্যি আশীবাদ পাঠিয়েছিলেন গগনবিহারী ও নিমাল্যকে।
তারই কিছুদিন বাদে নিমাল্যর চিঠি এল শাশুড়ীর কাছে তাঁকে প্রণাম দিয়ে। শাশুড়ী জীবিতা থাকবার সময় বার-দুই নিমাল্য বর্ধমানের সেই অজ পাড়াগাঁয়ে গিয়েছিল। একবার দশদিন ও একবার সাতদিন কাটিয়েও এসেছিল সে শ্বশুরবাড়িতে।
সুবীরের.বয়স তখন বারো কি তেরো। স্কুলের ছাত্র।
আর একমাত্র বোন বাসন্তীর বয়স বছর-কুড়ি। প্রাইভেটে সে ম্যাট্রিক পাস করে বাড়িতে বসে লেখাপড়া, ছুঁচের কাজ ও অন্যান্য ঘরের কাজ করে।
সুবিনয়ের বাবা কল্যাণ সান্যাল ঐ সময় বিজনবিহারীর স্কুলে নতুন টিচার হয়ে যান। সেই সূত্রেই কল্যাণ সান্যালের সঙ্গে বিজনবিহারীর পরিচয় ও পরে ঘনিষ্ঠতা হয়।
কল্যাণ সান্যাল বাসন্তীকে বিবাহ করে। বিবাহ স্থির হওয়ার পর বিজনবিহারী ভাইকে চিঠি দিয়েছিলেন সব কথা জানিয়ে। ছেলেটি যদিও স্কুলমাস্টার, সামান্য মাইনে পায়, তাহলেও লেখাপড়ায় ও চরিত্রে আদর্শ মনে হয়েছিল বিজনবিহারীর।
গগনবিহারী, বলাই বাহুল্য, সে চিঠির জবাব দেননি। তবে নির্মাল্য দিয়েছিল চিঠির জবাব ও পাঁচশো টাকা মনিঅর্ডার করে পাঠিয়ে দিয়েছিল।
এসব কথা সুবিনয়ের বড় মামার মুখেই শোনা।
ঐ কাহিনী শোনার পর থেকেই সুবিনয়ের মনে ঐ মিলিটারি অফিসার বড়লোক মামার প্রতি কেমন যেন একটা বিতৃষ্ণার ভাব ক্রমশঃ জেগে ওঠে।
পরে অবিশ্যি ঐ মামার সঙ্গে বার-দুই দেখা হয়েছে তার।
একবার দিল্লীতে বছর সাতেক আগে, আর শেষবার লক্ষ্ণৌতে বছর দুই আগে। এবং ঐ দেখা হওয়া মাত্রই তার বেশি কিছু না।
গগনবিহারী তাঁর চিঠিতে লিখেছিলেন সুবিনয়কে—সে যেন তার মা ও ছোট বোনকে নিয়ে তাঁর বালিগঞ্জের বাড়িতেই এসে ওঠে। গ্রামের বাসা আর রাখার দরকার নেই।
সুবিনয় চা পান করতে করতে তার মামার চিঠিটার কথাই ভাবছিল, এমন সময় সুবীর তার মামাতো ভাই এসে ঘরে ঢুকল।
সুবীর বলতে গেলে তার চাইতে বছর তেরোর বড়। কিন্তু ছোটবেলায় পাশাপাশি একই জায়গায় মানুষ হওয়ায় দীর্ঘদিন থেকেই পরস্পরের মধ্যে রীতিমত একটা ঘনিষ্ঠতা ছিল।
কলকাতায় দুজনে দুজায়গায় থাকলেও মধ্যে মধ্যে দেখাসাক্ষাৎ হত।
সুবীর ঘরে ঢুকতেই সুবিনয় বলে, এই যে সুবীরদা, এস। চা হবে নাকি?
বল।
সুবিনয় উঠে গিয়ে মেসের চাকরকে চেঁচিয়ে এক কাপ চা উপরে দিয়ে যেতে বলে আবার এসে চৌকিটার উপর বসল।
সুবিনয় বললে, একটু আগেই তোমার কথাই ভাবছিলাম সুবীরদা।
সুবীর সে কথার কোন জবাব না দিয়ে বলল, কাকার একটা চিঠি পেয়েছি আজ সুবিনয়।
তাই নাকি? আমিও মামার একটা চিঠি পেলাম আজ ফিরে এসে।
কি লিখেছেন রে কাকা তোকে?
সুবিনয় চিঠিটা বালিশের তলা থেকে বের করে সুবীরের হাতে দিল, পড়ে দেখ না।
সুবীর চিঠিটা পড়ল। পড়ে ফিরিয়ে দিল আবার সুবিনয়কে।
ইতিমধ্যে চাকর এসে এক কাপ চা রেখে যায় ওদের সামনে।
সুবীর পকেট থেকে তার চিঠিটা বের করে সুবিনয়কে দিল, পড়ে দেখ আমার চিঠিটা।
মোটামুটি ঐ একই বয়ান দুটি চিঠির। দুজনের ওপরেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছে চিঠিতে তারা যেন অবিলম্বে গিয়ে বাড়ির কেয়ারটেকার জানাল সিংহের সঙ্গে দেখা করে এবং বালিগঞ্জ টেরেসে গিয়ে গগনবিহারীর বন্ধু সোমেশ্বর ব্যানার্জীর সঙ্গে দেখা করে টাকা নিয়ে কিছু আসবাবপত্র পছন্দমত কিনে বাড়িটাকে সাজিয়ে ফেলে। টাকার জন্যে যেন কৃপণতা কোন রকম না করা হয়। যে টাকাই লাগুক সোমেশ্বর দেবেন। তাঁকে চিঠিতে তিনি সেই রকমই নির্দেশ দিয়েছেন।
এখন কি করবে? সুবীর জিজ্ঞাসা করে।
সুবিনয় বলে, সব ব্যবস্থা করতে হবে।
তাহলে?
সুবিনয় বললে, মামা সাহেব মানুষ—সেরকম ব্যবস্থাই করতে হবে। এক কাজ কর সুবীরদা!
কি?
তুমি কটা দিনের ছুটি নাও, আমিও নিই। দুজনে মিলে সব ব্যবস্থা করে ফেলি।
সুবিনয় ও সুবীর দুজনে মিলে ভাল নামকরা ফার্নিচারের দোকান থেকে সব কিনে এনে গগনবিহারীর সাদার্ন অ্যাভিনুর বাড়িটা সাজিয়ে ফেলল সাতদিনের মধ্যেই।
জানলা-দরজায় পদা, মেঝেতে কার্পেট, বসবার ঘরে সোফা সেট, খাবার ঘরে ডাইনিং টেবিল, একটা ফ্রিজ, কিছু ক্ৰকারিস—কিছুই বাদ দিল না।
এবং দুজনে নির্দেশমত একদিন সাদার্ন অ্যাভিনুর বাড়িতে এসে উঠল।
একজন রাঁধুনী বামুন প্রিয়লাল ও ভৃত্য রতনকেও খুঁজেপেতে নিযুক্ত করল।
কিন্তু তারপর দেখতে দেখতে এক মাস কেটে গেল, গগনবিহারীর দেখা নেই। কোন চিঠিপত্রও আর এল না।
আরও দুমাস পরে পৌষের এক সন্ধ্যায় গগনবিহারী সোজা দিল্লী থেকে গাড়ি নিয়ে এসে হাজির হলেন।
সুবীর তখনও অফিস থেকে ফেরেনি। বাড়িতে সুবিনয় একাই ছিল। সে রাত্রে কি রান্না হবে প্রিয়লালকে বুঝিয়ে দিচ্ছিল। হঠাৎ গাড়ির হর্ন শুনে উঠে দাঁড়াল সুবিনয়, কে এল আবার!
একতলার জানালাপথে উঁকি দিল সুবিনয়। নজরে পড়ল ধুলোভর্তি বিরাট এক ডজ গাড়ি গাড়িবারান্দার, সামনে দাঁড়িয়ে।
গাড়ি থেকে নামল দীর্ঘকায় এক ব্যক্তি। পরনে গরম সুট, মাথায় একটা মিলিটারি ক্যাপ। মুখে পাইপ। আন্দাজেই অনুমান করতে পেরেছিল আগন্তুক কে।
সঙ্গে সঙ্গে ছুটে বাইরে গেল সুবিনয়।
জানাল সিং ড্রাইভার বাহাদুরের সঙ্গে হাত মিলিয়ে গাড়ি থেকে মালপত্র নামাতে ব্যস্ত তখন।
সুবিনয় সামনে গিয়ে প্রণাম করতেই গগনবিহারী ওর মুখের দিকে তাকালেন, তুমি!
আজ্ঞে আমি সুবিনয়।
মনুর ছেলে তুমি?
সুবিনয়ের মায়ের ডাকনাম মনু।
আজ্ঞে।
আমার চিঠি পেয়েছিলে?
আজ্ঞে।
সব ব্যবস্থা করে রেখেছ?
হ্যাঁ।
চল। বেশ ভরাট গম্ভীর গলা।
দুজনে ভিতরের হলঘরে গিয়ে ঢোকে।
দাঁতে পাইপটা চেপে ধরে গগনবিহারী একবার চারিদিকে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগলেন। লম্বা-চওড়া পুরুষ গগনবিহারী।
এককালে রীতিমত গৌরবর্ণ ছিলেন, সুপুরুষ যাকে বলে দেখতে ছিলেন। কিন্তু এখন যেন গায়ের রঙ কেমন তামাটে মনে হয়। মুখে কাঁচাপাকা ফ্রেঞ্চকাট দাড়ি।
চোখে কোন চশমা নেই। ছোট ছোট চোখ, খাড়া নাক, দুপাশে গালের হনু দুটো একটু সজাগ।
কপালে বয়সের বলিরেখা জেগেছে, যদিও দেহের মধ্যে কোথাও বার্ধক্যের লক্ষণ দেখা যায় না। চারিদিকে তাকিয়ে মনে হল যেন সুবিনয়ের গগনবিহারী খুব অখুশি হননি, কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করলেন না।
চিরদিনই একটা চাপা প্রকৃতির মানুষ গগনবিহারী। কথাবাতা কম বলেন, অবিশ্যি সেটা পরবতী চারমাসেই বেশ জানতে পেরেছিল সুবিনয়রা। অতি বড় দুঃখেও যেমন কোন বহিঃপ্রকাশ নেই, তেমনি আনন্দের ক্ষেত্রেও তাই।
সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে লাগলেন গগনবিহারী। সুবিনয় পিছনে পিছনে উঠতে লাগল।
সুবীরবাবু কই, তাকে দেখছি না?
এখনও অফিস থেকে ফেরেনি, সুবিনয় বললে।
আর কোন প্রশ্ন করলেন না। উপরে উঠে সব ঘুরে দেখলেন। তারপর গিয়ে শোবার ঘরের সংলগ্ন বসবার ঘরে গিয়ে বসলেন।
পাইপটা বোধ হয় নিভে গিয়েছিল, পকেট থেকে একটা দামী লাইটার বের করে পুনরায় তাতে অগ্নিসংযোগ করতে করতে বললেন, সুবিনয়বাবু, আমার ড্রাইভার বাহাদুরকে একবার ডাকতে পার?
সুবিনয় তখুনি গিয়ে নীচ থেকে বাহাদুরকে ডেকে নিয়ে এল।
বাহাদুরেরও বয়স হয়েছে, চল্লিশের ঊর্ধ্বে বলেই মনে হয়। চ্যাপ্টা মঙ্গোলিয়ান টাইপের মুখ তবে নেপালীদের মত পরিষ্কার রঙ নয়, খানিকটা কালোর দিকে ঘেঁষা। চ্যাপ্টা নাক, খুদে খুদে চোখ। চোখের দিকে তাকালেই মনে হয় নোকটা সতর্ক ও ধূর্ত।
পরনে বটু-গ্রীন রঙের মিলিটারি ইউনিফর্ম। কোমরে খাপেভরা একটা ছোট ভোজালি। বাহাদুর সেলাম দিয়ে দাঁড়াল, সাব, আমাকে ডেকেছেন?
হ্যাঁ। বাহাদুর, তুই নীচের তলায় থাকবি আর রামদেও এই ঘরের পাশের যে ঘরটা সেই ঘরে থাকবে। তোর সমনপত্র গুছিয়ে নে গিয়ে–
বহুত আচ্ছা সাব।
গাড়ি গ্যারেজ করে দিয়েছিস?
না সাব, গাড়ি পুছে পরিষ্কার করে গ্যারেজে তুলব।
ঠিক আছে, যা।
বাহাদুর চলে গেল।
তারপর সুবিনয়বাবু, তোমার মাকে আমার চিঠির কথা জানিয়েছিলে?
হ্যাঁ। তা সে এল না কেন?
গগনবিহারী বুঝতে পেরেছিলেন বোধ হয় তাঁর বোন দেশের বাড়ি ছেড়ে আসেনি।
এলে সে ইতিমধ্যে এসে নিশ্চয়ই তাঁর সঙ্গে দেখা করত।
মা গ্রামের বাড়ি ছেড়ে এলেন না, মৃদু গলায় সুবিনয় বললে।
কেন? ভদ্রমহিলার প্রেস্টিজে লাগত বুঝি?
সুবিনয় কোন জবাব দেয় না।
ভুয়ো প্রেস্টিজের কোন মূল্য নেই, বুঝেছ! ঠিক আছে। আসেনি যখন তার আর আসার দরকার নেই। তা তোমাদের আমার এখানে কোন কষ্ট হচ্ছে না তো?
না। কষ্ট কিসের!
হ্যাঁ, নিজের বাড়ি এটা মনে করলেই আর কোন ঝামেলা থাকে না। তা এখানে রান্নাবান্নার কি ব্যবস্থা?
একজন ভাল কুক পেয়েছি—প্রিয়লাল।
ইংলিশ ডিশ করতে জানে কিছু, না ঝোল ডাল চচ্চড়ি পর্যন্ত বিদ্যে?
জানে—সব রকম রান্নাই জানে।
ঐ সময় একটা গাড়ি এসে থামবার আওয়াজ পাওয়া গেল নীচে। তারপরই গুরুগম্ভীর একটা কুকুরের ডাক।
সুবিনয়ের হতচকিত ভাবটা কাটবার আগেই বাঘের মত একটা অ্যালসেসিয়ান কুকুর ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল।
কাম হিয়ার জ্যাকি!
কুকুরটা এগিয়ে এসে গগনবিহারীর কোলের উপরে দুপা তুলে দিয়ে নানাভাবে তার প্রভুকে আদর জানাতে লাগল।
একটু পরে এসে ঢুকল রামদেও, গগনবিহারীর বহুদিনের পুরাতন এবং খাসভৃত্য।
রামদেও জ্যাকিকে নিয়ে ট্রেনেই এসেছে।
রামদেও লক্ষ্ণৌর লোক।
দুপুরে জ্যাকি কিছু খেয়েছিল রে? জিজ্ঞাসা করলেন গগনবিহারী।
জী হাঁ।
জ্যাকি ইতিমধ্যেই গগনবিহারীর কাছে বসে পড়ে পা চাটছিল নিজের।
রামদেও?
জী সাব!
তুই এই ঘরের পাশের ঘরটায় থাকবি।
বহুৎ খুব সাব!
নীচে রান্নাঘরে গিয়ে দে ঠাকুর কি কি এনেছে, চিকেন না থাকলে চিকেন নিয়ে আয়, আর জ্যাকির জন্য মাংস।
সুবিনয় বলে, আমি টাকা দিচ্ছি–
তাহলে তাই যাও। টাকা দিয়ে দাও গে। আর চাকরটাকে বল ওর সঙ্গে গিয়ে বাজারটা চিনিয়ে দিতে।
চল রামদেও।
চলিয়ে সাব।
সুবিনয় এগুচ্ছিল, গগনবিহারী আবার ওকে ডাকলেন, শোন সুবিনয়বাবু!
কিছু বলছিলেন?
হ্যাঁ। সুবীরবাবুর ফিরতে কি এর চাইতেও বেশী রাত হয়?
ঘড়িতে তখন রাত পৌনে আটটা।
আজ্ঞে হ্যাঁ, মধ্যে মধ্যে রাত দশটাও হয়ে যায় ফিরতে।
আর তোমার?
আমারও হয়।
দেখ একটা কথা মনে রেখো আর সুবীরবাবুকেও বলে দিও, রাত ঠিক সাড়ে দশটায় কিন্তু আমি জানাল সিংকে কাল থেকে গেট বন্ধ করে দেবার জন্য বলব।
বেশ, বলব।
আচ্ছা যাও।
সেরাত্রে সুবীর এল প্রায় পৌনে এগারোটায়। গেট দিয়ে ঢুকতে গিয়েই থমকে দাঁড়াল সুবীর, দোতলার উপর থেকে জ্যাকি গর্জন শুরু করে দিয়েছে। মুখ তুলে তাকাল সুবীর দোতলার বারান্দার দিকে।
বারান্দার আলোয় চোখে পড়ল ড্রেসিংগাউন গায়ে কে একজন দীর্ঘকায় ব্যক্তি বারান্দার রেলিংয়ের সামনে দাঁড়িয়ে। তার পাশে দাঁড়িয়ে বাঘের মত একটা কুকুর ঘেউ ঘেউ করছে।
উপর থেকেই ভারী গলায় সাড়া এল, হু কামস দেয়ার?
সুবীর সাড়া দেয়, আমি সুবীর।
সুবিনয় জেগেই ছিল সুবীরের প্রতীক্ষ্ণয়, সে ততক্ষণে বের হয়ে গেটের কাছে এগিয়ে গিয়েছে।
কে, সুবীরদা?
হ্যাঁ।
এস ভেতরে।
কাকা এসে গেছেন বলে মনে হচ্ছে!
হ্যাঁ।
জ্যাকির ডাকাডাকি তখন থেমে গিয়েছে।
০২. নীচের তলায় দুটো ঘরে
নীচের তলায় দুটো ঘরে সুবিনয় ও সুবীর নিজেদের ব্যবস্থা করে নিয়েছিল। সুবীর এসে সুবিনয়ের ঘরে ঢুকল।
কখন এল রে?
সন্ধ্যাবেলা। সুবিনয় বলল।
ঐ বাঘের মত কুকুরটাও সঙ্গে এনেছে নাকি?
হ্যাঁ। আরও আছে—
আর কে এল আবার?
ড্রাইভার কাম বডিগার্ড নেপালী বাহাদুর, আর এক্স-মিলিটারী পার্সোন্যাল রামদেও।
হুঁ।
সুবীর পকেট থেকে সিগারেট কেসটা বের করে, তা থেকে একটা সিগারেট ধরিয়ে তাতে অগ্নিসংযোগ করল। নিঃশব্দে গোটা-দুই টান দিল।
এখনও জেগে আছেন?
বোধহয় তোমার ফেরবার প্রতীক্ষ্ণতেই জেগে ছিলেন।
তাই নাকি?
তাই তো মনে হচ্ছে।
কেন?
বলে দিয়েছেন কাল থেকে নাকি রাত ঠিক সাড়ে দশটায় গেট বন্ধ হয়ে যাবে।
গেট বন্ধ হয়ে যাবে!
হ্যাঁ।
তাহলে তো এখানে আমার পোষাবে না সুবিনয়।
কটা দিন একটু তাড়াতাড়ি ফেরবার চেষ্টা কর না।
থাম্ তো তুই। রাত এগারোটা সাড়ে-এগারোটার আগে কোন ভদ্রলোক আজকালের দিনে বাড়ি ফিরতে পারে নাকি? ওসব আমার দ্বারা হবে না।
সুবিনয় মৃদু হাসল। তারপর জিজ্ঞাসা করে, কিছু সুবিধে হল?
সুবীরের চাকরিটা টেম্পোরারী ছিল, মাসখানেক হল চাকরি গিয়েছে, সে আবার একটা চাকরির চেষ্টা করছে।
না।
নটরাজনের সঙ্গে দেখা করেছিলে?
করেছিলাম।
কি বললে সে?
বললে এখনও কিছু স্থির হয়নি। ঐ পোস্টটার জন্য তোদের অফিসে দিন পনেরো বাদে একবার খোঁজ নিতে বলেছেন।
ঠিক আছে। আমাদের সার্কুলেশন ম্যানেজার মিঃ গিল বম্বে থেকে ফিরুক, তাকে আবার আমি বলব।
কবে ফিরবে রে?
দিন সাত-আট বাদে বোধ হয়।
এদিকে পকেট তো আমার গড়ের মাঠ! নেহাৎ থাকা-খাওয়ার ভাবনা নেই এখন—
পরশু পঁচিশ টাকা নিলে যে!
পঁচিশ টাকা একটা টাকা নাকি?
তা এত রাত হল কেন ফিরতে?
মিত্ৰাণীকে নিয়ে সিনেমায় গিয়েছিলাম।
সুবীর চরিত্রে একটু ঢিলেঢালা, দিলদরিয়া ভাব, যা উপার্জন করে দুহাতে খরচ করে। কাল কি হবে তার জন্য কোন চিন্তাই নেই যেন।
পোশাক-পরিচ্ছদেও একটু বাবু গোছের।
সুবিনয় কিন্তু সুবীরের ঠিক বিপরীত। সঞ্চয়ী, গোছানো চিরদিনই।
সুবিনয়!
কি?
কাল আমাকে আরও কিছু দিতে পারিস?
কত?
এই গোটা কুড়ি টাকা!
দেব।
মাসের শেষ, তোর অসুবিধা হবে না তো আবার?
না। চল ওঠ, এবার খাবে চল। না খেয়ে এসেছ!
বিশেষ কিছু খাইনি—একটা কাটলেট আর এক কাপ চা। চল, খিদে পেয়েছে দারুণ।
ডাইনিং হলে দুজনে খেতে বসে।
চিকেন স্টু ও পুডিং দেখে খেতে বসে সুবীর বলে, আরে বাবা, এ যে রাজকীয় ব্যাপার! প্রিয়লাল, এসব কখন রাঁধলি রে!
আজ্ঞে কত্তাবাবুর বেয়ারা বেঁধেছে–রামদেও।
আই সি!
সুপ থেকে একটুকরো চিকেন তুলে নিয়ে চিবুতে চিবুতে সুবীর বলে, বেঁধেছে তো খাসা!
সুবীর চিরদিনই একটু ভোজনবিলাসী।
ঐ সময় জ্যাকি এসে ঘরে ঢুকে সুবীরের গায়ের গন্ধ শুঁকতে থাকে। ভয়ে সুবীর সিঁটিয়ে ওঠে। হাত থেমে যায় তার।
বলে, ওরে বাবা, এটা আবার এখানে কেন?
সুবিনয় বললে, কিছু বলবে না। গন্ধ শুঁকে চিনে নিচ্ছে।
বিশ্বাসও নেই কিছু—সুবীর বলে।
জ্যাকি গন্ধ শুঁকে চলে গেল ঘর থেকে।
খাওয়া-দাওয়ার পর দুজনে ঘর থেকে বেরুল। বারান্দায় আসতেই অন্ধকারে নজরে পড়ে বারান্দার শেষপ্রান্তে কে যেন আবছায়া দাঁড়িয়ে আছে।
সুবীর প্রশ্ন করে, কে? কে ওখানে?
আমি বাহাদুর হুজুর।
সেই নেপালীটা বুঝি সুবিনয়? সুবীর শুধায়।
হ্যাঁ।
যে যার ঘরে গিয়ে অতঃপর খিল তুলে দিল।
জামা-কাপড় বদলে সুবীর শ্লিপিং-সুটটা পরে নিল। একটা সিগারেট ধরিয়ে ঘরের আলো নিভিয়ে জানলার সামনে এসে দাঁড়াল।
ভাল লাগছে না সুবীরের, কাল এখান থেকে চলে যেতে পারলে ভাল হত কিন্তু উপায় নেই।
গত মাস থেকে চাকরি নেই। টেম্পোরারি চাকরি অবিশ্যি যাবে জানতই, তাছাড়া ডেপুটি ম্যানেজার মিঃ সিংয়ের সঙ্গে আদৌ বনিবনা হচ্ছিল না।
হয়ত এত তাড়াতাড়ি চাকরিটা যেতও না, আর মাস দুই থাকত—কিন্তু সিং-এর সঙ্গে হঠাৎ সেদিন চটাচটি হতেই পরের দিনই চাকরিটা গেল।
পরের দিন অফিসে গিয়েই নোটিস পেল। ডেপুটি ম্যানেজারের নোটিস। মাইনে বুঝে নিয়ে তাকে চলে যেতে বলা হয়েছে। সুবীরও চলে এসেছিল সোজা টাকাকড়ি বুঝে নিয়ে অফিস থেকে বের হয়ে। চাকরি আজও একটা জোটেনি। তাহলেও এখানে সে থাকবে না। থাকতে সে পারবেও না। তবে একটা চাকরি চাই সর্বাগ্রে। এখানে অন্ততঃ থাকা-খাওয়ার ব্যাপারে নিশ্চিন্ত ছিল সে। তাছাড়া মিত্ৰাণীর হোস্টেলটাও কাছে।
শ্যামবাজার থেকে মাস দুই হল মিত্ৰাণী কাছেই এখানকার একটা মেয়েদের হোস্টেলে উঠে। এসেছে।
হেঁটে যেতেই পারা যায় মিত্ৰাণীর হোস্টেলে। মিত্ৰাণীর কথা মনে পড়তেই অন্ধকারে সুবীরের ঠোঁটের কোণে হাসি ফুটে ওঠে, বয়স কত হল মিত্ৰাণীর! মনে মনে একটা হিসাব করে সুবীর।
খুব কম করেও ত্রিশের কাছাকাছি তো হবেই। চাকরিই তো করছে দশ বছর। এখনও মিত্ৰাণী ঘর বাঁধার স্বপ্ন দেখে। বেচারী! আজকের দিনে ঘর বাঁধার ব্যাপারটা যেন এতই সহজ!
মিত্ৰাণী এখনও জানে না বছর দুই আগেই তার পার্মানেন্ট চাকরিটা গিয়েছে। তারপর দু জায়গায় টেম্পোরারি কাজ করল। শেষ চাকরিটাও মাসখানেক হল গিয়েছে।
ব্যাপারটা জানলে অত উৎসাহের সঙ্গে বলত না, আমি আড়াইশো মত পাই, তুমিও তিনশো সাড়ে তিনশো পাও। দুজনের বেশ ভাল ভাবেই চলে যাবে। একটা দুঘরওয়ালা ফ্ল্যাট।
নাঃ, একটা চাকরি যোগাড় করতে হবেই।
.
পরের দিন দেখা হল সুবীরের গগনবিহারীর সঙ্গে। সামান্যই কথাবার্তা হল। তার মধ্যে বিশেষ যে কথাটা সেটা হচ্ছে তার চাকরি ও উপার্জন সম্পর্কে।
তাহলে বি.এ.টাও পাস করতে পারনি?
গগনবিহারী বললেন। পরীক্ষা দিইনি।
দিলে অন্ততঃ নির্বুদ্ধিতা প্রকাশ করা হত না। তা কোথায় চাকরি করছ?
ঐ একটা মার্চেন্ট অফিসে। কোনমতে ঢোঁক গিলে কথাটা উচ্চারণ করল সুবীর কতকটা যেন ভয়ে-ভয়েই।
মাইনে কত?
শ-দুই মত।
ঠিক আছে, যোগজীবন আসুক, তাকে বলবখন তোমার কথা।
আমি তাহলে উঠি?
হ্যাঁ, এস।
সুবীর উঠে দুপা এগিয়েছে, পিছন থেকে গগনবিহারী ডাকলেন, হ্যাঁ শোন, আর একটা কথা—
থেমে ঘুরে তাকাল সুবীর গগনবিহারীর মুখের দিকে।
রাত ঠিক সাড়ে দশটায় আজ থেকে কিন্তু গেট বন্ধ হয়ে যাবে, বুঝেছ?
হ্যাঁ।
যাও।
সুবীর ঘর ছেড়ে চলে গেল।
নীচে এসে নিজের ঘরে ঢুকতেই দেখে সুবিনয় বসে আছে।
সুবিনয় জিজ্ঞাসা করল, কি বললেন মামা, সুবীরদা?
সুবীর খাটের উপর থপ করে বসে পড়ে বললে, ইম্পসিবল।
কি হল?
এখানে বাস করা আমার চলবে না সুবিনয়। এত কড়াকড়ি, এত নিয়মকানুন—এ তো কয়েদখানা!
একটা কথা বলব সুবীরদা?
কি?
বলছিলাম ভাল একটা যা হোক চাকরিবাকরি না পাওয়া পর্যন্ত—
তার আগেই মৃত্যুরেব ন সংশয়!
পাগলামি করো না সুবীরদা। যা বলি শোন, হুট করে একটা কিছু করে বসোনা। তাছাড়া রাজীব ওদেশ থেকে আর ফিরবে না, মামার যা কিছু তো তুমিই পাবে।
আমি?
হ্যাঁ, তুমি ছাড়া আর কে আছে বল?
তাহলে বলব সুবিনয় তুমি ভুল করেছ।
ভুল করেছি!
হ্যাঁ। আমি ঐ চীজটিকে এক আঁচড়ে চিনে নিয়েছি ঘরে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে।
তার মানে?
মানে অতীব সরল, অতীব প্রাঞ্জল।
হেঁয়ালি রাখ তো।
শোন, ঘরে ঢুকে কি দেখলাম জান?
কি?
যত রাজ্যের বিলিতী আমেরিকান আর ফ্রেঞ্চ ম্যাগাজিন।
হ্যাঁ, সঙ্গে দু-বাক্স ভর্তি ম্যাগাজিন ও বইপত্র এসেছে কাল দেখছিলাম।
ঐ ম্যাগাজিনগুলো কিসের জানো?
কিসের?
যত নগ্ন মেয়েদের মানে ন্যাংটো মেয়েদের ছবিতে ভরা। আর সেই ছবিগুলো বসে উল্টে উল্টে দেখছেন তোমার মামাবাবু।
সত্যি!
এক বর্ণ মিথ্যে নয়। ঐ ম্যাগাজিনগুলো দেখে বুঝে নিয়েছি, ওঁর মনের অলিতেগলিতে
এই বয়সেও কোন রসের প্রবাহ চলেছে।
কিন্তু–
ছি ছি, বুড়ো হয়েছেন, সাতকাল গিয়ে এককালে ঠেকেছেন, এখনও ঐসব পর্ণোগ্রাফি নিয়ে মজে আছেন! এই মানুষ দেবে আমায় সম্পত্তি? একটি কপর্দকও নয়!
সুবিনয় আর কোন কথা বলে না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলে, যাই উঠি, অফিসের বেলা হল।
টাকাটা দিয়ে যেও কিন্তু–
হ্যাঁ, মনে আছে।
সুবিনয় উঠে পড়ল।
.
দিনচারেক বাদে এলেন যোগজীবন সান্যাল, কলেজ-জীবনের সহপাঠী গগনবিহানীর এবং দুজনের মধ্যে দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠতা। যোগজীবনও দীর্ঘদিন সেন্ট্রালের বড় চাকরি করে রিটায়ার করেছেন। যোগজীবন একা আসেননি, সঙ্গে তাঁর ছাব্বিশ-সাতাশ বছরের বোন শমিতা।
শমিতার গায়ের রংটা কালো হলেও সারা দেহ জুড়ে যেন একটা অপূর্ব যৌবনশ্রী। যৌবন যেন সারা দেহে টলমল করছে।
যেন উপচে পড়ছে কানায় কানায়। বেশভূষাও অনুরূপ। শমিতা এম.এ পাশ—কোন এক বেসরকারী কলেজের অধ্যাপিকা। ভালবেসে একজনকে বিবাহ করেছিল, কিন্তু সে বিবাহ দুবছরের বেশি টেকেনি, ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিল সেও আজ বছর পাঁচেকের কথা।
শমিতা এসেছিল নিজেই ইচ্ছা করে গগনবিহারীর সঙ্গে দেখা করতে, কারণ যোগজীবনের বাড়িতে গগনবিহারীর ছাত্রজীবনে যখন যাতায়াত ছিল তখন থেকেই বালিকা শমিতাকে চিনতেন গগনবিহারী।
যোগজীবনের ছোট বোন ওঁকেও দাদা বলে ডাকত। গগনবিহারী ভালও বাসতেন।
শমিতা যোগজীবনের সঙ্গে গগনবিহারীর ঘরে ঢুকে একেবারে হৈ-হৈ করে উঠল, তোমার উপরে ভীষণ রাগ করেছি গগনদা!
কেন বল তো? গগনবিহারী হাসতে থাকেন।
চারদিন এসেছ অথচ একটিবার আমাদের ওখানে গেলে না দেখা করতে।
আর দুদিন অপেক্ষা করলে না কেন? দেখতে যেতাম কিনা?
সত্যি বলছ যেতে?
পরীক্ষা করা উচিত ছিল আগে।
যোগজীবন বলেন, শমির সঙ্গে তুমি কথায় পারবে না গগন।
গগনবিহারী নিঃশব্দে মৃদু মৃদু হাসেন আর দুচোখের দৃষ্টি দিয়ে স্বল্প বেশবাসের ফাঁকে ফাঁকে শমিতার যে উগ্র যৌবন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে সেই যৌবনকে যেন উপভোগ করতে থাকেন।
শমিতা ঐ সময় বলে, শোন গগনদা, দাদার সঙ্গে তোমার এখানে আসার আমার আরও একটা উদ্দেশ্য আছে কিন্তু–
তাই নাকি!
হ্যাঁ।
তা উদ্দেশ্যটা কি?
আমাদের একটা ক্লাব আছে—
ক্লাব! তা ক্লাবের নাম কি?
ক্লাবের নাম মরালী সঙ্ঘ।
বেশ নামটা তো!
যোগজীবন বলেন, ঐসব করছে আর কি! তা বাপু বলেই ফেল না গগনকে কি করতে হবে!
পেট্রোন হতে হবে।
পেট্রোন?
হ্যাঁ।
গগনবিহারী হাসতে হাসতে বলেন, তা দক্ষিণা কত?
পেট্রোনের কোন ধার্য দক্ষিণা নেই—তাঁরা যা-ই দেবেন তাই গ্রহণীয় হবে।
সুবীর একপাশে দাঁড়িয়ে ছিল নিঃশব্দে।
যোগজীবন আসছেন বলে গগনবিহারী তাকে ঘরে ডেকে পাঠিয়েছিলেন, সুবীর দেখছিল তার কাকার দুচোখের লুব্ধ দৃষ্টি কেমন করে লেহন করছে শমিতার যৌবনকে।
ঠিক আছে, বস—আসছি।
গগনবিহারী উঠে গেলেন এবং একটু পরে চেক-বইটা হাতে ঘরে এসে খস খস করে একটা দেড় হাজার টাকার চেক লিখে শমিতার দিকে চেকটা ছিঁড়ে এগিয়ে ধরলেন, নাও।
চেকটায় একবার চোখ বুলিয়ে শমিতা বললে, মেনি মেনি থ্যাংকস্। আজ সন্ধ্যায় তাহলে আসছ?
কিন্তু আমি তো তোমাদের ক্লাব চিনি না।
আমি নিজে এসে নিয়ে যাব, শমিতা বললে।
বেশ, কখন আসবে?
সাড়ে সাতটায়। আমি তাহলে এখন উঠি গগনদা!
এখুনি উঠবে কি, চা-টা খাও। সুবীর?
কাকা!
রামদেকে চা দিতে বল।
সুবীর ঘর থেকে বের হয়ে গেল। তার সমস্ত মনটা জুড়ে তখন একটা ভরন্ত উজ্জ্বল যৌবন যেন নানা রংয়ের তুলি টেনে চলেছে!
.
চা-পর্ব শেষ হবার পর শমিতা চলে গেল।
গগনবিহারী তখন সুবীরের পরিচয় দিলেন, যোগজীবন, এই ভাইপোটির একটা কিছু ব্যবস্থা করে দিতে পার? তোমার তো অনেকের সঙ্গে পরিচয় আছে!
কতদূর লেখাপড়া করেছে? যোগজীবন প্রশ্ন করেন।
আরে তাহলে আর ভাবনা ছিল কি! আই.এ. পাস করে শর্টহ্যান্ড টাইপ-রাইটিং শিখেছে। অবিশ্যি একটা অফিসে কাজ করছে, মাইনে তেমন সুবিধার নয়।
যোগজীবন বললেন, বলবখন দু-একজনকে।
সুবীর ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
তারপরও ঘণ্টাখানেক দুই বন্ধুতে আলাপ-সালাপ হল।
দুজনেরই স্ত্রী-বিয়োগ ঘটেছে।
গগনবিহারীর তবু এক ছেলে আছে, যোগজীবনের তাও নেই।
যোগজীবন একসময় জিজ্ঞাসা করেন, ছেলের খবর কি তোমার, ফিরছে কবে?
সে আর ফিরবে না।
সে কি হে!
হ্যাঁ, সেখানেই বিয়ে-থা করে সংসার পেতেছে। যাক গে যা খুশি তার করুক।
আমার তো তবু শমিকে নিয়ে একরকম জীবন কেটে যাচ্ছে। তোমার তো তাহলে দেখছি একা একা খুবই কষ্ট হবে হে।
সেই জন্যেই তো ভাগ্নে আর ভাইপোটাকে এখানে এনে রেখেছি। গগনবিহারী বললেন।
.
ঐদিন সন্ধ্যায় শমিতা এল গগনবিহারীকে নিতে নিজেরই গাড়িতে।
সুবীর নীচের বারান্দায় একটা আরামকেদারায় বসে একটা পিকটোরিয়াল ম্যাগাজিনের পাতা উল্টোচ্ছিল।
।মনে মনে সে স্থির করে রেখেছিল কাকা গগনবিহারী বের হয়ে যাবার পরেই সে বেরুবে।
শমিতা এল সাড়ে সাতটা নাগাদ প্রায়। দূর থেকে দেখতে পেল সুবীর শমিতাকে। সকালের বেশভূষায় তবু তার কিছু আব্রু ছিল, কিন্তু সন্ধ্যার বেশভূষায় সুবীরের মনে হল তাও বুঝি নেই।
পরচুলা দিয়ে উঁচু করে খোঁপা বাঁধা। পরনে ফিনফিনে দামী আমেরিকান নাইলনের শাড়ি, গলা ও বগলকাটা অনুরূপ এক জামা গায়ে—যার তলা থেকে ব্রেসিয়ার ও দেহের প্রতিটি ভাঁজ ও উদ্ধত উচ্ছল যৌবন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
শমিতা তার সামনে দিয়ে উপরে চলে গেল এবং মিনিট কয়েক বাদে গগনবিহারীকে নিয়ে নেমে এল। গগনবিহারীও সাজের কসুর করেননি। দামী ব্লু রংয়ের টেরিউল স্যুট, গলায় দামী টাই। দুজনে গাড়িতে উঠল, গাড়ি চলে গেল।
.
তারপর তিনটে মাস।
প্রতিদিন সন্ধ্যায় গগনবিহারীবের হয়ে যান মরালী সঙ্ঘে এবং ফেরেন রাত সাড়ে এগারোটায়। রাত সাড়ে দশটায় গেট বন্ধ হয়ে যায়, তবে রাত সাড়ে এগারোটায় একবার খোলে। কাজেই সুবীরের কোন অসুবিধাই হয় না।
তাছাড়া যোগজীবনের চেষ্টায় সুবীরের একটা ভাল চাকরিও জুটে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। গগনবিহারী যেন এক নতুন মানুষ হয়ে ওঠেন।
সুবীর ও সুবিনয় আরামেই কাটায়। গগনবিহারীর সঙ্গে তাদের বড় একটা দেখাই হয় না। ওরা যে দুজন ঐ গৃহে আছে তাও যেন গগনবিহারীর মনে পড়ে না।
মধ্যে মধ্যে গগনবিহারী যেদিন ক্লাবে যান না শমিতাই আসে। রাত সাড়ে এগারোটা বারোটা পর্যন্ত থাকে সে এবং ঐ সময়টা একমাত্র রামদেও ব্যতীত কারও উপরে যাবার হুকুম নেই।
সিঁড়ির নীচে বাহাদুর বসে থাকে। সুবিনয় ও সুবীরের সঙ্গে জ্যাকির বেশ ভাব হয়ে গিয়েছে।
আরও তিন মাস পরে হঠাৎ আর একজনের আবির্ভাব ঘটল ঐ বাড়িতে। রামদেওর তৃতীয় পক্ষের স্ত্রী রুক্মিণী।
রুক্মিণীর বয়স সতের কি আঠার। সবে যৌবনে পা দিয়েছে। যৌবন যেন টলমল করছে রুক্মিণীর সারা দেহে। দেহাতী গাঁয়ের মেয়ে হলে কি হবে রুক্মিণী রীতিমত চটুল। লাজলজ্জার তেমন বালাই নেই। সারা বাড়ি সে স্বচ্ছন্দে ঘুরে বেড়ায়।
সন্ধ্যায় সাজগোজ করে, খোঁপায় ফুল গোঁজে। গুনগুন করে গান গায়। রুক্মিণীর স্থান হল উপরেই রামদেওর ঘরে।
রুক্মিণী ঐ গৃহে আসবার দিন কুড়ি-বাইশ বাদেই আকস্মিক ঘটনাটা ঘটল।
একদিন প্রত্যুষে—
হঠাৎ বাহাদুরের চেঁচামেচিতে সুবিনয়ের ঘুমটা ভেঙে গেল।
সুবীর গতরাত্রে গৃহেই ফেরেনি। সুবিনয়কে সে বলেই গিয়েছিল, রাত্রে হয়তো ফিরবে না–কোথায় এক বন্ধুর বিয়েতে বরযাত্রী হয়ে যাবে।
সুবিনয় বাহাদুরের চেঁচামেচিতে চোখ মুছতে মুছতে বাইরে এসে জিজ্ঞাসা করল, কি রে, ব্যাপার কি?
সাব—
বাহাদুর আর বলতে পারে না। গলা আটকে যায়।
কি হয়েছে সাহেবের?
সাব খতম হো গিয়া—
খতম হো গিয়া! সে কি রে!
হাঁ। চলিয়ে—উপরমে চলিয়ে—
ত্বরিত স্খলিত পদে সুবিনয় উপরে উঠে গেল।
গগনবিহারী আসবার পর থেকে আর সে উপরে ওঠেনি। প্রয়োজনও হয়নি তার।
গগনবিহারীর শয়নকক্ষে ঢুকে থমকে দাঁড়াল সুবিনয়।
ঘরের মেঝেতে গগনবিহারীর মৃতদেহটা পড়ে আছে। পিঠে একটা ছোরা বসানো আমূল—চাপ চাপ রক্ত চারদিকে জমাট বেঁধে আছে।
সঙ্গে সঙ্গে ও চোখ বোজে।
০৩. প্রায় মিনিট দশ-পনেরো লাগে
প্রায় মিনিট দশ-পনেরো লাগে সুবিনয়ের নিজেকে সামলে নিতে।
ধীরে ধীরে একসময় নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়ায় সুবিনয়। আবার মেঝের দিকে তাকায়, পরনে গগনবিহারীর পায়জামা ও ড্রেসিংগাউন।
খালি পা। পায়ের চপ্পল জোড়ার একটা খাটের সামনে পড়ে আছে, অন্যটা মৃতদেহের পায়ের অল্প দূরে।
উপুড় হয়ে পড়ে আছেন গগনবিহারী। একটা হাত ছড়ানো, অন্য হাতটা দেহের নীচে। ঘরের মধ্যে সেন্ট্রাল টেবিলটা উল্টে পড়ে আছে। একটা অর্ধসমাপ্ত হোয়াইট হর্সের বোতল, একটা ভাঙা কাচের গ্লাস, গোটা-দুই সোডার বোতলও মেঝের মধ্যে পড়ে আছে।
সুবিনয় ভেবে ঠিক করতে পারে না অতঃপর তার কি কর্তব্য। সব যেন কেমন গোলমাল হয়ে যাচ্ছে।
বাহাদুর পাশেই দাঁড়িয়ে কাঁদছিল। সে-ই বলে, অব কেয়া হোগা দাদাবাবু!
রামদেও কোথায়? এতক্ষণে যেন নিজেকে অনেকটা গুছিয়ে নিয়ে প্রশ্নটা করে সুবিনয়।
রামদেও!
হ্যাঁ, রামদেও কোথায়?
সে তো রাত্রে পাশের ঘরেই থাকে?
রামদেও নেহি হ্যায়।
নেহি হ্যায়? কোথায় গেল সে জান?
মুঝে মালুম নেহি হ্যায় দাদাবাবু। সুবেসেই উসকা পাত্তা নেহি।
ওর বৌ রুক্মিণী?
উ তো হ্যায়।
কোথায়?
উসিকা কামরামেই হ্যায়, নিদ যাতা হ্যায়।
অভিতক নিদ যাতা হ্যায়! ওকে ডেকে আন।
বাহাদুর চলে গেল এবং একটু পরে রুক্মিণীকে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকল। রুক্মিণী ঘরে পা দিয়েই ভূপতিত গগনবিহারীর রক্তাক্ত নিষ্প্রাণ দেহটার দিকে তাকিয়ে অধস্ফুট একটা চিৎকার করে ওঠে, এ মাইয়া—হায় রাম!
এই রুক্মিণী, কাল রাত্রে তুই পাশের ঘরেই ছিলি তো?
হ্যাঁ, ছিলাম।
কোন শব্দ বা চিৎকার শুনিসনি?
হায় রাম! নেহি দাদাবাবু, কুছ নেহি শুনা।
মিথ্যে কথা। সুবিনয় গর্জন করে ওঠে, সত্যি কথা বল?
হায় রাম! সাচ্ বলছি দাদাবাবু, তোর গোড় লাগি, আমি কিছু জানি না, কিছু শুনিনি।
রামদেও কোথায়, তোর স্বামী?
কেন, সে তত বাড়িতেই আছে।
না, তাকে দেখছি না। কোথায় গিয়েছে সে?
কোথায় আবার যাবে! হয়তো বাজারে গিয়েছে।
এত সকালে বাজারে?
তবে কোথায় যাবে?
ঐ সময় সুবীর এসে ঘরে ঢুকল হন্তদন্ত হয়ে। সে বাড়ি ফিরেই নিচে চাকর ও প্রিয়লালের মুখে দুঃসংবাদটা পেয়েছিল।
ঘরে পা দিয়ে সুবীর বলল, এ কি, কখন হল!
সুবিনয় বললে, মাথার মধ্যে আমার যেন কেমন করছে সুবীরদা। চল চল, এ ঘর থেকে বের হয়ে চল—এখানে দাঁড়িয়ে থাকা ভাল নয়।
পুলিসে একটা খবর দিয়েছ? সুবীর প্রশ্ন করে।
পুলিস!
হ্যাঁ, খুন—সর্বাগ্রে আমাদের পুলিসকেই খবর দেওয়া উচিত। এস। এই রুক্মিণী, বাইরে যা!
রুক্মিণী বাইরে চলে গেল।
সুবীরই পাশের ঘরে গিয়ে নিকটবর্তী থানায় একটা ফোন করে দিল এবং থানায় ফোন করার পর যোগজীবনবাবুকেও একটা ফোন করে দিল।
ফোন করে দুজনে নিচে এসে বসল সুবিনয়ের ঘরে।
সুবিনয় বললে, এখন কি হবে সুবীরদা?
পুলিস এসে যা ব্যবস্থা করে তাই হবে।
কিন্তু ঐ ভাবে ব্লুটালি কে মামাকে খুন করল!
যে ভাবে বুড়ো বয়সে মামা মেয়েমানুষ নিয়ে বেলেল্লাপনা শুরু করেছিলেন, এমন যে একটা কিছু হবে আমি বুঝতেই পেরেছিলাম। তা রামদেও রুক্মিণী কি বলে—ওরা তো রাত্রে পাশের ঘরেই থাকে!
রুক্মিণী বললে সে কিছু জানে না।
বললেই অমনি হল? পাশের ঘরে একটা মানুষ খুন হয়ে গেল, আর ওরা কিছুই জানে? রামদেও কি বলে?
রামদেও নেই।
নেই মানে?
পাওয়া যাচ্ছে না তাকে সকাল থেকে।
তবে হয়তো ঐ বেটারই কীর্তি!
কি বলছ তুমি সুবীরদা?
কাকাবাবুর যা চরিত্র ছিল—হয়তো ঐ ছুকরি রামদেওর বৌটার দিকে হাত বাড়িয়েছিলেন, দিয়েছে বেটা খতম করে!
না, না—
নচেৎ বেটা গায়েবই বা হবে কেন?
হয়তো ব্যাপারটা জানতে পেরে ভয়ে নাভাস হয়ে পালিয়েছে।
সুবীর মৃদু হাসল, ভুলে যেও না সুবিনয়, বেটা এককালে মিলিটারিতে চাকরি করত।
কিন্তু ও তো মামার কাছে অনেকদিন থেকেই আছে।
হুঁ, মেয়েমানুষের ব্যাপারে বিশ্বাস! দুনিয়াটা অত সহজ রাস্তায় চলে না হে সুবিনয়। অত্যন্ত জটিল। আমি তোমাকে বলে রাখছি, ঐ রুক্মিণী ছুঁড়ীকে নিয়েই ব্যাপারটা ঘটেছে। তা গতরাত্রে মিস শমিতা সান্যাল আসেনি?
শুনলাম তো এসেছিলেন কাল রাত্রে—
কে বললে?
রামদেওই বলছিল।
ঐ মিস শমিতা সান্যালটি আর একটি চিজ!
.
আধঘণ্টার মধ্যে থানা অফিসার অরূপ মুখার্জী এসে গেলেন। অরূপ মুখার্জী একেবারে ইয়ং নয়–বয়স প্রায় চল্লিশের কাছাকাছি, লম্বাচওড়া চেহারা। সঙ্গে জনাচারেক সিপাইও আছে।
পুলিসের জিপের আওয়াজ পেয়েই সুবীর সুবিনয়কে নিয়ে বাইরের বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছিল।
অরূপ মুখার্জী জিজ্ঞাসা করলেন, থানায় ফোন করেছিলেন কে?
সুবীর বললে, আমি স্যার।
আপনি?
আমি এই বাড়িতেই থাকি, আমার কাকা এক্স-মিলিটারি অফিসার কর্ণেল গগনবিহারী চৌধুরী খুন হয়েছেন।
কি করে খুন হল?
খুব সম্ভব স্ট্যান্ড্র টু ডেথ!
ডেড বডি কোথায়?
দোতলায়।
চলুন।
ঐ সময় হঠাৎ দূরে কোথা থেকে ক্ষীণ একটা কুকুরের ডাক যেন কানে এল সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে থানা-অফিসার অরূপ মুখার্জীর।
ডাকটা সুবীর ও সুবিনয়ের কানেও এসেছিল।
অরূপ মুখার্জী বললেন, একটা কুকুরের ডাক শুনছি যেন! এ বাড়িতে কোন কুকুর আছে নাকি?
সুবিনয় বলে, হ্যাঁ স্যার, একটা আলসেসিয়ান কুকুর আছে।
কুকুরটা কার সুবিনয়বাবু?
মামার পোষা কুকুর।
মানে যিনি খুন হয়েছেন?
হ্যাঁ।
আশ্চর্য! এ বাড়িতে একটা কুকুর ছিল তাহলে? তা কোথায় কুকুরটা?
সুবিনয় বললে, তাই তো, কুকুরটা কোথায়?
সুবিনয় ও সুবীর তখন দুজনেই জ্যাকির নাম ধরে ডাকতে শুরু করে, জ্যাকি জ্যাকি!
কিন্তু জ্যাকি আসে না। জ্যাকির দেখা পাওয়া যায় না।
সুবীর বলে, আশ্চর্য, সত্যিই এতক্ষণ আমাদের একবারও জ্যাকির কথা মনে পড়েনি। জ্যাকি কোথায় গেল?
একটা বাঘের মত কুকুর।
জ্যাকির ডাক আবারও শোনা গেল।
ওরা সকলে সিঁড়ি থেকে নেমে এল। একতলাটা তন্নতন্ন করে খুঁজতে খুঁজতে বাড়ির পিছনে মালীর জন্য যে ঘর তৈরি করা হয়েছিল, অথচ কোন মালী না থাকায় এতদিন যে ঘরটা খালি পড়েছিল সেখানে সকলে এসে দাঁড়াল।
বাড়ির পিছনে যে জায়গাটা খালি পড়েছিল সেখানেই ছিল ঘরটা। ঘরটার মধ্যে বাড়ি তৈরির সব জিনিসপত্র, কোদাল, শাবল, চুপড়ি, বালতি, লোহার রড, বাঁশ, দড়ি তূপীকৃত করা ছিল এবং বাইরে থেকে তালা লাগানো ছিল। দেখা গেল সেই ঘরের তালা নেই, একটা দড়ির সাহায্যে কড়া দুটো দরজায় শক্ত করে বাঁধা আর সেই ঘরের ভিতর থেকে কুকুরের ডাক শোনা যাচ্ছে, দরজার গায়ে নখের আঁচড়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে।
ডাকটা এবারে বেশ স্পষ্ট।
অরূপ মুখাজী থমকে দাঁড়ালেন দরজার সামনে এসে।
কুকুরটা আপনাদের চেনে তো! সুবীর ও সুবিনয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ, স্যার। সুবীর বললে।
তাহলে আপনারাই কেউ দরজাটা খুলুন তো!
সুবীরই এগিয়ে গিয়ে দরজাটার দড়ি খুলে দিল। ঘরটা অন্ধকার, একটা বিশ্রী ভ্যাপসা গন্ধ দরজাটা খুলতেই ওদের নাকে এসে যেন ঝাপটা দেয়।
জ্যাকি ডাকতে ডাকতে ঘর থেকে বের হয়ে এল দরজাটা খুলে দিতেই। কিন্তু তার তেজ ও গতির ক্ষিপ্রতা যেন নেই আর।
কেমন যেন একটা মিয়ানো ভাব।
কুকুরটা কিন্তু ওদের দিকে তাকালও না, একবার অরূপ মুখার্জীর সামনে এসে ওর গন্ধ শুঁকে সোজা ভিতরের দিকে চলে গেল।
সকলে ওরা অনুসরণ করে জ্যাকিকে।
জ্যাকি আগে চলেছে, ওরা তিনজন পিছনে পিছনে।
জ্যাকি ভিতরে ঢুকে সোজা সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে যেতে থাকে। পিছনে পিছনে সিঁড়ি বেয়ে ওঠে ওরা তিনজন।
জ্যাকি এসে একেবারে খোলা দরজাপথে সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠে গগনবিহারীর শয়নঘরে প্রবেশ করল, ওরাও ঘরে গিয়ে ঢুকল।
জ্যাকি ঘরে ঢুকে সোজা গিয়ে ভূপতিত গগনবিহারীর মৃতদেহটার সামনে দাঁড়িয়ে আপাদমস্তক শুঁকলো দেহটা, তারপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল মৃতদেহের কাছেই একেবারে।
তারপরই হঠাৎ মুখ তুলে জ্যাকি কয়েকবার ডাকল। ডাকল ক্ষীণ, ক্লান্ত কিন্তু দীঘায়ত। মনে মনে যেন প্রভুর মৃত্যুতে কাঁদছে।
আশ্চর্য, জ্যাকির চোখে সত্যিই জল! সত্যিই জ্যাকি কাঁদছে।
তিনজনেই সেই করুণ দৃশ্য দেখে একেবারে নির্বাক। বোবা যেন!
০৪. যোগজীবন যখন ফোনটা পেলেন
যোগজীবন যখন ফোনটা পেলেন সে সময় তিনি একা ছিলেন না। ঘরের মধ্যে দুজন ছিলেন। তিনি আর কিরীটী।
যোগজীবনের খুব ভোরে ওঠা অভ্যাস বরাবরই, লেকের কাছাকাছি বাড়ি তৈরি করার পর থেকে প্রত্যহ খুব ভোরে রাত থাকতে উঠে বেড়াতে চলে যেতেন লেকে।
সারাটা লেক হেঁটে চক্কর দিতেন এবং সূর্যোদয়ের আগেই ফিরে আসতেন আবার। কি গ্রীষ্ম, কি শীত কখনও বড় একটা তাঁর ঐ রুটিনের ব্যতিক্রম হত না।
কিরীটীও তার নতুন বাড়ি গড়িয়াহাটায় চলে আসবার পর খুব ভোরে উঠে লেকে বেড়াতে যেতে শুরু করেছিল।
সেইখানেই অনেকের সঙ্গে আলাপ।
যোগেশবাবু, ধীরেনবাবু, মাস্টারমশাই প্রমোদবাবু, ফণীবাবু, দীনেশবাবু ও যোগজীবন— সবারই রিটায়ার্ড লাইফ।
অবসর জীবন যাপন করছেন। যোগজীবনের সঙ্গেই কিরীটীর একটু বেশি ঘনিষ্ঠতা জমে ওঠে। মধ্যে মধ্যে যোগজীবন আসতেন কিরীটীর গৃহে, কিরীটীও যেত যোগজীবনের গৃহে। কিরীটীর মাথায় আবার নানা ধরনের ফুলের গাছের শখ চেপেছিল, যোগজীবনেরও ফুলগাছের শখ। যোগজীবন প্রায়ই গাড়ি নিয়ে এদিক-ওদিক কলকাতার বাইরে সব নারীতে যেতেন ফুলগাছের সন্ধানে।
কিছুদিন আগে ক্রোটন ফুলের একটা চারা এনেছিলেন যোগজীবন। তাতে প্রথম ফুল ধরেছে কথাটা–লেকে বেড়াতে বেড়াতে শুনে কিরীটী যোগজীবনের সঙ্গে তাঁর গৃহে এসেছিল দেখতে টবে ফোঁটা ফুলটা।
ফুল দেখার পর কিরীটী বললে, এটা ক্রোটন নয় যোগজীবনবাবু।
নয়! কিন্তু নারীর লোকটা যে বললে!
হয় সে ক্রোটন চেনে না, না হয় আপনাকে ঠকিয়েছে।
যোগজীবন হা হা করে হেসে ওঠেন, যাক গে, না জেনে ঠকেছি দুঃখ নেই।
ভৃত্য এসে ঐ সময় বললে, চা দেওয়া হয়েছে।
যোগজীবনের লেক থেকে বেড়িয়ে সর্বাগ্রে এক কাপ চায়ের প্রয়োজন হয়। তিনি কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললেন, চলুন রায় সাহেব, চা খাওয়া যাক।
চলুন।
দুজনে বসে গল্প করতে করতে চা পান করছেন, ঐ সময় এল ফোন।
চাকর এসে ফোনের কথা বললে।
যোগজীবন শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকলেন।
ফোনে গগনবিহারীর মৃত্যুর সংবাদ পেয়ে তো একেবারে থ যোগজীবন! তাও স্বাভাবিক মৃত্যু নয়—খুন!
যোগজীবন মিনিট দশেক বাদে বসবার ঘরে ফিরে আসতেই কিরীটী যোগজীবনের মুখের দিকে তাকিয়ে যেন একটু বিস্মিতই হয়।
কি ব্যাপার যোগজীবনবাবু? ফোনে কোন দুঃসংবাদ ছিল নাকি? ইউ লুক ভেরী মাচ পেল পেল অ্যান্ড ডিসটার্বড়!
যোগজীবন চেয়ারটার ওপর বসতে বসতে বললেন, সত্যিই দুঃসংবাদ রায় সাহেব। আমার এক দীর্ঘদিনের বন্ধু, মাত্র কয়েক মাস আগে মিলিটারি থেকে রিটায়ার করে সাদার্ন অ্যাভিনুতে বাড়ি করে বসবাস করতে এসেছিল, সে—
কি হয়েছে তাঁর?
হি হ্যাজ বিন কিল্ড!
কিন্তু! মানে হত্যা করেছে তাঁকে? কিরীটী প্রশ্ন করে।
হ্যাঁ, স্ট্যাবড টু ডেথ!
কোথায়?
তার শোবার ঘরেই, আমাকে তার ভাইপো সুবীর এখুনি একবার যেতে বললে। আপনি বসুন, প্রস্তুত হয়ে আসি। ড্রাইভার তো এত তাড়াতাড়ি আসেনি, একটা ট্যাক্সি নিয়েই যাব ভাবছি।
যোগজীবন ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন।
কিরীটী তার পকেট থেকে চুরুট ও দেশলাই বার করে চুরুটে অগ্নিসংযোগ করল।
যোগজীবন মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই ফিরে এলেন, চলুন।
রাস্তায় বের হয়ে কিন্তু ট্যাক্সি পাওয়া গেল না। এমনিই হয়। দরকারের সময় হাতের কাছে কখনই একটা ট্যাক্সি পাওয়া যায় না।
চলুন না, কাছেই তো। হেঁটেই যাওয়া যাক, কিরীটী বললে।
চলুন।
দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে লাগলেন।
রাস্তায় তখনও একটা বড় লোক-চলাচল শুরু হয়নি। খুব বেশি হলে সাড়ে-ছটা হবে।
আপনার বন্ধুর বাড়িতে কে কে ছিল যোগজীবনবাবু?
ওর স্ত্রীর আগেই মৃত্যু হয়েছে। একমাত্র ছেলে বিলেতে সেটেল্ড করেছে—ইঞ্জিনিয়ার। বাড়িতে এক ভাগ্নে আর এক ভাইপো তাদেরই এনে রেখেছিল।
ভাড়া দেননি বুঝি?
না।
ফোন করেছিল একটু আগে আপনাকে আপনার বন্ধুর ভাইপোই না?
হ্যাঁ।
কি করেন ভদ্রলোক?
আমিই কিছুদিন আগে এক মারোয়াড়ী ফার্মে ভাল চাকরি করে দিয়েছি।
বয়স কত?
ত্রিশ-বত্রিশ হবে। বিবাহিত?
না। বিয়ে-থা করেনি সুবীর আজও।
আর ভাগ্নে?
সুবিনয় সুবীর থেকে বছর দুই-তিনের বোধহয় ছোট। কোন একটা নামকরা ঔষধের প্রতিষ্ঠানে মেডিকেল রিপ্রেজেন্টেটিভ, শুনেছি ভালই মাইনে পায়।
বাড়িতে চাকর-বাকর আছে কজন?
গগনের সঙ্গেই এসেছিল তার নেপালী ড্রাইভার বাহাদুর—ভৃত্য রামদেও। রামদেও লোকটা মিলিটারিতে চাকরি করত, খুব বিশ্বাসী এবং গগনের খুব প্রিয়। কেয়ারটেকার ও দারোয়ান জানাল সিং আর এদেশীয় ভৃত্য রতন ও কুক প্রিয়লাল। হ্যাঁ, আর একটি জীব আছে।
জীব?
একটি অ্যালসেসিয়ান কুকুর-জ্যাকি।
কুকুরটা কার?
গগনেরই। গগনের সঙ্গেই এসেছে। বাঘের মতন কুকুর।
আশ্চর্য!
কি বললেন?
বলছি অমন একটা কুকুর বাড়িতে, তবু ঐ রকম দুর্ঘটনা ঘটল!
আমিও তো তাই ভাবছি রায় সাহেব।
মানুষটি এমনিতে কেমন ছিলেন—মানে বলছি কোন রকমের ভাইস ছিল কি?
না। সে রকম কিছু আমি অন্ততঃ জানি না। অবিশ্যি এমনিতে একটু সেলফসেন্টার্ড, লোকজনের সঙ্গে বড় একটা মেশে না। তবে ইদানীং শুনতাম শমিতাদের ক্লাবে প্রত্যহ প্রায় যেত।
শমিতা কে?
আমার বোন।
বয়স কত?
বেশী নয়, বছর ছাব্বিশ-সাতাশ হবে। ভবতারিণী কলেজে ইংলিশের প্রফেসার।
ক্লাবটার নাম কি?
মরালী সঙ্ঘ।
মরালী সঙ্ঘের নাম শুনে কিরীটী যোগজীবনের দিকে তাকাল, কারণ ক্লাবটার নাম সেও শুনেছিল। বালীগঞ্জ অঞ্চলেই ক্লাবটা। শহরের একদল ধনী প্রৌঢ় ও তথাকথিত অভিজাত পরিবারের যুবক-যুবতী মিলে ক্লাবটা গড়ে তুলেছে। ব্যারিস্টার, অধ্যাপক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার সবাই। ক্লাবে কিরীটী শুনেছিল নানা ধরনের খেলাধূলার সঙ্গে সঙ্গে ঢালোয়া মদ্যপানও চলে। মধ্যে মধ্যে আবার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও করে।
সাধারণ স্তরের লোকেরা সেখানে প্রবেশ অধিকার পায় না।
আপনার বোন বুঝি ঐ ক্লাবের মেম্বার?
মেম্বার মানে একজন প্রধান পাণ্ডা। লেখাপড়া আর ক্লাব নিয়ে তো আছে হৈ-চৈ করে! আমিও আপত্তি করিনি। থাক।
বিয়ে-থা হয়নি?
হয়েছিল, কিন্তু বছর দুই হল ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে।
আর বিয়ে-থা করলেন না?
না। ভালবেসে বিয়ে করেছিল কিন্তু তাও টিকল না দুবছরের বেশী।
কিরীটী কোন কথা আর বলে না। ইতিমধ্যে ওরা গগনবিহারীর বাড়ির গেটের সামনে পৌঁছে গিয়েছিল।
যোগজীবন বলেন, এই বাড়ি।
কিরীটী লক্ষ্য করল দুজন লাল পাগড়ি গেটের সামনে দাঁড়িয়ে। তারা ওদের প্রবেশে বাধা দিল না।
বাড়িতে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই একটা করুণ দীঘায়ত কুকুরের ডাক ওদের কানে এল। কিরীটী বললে, কুকুরটা কাঁদছে।
যোগজীবন কিছু বললেন না।
দুজনে এগিয়ে গিয়ে গাড়িবারান্দায় উঠল।
ভৃত্য রতন ও বাহাদুর সেখানে দাঁড়িয়ে ছিল। যোগজীবনকে দেখে বাহাদুর সেলাম দিল, বাবুজী!
বাহাদুর?
সাব চলা গিয়া বাবুজী! বাহাদুরের গলায় কান্নার আভাস। চোখে জল।
কেইসে হুঁয়া কুছ পাতা মিলা বাহাদুর?
নেহি বাবুজী, আভিতক সমঝ মে নেহি আতা হ্যায় এইসা কেইসে হো সেকতা!
তুমি তো কাল রাত্রে বাড়িতে ছিলে?
জী।
রামদেও-ও কিছু জানে না? সেও কিছু বলতে পারছে না? যোগজীবন আবার প্রশ্ন করলেন।
রামদেকো পাতাই নেহি মিলতা বাবুজী সুবেসে!
কেন, সে কোথায় গিয়েছে?
কা জানে কিধার গিয়া, আভিতক নেহি লৌটা।
ওর বৌজেনানা কোথায়?
উপরমে হ্যায়।
ওর বৌ তো পাশের ঘরেই থাকত, সেও কিছু বলতে পারছে না?
নেহি বাবুর্জী, বেচারী রোতা হ্যায় শুনকর।
কিরীটী ঐ সময় প্রশ্ন করে, রামদেওর বৌ এখানে থাকত নাকি?
হ্যাঁ। বেটার তৃতীয় পক্ষের বৌ, কিছুদিন হল এসেছে এখানে।
বয়স তো তাহলে খুব অল্প?
হ্যাঁ, মোল-সতের হবে।
দেখতে কেমন?
দেখতে মোটামুটি ভালই।
চলুন উপরে যাওয়া যাক, কিরীটী বললে।
সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠে বারান্দায় পৌঁছতেই সুবীরের সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।
এই যে স্যার, আপনি এসে গিয়েছেন, যান ভিতরে গিয়ে দেখুন, কাকা কথাটা শেষ করতে পারে না সুবীর, কান্নায় যেন তার গলাটা বুজে আসে।
কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে সুবীরকে দেখছিল।
বেশ সুন্দরই চেহারা, তবে রোগা। গায়ের রং সুবীর বংশের ধারা অনুযায়ীই পেয়েছিল। রীতিমত ফসা। মাথাভর্তি চুল ব্যাকব্রাস করা, তারই মধ্যে দু-একটা রূপালী চুল চোখে পড়ে। চোখ দুটি বড় বড়, টানা টানা। উন্নত নাসা। ধারালো চিবুক। চোখে সৌখীন ফ্রেমের চশমা।
পরনে পায়জামা ও পাঞ্জাবি। ইতিমধ্যে সুবীর বাইরের বেশ বদলে ফেলেছিল।
কিরীটীই প্রশ্ন করে, বাইরে পুলিস দেখলাম, থানার ওসি এসেছে বোধহয়?
হ্যাঁ, মিঃ মুখার্জী।
অরূপ, না?
কিরীটীর কথা শেষ হল না, সুবিনয় বাইরে এল ঐ সময় ঘর থেকে।
রায় সাহেব—এই সুবিনয়, গগনের ভাগ্নে।
কিরীটী তার অনুসন্ধানী তীক্ষ্ণ দৃষ্টি একবার বুলিয়ে নেয় সুবিনয়ের সর্বাঙ্গে।
বেশ হৃষ্টপুষ্ট চেহারা। গায়ের রংটা একটু চাপা। মাথার চুল রুক্ষ, বিস্রস্ত। চোখেমুখে একটা দুশ্চিন্তা ও বিষণ্ণতার ছাপ পড়েছে যেন। পরনে একটা লুঙ্গি, গায়ে গেঞ্জি। চোখের দৃষ্টি তীক্ষ্ণ ও বুদ্ধিদীপ্ত।
আপনি এসেছেন! যোগজীবনের দিকে তাকিয়ে বলে সুবিনয়, যান ভিতরে যান, থানা-অফিসার ভেতরেই আছেন। কথাটা বলে সুবিনয় সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে কিরীটীর দিকে তাকায়।
কিরীটী যোগজীবনকে বললে, চলুন সান্যাল মশাই, ভেতরে যাওয়া যাক।
হ্যাঁ, চলুন।
দুজনে এগিয়ে গেল।
০৫. মৃতদেহ পরীক্ষান্তে অরূপ মুখার্জী
মৃতদেহ পরীক্ষান্তে অরূপ মুখার্জী তখন ঘরের চারদিকে সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে পরীক্ষা করছিল। যোগজীবন আগে ও পরে কিরীটী ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল।
পদশব্দে চোখ তুলে তাকাতেই অরূপের সঙ্গে কিরীটীর চোখাচোখি হল, অরূপের চোখের তারা দুটো যেন আনন্দে চকচক করে ওঠে।
মিঃ রায়, আপনি!
নতুন থানায় বদলি হয়ে এসে অরূপ কিরীটী তার এলাকাতেই আছে জানতে পেরে নিজেই একদিন গিয়ে স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আলাপ করে এসেছিল।
কাজেই পরস্পর পরস্পরের কাছে তারা অপরিচিত নয়।
কিরীটী যোগজীবনকে দেখিয়ে বললে, হ্যাঁ অরূপ, উনি আসবার সময় আমায় ধরে নিয়ে এলেন, ফোনটা যখন যায় আমি ওঁর ওখানে বসে চা খাচ্ছিলাম।
খুব ভাল হয়েছে আপনি এসেছেন। কিন্তু উনিওঁর পরিচয়? অরূপ যোগজীবনকে দেখিয়ে প্রশ্ন করল।
যোগজীবন সান্যাল, রিটায়ার্ড লাইফ লিড করছেন। কাছাকাছিই বাড়ি। গগনবিহারীর দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
আই সি! আপনাকে বুঝি ফোনে সংবাদ দিয়েছিল কেউ? যোগজীবনকে প্রশ্ন করে অরূপ।
হ্যাঁ। ফোন পেয়েই তো আসছি।
কে ফোন করেছিল?
সুবীর, গগনের ভাইপো।
কিরীটী ইতিমধ্যে ভূপতিত মৃতদেহটার সামনে এগিয়ে গিয়েছিল।
মৃতদেহের সামনে তখন জ্যাকি বসে আছে।
সে তাকালও না। পৃষ্ঠদেশে ছোরাটা আমূল বিদ্ধ হয়ে আছে। খানিকটা বাঁদিক ঘেঁষে ছোরাটা বিদ্ধ করা হয়েছে। বোঝা যায় ঐ ছুরিকাঘাতেই সম্ভবতঃ মৃত্যু হয়েছে গগনবিহারীর।
একটু দুরে দামী খাট, উপরে আধুনিক ডিজাইনের শয্যা, শয্যার চাদর এলোমেলো, বালিশ দুটোও যথাস্থানে নেই। খাটের নীচে খানিকটা জায়গা জুড়ে মেঝেতে দামী একটা কার্পেট বিছানো, বাকি মেঝেটায় কোন কার্পেট নেই।
সাদা কালো ডিজাইনের মোজাইক টাইলসয়ের মেঝে ঘরে। ঝকঝকে পরিষ্কার মেঝে। খাটের হাত পাঁচেক দূরে মৃতদেহটা উত্তর-দক্ষিণ ভাবে কোণাকুণি পড়ে আছে।
বড় সাইজের মিরার বসানো একটা গড়রেজের স্টীলের আলমারির গা ঘেঁষে।
কিরীটী নীচু হয়ে বসল মৃতদেহের সামনে। চোখেমুখে মৃতদেহের যেন একটা সুস্পষ্ট যন্ত্রণার চিহ্ন অঙ্কিত হয়ে আছে।
বুকের ছোরাবিদ্ধ রক্তাক্ত ক্ষতস্থান ছাড়া মৃতের ডানদিককার গালে একটা সরু লম্বা ক্ষতচিহ্ন চোখে পড়ল, ডান হাতটা মৃতের মুঠো করা।
হাতের পাতায় খানিকটা রক্ত জমে আছে কালো হয়ে।
কিরীটী মৃতদেহের বদ্ধ মুঠি খোলবার চেষ্টা করল কিন্তু পারল না। কি যেন একটা চকচক করছে মুঠির মধ্যে, ওর নজরে পড়ে। রাইগার মর্টিস সেট ইন করেছিল মৃতদেহে।
চকচকে বস্তুটি কোনমতে বদ্ধ মুঠি থেকে বের করতে গিয়ে ভেঙে গেল। কিরীটী সেই ভাঙা বস্তুটি নিয়ে উঠে দাঁড়াল। একবার দেখল ভাল করে জিনিসটা কি? ঠিক বুঝতে পারল না।
অরূপ পাশেই দাঁড়িয়ে লক্ষ্য করছিল, জিজ্ঞাসা করল, কি ওটা মিঃ রায়?
মনে হচ্ছে একটা ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরো।
ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরো!
তাই তো মনে হচ্ছে।
কিরীটী রেখে দিল পকেটের মধ্যে ভাঙা চুড়ির টুকরোটা।
হাতের মুঠোর মধ্যে কোথা থেকে এল ওটা?
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, হয়তো কোন পলাতকা প্রেয়সীর চিহ্ন রয়ে গিয়েছিল ভদ্রলোকের হাতের মুঠোর মধ্যে।
কি বলতে চান মিঃ রায়?
কিরীটী কিন্তু অরূপ মুখার্জীর সে প্রশ্নের কোন জবাব দিল না। সে তখন ঘরের চারদিক তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে দেখছে।
ঘরটা বেশ বড় সাইজের। দক্ষিণ ও উত্তরমুখী দুটো দুটো করে বড় সাইজের ডবল পাল্লার জানালা, জানালার গ্রিলস বসানো। ঘরের সংলগ্ন বাথরুম। ঘরে দুটো দরজা, একটা পাশের ঘরে যাবার তার মধ্যে।
কিরীটী বাথরুমের মধ্যে গিয়ে ঢুকল ঘর থেকে। ইটালিয়ান টাইলস দিয়ে বাথরুমের দেওয়ালের অধের্কটা মোড়া, মেঝে মোজাইকের। মস্ত বড় একটা বাথটব। আয়না বসানো দেওয়ালে। আয়নার নীচে কাচের সেল। সেলফের উপরে সেভিং সেটস্ সেভিং ক্রিম, ব্রাস, টুথপেস্ট, টুথব্রাস, টাংগ ক্লিনার, চিরুনি ও ব্রাস, সেভিং লোসন, ল্যাভেণ্ডার স্প্রে, নেইল কাটার সযত্নে সাজানো।
সবই পরীক্ষা করে দেখল কিরীটী-দামী ও বিলিতি। ব্লু রংয়ের একটা বেসিন। টাওয়েল র্যাকে ব্লু রংয়ের একটা টার্কিশ টাওয়েল এলোমেলো ভাবে ঝোলানো। টাওয়েলটা তুলে নেড়েচেড়ে পরীক্ষা করতে গিয়ে নজরে পড়ল কিরীটীর, ফিকে লালচে অনেকটা ব্রাউন রংয়ের ছোপ ছোপ দাগ টাওয়েলের মধ্যে।
কিরীটী ঝুঁকে পড়ে বেসিনটা দেখতে লাগল। বেসিনের কলটা ভাল করে বোধ হয় টাইট করা নেই, ক্ষীণধারায় জল পড়ে যাচ্ছিল তখনও।
বেসিনের সাইডে সাবান রাখবার জায়গায় সাবানটাও ঠিকভাবে রাখা নেই মনে হয় যেন। সাবানটা তুলে নিয়ে ঝুঁকে দেখল কিরীটী, দামী গন্ধওয়ালা সাবান। সাবানটাও বিলিতি মনে হয়।
বাথরুমের ফ্লোরে এখানে ওখানে জল তখনও জমে আছে। ব্র্যাকেটে একটা ড্রেসিংগাউন ঝুলছে।
পুনরায় কাচের সেলফটা ভাল করে পরীক্ষা করে দেখতে গিয়ে হঠাৎ কিরীটীর নজরে পড়ল মাথার চিরুনির গায়ে কয়েকটা বড় বড় চুল আটকে আছে।
চিরুণি থেকে চুলগুলো ছাড়িয়ে একটা কাগজে মুড়ে কিরীটী পকেটে রেখে দিয়ে বাথরুম থেকে বের হতে গিয়ে থমকে দাঁড়াল।
বাথরুমে মেথরদের যাতায়াতের যে দরজাটা তার পাল্লা দুটো ভেজানো থাকলেও ভিতর থেকে খিল দেওয়া নেই। খোলা।
কিরীটী দরজার পাল্লা দুটো টেনে খুলতেই নজরে পড়ল ঘোরানো লোহার সিঁড়িটা। ঐ সিঁড়িই মেথরদের বাথরুমে আসা-যাওয়ার জন্য ব্যবহৃত হয়।
বাথরুমের দরজাপথেই কিরীটীর নজরে পড়ে বাড়ির পিছনদিকে বেশ খানিকটা খোলা জায়গা, ঘাস ও আগাছায় ভর্তি। দুরে প্রাচীর ঘেঁষে একেবারে ছোট একটা ঘর।
চারিদিকে দেখে কিরীটী দরজাটা টেনে দিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে এল আবার। ঘরের চারিদিক নজর করে আবার দেখে, একটা দামী সিঙ্গল খাট, একটা গোদরেজের আলমারি, ওয়ারড্রোব, তার উপরে একটা বুদ্ধমূর্তি ও একটা কাঠের হাতী।
অরূপ!
কিছু বলছিলেন? কিরীটীর ডাকে ওর দিকে তাকাল অরূপ কথাটা বলে।
তোমার সব জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হয়েছে?
না।
তাহলে শুরু করে দাও!
আপনি এখন চলে যাবেন?
না। তোমার জিজ্ঞাসাবাদ শেষ হোক, তারপর যাব।
তাহলে চলুন পাশের ঘরে যাওয়া যাক।
ডেড বডি সরাবার ব্যবস্থা করেছ?
করেছি, ফোন করে দিয়েছি।
পাশের ঘরে এসে সকলে বসল। ওটাই বসবার ঘর। চমৎকার ভাবে সাজানো। একপাশে ফোনও আছে।
যোগজীবনবাবু কাঁদছিলেন। চোখ দুটো তাঁর লাল হয়ে উঠেছিল। কিরীটী যে সোফাটায় বসে, যোগজীবনবাবু সে সোফাতেই কিরীটীর পাশ ঘেঁষে বসলেন।
রায় সাহেব! যোগজীবনবাবু রুদ্ধ গলায় ডাকলেন।
বলুন?
এ কি হল বলুন তো! গগনকে এমন নিষ্ঠুরভাবে কে হত্যা করল? যোগজীবন যেন কান্না রোধ করতে পারছিলেন না।
আমি বুঝতে পারছি সান্যাল মশাই, বন্ধুর মৃত্যুতে খুব শ হয়েছেন, তবে—
কি তবে?
ওঁর মৃত্যুর–মানে অপঘাত মৃত্যুর জন্য আমার মনে হচ্ছে যেন উনিই দায়ী?
গগন নিজে দায়ী?
তাই তো আপাততঃ মনে হচ্ছে আমার।
কেন?
কিরীটীর জবাবটা আর দেওয়া হল না, সুবিনয় এসে ঘরে ঢুকল।
অরূপ সুবিনয়ের দিকে তাকিয়ে বললে, বসুন সুবিনয়বাবু।
সুবিনয় বসল।
আপনিই তো প্রথম দেখেন মৃতদেহ, তাই না?
না মিঃ মুখার্জী, আমি না, বাহাদুর। সে-ই প্রথমে দেখে, দেখে আমাকে ডেকে আনে।
হুঁ। কাল রাত্রে আপনি তো বাড়িতেই ছিলেন?
হ্যাঁ। কাল শনিবার ছিল, বেলা চারটে নাগাদ অফিস থেকে ফিরে আসি, তারপর আর বের হইনি। নীচে নিজের ঘরেই ছিলাম।
কখন শুতে যান?
আমার বরাবর একটু তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়াই অভ্যাস রাত্রে। দশটা নাগাদ শুয়ে পড়েছিলাম।
আর সুবীরবাবু?
সে বিকেলেই সেজেগুঁজে বের হয়ে গিয়েছিল, আজ সকালে ফিরেছে। রাত্রে বাড়িতে ছিল না।
আর আপনার মামা গগনবাবু? তিনি কাল বের হননি কোথাও?
মামাও কাল বের হননি।
কেউ তাঁর কাছে এসেছিল?
হ্যাঁ। রাত তখন বোধ করি সাড়ে নটা কি পৌনে দশটা হবে–ঠিক সময়টা মনে নেই, আমার খাওয়া হয়ে যাবার পরই শমিতা দেবী এসেছিলেন।
কথাটা সুবিনয় শেষ করল একবার আড়চোখে কিরীটীর পার্শ্বে উপবিষ্ট যোগজীবনের দিকে তাকিয়ে।
অত রাত্রে শমিতা দেবী এসেছিলেন।
হ্যাঁ, প্রায়ই তো আসতেন। তবে ইদানীং হপ্তাখানেক আসছিলেন না, মামাও বের হতেন সন্ধ্যায় বাড়ি থেকে দেখছিলাম।
শমিতা দেবী কে? অরূপ প্রশ্ন করল।
যোগজীবনবাবুর বোন!
অরূপ যোগজীবনবাবুর মুখের দিকে তাকাল।
যোগজীবনবাবু বললেন, হ্যাঁ, আমার বোন। গগন ওকে ছোটবেলা থেকেই চিনত। তাছাড়া শমিতাদের মরালী সঙেঘর পেট্রোন ছিল গগন।
গগনবাবুর সঙ্গে আপনার অনেক দিনের পরিচয় বলুন তাহলে?
হ্যাঁ, দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব আমাদের পরস্পরের।
আচ্ছা, শমিতা দেবী বিবাহিত, না অবিবাহিত?
জবাবটা দিল সুবিনয়ই, বিবাহ করেছিলেন তবে বছর দুই আগে ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। মামাবাবুর সঙ্গে বেশ ভাল পরিচয়ই ছিল শমিতা দেবীর।
তা কখন শমিতা দেবী চলে যান আবার রাত্রে?
বলতে পারি না। আমি ঘুমোবার পর হয়তো চলে গিয়েছিলেন। বাহাদুর বলছিল—
কি বলছিল?
রাত এগারোটা নাগাদ নাকি কাল গিয়েছিলেন শমিতা দেবী।
আপনি জানতে পারেননি কখন গিয়েছেন?
না।
আপনি তাহলে জানতেই পারেননি কখন শমিতা দেবী চলে গেলেন? কিরীটীই প্রশ্নটা করে আবার।
না।
আচ্ছা সুবিনয়বাবু–
বলুন।
আপনার মামার একমাত্র ছেলে তো বিলেতেই সেটে। শুনেছিলাম আর ফিরবে না?
সেই রকমই শুনেছি।
আপনার মামাকে তাঁর সম্পর্কে কখনও কিছু বলতে শুনেছেন?
না।
তিনি চিঠিপত্র লিখতেন না তাঁর বাবাকে?
না, শুনিনি কখনও।
তাহলে তো দেখা যাচ্ছে গগনবাবুর যা কিছু আছে, এই বাড়ি ও অন্যান্য সম্পত্তি টাকাকড়ি সব কিছুর ওয়ারিশন আপনি ও সুবীরবাবুই?
তা আমি কি করে বলব, কাকে তিনি সব কিছু দেবেন বা না দেবেন!
উইল-টুইল কিছু করেছিলেন?
মাসখানেক আগে শুনেছি উইল করেছিলেন মামাবাবু।
কার কাছে শুনলেন?
সুবীরদার মুখে।
তিনি কেমন করে জানলেন কথাটা?
জানি না।
জিজ্ঞাসা করেননি?
না।
অরূপ, সুবিনয়বাবুকে আর কিছু জিজ্ঞাসা করবে?
আপাত না। আপনি সুবিনয়বাবু এখন যেতে পারেন। সুবীরবাবুকে পাঠিয়ে দিন এ ঘরে। সুবিনয় চলে গেল, আর একটু পরেই সুবীর এসে ঘরে ঢুকল।
অরূপই প্রশ্ন শুরু করে, সুবীরবাবু, কাল রাত্রে শুনলাম আপনি এ বাড়িতে ছিলেন না!
না।
কোথায় গিয়েছিলেন?
এক বন্ধুর বোনের বিয়েতে বেলগাছিয়ায় গিয়েছিলাম। রাত্রে ফিরতে পারিনি। সকালে ফিরেই তো ব্যাপারটা জানতে পারলাম।
কিরীটী ঐ সময় বলে ওঠে, সঙ্গে সঙ্গে বোধ হয় থানায় ফোন করেন!
ঠিক তখুনি ফোন করিনি, কিছুক্ষণ বাদে করি।
আচ্ছা সুবীরবাবু, শমিতা দেবীকে আপনি চিনতেন?
চিনতাম বৈকি। তিনি তো এখানে কাকার কাছে প্রায়ই সন্ধ্যায় আসতেন!
দিনের বেলায় আসতেন না?
হ্যাঁ, আসতেন।
আপনার কখনও কোন কৌতূহল হয়নি, কেন ঘন ঘন শমিতা দেবী আপনার কাকার কাছে আসতেন!
শুনেছিলাম ওঁদের ক্লাবের উনি পেট্রোন একজন। তা ছাড়া ওঁদের দীর্ঘদিনের পরিচয়।
দুজনের মধ্যে খুব ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাই না?
সুবীর ইতস্ততঃ করে। কিরীটীর পার্শ্বে উপবিষ্ট যোগজীবনের দিকে তাকায়।
বলুন না। ওঁকে দেখে কোন সংকোচের আপনার কারণ নেই। যা বলতে চান বলুন!
আপনি যখন বললেন বলতে বলছি, ওর বন্ধু–আমার পূজনীয় কাকা, তা হলেও বলব তাঁর অল্প বয়সের স্ত্রীলোকদের ওপরে কেমন একটা দুর্বলতা ছিল, প্রশ্রয় ছিল।
আপনার চোখে কখনও কিছু পড়েছে?
না।
তবে? একথা আপনার মনে হয়েছিল কেন?
চোখে না পড়লেই কি সব কথা সব সময় অস্বীকার করতে পারি আমরা! সুবীর বললে।
তা অবিশ্যি ঠিক। তবু বুঝতেই পারছেন আমি আর একটু স্পষ্ট করে শুনতে চাই কথাটা আপনার মুখ থেকে!
সুবীর এবারে একধারে একটা বুক–কেসের উপরে সাজানো ম্যাগাজিনগুলো দেখিয়ে বলে, ঐ ম্যাগাজিনগুলো একবার উল্টেপাল্টে দেখুন, তাহলেই বুঝতে পারবেন। সব নৃড় পিকচার্সে ভর্তি–সর্বক্ষণই ঐসব নিয়ে মশগুল থাকতেন কাকা!
কিরীটী উঠে গিয়ে সযত্নে রক্ষিত ম্যাগাজিনের থাক থেকে একটা ম্যাগাজিন নিয়ে উল্টেপাল্টে দেখে সেটা পুনরায় যথাস্থানে রেখে দিয়ে সোফায় এসে বসল।
দেখলেন!
হ্যাঁ। সব ম্যাগাজিনগুলোই অমনি জানলেন কি করে আপনি? আপনিও নিশ্চয়ই মনে হচ্ছে আপনার কাকার অ্যাবসেন্সে ম্যাগাজিনগুলো উল্টেপাল্টে দেখেছেন! তাই কি?
না। ওসব নোংরা জিনিস আমি হাতে ধরি না।
০৬. কিরীটী সুবীরের কথায় মৃদু হাসল
কিরীটী সুবীরের কথায় মৃদু হাসল।
আচ্ছা সুবীরবাবু, ঐ শমিতা দেবী ও তাঁর ক্লাবের ব্যাপার এবং ঐ ম্যাগাজিনগুলো ছাড়া আর কখনও কিছু আপনার কাকার ব্যাপারে চোখে পড়েছে?
কেন, ঐ যে রামদেওর যুবতী তৃতীয় পক্ষের বৌটা! সে তো সব সময়ই এ ঘরে থাকত শুনেছি!
কিরীটী আবার মৃদু হাসল।
এসব কারণে আপনি মনে হচ্ছে আদৌ আপনার কাকার উপরে সন্তুষ্ট ছিলেন না!
সুবীর কিরীটীর কথার কোন জবাব দেয় না।
ভাল কথা, সুবিনয়বাবু বলছিলেন, আপনি নাকি তাঁকে বলেছিলেন আপনার কাকা উইল করেছেন?
শুনেছি।
আপনিও শুনেছেন?
হ্যাঁ, শোনা কথা আমারও।
কার কাছে শুনলেন?
রামদেওই বলেছিল।
রামদেও মানে সেই চাকরটা?
হ্যাঁ।
তার সঙ্গে আপনার খুব কথাবার্তা হত, তাই না সুবীরবাবু?
মানে?
তার মুখ থেকেই সব খবরাখবর উপরের তলার নিতেন আপনি?
ও ধরণের প্রবৃত্তি আমার নেই।
কিরীটী আবার মৃদু হাসল। তারপর বললে, ঠিক আছে। আপনার উপরে কাকার মনোভাবটা কেমন ছিল?
কেন, ভালই! হি লাইক মি ভেরি মাচ!
সুবীরবাবু, এবার আর একটা প্রশ্নের আমার জবাব দিন।
বলুন?
আপনার কাকার হত্যার ব্যাপারে কাউকে আপনার সন্দেহ হয়?
কাকে সন্দেহ করব!
কেন, রামদেওকে?
রামদেও!
হ্যাঁ, আপনিই তো একটু আগে বলছিলেন তার যুবতী স্ত্রীর প্রতি আপনার কাকার দুর্বলতা ছিল, রামদেও হয়ত সে কথা জানতে পেরে আক্রোশের বশে আপনার কাকাকে ছোরা মেরে পালিয়েছে!
বিচিত্র নয় কিছু।
বলছেন?
আপনিই তো তাই বলছেন!
আমি আপনার ওপিনিয়নটা নিচ্ছিলাম!
সুবীর যেন কেমন একটু বিব্রত বোধ করে।
অরূপ, তুমি আর ওঁকে কিছু জিজ্ঞাসা করতে চাও নাকি? কিরীটী বলে।
না, আপনি যেতে পারেন। বাহাদুরকে পাঠিয়ে দিন।
বাহাদুর ঘরে এসে ঢুকল। কেঁদে কেঁদে বাহাদুরেরও চোখ দুটো ফুলে গিয়েছে।
বাহাদুর, কতদিন তুমি সাহেবের কাছে আছ? অরূপ প্রশ্ন করে।
কমসে কম দশ সাল।
কাফি বরষ।
জী সাব।
তোম বাংলা বাত সমঝতে?
জী। ঘোড়ী ঘোড়ী বলনে ভি সেকতা।
তোমার বাবুর কাছে এ বাড়িতে আসার পর কে কে আসত বলতে পার? অরূপই প্রশ্ন করে।
ঐ বাবুজী আসতেন, আর—
আর?
দিদিমণি আসতেন, ঐ বাবুর বহিন।
প্রায়ই আসতেন?
হ্যাঁ।
কতক্ষণ থাকতেন?
তা দেড় ঘণ্টা দু’ঘণ্টা। কখনও তিন ঘণ্টাও থাকতেন।
কখন আসতেন?
রাতের বেলাতেই বেশী।
কালও এসেছিলেন?
হ্যাঁ।
কখন?
রাত তখন সোয়া নটা হবে।
তুমি জানলে কি করে?
আমি রামদেওর মুখে শুনি। সে নীচে এসে আমায় বলে, আবার আজ সেই দিদিমণি এসেছে সাত রোজ বাদে!
সাত রোজ! তার আগে বুঝি আসেননি দিদিমণি?
না।
কি করে জানলে?
রামদেওই বলেছিল, দিদিমণির সঙ্গে নাকি কি কথা–কাটাকাটি হয়েছিল খুব সাহেবের। তারপর সাত বোজ দিদিমণিও আসেননি, সাহেবও ক্লাবে যাননি।
হঠাৎ কিরীটী ঐ সময় যোগজীবনের দিকে ফিরে বললে, সান্যাল মশাই, আপনি কিছু জানেন?
যোগজীবন মাথাটা নীচু করলেন।
অবিশ্যি আপনার বলতে আপত্তি থাকলে
না, রায় সাহেব। একটু আগেও সুবীর যা বলছিল গগন সম্পর্কে আমিও ঐ ধরনেরই একটা রিপোর্ট পেয়েছিলাম।
কার কাছে?
শমিতাই বলছিল।
কি বলেছিলেন তিনি?
বিশেষ কিছু বলেনি, কেবল বলেছিল, তোমার বন্ধুটি যে দাদা এমন একটা ব্রুট, ফিদি ক্যারাকটারের জানতাম না আমি!
আপনি কি বললেন?
ইট ওয়াজ র্যাদার শকিং টু মি! বুঝতেই পারছেন রায় সাহেব, তবু আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ব্যাপার কি? কিন্তু শমি কিছু ভেঙে স্পষ্ট করে বলেনি আর।
আপনি বন্ধুকে জিজ্ঞাসা করেননি কিছু?
না।
কেন?
আপনিই বলুন কেমন করে জিজ্ঞাসা করি!
আপনি আপনার বোনকে কিছু বলেননি ঐ কথাটা শোনার পর?
হ্যাঁ, বলেছিলাম একটা কথা!
কি?
গগনের বাসায় আর না যাওয়ার জন্য। তবে ঐ ঘটনার কিছুদিন আগে কথায় কথায় ও একদিন আমাকে বলেছিল, শীঘ্রই হয়ত ও আবার বিয়ে করতে পারে!
তাই নাকি? কাকে?
বলেছিল সময় হলেই জানাবে, তাই আমি জিজ্ঞাসা করিনি কিছু আর।
তারপর বিয়ের কথায় কিছু বলেননি আপনি?
হ্যাঁ, বলেছিলাম।
কি বলেছিলেন?
বলেছিলাম, ইফ ইউ রিয়েলি হ্যাঁভ সেটলড–ব্যাপারটা শেষ করে ফেল!
কি জবাব দিলেন তিনি?
কোন জবাব দেয়নি।
তাহলে শমিতা দেবী গগনবাবুর ওপরে ঐ ধরনের remark pass করার ব্যাপারটা আর বেশী কিছু খুলে বলেননি আপনাকে স্পষ্ট করে?
না।
কিরীটী এবার বাহাদুরের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, বাহাদুর, রামদেওর জেনানা সব সময় তোমার সাহেবের ঘরে থাকত শুনলাম, জান কিছু তুমি?
আমিও দেখেছি বাবুজী।
আর কিছু দেখনি?
হাসিমস্করা হত, কিন্তু ব্যাপারটা আমার একটুও ভাল লাগত না বাবুজী!
কেন?
রামদেও ভীষণ রাগী লোক। সেরকম কিছু হলে ও সাহেবকে হয়ত খুনই করে দেবে!
আচ্ছা বাহাদুর–
জী!
তোমার সাহেবকে কে খুন করতে পারে বলে তোমার মনে হয়?
কেমন করে জানব বাবুজী! একমাত্র পশুপতিনাথই জানেন।
কিরীটী এবারে অন্য প্রসঙ্গে চলে গেল।
জ্যাকিকে কে খাবার দিত বাহাদুর? কিরীটী জিজ্ঞাসা করে।
জ্যাকি সাহেব ও রামদেওর হাতে ছাড়া কারও হাতে খেত না। সাহেবকে ও বড় ভালবাসত বাবুজী, খুব চোট লেগেছে ওর দিলে।
রামদেও কতদিন ছিল তোমার সাহেবের কাছে?
কমসে কম চোদ্দ সাল। মিলিটারিতে বরাবর সাহেবের ব্যাটম্যান ছিল শুনেছি। তারপর সাহেব যখন ছুটি নিয়ে আসেন, ওকেও ছুটি করিয়ে নিয়ে আসেন।
ঠাকুর প্রিয়লাল আর ভৃত্য রতন ওপরে আসত না?
না বাবুজী, ওদের ওপরে আসবার কোন হুকুম ছিল না।
দাদাবাবুরা?
দাদাবাবুরা আসত না ওপরে বড় একটা সাহেব না ডাকলে।
সাহেব ডাকতেন না?
এক-আধদিন হয়ত ডাকতেন।
তোমার সাহেব খুব মদ খেতেন?
হ্যাঁ। এক বোতল সাধারণতঃ দেড়দিন কি বড়জোর দু’দিনের বেশী কখনও যেত না।
যে দিদিমণি আসতেন, তিনি?
রামদেওর মুখে শুনেছি তিনিও নাকি খুব খেতেন সরাব।
আর রামদেওর স্ত্রী?
কে, রুক্মিণী?
হ্যাঁ!
হ্যাঁ বাবুজী, ওরা স্বামী-স্ত্রী দুজনেই খেত।
সুবিনয়বাবু, সুবীরবাবু?
বলতে পারি না।
ঠিক আছে, তুমি এবারে রুক্মিণীকে এ ঘরে পাঠিয়ে দাও গে।
বাহাদুর চলে গেল।
অরূপ কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে, একটা কথা আপনাকে কিন্তু আমি বলতে ভুলে গেছি মিঃ রায়–
কি বল তো।
ঐ ছোরাটার কথা—
মানে ঐ যে সাদা বাঁটের ছোরাটা যা দিয়ে গগনবাবুকে হত্যা করা হয়েছে?
হ্যাঁ, ছোরাটা নাকি ওঁরই মানে গগনবাবুরই।
কে বললে?
বাহাদুরই বলছিল। ছোরাটা ওঁরই শোবার ঘরের ড্রেসিং টেবিলের ড্রয়ারে থাকত।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
ঐ সময় রুক্মিণী এসে ঘরে ঢুকল।
ছিপছিপে দেহের গড়ন, দেহে যৌবন যেন কানায় কানায় উপচে পড়ছে। দেহের প্রতিটি ভাঁজ, প্রতিটি ঢেউ স্পষ্ট, মুখর। বেশভূষা আদৌ দেহাতী স্ত্রীলোকদের মত নয় বরং অনেকটা শহরের আধুনিকাঁদের মত। মাথায় সামান্য ঘোমটা।
ঐ ঘোমটার ফাঁক দিয়ে দেখা যায় মুখোনা। মুখোনা একটু ভোঁতা-ভোঁতা হলে কি হবে, দুটি চোখ যেন চকিতপ্রেক্ষণা! ইঙ্গিতপূর্ণ!
পাতলা দুটি ঠোঁটে ও ধারালো চিবুকে যেন একটা চাপা হাসির ঢেউ খেলে যাচ্ছে।
অরূপ জিজ্ঞাসা করে, কি নাম তোর?
রুক্মিণী।
চাপা হাসির ঢেউটা যেন কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গে সারাটা মুখে ছড়িয়ে পড়ল। আরও স্পষ্ট হল।
তোর মরদ রামদেও কোথায়?
হায় রাম! আমি কি করে জানব?
তুই জানবি না তো জানবে কে? তোরই তো জানবার কথা! তোর মরদ!
কে জানে, হয়তো বাজারে গিয়েছে।
এত সকালে বাজারে?
আর কোথায় যাবে তবে?
তা বাজারে গেলে এখনও ফিরছে না কেন?
আমি কি করে জানব?
জানিস না?
না।
এখানে তুই কি কাজ করিস? কি করতে হয় তোকে?
কিছুই করি না। আবার সেই চাপা হাসির ঢেউ ছড়িয়ে গেল দুই ওষ্ঠে ও চিবুকে।
কিছুই করিস না?
না।
বসে থাকিস?
বসে থাকব কেন?
তবে? কাজ করিস না তো কি করিস সারাদিন? মাইনে দিত না তোকে তোর সাহেব?
মাইনে–বলতে বলতে গলার সেই চাপা হাসির ঢেউ সারা মুখে ওর ছড়িয়ে পড়ল। বললে, , তবে সাহেব এখানে থাকতে দিত, জামাকাপড় খাওয়া দিত আর মধ্যে মধ্যে দু-চার টাকা বকশিশ দিত।
বকশিশ! হ্যাঁ।
গয়না দিত না?
একটা হার দিয়েছে–আবার সেই চাপা হাসির ঢেউ ছড়িয়ে গেল মুখে।
শুনলাম সাহেবের ঘরেই তুই সব সময় থাকতিস?
সাহেব ডাকলে আসতাম।
কখন ডাকত সাহেব? সন্ধ্যেবেলা?
হ্যাঁ, ডাকত।
রামদেও তোর মরদ জানত যে তুই সাহেবের ঘরে আসতিস?
না।
জানত না? সে তো পাশের ঘরেই থাকত।
ওকে তো প্রায়ই সাহেব ঐ সময়টা এটা ওটা আনতে পাঠাতো—
আর সেই সময়ই বুঝি ডাকত তোকে তোর সাহেব?
আবার সেই হাসির ঢেউ সারা মুখে ছড়িয়ে গেল।
সাহেব তোকে খুব পছন্দ করত বুঝি?
বোধ হয়।
কেন, জানিস না?
আবার সেই চাপা হাসির ঢেউ সারা মুখে ছড়িয়ে গেল।
তুই তাহলে লুকিয়ে লুকিয়ে তোর স্বামীকে না জানিয়ে তোর সাহেবের ঘরে আসতিস বল?
হঠাৎ ঐ সময় কিরীটী হাতের বাহারে রেশমী চুড়িগুলো দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করে, তোর হাতের ঐ চুড়িগুলো তোকে তোর সাহেব কিনে দিয়েছিল বুঝি?
না তো! ও তো আমার মরদ কিনে দিয়েছে!
কবে?
এই তো সেদিন।
কাল রাত্রে বাইরের সেই দিদিমণি তোর সাহেবের কাছে এসেছিল, জানিস?
জানি তো।
কখন চলে যায় জানিস সেই দিদিমণি?
অনেক রাতে।
কখন?
আমি কি ঘড়ি দেখতে জানি?
তুই তখন কোথায় ছিলি?
আমার ঘরে।
আর রামদেও?
সে নীচে ছিল।
নীচে? হ্যাঁ
হ্যাঁ, ও ঐ সময়টা দারু পিত।
দারু? কোথায় পেত দারু?
সাহেবের আলমারি থেকে সরাত। আমিও নিয়ে দিতাম–মধ্যে মধ্যে—
সাহেব টের পেত না?
পাবে কি করে–চাবি তো ওর কাছেই থাকত দারুর আলমারির!
খুব দারু খেত বুঝি রামদেও?
মাঝে মাঝে খুব পিত। মাতোয়ালা হয়ে যেত।
কাল রাত্রে কোন গোলমাল বা চেঁচামেচি শুনেছিলি তোর সাহেবের ঘরে?
না।
কেন, তুই পাশের ঘরেই তো থাকিস?
কাল রাত্রে আমার খুব ঘুম পাচ্ছিল–ঘুমিয়ে পড়েছিলাম।
অতঃপর বাকি ছিল দারোয়ান জানাল সিং। তাকেও কিছু প্রশ্ন করে ওদের তখনকার মত কাজ শেষ হল।
» ০৭. মৃতদেহ মর্গে পাঠিয়ে
মৃতদেহ মর্গে পাঠিয়ে কিরীটীর নির্দেশমত সুবীর সুবিনয় বাহাদুর প্রিয়লাল ও অন্যান্য ভৃত্যদের আপাততঃ পুলিসের বিনানুমতিতে বাড়ি ছেড়ে কোথাও না যেতে বলে বাড়িটা পুলিস পাহারায় রেখে অরূপ ও অন্যান্য সবাই বাড়ি থেকে বের হয়ে এল।
কিরীটী আর যোগজীবন পাশাপাশি হাঁটছিল।
সান্যাল মশাই!
বলুন!
শমিতা দেবীকে আমি কয়েকটি প্রশ্ন করতে চাই, অবিশ্যি যদি আপনার আপত্তি না থাকে?
আপত্তি হবে কেন? বলব শমিকে—
আমি বিকেলের দিকে যাব আপনার ওখানেই–উনি যদি সে সময় থাকেন!
বলে দেব থাকতে ঐ সময়।
যোগজীবনকে কিরীটীর মনে হল যেন বেশ কেমন একটু অন্যমনস্ক।
তাহলে এবারে আমি চলি–বলে কিরীটী উল্টোদিকে বাড়াতেই যোগজীবন ডাকেন, রায় সাহেব!
কিরীটী ঘুরে দাঁড়াল, কিছু বলছিলেন?
হ্যাঁ–একটা কথা!
বলুন?
আচ্ছা আপনি কি গগনের হত্যার ব্যাপারে আমার বোন শমিকে কোন রকম সন্দেহ করছেন?
দেখুন সান্যাল মশাই, ওকে আমি দেখিনি আজ পর্যন্ত–তবে আপনাদের সকলের মুখ থেকে যেটুকু জানতে পারলাম তাতে করে–
কি রায় সাহেব?
তার চরিত্রে কিছুটা স্বেচ্ছাচারিতা ও উজ্জ্বলতা আছেই।
না না–সে রকম যা আপনি ভাবছেন তেমন কিছু নয়। ক্লাব নিয়ে হৈচৈ করে, একটু-আধটু ড্রিঙ্ক করে ঠিকই, কিন্তু সে সত্যিই সেরকম উচ্ছল প্রকৃতির বলতে যা বোঝায় সে ধরণের মেয়ে নয়। তাছাড়া আজকালকার দিনে ওরকম তো প্রায়ই দেখা যায় বয়সের ছেলেমেয়েদের মধ্যে।
আপনি কিছু ভাববেন না সান্যাল মশাই–সত্যিই গতরাত্রের ব্যাপারের সঙ্গে যদি তার কোন সম্পর্ক না থাকে তো কেউ তাকে স্পর্শ করতে পারবে না। আর একটা কথা–
কি?
আপনি যদি চান তো আমি আপনার বন্ধুর হত্যার ব্যাপার থেকে একেবারে সরে দাঁড়াতে পারি!
না, না–তার কোন প্রয়োজন নেই। দৈবক্রমে ঘটনাচক্রে যখন আপনি ব্যাপারটার মধ্যে গিয়েই পড়েছেন, আপনার করণীয় অবশ্যই আপনি করবেন।
আমিও ঐ উত্তরটাই আপনার কাছে আশা করেছিলাম সান্যাল মশাই।
সত্য আর গরলকে চাপা দিয়ে রাখা যায় না চিরদিন, একদিন-না-একদিন সে প্রকাশ হয়ে পড়েই–তাছাড়া শমিতা যেমন আমার সহোদরা বোন তেমনি গগনও ছিল আমার দীর্ঘদিনের বন্ধু। আমার–হ্যাঁ, আমারও কিছু দোষ আছে বৈকি। গগন আর শমিতা সম্পর্কে আমার কানে ইদানীং কিছুদিন ধরে অনেক কথাই আসছিল, কিন্তু তবু আমি সতর্ক হইনি।
হওয়া বোধ হয় উচিত ছিল আপনার সান্যাল মশাই!
এখন বুঝতে পারছি উচিত ছিল। তবে বিশ্বাস করুন রায় সাহেব, এতটা আমি কল্পনাও করতে পারিনি।
এবারে বাড়ি যান সান্যাল মশাই।
যোগজীবন বিদায় নিয়ে গৃহের দিকে চলা শুরু করলেন।
কিরীটীও তার গৃহের দিকে পা পাড়াল।
.
বেলা দশটা প্রায় হয়ে গিয়েছিল সেদিন কিরীটীর গৃহে ফিরতে। কৃষ্ণা উদ্বিগ্ন হয়ে ঘর–বার করছিল–সুব্রতকেও ফোন করে আনিয়েছিল।
কিরীটী এসে যখন গৃহে প্রবেশ করল, জংলী তখন আবার কিরীটীর সন্ধানে চতুর্থবার লেকের দিকে যাচ্ছিল। কিরীটীকে দেখে সে দাঁড়াল, বাবুজী, কোথায় ছিলে তুমি এতক্ষণ?
কেন রে?
মাইজী খুব ব্যস্ত হয়েছে–যাও। উপরে যাও।
দেড়তলার বসবার ঘরে ঢুকতেই সুব্রত বলে ওঠে, কি রে, কোথায় গিয়েছিলি?
কেন?
কেন মানে? সেই সকাল সাড়ে তিনটেয় লেকে বেড়াতে গিয়ে আর পাত্তা নেই?
কৃষ্ণা বলে, সত্যি–আশ্চর্য মানুষ তুমি!
কিরীটী সোফার উপর বসতে বসতে বললে মৃদু হেসে, হারিয়ে যাব না সে তত জানতেই প্রিয়ে–আর সেরকম কোন একটা দুর্ঘটনা ঘটলেই আগে সে সংবাদ পেতে।
থাক। আর বাহাদুরিতে প্রয়োজন নেই। তা চা খেয়েছ, না তাও পেটে পড়েনি এখনও?
পড়েছিল সেই ঘন্টা তিনেক আগে এক কাপ, তাও সম্পূর্ণ নয়। এক কাপ পেলে মন্দ হত না।
কৃষ্ণা উঠে গেল। সুব্রত আবার জিজ্ঞাসা করে, কিন্তু কোথায় ছিলি এতক্ষণ?
আর বলিস কেন! গিয়েছিলাম অবিশ্যি একটি রেয়ার ফুল দেখতে–অবশেষে জড়িয়ে পড়লাম এক খুনের ব্যাপারে।
খুন! কোথায়? কে?
ধীরে বন্ধু ধীরে। তারপর একটু থেমে কিরীটী বলে, নিহত হয়েছেন এক এক্স আর্মি কর্নেল। মৃত্যুর কারণ ছুরিকাঘাত–স্থান অনতিদূরে, সাদার্ন অ্যাভিনুতে।
তা তুই তো গিয়েছিলি লেকে বেড়াতে—
বললাম যে, বেড়ানো শেষ হবার পর গিয়েছিলাম সান্যাল মশাইয়ের গৃহে একটা রেয়ার ফুল দেখতে!
সান্যাল মশাই কে?
লেকের ভ্ৰমণবন্ধু–এক প্রৌঢ় রিটায়ার্ড ভদ্রলোক এবং যিনি নিহত হয়েছেন তাঁরই ঘনিষ্ঠ বন্ধু।
তারপর?
সান্যাল মশাইয়ের ওখানে ফোন এল বন্ধুটি তাঁর নিহত। তখন তিনি–মানে তাঁরই অনুরোধে তাঁর সঙ্গে যাই।
চায়ের কাপ হাতে কৃষ্ণা ঘরে ঢুকতে ঢুকতে বলে, তা সেখান থেকে একটা ফোন করে দিতে কি হয়েছিল?
ক্ষমা করো দেবী–মনে পড়েনি।
তা মনে পড়বে কেন? খুনখারাপির গন্ধ পেলে কি আর কিছু মনে থাকে?
কিরীটী কৃষ্ণার হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়ে কাপে চুমুক দিতে দিতে মৃদু মৃদু হাসে।
শোন, বস–খুব ইন্টারেস্টিং ব্যাপার!
থাক তোমার ইন্টারেস্টিং ব্যাপার, আমার শোনার প্রয়োজন নেই। কৃষ্ণা বলে।
প্রসীদ দেবী! তুমি মুখ ভার করলে এ অভাজনকে নিজগৃহেই যে পরবাসী হতে হবে! ঘটনাটা সত্যিই রোমাঞ্চকর। শোনই না।
না–ও শোনায় আমার কোন লাভ নেই।
বল কি? আমাকে যারা ভালবাসে তারা শুনলে যে তোমায় ধিক্কার দেবে! কিরীটী-কাহিনী শুনতে চায় না এমন মতিচ্ছন্ন যার হয়েছে তাকে—
সেই তো একঘেয়ে ব্যাপার। হয় টাকাপয়সা না হয় প্রতিহিংসা–না হয় কোন এক স্ত্রীলোকের বা পুরুষের প্রেমের জ্বালা। বিয়ে হওয়া অবধি তোমার মুখে ঐসব শুনতে শুনতে।
থাক্ গিয়ে। তা ও ছাড়া আর ক্রাইম জগতে কি আছে বল? পাপিষ্ঠ–পাপিষ্ঠার দল ঐ পাকচক্রেই ঘূর্ণিপাক খাচ্ছে যে অহরহ!
সুব্রত হাসছিল। এবারে বললে, নে, বল্ শুনি তোর এক্স আর্মি অফিসারের নিধন ব্যাপারটা!
তুইও সুব্রত দাউ টু ব্রুটাস! তুইও ব্যাপারটাকে লাইট করে নিচ্ছিস?
কিন্তু ব্যাপারটা বলবি তো?
কিরীটী অতঃপর সমস্ত ব্যাপারটা সংক্ষেপে বিবৃত করে যায়।
সব শুনে সুব্রত বলে, এ তো মনে হচ্ছে—
কি, বল?
বিকৃত এক লালসার পরিণতি।
আমারও যেন মনে হচ্ছে তাই। কারণ লালসা বস্তুটা মানুষের অন্যতম রিপু হিসাবে–অর্থাৎ নারী–পুরুষের চরিত্রের অচ্ছেদ্য এক ধর্ম, ওটা বাদ দিয়ে মানুষ যেমন কোন যুগেই চলতে পারেনি এ যুগেও পারবে না, এবং ভবিষ্যতেও বোধ হয় কখনও পারবে না।
কথাটা শেষ করল সুব্রত, তাই খুনখারাপি হবেই। কিন্তু গগনবিহারীর অমন মতিচ্ছন্ন হল কেন?
আরে প্রৌঢ় ও বৃদ্ধের দলই তো ঐ ধরনের বিকৃত লালসার বড় ভিকটিম হয়!
কিন্তু একটা ব্যাপারে কেমন যেন আমার খটকা লাগছে কিরীটী! সুব্রত বললে।
ঐ অ্যালসেসিয়ান কুকুরটা তো?
হ্যাঁ। হত্যাকারী কুকুরটাকে ম্যানেজ করল কি করে?
সে আর এমন দুরূহ ব্যাপার কি! আগে থেকেই হয়ত কুকুরটাকে সরিয়ে ফেলেছিল কৌশলে। তবে এও ঠিক, শেষ পর্যন্ত হয়ত ঐ কুকুরটাই হবে তার মৃত্যুবাণ। ভাল কথা মনে করিয়ে দিয়েছিস বলতে বলতে উঠে গিয়ে কিরীটী অরূপকে ফোনে ডাকল।
বালীগঞ্জ থানার ও. সি. কথা বলছি–সাড়া এল অপর প্রান্ত থেকে।
অরূপ–আমি কিরীটী। একটা কথা তখন তোমাকে তাড়াতাড়ি বলতে ভুলে গিয়েছি—
কি কথা?
একজন ভেটানারী সার্জেনকে দিয়ে কুকুরটাকে একবার পরীক্ষা করবার ব্যবস্থা করতে পার?
কেন পারব না? অরূপ বললে।
হ্যাঁ দেখাও, আমার মনে হয় কুকরটাকে খাবারের সঙ্গে কোন তীব্র ঘুমের ওষুধ দেওয়া হয়েছিল। শুধু তাই নয়, আর একটা কথা, কুকুরটার উপরে যেন কস্টান্টু ওয়াচ রাখা হয়।
অরূপকে নির্দেশ দিয়ে কিরীটী ফোনটা রেখে দিল।
সারাটা দুপুর কিরীটী কোথাও বের হল না। নিজস্ব লাইব্রেরী থেকে অ্যালসেসিয়ান কুকুর সম্পর্কে এক বিশেষজ্ঞের বই নিয়ে তারই মধ্যে ডুবে রইল।
বিকেলের দিকে যোগজীবনের ওখানে যাবে বলেছিল কিন্তু বেরুতে সন্ধ্যা হয়ে গেল।
সুব্রতকে কিরীটী বলে দিয়েছিল বিকেলে তার ওখানে চলে আসতে। দুজনে একসঙ্গে যোগজীবনের ওখানে যাবে।
সুব্রত যথাসময়েই এসে হাজির হয়েছিল।
কিন্তু সুব্রত এসে দেখল কিরীটী কি একটা বই নিয়ে তার মধ্যে ডুবে আছে, কাজেই তাকে আর বিরক্ত করেনি।
বইটা শেষ করে কিরীটী যখন উঠে দাঁড়াল বেলা তখন গড়িয়ে গিয়েছে–বাইরের আলো ম্লান হয়ে গিয়েছে।
সন্ধ্যার ধূসর ছায়া নামছে ধীরে ধীরে।
কি রে, বেরুবি না? সুব্রত শুধাল।
হ্যাঁ, চল।
সুব্রত তার গাড়ি এনেছিল। সেই গাড়িতেই চেপে দুজনে যোগজীবনের গৃহের দিকে রওনা হল।
গাড়িতে উঠে কিরীটী বললে, চল একবার থানায় ঘুরে যাই। রামদেওর কোন পাত্তা পাওয়া গেল কিনা জেনে যাই। আর অরূপ যদি থাকে তো তাকেও সঙ্গে নিয়ে যাব।
থানার সামনে এসে ওদের গাড়ি যখন থামল সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছে তখন। রাস্তার আলো জ্বলে উঠেছে। অরূপ থানাতেই ছিল।
অরূপের অফিস–ঘরে ঢুকেই কিরীটী জিজ্ঞাসা করল, রামদেওর কোন খবর পেলে অরূপ?
না।
খবরটা যে চাই।
প্রতাপগড়ে ওর দেশে খোঁজ নেবার জন্য ইউ, পি-র ইনটেলিজেন্স ব্রাঞ্চে ফোন করে টেলিজেন্স ব্রাঞ্চে ফোন করে দিয়েছি। বেটার একটা ফটো পেলে সুবিধা হত।
রুক্মিণীর কাছে খোঁজ করে দেখো–পেতে পার।
দেখি, কাল একবার যাব। হ্যাঁ ভাল কথা, সুবীর চৌধুরী ফোন করেছিল।
কেন?
সে বাইরে বেরুতে চায়। আমি বলে দিয়েছি, আপাত চার–পাঁচদিন ঐ বাড়ির বাইরে কোথাও তার যাওয়া চলবে না।
তারপর?
চেঁচামেচি করেছিল ফোনে। আমরা কি তাকেই গগনবিহারীর হত্যাকারী বলে সন্দেহ করছি নাকি ইত্যাদি।
কিরীটী মৃদু হাসে।
আমার কিন্তু মনে হয় মিঃ রায়–অরূপ বলে।
কি?
ঐ হত্যাকাণ্ডের মধ্যে সুবীর চৌধুরী জড়িয়ে আছে।
কেন?
আমার মনে হয় ঐ বরযাত্রী যাওয়ার ব্যাপারটা একটা তার অ্যালিবি মাত্র।
হওয়া অসম্ভব নয়, কিন্তু হত্যা সে করবে কেন তার কাকাকে? কি উদ্দেশ্য থাকতে পারে?
কি আবার, গগনবিহারীর সমস্ত সম্পত্তির সেই-ই তো প্রকৃতপক্ষে লিগ্যাল উত্তরাধিকার!
তা তো নাও হতে পারে অরূপ।
কিন্তু—
কিরীটী বলে, এমনও তো হতে পারে গগনবিহারী উইলে তাকে কিছুই দিয়ে যাননি। না অরূপ, গগনবিহারীর হত্যার সঙ্গে আর যাই থাক অর্থের কোন সম্পর্ক আছে বলে আপাতত আমার মনে হচ্ছে না।
তবে কি–
অবিশ্যি আমি নিজেও এখনো কোন স্থিরসিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারনি। তবে আমার মনে হয়, গগনবিহারীর হত্যার মূলে আছে অন্য কিছু–অর্থ নয়।
আপনি কি বলতে চান মিঃ রায়!
ঐ হত্যাকাণ্ডের আশেপাশে যারা ছিল–তাদের মধ্যে ভেবে দেখছ কি, শমিতা আর রুক্মিণী যে দুটি মেয়ে গগনবিহারীর জীবনে এসেছিল–মনে করে দেখ তাদের দুজনেরই রূপ ও যৌবনের কথা। গগনবিহারী দুজনের প্রতিই আকৃষ্ট ছিল।
তাহলে?
সে–সব পরে বিচার করা যাবে। আপাতত তোমার হাতে যদি কোন জরুরী কাজ না থাকে তো চল, এক জায়গা থেকে ঘুরে আসি।
কোথায়?
যোগজীবনবাবুর ওখানে।
সেখানে কেন?
শমিতা দেবীর সঙ্গে একটু আলাপ করে আসি, চল না!
বেশ তো, চলুন।
অরূপ উঠে পড়ল।
০৮. যোগজীবনবাবু বাইরের ঘরেই বসেছিলেন
যোগজীবনবাবু তাঁর বাইরের ঘরেই বসেছিলেন একাকী।
কিরীটী আসবে বলেছিল তাই আর তিনি বেরোননি ঐ দিন বিকালে। কিরীটীরা যখন এসে পৌঁছল তখন সাতটা বেজে গিয়েছে।
আসুন রায় সাহেব। দেরী হল যে? আপনি–
কথাটা যোগজীবন আর শেষ করেন না। কিরীটীর সঙ্গে সুব্রত আর থানা-অফিসার অরূপ মুখাজীকে দেখে থেমে গেলেন।
কিরীটী বসতে বসতে বললে, অরূপকে সঙ্গেই নিয়ে এলাম সান্যাল মশাই, আইন মেনে চলাই ভাল।
সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকালেন যোগজীবন কিরীটীর মুখের দিকে।
বুঝতেই তো পারছেন, ব্যাপারটা খুব delicate হলেও শমিতা দেবীর সঙ্গে যখন গগনবাবুর পরিচয় ছিল এবং তাঁর গগনবাবুর গৃহে যাতায়াত ছিল, পুলিস তাঁকে নিয়েও টানাটানি করতে ছাড়বে না। সেক্ষেত্রে ব্যাপারটা যদি একটা ঘরোয়া পরিবেশে শেষ করে ফেলা যায়, সব দিক দিয়েই ভাল হয়।
যোগজীবন কোন জবাব দেন না।
তাঁর সমস্ত মুখে যেন একটা দুশ্চিন্তার কালো ছায়া।
কিরীটী বললে, তাই অরূপকে সঙ্গে করেই নিয়ে এলাম।
উনিও–মানে মিঃ মুখাজীও কি শমিকে প্রশ্ন করতে চান? যোগজীবন ক্ষীণ গলায় প্রশ্ন করেন।
না, না–উনি কেবল উপস্থিত থাকবেন। যা জিজ্ঞাসা করবার আমিই করব। আপনার ভগ্নী বাড়িতেই আছেন তো?
আছে।
গগনবাবুর ব্যাপারটা নিশ্চয়ই শুনেছেন?
শুনেছে।
কে বলল? আপনি?
না–আমি বলিনি।
তবে?
সুবীর তাকে ফোনে জানিয়েছে।
কিরীটী যেন একটু চমকেই ওঠে কথাটা শুনে। বলে, কে? সুবীরবাবু?
হ্যাঁ।
কখন ফোন করেছিলেন তিনি?
সকালেই।
সকালে? কখন?
আমি ফোন পেয়ে চলে যাবার পরই।
কিরীটী যেন একটু অন্যমনস্ক। মনে হয় যেন কি ভাবছে সে। কিরীটী যোগজীবনের কথার পর আর কোন কথা বলে না।
একটু পরে আবার বলে, তাহলে চলুন, ওঠা যাক।
অ্যাঁ–হ্যাঁ, চলুন।
দোতলায় উঠে যোগজীবন তাঁর শয়নঘরে ওদের বসিয়ে শমিতার ঘরের দিকে পা বাড়ান।
বাড়িটা বেশ বড়। দোতলায় পাঁচটি ঘর, তিনতলায় তিনটি ঘর।
তিনতলাতেই একটি ঘর নিয়ে শমিতা থাকে।
একতলাটা ভাড়া দেওয়া একটি ঘর ছাড়া।
শমিতার ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল।
খোলা দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেলেন যোগজীবন। ঘরের ভিতরে অন্ধকার। একটু ইতস্ততঃ করলেন যোগজীবন, তারপর মৃদু কণ্ঠে ডাকলেন, শমি!
কোন সাড়া এল না।
আবার ডাকলেন একটু উঁচু গলাতেই, শমি?
কে, দাদা? সাড়া এল এবার অন্ধকার ঘরের ভিতর থেকে।
হ্যাঁ।
এস।
যোগজীবন অন্ধকার ঘরের মধ্যে এসে ঢুকলেন, আলো জ্বালাসনি কেন?
খট করে একটা শব্দ হল। ঘরের আলোটা জ্বলে উঠল পরমুহূর্তেই। যোগজীবন দেখলেন শমিতা একটা আরাম–কেদারার উপর দেহটা এলিয়ে দিয়ে পড়ে আছে।
সব সময়ই যে বেশভূষা ও প্রসাধন ছাড়া থাকে না তার আজ কোন বেশভূষা ও প্রসাধন নেই। পরনে সাধারণ একটা তাঁতের রঙিন শাড়ি। গেরুয়া রংয়ের হাতকাটা একটা ব্লাউজ গায়ে। মাথার চুল রুক্ষ, চিরুনি পড়েছে বলে মনে হয় না।
চোখেমুখে প্রসাধনের চিহ্নমাত্র নেই। চোখ দুটো যেন ঈষৎ রক্তিম।
সামনে ছোট একটা ত্রিপয়ের উপরে কাচের গ্লাসে রক্তিম তরল পদার্থ। গ্লাসটার প্রতি নজর পড়তেই যেন যোগজীবন একটু থমকে গেলেন। গ্লাসের রক্তিম তরল বস্তুটি যে কী যোগজীবনের বুঝতে কষ্ট হয় না।
শমিতা ড্রিঙ্ক করে জানতেন তিনি, কিন্তু সে সব কিছুই ক্লাবে। ঘরে বসেও যে শমিতা ড্রিঙ্ক করতে পারে এটা যেন ধারণার অতীত ছিল যোগজীবনের কাছে।
হঠাৎ যেন একটা ক্রোধের উদ্রেক হয়, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে সামলে নিলেন যোগজীবন। তারপর গম্ভীর হয়ে বললেন, রায় সাহেব এসেছেন, আমার ঘরে বসে আছেন–তোমার সঙ্গে কথা বলতে চান।
অনিচ্ছা সত্ত্বেও যোগজীবনের কণ্ঠস্বরটা যেন একটু রূঢ়ই শোনাল।
কি দরকার আমার সঙ্গে তাঁর? শমিতা একটু যেন রুক্ষ স্বরেই প্রশ্নটা করল।
জানি না। তোমাকে তো সকালেই বলেছিলাম, তিনি আসবেন আজ বিকেলে তোমার সঙ্গে দেখা করতে।
বাট আই ডোন্ট লাইক টু মীট এনিবডি অ্যাট দিস্ মোমেন্ট!
শোন, শুধু রায় সাহেবই নন–থানা-অফিসারও এসেছেন।
বাট হোয়াই? কি চান তাঁরা আমার কাছে?
চেঁচিও না, শোন ওঁরা জানতে পেরেছেন গগনের সঙ্গে তোমার পরিচয় ছিল—
হোয়াটস টু দ্যাট–পরিচয় ছিল, তাতে হয়েছে কি?
তাছাড়া কাল রাত্রে তুমি ওখানে গিয়েছিলে—
ইটস্ এ ড্যাম লাই–মিথ্যে কথা।
মিথ্যে কথা!
নিশ্চয়ই। গত সাতদিন ধরে তার বাড়ির ছায়াও মাড়াইনি আমি। একটা ডার্টিফিলদি স্কাউনড্রেল!
বিষ যেন উগারিত হল শমিতার কণ্ঠ থেকে।
সত্যি–সত্যি শমি–তুই কাল গগনের বাড়িতে যাসনি?
সিওরলি নট!
তবে যে গগনের বাড়ির লোকেরা কেউ কেউ বললে, তোকে তারা যেতে দেখেছে গত রাত্রে গগনের ঘরে?
কে–কে বলেছে?
বললাম তো, গগনের বাড়ির লোকেরা বলেছে।
মিথ্যে কথা। কাল আমি রাত আটটা থেকে সাড়ে এগারোটা পর্যন্ত ক্লাবে ছিলাম। এভরিবডি নোজ দ্যাট–সবাই সেখানে তার সাক্ষী আছে।
কিন্তু–
ব্যাপার কি বল তো দাদা? তুমি কি বিশ্বাস করছ না আমার কথাটা?
শমিতা উঠে দাঁড়িয়েছে ততক্ষণে।
না, মানে—
ঠিক আছে, চল, তোমার থানার ও. সি. কি বলতে চায় শুনে আসি। আর তোমার রায় সাহেবেরই বা কি বলবার আছে শুনি।
চল্।
ভাই-বোনে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
পাশের ঘরে ঢুকে যোগজীবন বললেন, রায় সাহেব, এই আমার বোন শমিতা।
কিরীটী চোখ তুলে তাকাল, নমস্কার মিস সান্যাল। বসুন।
আপনি আমার সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছেন? শমিতা প্রশ্নটা করে বসল না, দাঁড়িয়েই রইল।
কিরীটী আবার বললে, বসুন।
না–বসলে হবে না। কি আপনি জানতে চান বলুন আমার কাছে!
রায় সাহেব–
যোগজীবনের কণ্ঠস্বরে কিরীটী তাঁর দিকে ফিরে তাকাল। যোগজীবন বললেন, শমিতা বলছে কাল রাত্রে ও আদৌ ওখানে নাকি যায়ইনি।
কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে শমিতাকে দেখছিল, যোগজীবনের কথায় ফিরে তাকাল না। কেবল প্রশ্ন করল, আপনি বলছেন কাল রাত্রে গগনবাবুর বাড়িতে যাননি?
না।
কিন্তু—
কি?
রামদেও আর সুবিনয়বাবুরা আপনাকে দেখেছে। কেবল তাই নয়, রুক্মিণী আপনার গলা শুনেছে গগনবাবুর শোবার ঘরে। কিরীটী বললে।
রামদেও বলেছে? সুবিনয় বলেছেন তিনি আমাকে দেখেছেন কাল রাত্রে সেখানে?
সেই কথাই তো তারা তাদের জবানবন্দিতে বলেছে।
ইটস এ ড্যাম লাই। ডাকুন তো তাদের, আমি জিজ্ঞাসা করছি কখন তারা আমাকে দেখেছে?
নিশ্চয়ই–জিজ্ঞাসা করা হবে বৈকি। কিন্তু আপনি যে সত্যি–সত্যিই কাল রাত্রে সেখানে যাননি তার কোন প্রমাণ আছে? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
নিশ্চয়ই।
কি প্রমাণ? কিরীটী শমিতার চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে আবার প্রশ্ন করে।
কাল রাত্রে ক্লাবে আমাদের যারা ছিল তাদের জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন কথাটা আমার সত্যি না মিথ্যে।
আপনি তাহলে বলছেন কাল রাত্রে ক্লাবেই ছিলেন? কিরীটীর গলার স্বর যেন অতিরিক্ত শান্ত–ঠাণ্ডা।
হ্যাঁ।
কখন ক্লাবে গিয়েছিলেন আর কতক্ষণ বা কাল রাতে সেখানে ছিলেন, নিশ্চয়ই মনে আছে আপনার?
নিশ্চয়ই, মনে আছে বৈকি। আটটায় গিয়েছিলাম, রাত সাড়ে এগারোটায় ফিরে আসি। বাড়িতে?
না।
তবে কোথায়?
সে কথা জানবার আপনার কি কোন প্রয়োজন আছে, মিঃ রায়?
নচেৎ কথাটা আপনাকে আমি নিশ্চয়ই জিজ্ঞাসা করতাম না।
অ্যাম স্যরি মিঃ রায়, আপনার ঐ প্রশ্নের আমি জবাব দিতে পারছি না। দুঃখিত। আপনার আর কিছু জিজ্ঞাস্য আছে?
গগনবিহারীবাবুর সঙ্গে আপনার যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল, তাই নয় কি?
আলাপ-পরিচয় ছিল। তাছাড়া ছোটবেলা থেকেই দাদার বন্ধু হিসাবে তিনি আমাদের পরিচিত ছিলেন।
গগনবাবু আপনাদের ক্লাব মরালী সঙ্ঘের অন্যতম পেট্রোন ছিলেন, তাই নয় কি?
হ্যাঁ।
আপনি প্রায়ই তাঁর ওখানে যেতেন। অনেকক্ষণ পর্যন্ত থাকতেন–কথাটা কি সত্যি?
একসময় যেতাম, তবে ইদানীং যেতাম না। গত সাত–আট দিন একবারও যায়নি।
কেন? ঝগড়া হয়েছিল কি?
শমিতা কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, হ্যাঁ।
কি নিয়ে ঝগড়া হয়েছিল?
শমিতা যেন আবার মুহূর্তকাল চুপ করে রইল। তারপর বললে, ক্লাবেরই কোন ব্যাপারে মতান্তর হয়েছিল।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, কিন্তু আমি যদি বলি মিস সান্যাল, আপনি সত্যি বলছেন না?
হোয়াট ডু ইউ মী! রুক্ষ ও কঠিন শোনাল শমিতার কণ্ঠস্বর।
কথাটা আমার অস্পষ্ট নয়, আর দু’রকম অর্থও তার হয় না এবং আপনিও যে সেটা বুঝতে পারেননি তাও নয়। কিরীটীর গলার স্বরটা শান্ত কিন্তু কঠিন।
শমিতা তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে নিঃশব্দে চেয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটীও কয়েক সেকেন্ড চেয়ে থাকে শমিতার মুখের দিকে। তারপর বলে, আপনার বাঁ হাতের কব্জিতে একটা দেখছি প্লাস্টার লাগানো আছে। কি হয়েছে ওখানে মিস সান্যাল? কেটে গিয়েছিল বোধহয়?
কিরীটীর কথায় শমিতা যেন হঠাৎ কেমন একটু হকচকিয়ে যায়, মনে হল কিরীটীর। সঙ্গে সঙ্গে যেন তার প্রশ্নের জবাবটা দিতে পারল না শমিতা।
একটু যেন বিব্রত–কিন্তু সে মুহূর্তের জন্য পরক্ষণেই বলে, হ্যাঁ, সামান্য একটু কেটে গিয়েছিল, তাই একটু প্লাস্টার লাগিয়ে দিয়েছিলাম। বলতে বলতে শমিতা যেন কিরীটীর তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সামনে থেকে হাতটা সরিয়ে নেবার চেষ্টা করে।
কি করে কাটল? কবে কাটল?
ঠিক মনে নেই, পরশু-তরশু হবে।
আপনার হাতে সরু একজোড়া সোনার রুলি দেখছি। ঐ সোনার রুলি ছাড়া আর কিছু বোধহয় আপনি কখনও হাতে পরেন না?
না।
মিস সান্যাল, আপনি সুবীরবাবু ও সুবিনয়বাবুকে নিশ্চয়ই চেনেন, গগনবাবুর বাড়িতে যখন আপনার যাতায়াত ছিল? কিরীটী প্রশ্নটা করে আবার তাকাল শমিতার মুখের দিকে।
সুবীরবাবুর সঙ্গে পরিচয় হয়েছিল সামান্যই আমার। শমিতা বললে।
সুবিনয়বাবুর সঙ্গে হয়নি? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
না।
গগনবাবুর একটা অ্যালসেসিয়ান কুকুর আছে আপনি জানেন নিশ্চয়ই?
জানি। জ্যাকি।
মধ্যে মধ্যে তাকে আপনি এটা–ওটা খেতে দিতেন?
না। আই হেট ডগস।
গগনবাবু সেটা জানতেন?
তা জানতেন বৈকি। কিন্তু আপনার যা জিজ্ঞাসা করবার শেষ হয়েছে কি? মে আই লিভ দিস রুম? শরীরটা আমার ভাল নেই।
নিশ্চয়ই। আপনাকে এখুনি আমি ছেড়ে দোব। আর একটা প্রশ্নের জবাব দিলেই–
বলুন? কি প্রশ্ন আপনার?
আপনার সঙ্গে গগনবাবুর বিয়ে প্রায় সেটুল হয়ে গিয়েছিল মিস সান্যাল, তাই নয় কি?
প্রশ্নটা এমনি আকস্মিক ও সকলের সেখানে যারা উপস্থিত তাদের চিন্তারও বাইরে ছিল যেন। সকলেই যেন শমিতার মুখের দিকে তাকায়।
বিশেষ করে যোগজীবনবাবু যেন বোবা। কিছুটা বিলও।
শমিতাও যেন কয়েকটা মুহূর্তের জন্য বোবা হয়ে যায়। তার মুখ থেকেও কোন শব্দ নির্গত হয় না। ঘরের মধ্যে অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা যেন থমথম্ করে।
কিন্তু হঠাৎ সেই স্তব্ধতা ভেঙে খিলখিল করে হেসে ওঠে শমিতা। তারপর বলে, সত্যিই, মিঃ রায়, আই মাস্ট অ্যাডমিট আপনার কল্পনাশক্তি আছে। একটা ওল্ড ভালচার! তার সঙ্গে বিয়ে?
হয়নি সেরকম কোন কথা তাহলে কখনও আপনাদের মধ্যে–মানে এনি আন্ডারস্ট্যান্ডিং?
না মশাই–আমার তো কিছু মাথার গোলমাল হয়নি!
তাহলে—
কি তাহলে?
তাঁর সমস্ত কিছু আপনার নামে লিখে দিয়ে গেলেন কেন?
আমার নামে দিয়েছেন?
কেন, জানেন না আপনি কথাটা বলতে চান?
শমিতা হঠাৎ যেন আবার চুপ করে গেল। থমকে গিয়েছে যেন শমিতা।
কিরীটী তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তখনও শমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে, শান্ত গলায় সে বলতে থাকে, নিশ্চয়ই অদূর ভবিষ্যতে আপনাদের পরস্পরের মধ্যে একটা সম্পর্ক গড়ে উঠতে চলেছিল বলেই আপনাকে তিনি তাঁর সবকিছু উইল করে দিয়েছেন।
থামুন থামুন–হঠাৎ যেন চিৎকার করে উঠল শমিতা। তারপরে ঝড়ের মতই যেন ছুটে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। ওদের দিকে তাকাল না পর্যন্ত।
ঘরের মধ্যে অকস্মাৎ যেন একটা হিমশীতল স্তব্ধতা নেমে এল। সবাই নিশ্চুপ– একেবারে যেন পাথর।
যোগজীবনবাবুর মুখোনা যেন ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে হয়ে গিয়েছে।
কিরীটী ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল, যোগজীবনবাবু, আজ যাই!
অ্যাঁ! চমকে উঠলেন যেন যোগজীবন।
আমরা যাই!
যাচ্ছেন?
হ্যাঁ। চল অরূপ, চল সুব্রত।
ওরা ঘর থেকে বের হয়ে গেল, আর যোগজীবন তখনও পাথরের মত বসে রইলেন।
০৯. রাত্রি তখন প্রায় সোয়া নটা
রাত্রি তখন প্রায় সোয়া নটা হবেই।
কিরীটী অরূপ সুব্রত সুব্রতর গাড়িতেই চলেছিল থানায় অরূপকে নামিয়ে দেবার জন্য।
শমিতা কিরীটীর বিস্ময়কর উক্তির পর সহসা ঘর ছেড়ে ঝড়ের মত বের হয়ে যাবার পর সকলের মধ্যেই যে স্তব্ধতা নেমে এসেছিল, চলমান গাড়ির মধ্যেও সেই স্তব্ধতাই যেন সকলকে আচ্ছন্ন করে রেখেছিল।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করে অরূপই প্রথমে কথা বলল, মিঃ রায়, গগনবিহারী যে তাঁর উইলে শমিতাকে সব কিছু দিয়ে দিয়েছেন আপনি জানতে পারলেন কখন?
কিরীটী মৃদুকণ্ঠে জবাব দিল, জানতে তো এখনও আমি পারিনি!
তবে যে আপনি বললেন?
সম্পূর্ণ অনুমানের ওপরে নির্ভর করে অন্ধকারে একটা ঢিল নিক্ষেপ করেছিলাম মাত্র।
তবে কথাটা সত্যি নয়! অরূপের কণ্ঠে রীতিমত বিস্ময় যেন প্রকাশ পায়।
সত্যও হতে পারে–মিথ্যাও হতে পারে। অবশ্য সত্যি-সত্যিই যদি তিনি উইল করে থাকেন। তবে আমার ধারণা–
কি?
আমার অনুমানটা হয়ত মিথ্যে নয়, নচেৎ ঐভাবে হঠাৎ তীক্ষ্ণ প্রতিবাদ জানিয়ে মিস সান্যাল ঘর থেকে বের হয়ে যেতেন না। শুধু তাই নয়, আরও আমার ধারণা, ওঁদের পরস্পরের মধ্যে ঘনিষ্ঠতা বিবাহের স্তর পর্যন্ত পৌঁছেছিল।
বলেন কি! অরূপ বললে, শমিতা সান্যালের মত একটি মেয়ে গগনবিহারীর মত এক বৃদ্ধকে বিবাহ করতে মনস্থ করেছিলেন? এ যে আমি ভাবতেও পারছি না মিঃ রায়!
ভাবতে তো আমরা সুস্থ ও স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি দিয়ে অনেক কিছুই পারি না অরূপ! তবে অনেক কিছুই ঘটে এ সংসারে, আর ঘটছেও। তাই নয় কি?
কিন্তু–
সামান্য পরিচয়ে মিস সান্যালকে যতটুকু আমি বুঝতে পেরেছি, ওঁরা হচ্ছেন সেই শ্রেণীর স্ত্রীলোক যাঁরা খানিকটা উচ্ছঙ্খলভাবে স্বাধীনচেতা এবং যাঁদের কাছে নিরঙ্কুশভাবে জীবনটা ভোগ করাই একমাত্র লক্ষ্য। এবং তার জন্য তাঁরা অনেক কিছুই হাসিমুখে ত্যাগ করতে পারেন। হয়ত বিবাহের পর স্বামীর সঙ্গে ঐখানেই মিস সান্যালের সংঘাত বেধেছিল–যার ফলে ডিভোর্স।
শমিতার শুনেছি যাঁর সঙ্গে বিবাহ হয়েছিল তাঁর অবস্থাও ভাল, বড় চাকরিও করেন, তাই হয়ত জীবনটাকে পুরোপুরি ভোগ করার জন্য সব চাইতে যে বস্তুটির বেশি প্রয়োজন–অর্থ–তার অভাব ছিল না। এবং শমিতার স্বামীর হয়ত আবার সেটা পছন্দ ছিল না। ফলে যা অবশ্যম্ভাবী ঐ ধরনের স্ত্রীলোকের পক্ষে তাই হয়ে গেল।
সুব্রত ঐ সময় বলে, তোর বন্ধু যোগজীবনবাবুর অবস্থাও তো খারাপ বলে মনে হল না।
যোগজীবনবাবু! কিরীটী বললে, মধ্যবিত্ত গৃহস্থ এবং সঞ্চয়ী ছিলেন। তাই হয়ত ঐ বাড়িটা করতে পেরেছেন। কিন্তু আজ তাঁর অবসর জীবন। শমিতা যে অর্থের সচ্ছলতার আকাঙ্ক্ষী সেরকম সচ্ছলতা যোগজীবনবাবুর কোথায়! থাকা সম্ভবও নয়।
শমিতা দেবীও তো চাকরি করেন।
তা করেন কিন্তু সেটা একান্ত দায়ে পড়েই। ভাইয়ের কাছ থেকে সেরকম অর্থ পাওয়া যাবে বলেই। এবং তাই বা তাঁর প্রয়োজনের পক্ষে কতটুকু? সেদিক দিয়ে ভেবে দেখ, গগনবিহারীর স্কন্ধারূঢ় হতে পারলে কত সুবিধা! সামান্য একটু যৌবনের ছলাকলা দিয়েই তাই হয়ত শমিতা প্রৌঢ় কামুক গগনবিহারীকে ধরাশায়ী করেছিল। অবিশ্যি গগনবিহারীকে করায়ত্ত করার আরও কারণ ছিল আমার মনে হয়!
কি? অরূপ প্রশ্ন করে।
প্রয়োজনীয় অর্থের অভাব তো হবেই না, ঐ সঙ্গে সম্পূর্ণ নিরঙ্কুশভাবে যে জীবনের সঙ্গে সে অভ্যস্ত সে জীবনও সে নিশ্চিন্তে চালিয়ে যেতে পারবে। ভোগের জীবনে একটানা ভেসে চলতে পারবে। কিন্তু ঐখানেই শমিতা ভুল করেছিল।
ভুল?
হ্যাঁ–গগনবিহারীর চরিত্রের সে সম্যক পরিচয় পায়নি। তাঁর দিকে তাঁর যে হাত প্রসারিত হয়েছিল, অনুরূপ ঘটনা ঘটলে যে সেই হাত দুটি আবার অন্যত্রও প্রসারিত হতে পারে সেটাই বুঝতে হয়ত পারেনি শমিতা। আর খটকা লাগছে আমার ঐখানেই।
খটকা?
হ্যাঁ। শমিতার মত মেয়ের সে কথাটা তো না বোঝার কথা নয়। তবে সে গোড়া থেকেই সতর্ক হল না কেন? কিংবা হয়ত এও হতে পারে, তার নিজের উপরে আত্মবিশ্বাসই তাকে শেষ পর্যন্ত চরম আঘাত হেনেছে।
বুঝলে অরূপ, কিরীটী একটু থেমে বলে, ব্যাপারটা অত্যন্ত জটিল। এবং জেনো, ঐ জটিলতার গিট খুলতে পারলেই তোমার কাছে বর্তমান হত্যারহস্যের সবটুকুই স্পষ্ট হয়ে উঠবে। কিছুই আর ঝাঁপসা অস্পষ্ট থাকবে না, রহস্যাবৃতও মনে হবে না।
গাড়ি ইতিমধ্যে থানার কাছে এসে থেমে গিয়েছিল।
ওরা গাড়ির মধ্যে বসে কথা বলছিল।
আপনি কি বুঝতে পেরেছেন মিঃ রায়, গগনবিহারীর হত্যাকারী কে? হঠাৎ ঐ সময় প্রশ্ন করে অরূপ।
অনুমান করতে পেরেছি বৈকি কিছুটা।
তবে কি শমিতা দেবীই?
এটা অবিশ্যি মিথ্যে নয় যে, কোন কিছুর প্রতিদ্বন্দ্বিতায় হেরে গেলে প্রত্যেক পুরুষ ও নারীই তখন কিছুটা হিংস্র হয়ে ওঠে ঠিকই এবং কাউকে হত্যা করতে হলে বিকৃত একটা মনোবলের প্রয়োজনও হয়। কিন্তু বর্তমান হত্যার ব্যাপারটা–অর্থাৎ যেভাবে নিহত হয়েছেন। গগনবিহারী–সেটার কথা ভুললে তো তোমার চলবে না অরূপ। কে হত্যা করেছে তাঁকে সে কথাটা চিন্তা করার আগে তোমাকে চিন্তা করতে হবে কার পক্ষে গতরাত্রে গগনবিহারীকে হত্যা করা সম্ভব ছিল এবং হত্যার উদ্দেশ্যটাও সেই সঙ্গে মনে রাখতে হবে। নচেৎ ভুলপথে তুমি গিয়ে পড়বে। ভাল কথা, রামদেওর কোন সংবাদ পেলে?
না।
আর একটা কথা—
বলুন?
সুবীরবাবুর জবানবন্দিটা ও সেই সঙ্গে শমিতা দেবীর ও রুক্মিণীর জবানবন্দিটারও ভাল করে খোঁজখবর নাও। কারণ আমার ধারণা ওরা তিনজনেই মিথ্যে বলেছে।
শমিতা দেবী যে মিথ্যে বলেছেন সে তো বুঝতেই পারছি। কিন্তু সুবীরবাবু আর রুক্মিণী–
কেউই সব সত্যি প্রকাশ করেনি।
রামদেওটার খোঁজ পেলে হয়ত অনেক কিছুই জানা যাবে।
খোঁজ পেলেও জেনো, সেও হয়তো সহজে মুখ খুলবে না। শোন অরূপ, আরও একটা কাজ তোমায় করতে হবে।
বলুন।
ভাল করে খোঁজ নিয়ে দেখ সত্যিই গগনবিহারী কোন উইল করে গিয়েছেন কিনা? তাঁর আইন–পরামর্শদাতা কে ছিলেন? তাঁর খোঁজ পেলে হয়তো তাঁর কাছেই খোঁজটা পাবে। সত্যিই যদি উইল একটা হয়ে থাকে তো জেনো এই হত্যা-মামলায় সেই উইলের একটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্থান আছে। কিন্তু আর না। আজ চলি–রাত অনেক হল।
ভাবছি ঐ রুক্মিণীকে অ্যারেস্ট করে থানায় নিয়ে আসব। ও মাগী নিশ্চয়ই জানে রামদেও কোথায় গিয়েছে বা আছে।
তাড়াহুড়ো করে কিছু করো না। ঘটনাকে তার স্বাভাবিক গতিতেই চলতে দাও। ঘটনার স্বাভাবিক গতি আপনা থেকে অনেক কিছুই জানিয়ে দেয়। ঘটনার ধর্মই তাই।
অতঃপর অরূপ গাড়ি থেকে নেমে গেল।
আর ওরা কিরীটীর গৃহের দিকে চলল।
.
যোগজীবন পাথরের মতই যেন বসেছিলেন।
কিরীটীর শেষ কথাগুলো ও শমিতার ঐ ধরনের ব্যবহার যোগজীবনকে যেন অকস্মাৎ একটা পাহাড়ের চূড়া থেকে ধাক্কা দিয়ে নীচে ফেলে দিয়েছিল।
একমাত্র বোন ঐ শমিতা। বয়সেও তাঁর চাইতে অনেক ছোট ও বলতে গেলে সন্তানের মতই। চিরদিনই তাই একটু বেশী প্রশ্রয় ও ভালবাসাই সে পেয়ে এসেছে যোগজীবনের দিক থেকে। ভালবেসে নিজের পছন্দমত বিয়ে করেছিল শমিতা এবং সে বিবাহে তাই কোন বাধা দেননি যোগজীবন।
ভালবাসার বিবাহবন্ধনও টিকলো না, ডিভোর্স হয়ে গেল।
ঘর ভেঙে গেল।
প্রথমটায় ভেবেছিলেন যোগজীবন সব দোষটাই বুঝি শমিতার স্বামী অমলেন্দুরই। সে-ই নিশ্চয়ই মানিয়ে নিতে পারেনি–যার ফলে ভালবাসার বন্ধনটাও ছিঁড়ে গেল। তাছাড়া কে-ই বা আপনজনের দোষ দেখে বা দেখতে চায়! তাই শমিতার দিক থেকে যে কোন দোষ থাকতে পারে সেটা তিনি ভাবতেই চাননি।
ভুলটা ভাঙতে যোগজীবনের খুব দেরি হল না। স্বামীর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করে শমিতা তাঁর গৃহে এসে উঠবার পর কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলেন অমলেন্দুর দোষ যতটুকুই থাকুক না কেন বিচ্ছেদের ব্যাপারে ঘর বেঁধে কোথাও সুখে বাস করবার মেয়ে নয় শমিতা।
আত্মসুখপরায়ণ, উচ্ছল, বিলাসী জীবনের প্রতিই ঝোঁক বেশী শমিতার।
মনে মনে দুঃখ পেয়েছিলেন যোগজীবন, কিন্তু তবু মুখে কিছু বলতে পারেননি।
শমিতা চাকরি করে। সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত ক্লাবে হৈ-হৈ করে কাটায়, সেখানে মদ্যপানও করে। কোনটাই তাঁর পছন্দ ছিল না, কিন্তু তবু বোনকে মুখ ফুটে কিছু বলেননি।
ইদানীং গগনবিহারীর সঙ্গে অতিমাত্রায় ঘনিষ্ঠতার কথাটাও যে কানে আসেনি তাঁর তাও নয়, সেটাও তাঁর কানে এসেছিল এবং তার জন্য শমিতার উপরে যতটা নয় তার চাইতে বেশী বিরক্ত হয়েছিলেন যোগজীবন গগনবিহারীর উপরেই।
ইচ্ছা হয়েছিল দু-একবার গগনকে কথাটা বলেন–গগন, ব্যাপারটা বড় দৃষ্টিকটু লাগছে–কিন্তু তাও বলেননি।
সমস্ত ব্যাপারটার কুশ্রীতা তাঁর রুচিবোধকে পীড়িত করলেও কেন যেন মুখ ফুটে কাউকেই কিছু বলতে পারেননি।
তাঁর সহজ সৌজন্য ও স্বাভাবিক রুচিবোধ তাঁকে নিরস্ত করেছে।
কিন্তু আজ কিরীটী যা স্পষ্ট করে সবার সামনে বলে গেল, তারপর লজ্জায় যেন মাথাটা আর তিনি তুলতে পারছিলেন না। কেবলই মনে হচ্ছিল, ছিঃ ছিঃ ছিঃ!
একেই তো আত্মীয়স্বজনরা সব সময়েই নানা ধরনের ইঙ্গিত করে শমিতার চরিত্র সম্পর্কে। এই ব্যাপার জানাজানি হবার পর তারা নিন্দায় পঞ্চমুখ হয়ে উঠবে এবার নিশ্চয়ই।
হঠাৎ চমক ভাঙল যোগজীবনের পদশব্দে। দেখলেন সাজগোজ করে শমিতা বের হয়ে যাচ্ছে।
উঠে দাঁড়ালেন যোগজীবন। ডাকলেন, শমি!
শমিতা ঘুরে দাঁড়াল।
এত রাত্রে কোথায় আবার বেরুচ্ছ?
দরকার আছে–শমিতা বললে।
যতই দরকার থাক এখন যেও না এই রাত্রে।
কি ব্যাপার বল তো দাদা? রাত্রে কি আজ আমি প্রথম বেরুচ্ছি? শমিতা একটু যেন ক্ষুণ্ণ হয়েই প্রশ্নটা করে।
যা বললাম তাই শোন। যোগজীবনের কণ্ঠস্বর গম্ভীর।
আমার কাজ আছে বলে আর দাঁড়াল না শমিতা। সদর গেটের দিকে বারান্দা দিয়ে এগিয়ে চলল।
যা ইতিপূর্বে কখনও হয়নি, যোগজীবন যেন দপ্ করে জ্বলে উঠলেন। কঠিন কণ্ঠে ডাকলেন, শোন শমিতা! দাঁড়াও!
শমিতা ঘুরে দাঁড়াল এবারে।
বারান্দার আলো শমিতার সঙ্গে পড়েছে। পরনে একটা দামী শাড়ি ও গায়ে একটা অনুরূপ ব্লাউজ। সাধারণতঃ যেভাবে বেশভূষা করে শমিতা বের হয় সেই রকমই বেশভূষা, হাতে একটা ব্যাগ। পায়ে ফ্ল্যাট-হীল জুতো।
আমি বারণ করলুম বেরুতে তবু বের হবে?
কয়েক পা এগিয়ে এসেছেন যোগজীবন তখন ওর সামনে।
আমার কাজ আছে বললাম তো।
না। এখন তোমার বেরুনো হবে না! পূর্ববৎ কঠিন কণ্ঠস্বর যোগজীবনের।
শমিতা যোগজীবনের মুখের দিকে তাকাল। শমিতার মুখটা কঠিন হয়ে উঠেছে। সে শান্ত গলায় যোগজীবনের মুখের দিকে তাকিয়ে বলল, আমাকে বেরুতেই হবে।
না! তোমার অনেক উচ্ছঙ্খলতাই আমি সহ্য করেছি এতদিন, আর আমি সহ্য করব না। বেরুনো তোমার হবে না। আর আমার কথা অমান্য করে তুমি যদি বের হও তো জানবে–
বল। থামলে কেন? তাহলে কি?
আমার এখানে আর থাকা চলবে না।
শমিতা স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কয়েকটা মুহূর্ত তার গলা দিয়ে কোন স্বরই বের হয়।
না। কেবল অপলক চেয়ে থাকে যোগজীবনের মুখের দিকে। তারপর ধীরে ধীরে বলে, বেশ, তাই হবে। আমি এখুনি তোমার বাড়ি থেকে চলে যাচ্ছি।
শমিতা কথাগুলো বলে আর দাঁড়াল না। সোজা সিঁড়ি বেয়ে পরক্ষণেই ফ্ল্যাট–হীল জুতোর খটখট শব্দ তুলে উপরে চলে গেল।
তিনতলায় নিজের ঘরে ঢুকে একটা সুটকেস টেনে নিয়ে ক্ষিপ্র হাতে কিছু জামাকাপড় ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসগুলো সুটকেসের মধ্যে ভরে আলমারি খুলে টাকা নিয়ে সুটকেসটা হাতে ঝুলিয়ে আবার সিঁড়ি দিয়ে নিচে নেমে এল।
যোগজীবনের সামনে দিয়েই খটখট করে ফ্ল্যাট-হীল শব্দ তুলে শমিতা বের হয়ে গেল।
যোগজীবন দাঁড়িয়ে রইলেন। একটি কথাও আর বললেন না।
শমিতার জুতোর শব্দটা ক্রমশঃ মিলিয়ে গেল।
সহসা যোগজীবনের চোখের কোল দুটো যেন জ্বালা করে ওঠে। দরজাটায় খিল তুলে দিয়ে যোগজীবন এসে আবার বাইরের ঘরের সোফাটার উপর বসলেন।
যোগজীবনের মনে পড়ে স্ত্রী প্রভাবতীর কথা ঐ মূহর্তে। বলতে গেলে শমিতা তাঁর সন্তানের বয়েসী–মা–বাবার শেষ বয়েসের সন্তান।
যোগজীবনের অনেক বছর পরে শমিতা জন্মেছিল। প্রভাবতী তখন বৌ হয়ে ওঁদের বাড়িতে এসেছেন–তাঁর একটি কন্যাসন্তানও হয়েছে।
শমিতার জন্মের পরই তাঁর মা যে শয্যা নিয়েছিলেন, আর উঠে বসেননি। চার বৎসর। রোগভোগের পর মারা গিয়েছিলেন। তার পরের বৎসর যোগজীবনের বাবারও মৃত্যু হয়।
স্ত্রীকে অত্যন্ত ভালবাসতেন যশোদাজীবন। যোগজীবনের বাবা স্ত্রীর মৃত্যুর শোকটা সামলে উঠতে পারলেন না। |||||||||| শমিতার সকল দায়িত্ব এসে পড়ল ওঁদেরই উপর। বাচ্চা শমিতা মাত্র চার বছরের মেয়ে তখন।
যোগজীবনের নিজের প্রথমা কন্যা-সন্তানের চাইতেও দু বছরের ছোট বয়সে।
পিসি ভাইঝি একসঙ্গে মানুষ হতে থাকে। মাঝখানে প্রভাবতীর আর একটি সন্তান হয়েছিল, কিন্তু মৃত। প্রভাবতীর আর কোন সন্তান হয়নি।
কন্যা সবিতার সঙ্গেই নামে নাম মিলিয়ে প্রভাবতী ছোট্ট ননদিনীর নাম রেখেছিলেন শমিতা।
সবিতার যখন সতেরো বছর বয়স তখন বিবাহ হয়ে গেল। লেখাপড়ায় তার মন ছিল না–লেখাপড়া সে করেনি। কিন্তু অসাধারণ বুদ্ধিমতী ছিল শমিতা।
শমিতা তখন স্কুল ফাইনাল পাস করে আই. এ. পড়ছে কলেজে।বিবাহের পর সবিতাকে তার স্বামী সঙ্গে করে সুদূর মালয় দেশে চলে গেল।
শমিতারও বিয়ের চেষ্টা করছিলেন যোগজীবন কিন্তু শমিতা বেঁকে বসল। বললে, না, বি. এ. পাস না করে সে বিবাহ করবে না।
প্রভাবতী বললেন, আহা থাক। সবিতার বিয়ে হয়েছে, কোথায় কোন্ দূর দেশে চলে গেছে। দু বছর তিন বছরের আগে আসবেও না। থাক, ওর বয়েসই বা এমন কি হয়েছে? পাস–টাস করুক, তারপর না হয় বিয়ে দেওয়া যাবে।
শমিতা যখন এম. এ পড়ছে সেই সময় হঠাৎ স্ট্রোকে প্রভাবতী মারা গেলেন। শমিতা এম. এ পাস করল, তারপর এক বেসরকারী কলেজে অধ্যাপিকার কাজ নিল।
যোগজীবন মধ্যে মধ্যে বিয়ের কথা বলতেন কিন্তু জোরজারি করতেন না। কারণ মৃত্যুর সময় প্রভাবতী স্বামীকে বলে গিয়েছিলেন, বিয়ের ব্যাপারে ওকে যেন চাপাচাপি না করা হয়। সেটাও এক কারণ ছিল আর শমিতা চলে গেলে একা পড়বেন, তাও এক কারণ ছিল।
তারপর হঠাৎ একদিন শমিতা অমলেন্দুকে সঙ্গে করে এনে তাঁর সামনে দাঁড়াল। তার এক সহকর্মী বান্ধবীর ভাই।
ভাল বংশের ছেলে, শিক্ষিত, ভাল চাকরি করে। দেখতেও সুশ্রী।
ইদানীং শমিতার ব্যাপারে একটু চিন্তিতই যেন হয়ে উঠেছিলেন যোগজীবন। শমিতার স্বভাবের মধ্যে কেমন যেন একটা উচ্ছলতা দেখা দিয়েছিল। তার চাল–চলনে, বেশভূষায়–সব কিছুতেই।
এমন কি বোনের বেশভূষার দিকে তাকাতেও যেন যোগজীবনের কেমন লজ্জা হত।
কিন্তু তবু কিছু তিনি বলেননি কোনদিন বোনকে।
কেমন যেন মায়া হয়েছে, কেমন যেন একটা সংকোচ বোধ করেছেন।
ঐ ঘটনার বছরখানেক আগে রিটায়ার করেছিলেন যোগজীবন কাজ থেকে।
শমিতা অমলেন্দুকে দেখিয়ে বললে, তাকে বিবাহ করবে। তারা পরস্পর পরস্পরকে কথা দিয়েছে।
যদিও এক জাত নয় তথাপি যোগজীবন সে বিবাহে অমত করেননি শমিতা সুখী হবে ভেবে।
বিবাহ হয়ে গেল।
শমিতা একদিন চলে গেল স্বামীর ঘরে।
কলকাতায় এক বনেদী অবস্থাপন্ন পরিবারের ছেলে অমলেন্দু। কলকাতাতেই শ্যামবাজার অঞ্চলে বাস করে। মধ্যে মধ্যে দুজনে আসত যোগজীবনের সঙ্গে দেখা করতে।
যোগজীবন তখন নিজের বাড়ির একতলাটা ভাড়া দিয়ে দিয়েছেন। কিন্তু শমিতা এসে মধ্যে মধ্যে দু’একদিন থাকত বলে তিনতলাটা ভাড়া দেননি। সেটা খালিই পড়ে ছিল।
দুটো বছরও গেল না বিবাহের পর, ডিভোর্স হয়ে গেল শমিতা ও অমলেন্দুর।
শমিতা যোগজীবনের কাছে ফিরে এল আবার এক শীতের মধ্যরাত্রে।
সেই সময়ই শমিতা মরালী সঙঘ নামে ক্লাবটা গড়ে তোলে। এবং কিছুদিন পরে শমিতা আবার চাকরি নিল অন্য একটা কলেজে।
ডিভোর্স করে ফিরে আসবার পর যেন শমিতা আরও বেশী উজ্জ্বল হয়ে উঠতে লাগল দিনকে দিন।
ক্লাব, পার্টি, হৈ–চৈ, নানা ধরনের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান–সর্বক্ষণ ঐ সব নিয়েই মেতে রইল।
যোগজীবন মনে মনে ভাবলেন, আহা থাক। যাতে সুখী হয় তাই করুক।
কিন্তু এই মুহূর্তে মনে হচ্ছে যোগজীবনের, সেদিন অমন করে রাশটা ছেড়ে না দিলে বোধ হয় এত বড় কলঙ্ক তাঁকে মাথায় নিতে হত না।
যাক চলে গিয়েছে, ভালই হয়েছে।
আর শমিতার মুখদর্শনও তিনি করবেন না।
১০. শমিতা বাড়ি থেকে বের হয়ে
শমিতা বাড়ি থেকে বের হয়ে কিছুদূর হাঁটতেই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গেল। তখন রাত প্রায় দশটা।
ট্যাক্সিওয়ালা শুধায়, কিধার যায়গা মাঈজী?
গড়িয়া চল। শমিতা বললে।
ট্যাক্সিতে উঠেই মনে পড়েছিল বান্ধবী সর্বাণীর কথা। কলেজজীবনে অনেক মেয়ের সঙ্গে বন্ধুত্ব হয়েছিল শমিতার, কিন্তু ঘনিষ্ঠতা বলতে বা সত্যিকারের বন্ধুত্ব বলতে একজনের সঙ্গেই গড়ে উঠেছিল–সর্বাণী।
এম, এ ফিফথ ইয়ারে পড়তে পড়তেই সর্বাণীর বিবাহ হয়ে গিয়েছিল।
সর্বাণীর স্বামী শিশিরাংশু একজন অধ্যাপক। শান্তশিষ্ট গোবেচারা মানুষটি। বেঁটেখাটো বোগা। ছোটবেলায় মা-বাপকে হারিয়ে শিশিরাংশু মামা-মামীর কাছেই মানুষ।
দুটো সাবজেক্টে এম. এ পাস। দুটোতেই প্রথম শ্রেণী। কাজেই একটা অধ্যাপনার কাজ জুটিয়ে নিতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি তার।
অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে ডক্টরেটের জন্য প্রস্তুত হচ্ছিল শিশিরাংশু।
কম ভাড়ায় বেশ ভোলামেলা চার কামরার ভালো একটা দোতলা বাড়ির একতলাটা গড়িয়ায় পেয়ে শিশিরাংশু সেখানেই উঠে গিয়েছিল ভবানীপুরের ঘিঞ্জি ছোট ঘোট দুটো ঘর ছেড়ে দিয়ে।
দুটি বাচ্চা–একটি ছেলে, একটি মেয়ে।
কলেজ, ক্লাব, পাটি, নানা সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান করতে করতে হঠাৎ এক-আধদিন যখন একটা ক্লান্তি আসতো শমিতার–সে চলে যেত সর্বাণীর ওখানে। তিন-চার ঘণ্টা সেখানে কাটিয়ে আসত।
সর্বাণী বলেছে, কি রে, হঠাৎ সূর্য কোন দিকে উঠল?
শমিতা হাসতে হাসতে বলেছে, সূর্যোদয় আজ পর্যন্ত জীবনে কখনও দেখবার সৌভাগ্য হয়েছে বলে মনে পড়ে না, কাজেই আজ যদি অন্য দিকে সূর্য উঠেও থাকে জানতে পারিনি।
তা এভাবে ছুটোছুটি না করে একটা বিয়ে কর না! সর্বাণী বলেছে।
কাকে রে? পাত্র হাতে আছে নাকি তোর? শমিতা বলেছে।
কি রকমটা চাই বল? এখুনি খুঁজে এনে দেব। তোর জন্য আবার পাত্রের অভাব?
বলিস কি? আজকাল কি তুই তাহলে ঘটকীর প্রফেশন নিয়েছিস?
নেব ভাবছি–অন্ততঃ তোর জন্য। সর্বাণী জবাবে বলেছে।
আহা রে–মরে যাই! এমনি না হলে বন্ধু!
তারপর বিবাহের পর একদিন নয়, চার–পাঁচদিন গিয়েছিল শমিতা অমলেন্দুকে নিয়েই সর্বাণীর ওখানে।
সর্বাণী জিজ্ঞাসা করেছে, কেমন লাগছে?
নো থ্রিল। তোর কথা শুনে মধ্যে মধ্যে ভেবেছি, না জানি কি একটা থ্রিল আছে বিবাহিত জীবনের মধ্যে!
বলিস কি?
সত্যি। আমি তো বুঝতে পারি না তোরা কি করে মশগুল হয়ে আছিস!
ন্যাকা!
না ভাই, একবর্ণও মিথ্যে বলছি না।
তাই বুঝি দেখা দিস না?
আগেই বা দেখা কত ঘন ঘন দিতুম যে আজ বিরলা হয়ে উঠেছি!
তারপরই হঠাৎ একদিন সর্বাণী জানতে পেরেছিল শমিতাদের ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। জানতে পেরেছিল সর্বাণী শমিতার একটা চিঠিতেই। শমিতাই লিখেছিল তাকে–
সর্বাণী, ডিভোর্স হয়ে গেল অমলেন্দুর সঙ্গে। দাদার এখানে ফিরে এসেছি। চাকরির একটা সন্ধান করছি। কি রে, চিঠিটা পড়ে তোর খুব অবাক লাগছে তো!
কিন্তু তুই বিশ্বাস করবি কিনা জানি না, সাত-আট মাস বিয়ের পরে যেতে-না-যেতেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম ঐ শাসন আর বিধিনিয়মের বন্ধনের চৌহদ্দির মধ্যে বিশ্রী ক্লান্তিকর একটা একঘেয়েমির মধ্যে থাকা আর যার পক্ষেই সম্ভব হোক আমার পক্ষে সম্ভবপর হবে না। শুধু কি তাই, সর্বক্ষণই যেন একটা সন্দেহের কাঁটা কি কি করে বিঁধছে। তাই ও পাট চুকিয়ে দিলাম। দেখা হলে সবিস্তারে তোকে বলতেই হবে–তখনই শুনিস। এই পত্রে আর লিখলাম না। শুধু সংবাদটা দিলাম–ইতি তোদের
শমিতা সান্যাল
স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল সর্বাণী শমিতার চিঠিটা পড়ে। কোন জবাব দেয়নি সে চিঠির।
তারপর আরও দুটো বছর কেটে গিয়েছে। এই দু বছরে কিন্তু একদিনও দেখা–সাক্ষাৎ আর হয়নি ওদের।
চলন্ত গাড়ির মধ্যে বসে বসে ভাবছিল শমিতা–সেই চিঠির কোন জবাব দেয়নি সবণিী!
সেও অবিশ্যি আর কোন চিঠি দেয়নি। যায়ওনি এই দু বছরের মধ্যে একটি দিনের জন্যে সর্বাণীদের ওখানে।
সর্বাণীদের ওখানে তো সে চলেছে! সর্বাণী তাকে কেমন ভাবে গ্রহণ করবে কে জানে! বিশেষ করে দুই বৎসরেরও অধিক সময় পরে হঠাৎ আজ রাত্রে যাই সে করুক একটা রাত্রির মত আশ্রয় কি সে তাকে দেবে না! দেবে নিশ্চয়ই। কাল সে যা হোক একটা থাকবার ব্যবস্থা করে নিতে পারবে যেখানেই থোক।
প্রায় দশটা চল্লিশ নাগাদ শমিতার ট্যাক্সিটা এসে সর্বাণীদের বাড়ির দরজায় থামল। রাত্রের আহারাদি সর্বাণীদের তখনও হয়নি। শিশিরাংশু তখনও বাইরের ঘরে বসে তার কাগজপত্র নিয়ে কি সব লিখছিল, সর্বাণী ভিতরের ঘরে ছিল।
ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিয়ে সুটকেসটা হাতে ঝুলিয়ে কলিং বেলটা টিপতেই কলিং-বেলের শব্দে সর্বাণীই এসে দরজা খুলে দেয়, এবং বলাই বাহুল্য অত রাত্রে এত দিন পরে একটা সুটকেস হাতে দরজার সামনে আবছা আলো-আঁধারিতে হঠাৎ শমিতাকে দেখে সে প্রথমটায় ঠিক চিনে উঠতে পারে না তাকে।
বলে, কে? কণ্ঠে সর্বাণীর একটা সংশয়।
সর্বাণী, আমি শমিতা–বললে শমিতা।
শমিতা! কি ব্যাপার? এত রাত্রে! সর্বাণী যেন কেমন একটু দ্বিধাগ্রস্ত ভাবেই বলে।
সুটকেসটা হাতে ঝুলিয়েই ঘরের মধ্যে পা দিল শমিতা।
কি ব্যাপার? শমিতার দিকে তাকিয়ে বিস্ময়ের সঙ্গে প্রশ্ন করে সর্বাণী। হাতে সুটকেস, কোথা থেকে আসছিস?
ইতিমধ্যে পাশের ঘর থেকে শিশিরাংশুও উঠে এসেছিল, কে, সবি!
কিন্তু পরক্ষণেই ঘরের আলোয় শমিতাকে দেখে শিশিরাংশুও চিনতে পারে তাকে। বলে, একি শমিতা দেবী, এত রাত্রে?
হ্যাঁ। যাক চিনতে পেরেছেন তাহলে আপনি আমায়! আমার বান্ধবী তো চিনতেই পারেনি। বলতে বলতে শমিতা হাতের সুটকেসটা একপাশে নামিয়ে রেখে একটা বেতের সোফার উপর বসে পড়ে বলে, শোন্ সর্বাণী, আজ রাতটা তোর এখানে আমি থাকতে চাই।
শিশিরাংশু বলে ওঠে, নিশ্চয়ই থাকবেন। আজকের রাতই বা কেন–যত দিন খুশি থাকুন না।
শিশিরাংশু উচ্ছ্বসিত অভ্যর্থনা জানালেও সর্বাণী যেন কেমন স্তব্ধ হয়ে শমিতার মুখের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল। সে কোন কথাই বলে না। তার চোখে-মুখে অভ্যর্থনার কোন
আনন্দই নেই যেন। শমিতার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি ব্যাপারটা এড়ায় না।
তাই সে একটু হেসে সর্বাণীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলে ওঠে, আজকের রাতটা ভাই, কাল সকালেই চলে যাব।
শিশিরাংশুই আবার বলে, আপনি এত কিন্তু-কিন্তু করছেন কেন শমিতা দেবী?
কিন্তু বেশী কিছু আর বলতে পারে না শিশিরাংশু, হঠাৎ তার স্ত্রীর মুখের দিকে নজর পড়ায়। একটু যেন বিব্রতই বোধ করে–বলে,সবি, ওকে তোমার ঘরে নিয়ে যাও। আমার সামান্য দেরি আছে।
শিশিরাংশু ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
শমিতা বললে, আমি বোধ হয় হঠাৎ এভাবে এই রাত্রে তোর এখানে এসে পড়ে তোকে একটু বিব্রত করলাম সর্বাণী, তাই না?
কোথা থেকে আসছিস? এতক্ষণে সর্বাণী আবার কথা বলে।
দাদার বাড়ি থেকে চলে এলাম।
চলে এলি মানে?
সে-সব অনেক কথা। দু’কথায় শেষ হবে না। দাদার ওখান থেকে বের হয়ে কোথায় যাই এত রাত্রে ভাবতে গিয়ে তোর কথাই মনে পড়ল তাই সোজা তোর এখানেই চলে এলাম।
অবিশ্যি কাল সকালেই চলে যাব।
চল ঐ ঘরে। বলে শমিতাকে নিয়ে পাশের ঘরে এসে সর্বাণী ঢুকল।
একটা আরাম–কেদারায় শমিতা বসল।
দাদার সঙ্গে ঝগড়া করেছিস? সর্বাণী আবার জিজ্ঞেস করে।
না রে।
তবে?
প্লীজ সর্বাণী, এখন কোন কথা নয়। পরে তোকে সব বলব।
সর্বাণী আর কোন প্রশ্ন করে না। কেমন যেন একটু অন্যমনস্ক ভাবে অন্যদিকে তাকিয়ে থাকে।
একজন সোফায় বসে, অন্যজন অল্প দূরে দাঁড়িয়ে। কারো মুখেই আর যেন কথা নেই। ওদের দেখে মনে হয় কেউ যেন আর বলার মত কিছু খুঁজে পাচ্ছে না।
যদিও দুজনেই মনে মনে চাইছিল একজন কেউ বলুক যা দুজনেই শুনতে চায়। অথচ দুজনের মধ্যে কি গভীর বন্ধুত্বই না ছিল একসময়!
মাত্র মাঝখানে দুটো বছরের অদর্শন। সময়টা কি এতই দীর্ঘ যে তাদের উভয়কে ঘিরে যে উত্তাপটা দুজনের মনের মধ্যে একসময় ছিল সেটা একেবারেই মিইয়ে গিয়েছে!
সর্বাণী।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করে ডাকল শমিতাই অবশেষে, কারণ সে সত্যিই যেন বেশ অস্বস্তি বোধ করছিল।
কিছু বলছিলি? সর্বাণী বান্ধবীর দিকে মুখ তুলে তাকাল।
মনে হচ্ছে তোকে খুব অসুবিধায় ফেললাম, তাই না রে! কথাটা বলে সর্বাণীর মুখের দিকে চেয়ে শমিতা হাসবার চেষ্টা করে।
না, অসুবিধা কি? কথাটা যেন নেহাৎ সৌজন্যের খাতিরেই বলার মত করে বললে সর্বাণী।
তা ফেলেছি বৈকি। সত্যি, আমি ভেবেছিলাম–যাক গে, শুধু আজকে রাতটা তোদের বাইরের ঘরে সোফাটার উপরে বসেই আমি কাটিয়ে দিতে পারব। আমি ঐ ঘরেই যাচ্ছি, বুঝলি?
শমিতা উঠে দাঁড়াল সুটকেসটা হাতে নিয়ে এবং ধীরে ধীরে সত্যি–সত্যিই একটু আগে যে ঘর থেকে বের হয়ে এসেছিল সেই ঘরের দিকেই পা বাড়াল।
তোকে ব্যস্ত হতে হবে না শমিতা। এক রাত্রের জন্য ব্যবস্থা হয়েই যাবে একটা। তুই বস।
শমিতা সর্বাণীর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে, না রে, কিছু অসুবিধা হবে না আমার সত্যিই। তুই ব্যস্ত হোস না।
শমিতা পাশের ঘরটার মধ্যে চলে গেল। ঘরটার মধ্যে তখনও আলো জ্বলছিল। শমিতা একটু আগে যে সোফাটার উপর বসেছিল সেই সোফাটার উপরেই এসে বসল দরজাটা টেনে দিয়ে।
সর্বাণী তখনও পাশের ঘরে দাঁড়িয়ে আছে।
রটা ঘোট। একধারে একটি ডাইনিং টেবিল–তার পাশে ছোট একটা ফ্রিজ।
খানচারেক চেয়ার আর ক্যাম্বিসের একটা আরামকেদারা। ঐ ঘরেরই সংলগ্ন একদিকে বাথরুম, অন্যদিকে কিচেন।
সামনে পাশাপাশি দুটো শোবার ঘর। একটাতে সর্বাণী তার মেয়েছেলেদের নিয়ে শোয়, অন্যটায় শিশিরাংশু শোয়।
খুশি হয়নি আদৌ সর্বাণী অত রাত্রে শমিতার আকস্মিক আবির্ভাবে। তার কারণও ছিল। শমিতা কথা বলছিল আর মুখ থেকে যে গন্ধটা বেরুচ্ছিল সেটা যে মদের গন্ধ সর্বাণীর সেটা বুঝতে দেরি হয়নি।
দুই বন্ধুর মধ্যে দেখাশুনা না হলেও ইদানীং দুই বৎসর সর্বাণী মধ্যে মধ্যে শমিতার বর্তমান উচ্ছল জীবনের খবর পেত এর-ওর মুখ থেকে। এবং শমিতা যে ক্লাবে ও হোটেলে গিয়ে পুরুষ-বন্ধুদের নিয়ে হৈচৈ করে মদ্যপান করে–খবরটা দিয়েছিল কিছুদিন আগে তারই আর এক বান্ধবী রমলা।
রমলা ঐ শ্রেণীর মেয়ে না হলেও, তার বড় চাকুরে স্বামী ও তার বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মধ্যে মধ্যে হোটেলে যেত ডিনার খেতে।
সে-ই দেখেছিল শমিতাকে।
বলেছিল, লেখাপড়ায় অত ভাল মেয়েটা, তার যে এতদূর অধঃপতন ঘটেছে ভাবতে পারিনি সর্বাণী। যেমন বিশ্রী পোশাক তেমনি নোংরা চালচলন। বরাবরই ও অবিশ্যি একটু চপল ও উচ্ছল প্রকৃতির ছিল।
সত্যি বলছিস? সর্বাণী শুধিয়েছিল। নিজের চোখেই যে দেখলাম রে! তাছাড়া কি এক ক্লাব করেছে মরালী সঙ্ঘ না কি–সেখানে শুনেছি একগাদা পুরুষ-মেয়ে জুটে মাঝরাত্তির পর্যন্ত বেলেল্লাপনা করে। আমার স্বামী সুহৃদ কি বলছিল জানিস?
কি?
ও একটা বেশ্যা। তা সত্যিই তো, বেশ্যা ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে! এককালে তো তোর সঙ্গে গলায় গলায় ভাব ছিল, আসে না এখানে?
না।
ছিঃ ছিঃ, ডিভোর্স করে স্বামীটাকে ছেড়ে এসে একটা স্বৈরিণীর জীবনযাপন করছে! ঐজন্যই বোধ হয় ডিভোর্স করেছে!
সর্বাণী কোন কথা বলেনি।
রমলার কথাগুলোই মনে পড়েছিল সর্বাণীর ঐ মুহূর্তে।
হঠাৎ শিশিরাংশুর কণ্ঠস্বরে সর্বাণীর চমক ভাঙে, কই, তোমার বান্ধবী কোথায় সবি? এক কাজ কর। আমার ঘরটায় ওঁর থাকবার ব্যবস্থা করে দাও বরং। খেয়েদেয়ে এসেছেন কিনা জিজ্ঞাসা করেছিলে?
না।
দেখ যদি না খেয়েদেয়ে এসে থাকেন–কিন্তু কোথায় তিনি?
বাইরের ঘরে।
যাও। দেখ খেয়ে এসেছেন কিনা।
ধীরে ধীরে কিছুটা চাপা গলায় সর্বাণী বললে, বোধ হয় খেয়েদেয়েই এসেছে।
তাহলেও একবার জিজ্ঞাসাটা করা দরকার। যাও।
ভাবছিলাম এক কাজ করলে হয় না? অন্য কথা পাড়ল সর্বাণী স্বামীর কথার জবাব না দিয়ে।
কি?
যে ফোলডিং ক্যাম্প-খাটটা আছে সেটাই বাইরের ঘরে পেতে ওকে শোয়ার ব্যবস্থা করে দিলে হয় না?
না, না–সেটা ভাল দেখাবে না।
কেন? ভাল দেখাবে না কেন?
হাজার হোক তোমার সহপাঠিনী—বান্ধবী।
তাতে কি হয়েছে? কবে কলেজে কটা দিন একসঙ্গে পড়েছিলাম! এমন কি সম্পর্ক–যে কথাটা স্বামীর মুখের দিকে তাকিয়েই বোধ হয় শেষ করতে পারল না সর্বাণী।
কিন্তু তার গলায় যে চাপা উষ্মটা প্রকাশ পেল সেটা সেই মুহূর্তে শিশিরাংশুর মত লোককেও যেন বিস্মিত করে দিয়েছিল।
সে বলে, আঃ সর্বাণী, কি বলছ তুমি?
ঠিকই বলছি।
আঃ, চুপ কর। থামিয়ে দেয় শিশিরাংশু স্ত্রীকে। যাও, দেখ উনি কি করছেন।
স্বামীর কথায় সর্বাণীও যেন এতক্ষণে খানিকটা সংবিৎ ফিরে পায়। নিজের রূঢ় আচরণে খানিকটা থমকে যায়।
সর্বাণী ভেজানো দরজাটা ঠেলে পাশের ঘরে পা দেয়।
১১. ঘরে পা দিয়ে থমকে দাঁড়ায় সর্বাণী
ঘরে পা দিয়ে কিন্তু থমকে দাঁড়ায় সর্বাণী।
ঘরটা অন্ধকার। আলো নেভানো।
একটু ইতস্তত করে সর্বাণী, অন্ধকার ঘরের মধ্যে দাঁড়ায় মুহূর্তের জন্য। তারপরই মৃদুকণ্ঠে ডাকে, শমিতা!
কিন্তু কোন সাড়া আসে না অন্ধকারে।
হাত বাড়িয়ে সর্বাণী সুইচটা টিপে ঘরের আলোটা জ্বেলে দিল। ঘরের আলোটা জ্বলে উঠতেই ওর নজরে পড়ল বড় সোফাটার উপরে পা তুলে চোখ বুজে শুয়ে আছে শমিতা। মনে হল ঘুমোচ্ছে।
একটু ইতস্তত করল সর্বাণী। তারপর মৃদুকণ্ঠে ডাকল, শমিতা, এই শমিতা?
কিন্তু সর্বাণীর ডাকে শমিতা চোখও খুলল না, সাড়াও দিল না।
এই শমিতা? ঘুমিয়ে পড়লি নাকি? বেশ মেয়ে তো! এই শমিতা, ওহ!
তথাপি শমিতার কোন সাড়া পাওয়া যায় না।
সর্বাণী তথাপি কিছুক্ষণ শায়িতা শমিতার দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর এক সময় ঘরের আলোটা আবার নিভিয়ে ঘরের বাইরে এসে দরজাটা ভিতর থেকে টেনে দিল।
কি হল? শিশিরাংশু জিজ্ঞাসা করে।
ঘুমিয়ে পড়েছে। সর্বাণী বললে।
ঘুমিয়ে পড়েছে! কোথায়?
সোফাটার উপরই শুয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে।
ছিঃ ছিঃ, দেখ তো কি ভেবেছেন!
কি আবার ভাববে? আর ভাবে ভাবুক। চল, তোমাকে খেতে দিই। বলতে বলতে সবণিী কিচেনে গিয়ে ঢুকল।
শিশিরাংশুকে খাবার পরিবেশন করে দিল, অথচ সর্বাণী বসল না টেবিলে।
শিশিরাংশু জিজ্ঞাসা করে, তুমি খাবে না?
ক্ষিধে নেই–তুমি খাও।
খেতে খেতে শিশিরাংশু একসময় বলে, কাজটা ভাল হল না সবি!
কেন?
তা নয় তো কি! একটা রাতের জন্য ভদ্রমহিলা আমাদের বাড়িতে এলেন–তাছাড়া ঐভাবে কেউ ঘুমোতে পারে নাকি! এদিকে যা মশা–
তা আমি তো আর সোফায় শুয়ে রাত কাটাতে বলিনি।
স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল শিশিরাংশু, সর্বাণী!
কি?
মনে হচ্ছে তুমি যেন হঠাৎ উনি এভাবে তোমার বাড়িতে আসায় ঠিক সন্তুষ্ট হওনি।
নিশ্চয়ই হইনি। কিন্তু কেন?
ওর সব কথা তুমি জান না, ইদানীং ও যেভাবে উচ্ছঙ্খল জীবনযাপন করছিল—
কথাটা তোমার আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না সর্বাণী।
পরে বলব, এখন খেয়ে নাও।
কিন্তু—
আচ্ছা, তুমি কি কিছুই টের পাওনি?
কি টের পাব?
কেন, কোন গন্ধ পাওনি ওর মুখে?
কিসের গন্ধ?
ওর মুখ থেকে ভড়ভড় করে মদের গন্ধ বেরুচ্ছিল যখন ও কথা বলছিল! গন্ধ পাওনি তুমি?
সে কি! কই, আমি তো—
আশ্চর্য! তোমার নাকে গন্ধ গেল না? সি ইজ ড্রাঙ্ক! আমার সারাটা গা এখনও বমি–বমি করছে। স্নান না করে আমি শুতে পারব না।
শিশিরাংশু আর কোন কথা বলে না।
একসময় তারপর পাশের ঘরের আলো নিভে গেল। সর্বাণী ও তার স্বামীর কথা আর শোনা যায় না। আরও কিছু পরে শমিতা উঠে বসল সোফাটার ওপরে অন্ধকারে ধীরে ধীরে।
এতক্ষণ ধরে অন্ধকারে মশার কামড়ে চোখ-মুখ জ্বালা করছিল শমিতার। বাকি রাতটুকু ঘুম হবে না। মশার কামড়ের জ্বালা না থাকলেও অবিশ্যি ঘুম আসত না শমিতার চোখে।
দাদা যে তাকে অমন স্পষ্টাস্পষ্টি মুখের উপরেই বলে দিতে পারে তার বাড়িতে আর শমিতার স্থান হবে না ভাবতে পারেনি ও। কাল সকালেই যেখানে হোক একটা ব্যবস্থা থাকার করে নিতেই হবে তাকে। কিন্তু কোথায়? সেটাই ভেবে কোন কূল-কিনারা পায় না শমিতা।
সর্বাগ্রে তাকে একবার সমরেশের সঙ্গে দেখা করতে হবে।
কিন্তু সমরেশের কথা মনে পড়তেই মনটা যেন কেমন একটা বিতৃষ্ণায় ভরে ওঠে শমিতার। তার প্রতি সমরেশের মনোভাবটা জানতে শমিতার বাকি নেই।
আজ যদি সমরেশের কাছে গিয়ে দাঁড়ায়, সমরেশ তার দুর্বলতার সুযোগটা পুরোপুরিই নেবে। সমরেশের বাহুবন্ধনে তাকে ধরা দিতেই হবে। অথচ মনের দিক থেকে এতটুকু সাড়া না মিললেও, সমরেশ ছাড়া এই মুহূর্তে আর কারো কথাই তার মনে পড়ছে না যে আজ তাকে বাঁচাতে পারে।
আর একজন অবিশ্যি পারত, কিন্তু তার নাগাল আর পাওয়ার তার কোন উপায় নেই।
না, অসম্ভব মশা। বসবারও উপায় নেই। শমিতা উঠে দাঁড়াল। ঘরের মধ্যে অন্ধকারেই পায়চারি শুরু করল।
.
সর্বাণী সারাটা রাত ঘুমোতে পারেনি। শমিতার কথাই ভেবেছে। শমিতা এক সময় তার ঘনিষ্ঠতম বান্ধবী ছিল। কিন্তু আজ যেন শমিতাকে সে কিছুতেই সহ্য করতে পারছিল না।
আশ্চর্য! শমিতার প্রতি এমন যে একটা বিতৃষ্ণা তার মনের মধ্যে জমা হয়ে উঠেছে কখনও সে জানতেও পারেনি। কিছুতেই যেন সর্বাণী মন থেকে শমিতাকে ক্ষমা করতে পারছিল না। এমনিই বিচিত্র মানুষের মন বটে! যাকে একদিন সর্বতোভাবে সমস্ত মন দিয়ে কামনা করেছে, আজ তারই প্রতি বিতৃষ্ণায় মনটা যেন শক্ত কঠিন হয়ে উঠেছে।
বাকি রাতটুকু শয্যায় ছটফট করে–ভোরের আলো একটু জানালাপথে দেখা দিতেই সর্বাণী উঠে পড়ল শয্যা ছেড়ে।
হাত মুখ ধুয়েই চায়ের জল চাপাল। এক কাপ চা তৈরি করে বাইরের ঘরের ভেজানো দরজাটা ঠেলে ভিতরে পা দিয়েই সর্বাণী থমকে দাঁড়াল। ঘর শূন্য। শমিতা নেই–তার সুটকেসটাও নেই। বাইরের দরজাটা ভেজানো। বুঝতে দেরি হয় না সর্বাণীর, শমিতা চলে গিয়েছে।
হঠাৎ দৃষ্টি পড়ল সামনের সেন্টার–টেবিলটার ওপরে। একটা কাগজ ভাঁজ করা রয়েছে, একটা বই দিয়ে চাপা দেওয়া। এগিয়ে গিয়ে ভাঁজ–করা কাগজটা তুলে নিল সর্বাণী।
যা ভেবেছিল তাই। শমিতা চিঠি লিখে রেখে গেছে একটা। ঘরের মধ্যে তখনও ঝাঁপসা–ঝাঁপসা অন্ধকার।
আলোটা জ্বেলে চিঠিটা পড়তে থাকে সর্বাণী।
সর্বাণী,
চলে যাচ্ছি ভাই। কাল রাত্রে এসে তোকে যে এতখানি বিব্রত করব ঠিক বুঝতে পারিনি, বুঝলে নিশ্চয়ই আসতাম না। আমাদের পুরনো দিনের বন্ধুত্বটার যে কিছুই আর অবশিষ্ট নেই বুঝতে পারি নি রে। যাওয়ার সময় তোকে মুখে বলে যেতে পারলাম না বলে আমাকে ক্ষমা করিস। তোকে কাল রাত্রে বলতে পারিনি, দাদা আমাকে বাড়ি থেকে বের হয়ে যেতে বলায়ই অত রাত্রে কোথায় যাই ভাবতে গিয়ে তোর কথাটাই সর্বাগ্রে মনে পড়ায় তোর কাছেই এসেছিলাম। তোর স্বামীকে এ চিঠিটা দেখাস না–ছিড়ে ফেলিস। আর হয়ত জীবনে দেখা হবে না।
ইতি—শমিতা
.
বড় রাস্তায় পড়ে কিছুটা হাঁটবার পরই একটা ট্যাক্সি পেয়ে গিয়েছিল শমিতা।
ট্যাক্সিতে বসে-বসেই মনে পড়ল আজ অনেক দিন পরে আবার স্বামী অমলেন্দুর কথা।
বছর দুই আগে এক শীতের রাত্রে সেই যে একবস্ত্রে বের হয়ে এসেছিল শমিতা অমলেন্দুর বাড়ি থেকে, তারপর আর কখনও অমলেন্দুর কথা মনে পড়েনি।
অমলেন্দুও আর কোন খোঁজ করেনি তার–সেও করেনি অমলেন্দুর। অমলেন্দু-পর্বটা যেন সে জীবনের পাতা থেকে একেবারে মুছেই দিয়েছিল।
কিন্তু অমলেন্দু কোন খোঁজখবর না নিলেও, অমলেন্দুর খবর মধ্যে মধ্যে ও কিন্তু পেত। তাদের ডিভোর্স হয়ে যাবার কিছুদিন পরেই অমলেন্দুর বাবা মারা যান, তার মাস কয়েক পরেই ভায়ে ভায়ে অমলেন্দুরা আলাদা হয়ে যায়।
পৈতৃক গৃহ ছেড়ে অমলেন্দু মিডলটন স্ট্রীটে একটা বিরাট ফ্ল্যাট-বাড়ির একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিয়ে উঠে এসেছে, সংবাদটা পেয়েছিল শমিতা সমরেশের কাছেই। সমরেশ একদিন অমলেন্দুর ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিল। অধ্যাপনার সঙ্গে সঙ্গে অমলেন্দু বইয়ের ব্যবসা শুরু করেছিল।
অমলেন্দু যে আর দ্বিতীয়বার বিবাহ করেনি সে খবরটাও পেয়েছিল শমিতা। চলমান ট্যাক্সিতে বসে অমলেন্দুর কথা হঠাৎ মনে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার মনে হয় অমলেন্দুর কাছে গেলে কেমন হয়! কোন হোটেলে গিয়ে উঠবার মতো টাকা তার হাতে নেই। একটা কোন বোর্ডিংই তাকে খুঁজে নিতে হবে, কিন্তু সেও সময়ের প্রয়োজন।
একবার মনে হয়, অমলেন্দু কিছু ভাববে না তো! মনে মনে হাসবে না তো! কিন্তু অমলেন্দু সে প্রকৃতির মানুষ নয়। মনে মনে সে যাই ভাবুক তার স্বাভাবিক শিষ্ঠাচারবোধ মুখে তাকে কিছু প্রকাশ করতে দেবে না।
তাছাড়া সেও আর চিরকালের জন্য কিছু সেখানে থাকতে যাচ্ছে না। তার বর্তমান সঙ্কটের সময় কিছুদিনের জন্য একটা আশ্রয় চায় মাত্র সে তার কাছে।
বিশেষ করে কিরীটী রায়ের শ্যেনদৃষ্টির সামনে থেকে সে আপাততঃ কিছুদিন দূরে দূরে থাকতে চায়, গগনবিহারীর ব্যাপারটা যতদিন না মিটে যায়, সে একটা নিভৃত কোটর চায় যেখানে সে নিজেকে আত্মগোপন করে রাখতে পারে নিশ্চিন্তে।
হ্যাঁ, আজ সে আত্মগোপন করতেই চায়।
কথাটা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কেমন যেন একটা ভয়ের অনুভূতি তাকে অক্টোপাশের মত আঁকড়ে ধরবার চেষ্টা করে। বুকটার মধ্যে যেন কেমন করতে থাকে।
কিরীটী কি তাকে সন্দেহ করেছে। তার চোখের সেই তীক্ষ্ণ অন্তর্ভেদী দৃষ্টি চোখের সামনে ভেসে উঠে যেন তাকে তীক্ষ্ণ শলাকার মত বিদ্ধ করছিল। আচ্ছা, সত্যিই গগনবিহারী উইল করেছিল নাকি?
আশ্চর্য, মানুষের কি লোভ! কামুক লম্পট গগনবিহারী ভেবেছিল তার অর্থ দিয়েই শমিতাকে। করায়ত্ত করতে পারবে। আর সেই–সেই কারণেই হয়ত তাকে টেলিফোনে ডেকে পাঠিয়েছিল ঐ রাত্রে।
কিন্তু আশ্চর্য, এসব পাগলের মত আবোলতাবোল কি সব সে ভাবছে।
কিধার যায়গা মাঈজী?
ট্যাক্সি–ড্রাইভারের ডাকে হঠাৎ যেন শমিতা চমকে ওঠে।
গাড়ি তখন গড়িয়াহাটা ব্রিজটা ক্রস করছে, নীচ দিয়ে একটা ইলেকট্রিক ট্রেন চলে যাচ্ছে–তার শব্দ ওর কানে আসে। ওর সমস্ত স্নায়ু যেন ঝিমঝিম করে ওঠে।
শমিতা তাড়াতাড়ি বলে, মিডলটন স্ট্রীট চল।
ড্রাইভার আর কোন কথা বলে না–যেমন গাড়ি চালাচ্ছিল তেমনিই চালাতে থাকে।
সবে প্রত্যুষের আলো চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। রাস্তার আলোগুলো এখনও নেভেনি। রাস্তা একপ্রকার খালি বললেই হয়।
মধ্যে মধ্যে পাশ দিয়ে এক-আধটা খালি বাস, মিল্ক ভ্যান বা প্রাইভেট গাড়ি চলে যাচ্ছে। দু’একজন পথিক চোখে পড়ে। শমিতার যেন কেমন শীত–শীত করে।
গাড়ি ক্রমে রামকৃষ্ণ কালচারাল মিশনগোলপার্ক পার হয়ে ট্রাম রাস্তার দিকে চলেছে।
হঠাৎ কি যেন আবার মনে হয় শমিতার। ঘাড় ফিরিয়ে পিছনের দিকে তাকাল। কেউ কোন গাড়ি তাকে অনুসরণ করছে না তো? পিছনে পিছনে একটা গাড়ি আসছে না?
কার গাড়ি? তার ট্যাক্সিটাকেই ফলো করছে নাকি?
নাঃ, শমিতা কি পাগল হয়ে যাবে নাকি! এসব কি সে ভাবছে! এসব কিসের প্রতিক্রিয়া? ভয়? কিরীটী রায়ের সেই দুটো চোখের দৃষ্টি! তীক্ষ্ণ শলাকার মত অন্তর্ভেদী!
পাশ দিয়ে একটা খালি ট্রাম চলে গেল পার্ক সাকার্সের দিকে। বলবে কি শমিতা ট্যাক্সি–ড্রাইভারকে মিডলটন স্ট্রীট নয়, অন্য কোথাও সে চলুক! কিন্তু কোথায়?
কেন, সোজা হাওড়া স্টেশনে। তারপর সেখান থেকে ট্রেনে চেপে দূরে–অনেক দূরে–আসানসোল, ধানবাদ, গোমো, গয়া, মোগলসরাই, বেনারস ছাড়িয়ে আরও দূরে!
কিন্তু তারপর?
সমস্ত শহরটা এরকম আশ্চর্যরকম ফাঁকা ফাঁকা কেন? শহরের এত লোকজন কোথায় গেল? আচ্ছা ট্যাক্সি-ড্রাইভারটা কিছু ভাবছে না তো! ট্যাক্সি ড্রাইভারটা যদি বলে দেয়!
শমিতা আবার একটু নড়েচড়ে বসল। কপাল বুকের কাছে পিঠে ঘাম জমছে। হাত দুটো কেমন যেন অবশ। হাত তুলে একবার নিজের মুখে হাতটা বুলিয়ে নিল শমিতা। কোন সাড় নেই মুখে।
হাওয়ায় কয়েকগাছি চূর্ণকুন্তল চোখে-মুখে এসে পড়ছে। হাত দিয়ে ওড়া চুলগুলো ঠিক। করে দেবার চেষ্টা করল শমিতা, কিন্তু পারল না–হাতের আঙুলগুলোও যেন কেমন অবশ হয়ে গিয়েছে।
কেমন যেন অনড় হয়ে বসে থাকে শমিতা। একসময় ট্যাক্সিটা ক্যামাক স্ট্রীট দিয়ে মিডলটন। স্ট্রীটে এসে ঢুকল।
কেতনা নাম্বার মাঈজী?
ইধারই রোখ।
ড্রাইভার ট্যাক্সি থামাল। শমিতা ট্যাক্সি থেকে নামল সুটকেসটা নিয়ে। হাতের ব্যাগ খুলে ট্যাক্সির ভাড়া মিটিয়ে দিল। ট্যাক্সিটা মিটার তুলে সোজা বের হয়ে গেল চৌরঙ্গীর দিকে।
কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে রইল শমিতা। তারপর এদিক–ওদিক তাকাতে তাকাতে এগিয়ে চলল।
নতুন একটা সাততলা বিরাট ম্যানসন। গেটটা খোলাই। মনে পড়ল শমিতার, কে যেন বলেছিল নতুন একটা ম্যানসনের কোন একটা ফ্ল্যাট নিয়েছে অমলেন্দু।
কোটইয়ার্ড দিয়ে এগুতেই একজন দারোয়ানকে নজরে পড়ল। দারোয়ানকেই ও শুধায়, ইধার মিঃ এ. মল্লিক কোন ফ্ল্যাটমে রহতা হ্যাঁয় দারোয়ানজী?
মিঃ মল্লিক!
হ্যাঁ।
চারতলা–আঠার নাম্বার ফ্ল্যাট।
সিঁড়ি কিধার হ্যাঁয়?
সিধা যাইয়ে বাঁয়ে তরফ–লিফট সিঁড়ি দুই হ্যাঁয়।
শমিতা আর দারোয়ানের দিকে তাকাল না। সুটকেসটা হাতে এগিয়ে গেল।
অটোমেটিক লিট। একজন সুট–পরিহিত ভদ্রলোক লিস্ট দিয়ে নেমে এল। শমিতা লিফটে ঢুকে থার্ড ফ্লোরের বোতামটা টিপে দিল। দরজা বন্ধ হয়ে গেল, আপনা হতেই লিফট উঠতে লাগল।
চারতলায় এসে লিস্ট থামল। দরজা আপনা হতেই খুলে যেতে শমিতা করিডরে পা দিল।
১২. আঠার নম্বর ফ্ল্যাট
আঠার নম্বর ফ্ল্যাট।
ফ্ল্যাটের দরজায় অমলেন্দুরই নেমপ্লেট রয়েছে। ডক্টর অমলেন্দু মল্লিক ডি লিট।
তাহলে এই ফ্ল্যাটই।
কোনমতে অবশ হাতটা তুলে কলিং বেলের বোতামটা টিপল শমিতা। বার–দুই বোম টিপতে দরজা খুলে গেল। সামনেই নজরে পড়ে সাজানো–গোছানো একটা ড্রইংরুম।
দরজার মুখোমুখি একেবারে দেওয়ালে অমলেন্দুর একটা এনলার্জড ফটো। ভুল হয়নি তাহলে তার–অমলেন্দুরই ফ্ল্যাট।
মধ্যবয়সী একটি বিহারী ভৃত্য দরজা খুলে দিয়েছিল। জিজ্ঞাসা করে, কিসকো মাংতা?
মল্লিক সাব হ্যাঁয়?
জী। আভিতো নিদ যাতা হ্যাঁয়।
ওঃ, তা—
আপ কিধার সে আতে হে?
এই মানে–কানপুর!
কানপুর।
হ্যাঁ।
আইয়ে, বৈঠিয়ে।
শমিতা এগিয়ে গিয়ে একটা সোফার উপর বসল। সুটকেসটা একপাশে নামিয়ে রেখে দিল। ভৃত্য দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে অন্দরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
এতক্ষণে–এতক্ষণে যেন একটা দুর্নিবার লজ্জা তাকে আচ্ছন্ন করে ফেলতে থাকে। সমগ্র পরিস্থিতির অবশ্যম্ভাবী পরিণতিটা যেন তার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকে।
ছিঃ ছিঃ, ঝোঁকের মাথায় এ একটা কি কাজ সে করে বসল! শেষ পর্যন্ত মরতে এখানে সে আসতে গেল কেন? একটু পরেই অমলেন্দু হয়ত এই ঘরে এসে ঢুকবে!
তারপর?
তারপর কি একটা নিষ্ঠুর ব্যঙ্গের হাসি তার চোখে-মুখে ফুটে উঠবে না?
বলবে না কি, ও, তাহলে তুমি! তা মিস শমিতা সান্যাল এখানে আবার কি প্রয়োজনে? দাদা বুঝি শেষ পর্যন্ত গলাধাক্কা দিল? জানতাম দেবে। কিন্তু দেখতে তো পাচ্ছি রূপ–যৌবন এখনও ফুরিয়ে যায়নি। আর বুঝি কাউকে গাঁথতে পারলে না মিস সান্যাল।
শমিতা এদিক-ওদিক তাকিয়ে উঠে দাঁড়াল।
নীচু হয়ে হাত বাড়িয়ে সোফার পাশ থেকে সুটকেসটা তুলতে যাবে হঠাৎ একটা চপ্পলের আওয়াজ কানে এল শমিতার। একেবারে দরজার গোড়াতেই। থপ করে আবার বসে পড়ল শমিতা।
পরক্ষণেই ঘরের ভারী পদাটা তুলে অমলেন্দু এসে ভিতরে প্রবেশ করল। শমিতার প্রতি দৃষ্টি পড়তেই অমলেন্দু থমকে দাঁড়িয়ে গেল। বিস্ময়ে অর্ধস্ফুট কণ্ঠে উচ্চারিত হল একটিমাত্র শব্দ, তুমি!
শমিতা চেয়ে থাকে অমলেন্দুর দিকে।
সদ্য বোধ হয় অমলেন্দুর ঘুম ভেঙেছে। গায়ে একটা ড্রেসিং–গাউন–মাথার চুল বিস্ত।
শমিতা নিজের অজ্ঞাতেই উঠে দাঁড়াচ্ছিল আবার কিন্তু অমলেন্দু বাধা দিল। বস, বসবলতে বলতে আরও দু’পা সামনের দিকে এগিয়ে এল অমলেন্দু।
ব্যাপারটা যেন তখনও তার সদ্য-ঘুম-ভাঙা মস্তিষ্কে ঠিক প্রবেশ করছে না। শুধু আকস্মিক নয়, অভাবিতও ব্যাপারটা তার কাছে। শমিতা তার গৃহে!
কি ব্যাপার বল তো? ইউ লুক সো শ্যাবি! মনে হচ্ছে যেন কোন দীর্ঘপথ ট্রেন-জার্নি করে আসছ–কোথা থেকে আসছ?
অমলেন্দু—
চল চল–তা এখানে বসে আছ কেন? বুধনটা বলল কে একজন মাইজী এসেছে কানপুর থেকে। আমি তো ভাবতেই পারিনি তুমি! চল চল, ভিতরে চল। অমলেন্দুর কণ্ঠস্বরে যেন একটা সাদর আগ্রহ অভ্যর্থনার আত্মীয়তার সুর ধ্বনিত হয়ে ওঠে।
এস।
শমিতা উঠে দাঁড়াল।
শমিতাকে নিয়ে অমলেন্দু শয়নঘরে গিয়ে ঢুকল তার। একপাশে এলেমেলো শয্যা, একপাশে দেওয়াল ঘেঁষে একটা ডিভান–অন্যপাশে একটা টেবিলের ওপরে একরাশ বই কাগজপত্র ছড়ানো।
মাথার কাছে টেলিফোন, সিগারেট প্যাকেট, অ্যাশট্রে, লাইটার, ছোট একটা টেবিল–ক্লক।
বস। ডিভানটা দেখিয়ে দিল অমলেন্দু।
শমিতা সত্যিই আর দাঁড়াতে পারছিল না। পা দুটো যেন কাঁপছিল। শমিতা ডিভানটার উপরে বসে পড়ল।
এত সকালে নিশ্চয়ই তোমার চা খাওয়া হয়নি শমিতা? এই বুধন–বুধন!
প্রভুর ডাকে বুধন এসে ঢোকে, জী।
চা হয়েছে?
জী হাঁ–চা রেডি।
এই ঘরে নিয়ে আয়।
বুধন চলে যাবার পর অমলেন্দু আবার শমিতার দিকে তাকিয়ে বলল, হাত–মুখ ধোয়া হয়নি এখনও বলেই মনে হচ্ছে। ঐ যে বাথরুম, যাও।
শমিতা একটা কথাও বলে না। যন্ত্রচালিতের মত উঠে বাথরুমে ঢোকে।
অমলেন্দু প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট নিয়ে অগ্নিসংযোগ করল। শমিতা! শমিতা হঠাৎ এল কেন আবার? মনে হচ্ছে শমিতা খুব চিন্তিত, ক্লান্ত। শমিতার কোন খবরাখবর না নিলেও, এই দুই বৎসর তার সম্পর্কে সকল সংবাদই অমলেন্দুর কানে এসেছে। বিশেষ করে মরালী সঙেঘর ব্যাপারটা।
শমিতা ইদানীং রীতিমত উচ্ছঙ্খল জীবনযাপন করছে। তার সম্পর্কে নানা ধরনের রসালো কেচ্ছা সবই তার কানে এসেছে।
কিন্তু অমলেন্দু কান দেয়নি সে-সব কোন সংবাদে। এককালে শমিতা তার স্ত্রী ছিল। তারপর ডিভোর্স হয়ে গিয়েছে। তার সঙ্গে তো আর কোন সম্পর্ক নেই। তবু–তবু কেন যেন মধ্যে মধ্যে অমলেন্দুর মনের ভিতরটা কি এক বেদনায় ক্লিষ্ট হয়ে উঠেছে। আসলে অমলেন্দু তাকে ভুলতে পারেনি।
ঐ ভুলতে না পারাটাও কি তার কাছে কম লজ্জা মনে হয়েছে?
বুধন ট্রেতে চা নিয়ে এল।
একটু পরেই শমিতা বাথরুম থেকে বের হয়ে এল। চোখে মুখে ও কপালের চুলে চূর্ণ জলকণা লেগে আছে। শাড়ির আঁচলটা গায়ে জড়ানো, শমিতা আবার ডিভানটার উপরে এসে বসল।
অমলেন্দুই চা তৈরি করে এক কাপ এগিয়ে দিল শমিতার দিকে, নাও।
হাত বাড়িয়ে শমিতা চায়ের কাপটা নেয়। হাতটা যেন কাঁপছে।
অমলেন্দু নিজের কাপটা হাতে তুলে নেয়। নিঃশব্দে দুজনে কিছুক্ষণ চা পান করে। কারও মুখেই কোন কথা নেই, দুজনেই মনে মনে ভাবে, ও আগে কথা বলুক। শমিতা ভাবে, ওরই তো জিজ্ঞাসা করার কথা। কেন আবার হঠাৎ এলাম!
অমলেন্দু ভাবে, নিশ্চয়ই শমিতা বলবে কিছু। তার বলবার কিছু নিশ্চয়ই আছে, আর সেই জন্যই হয়ত এসেছে। কিন্তু দুজনেই বুঝতে পারে মনে মনে, মধ্যিখানে দুই বৎসরের ব্যবধানে দুজনে দুজনের কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গিয়েছে।
অত্যন্ত সহজ ছিল যা একদিন আজ তা অত্যন্ত কঠিন হয়ে দুজনের মধ্যে একটা অদৃশ্য প্রাচীর তুলে দাঁড়িয়েছে কখন যেন।
এক সময় চা শেষ হল বাক্যহীন স্তব্ধতার মধ্য দিয়ে।
অমলেন্দু একটা সিগারেট ধরাল। বুধন ঐ সময় ঐদিনকার সংবাদপত্রটা রেখে গেল ওদের সামনে। অমলেন্দু হাত বাড়িয়ে সংবাদপত্রটা তুলে নিল। প্রথম পৃষ্ঠার বড় বড় হেডলাইনগুলোয় চোখ বুলিয়ে তৃতীয় পৃষ্ঠাটা খুলতেই অমলেন্দুর চোখে পড়ল গগনবিহারীর নিহত হবার সংবাদটা।
অমলেন্দু যেন চমকে ওঠে। কারণ গগনবিহারীর সঙ্গে শমিতার ইদানীংকার ঘনিষ্ঠতার সংবাদটা সে পেয়েছিল।
সংক্ষিপ্ত সংবাদ। গগনবিহারীকে তাঁর শয়নগৃহে মৃত রক্তাপ্লুত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে পৃষ্ঠে ছুরিকাবিদ্ধ। কাউকেই এখনও গ্রেপ্তার করা হয়নি। গগনবিহারীর বহুদিনের ভৃত্য রামদেওর কোন সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে না।
অমলেন্দু একবার আড়চোখে তাকাল পাশেই উপবিষ্ট শমিতার দিকে, তারপর আবার সংবাদপত্রে মনোনিবেশ করল।
কিন্তু পড়তে পারল না। কাগজটা ভাঁজ করে টেবিলের উপরে রেখে উঠে দাঁড়াল। আমি একটু বেরুব শমিতা!
বেরুবে? কোথায়?
একটা বই আজ বেরুবার কথা। শেষ ফমাটা কাল রাত্রে ডেলিভারী দেবার কথা ছিল। একবার প্রেসে যেতে হবে, সেখান থেকে একবার প্রফেসার চৌধুরীর ওখানে যাব। বুধন রইল–তোমার কোন অসুবিধা হবে না।
শমিতা অমলেন্দুর প্রশ্নের জবাব দেয় না।
আধ ঘণ্টার মধ্যে অমলেন্দু স্নান করে সাজগোজ করে যখন বের হয়ে গেল, শমিতা তখনও তেমনি ডিভানটার উপরে বসে আছে।
আশ্চর্য!
অমলেন্দু তো তাকে কোন কথাই জিজ্ঞাসা করল না! কেন সে হঠাৎ এখানে এসেছে, তার কিছু বলার আছে কিনা!
কি করবে সে? চলে যাবে?
কিন্তু কোথায় যাবে? কলেজে একবার যেতে হবে বটে, তাছাড়া থাকবার একটা ব্যবস্থাও করতে হবে। অমলেন্দুর এখানে সে থাকতে পারে না। অমলেন্দুই বা তাকে থাকতে দেবে কেন? কি সম্পর্ক আজ আর তার সঙ্গে?
.
বেলা দুটো নাগাদ অমলেন্দু ফিরে এল।
ঘরে ঢুকে দেখে শমিতা তার শয্যায় শুয়ে গভীর নিদ্রাভিভূত। স্নান করে অন্য একটা সাধারণ তাঁতের শাড়ি পরেছে। ভিজে চুলের রাশ বালিশে ছড়িয়ে আছে।
ঘর থেকে বের হয়ে এসে অমলেন্দু বুধনকে ডাকল।
বুধন, মাইজী খেয়েছে?
না।
খায়নি?
না। দুবার তিনবার ডাকতে এসে দেখি মাইজী ঘুমাচ্ছেন। আপনার খানা দেব টেবিলে?
হ্যাঁ, দে।
বুধন চলে যাচ্ছিল, তাকে আবার ডাকল অমলেন্দু, শোন। দুজনের খানাই দে টেবিলে।
বুধন ঘাড় হেলিয়ে চলে গেল।
অমলেন্দু এসে শয্যার পাশে দাঁড়াল। ডাকল, শমিতা!
কোন সাড়া নেই শমিতার।
শমিতা, ওঠ। খাবে না?
শমিতার ঘুম ভাঙে না।
অমলেন্দু একটু ইতস্তত করে, তারপর শিয়রের ধারে বসে ওর ভিজে চুলের উপরে হাত রেখে ডাকে মৃদুকণ্ঠে, শমিতা, শমিতা ওঠ।
উঁ!
ওঠ। চল–টেবিলে খাবার দিয়েছে।
শমিতা এবারে উঠে বসে, তুমি? কখন এলে?
এই আসছি–চল টেবিলে খাবার দিয়েছে। যাও বাথরুম থেকে চোখে-মুখে জল দিয়ে এসো।
শমিতা শয্যা থেকে উঠে বাথরুমের দিকে পা বাড়ায়।
খাবার টেবিলে বসে শমিতা বলে, একটা কথা বলব ভাবছিলাম অমল—
বল।
আমি যদি কটা দিন তোমার এখানে থাকি, তোমার কি খুব অসুবিধা হবে?
অমলেন্দু কোন জবাব দেয় না।
অবিশ্যি বেশী দিন নয়, একটা থাকবার ব্যবস্থা হলেই—
যতদিন খুশি এখানে থাকতে পার শমিতা। অমলেন্দু মৃদু গলায় জবাব দেয়।
না, না, বেশী দিন তোমাকে বিরক্ত করব না।
বিরক্তির তো কিছু নেই
তোমার তো অসুবিধে হতে পারে!
অসুবিধা আবার কি?
হবে না?
কেন, অসুবিধা হবে কেন? হয়ত তোমারই অসুবিধা হতে পারে।
আমার?
হ্যাঁ–এখানে থাকতে
না, অমলেন্দু তা নয়—
তবে কি?
আমি ভাবছিলাম অন্য কথা।
কি?
না, কিছু না। তারপর একটু থেমে বলে, বুধন–তোমার চাকর কি ভাববে!
ও কেন ভাবতে যাবে?
ভাববে না বলছ?
না। তাছাড়া এর মধ্যে ভাবাভাবির কি আছে?
তবুও হয়ত ভাববে–কে আমি কোথা থেকে হঠাৎ এলাম—
ওকে বললেই হবে—
কি বলবে?
তুমি আমার চেনা বন্ধু।
বন্ধু!
হ্যাঁ–কলকাতায় এসে আমার এখানে উঠেছ। তাছাড়া ও কি ভাববে-না-ভাববে সে কথা ভেবে তুমি এত সংকুচিতই বা হচ্ছ কেন? তোমার কোন অসুবিধা না হলে তুমি থাকতে পার। কিন্তু তুমি তো কিছুই খাচ্ছ না!
খিদে নেই–
তবে জোর করে খেও না।
আচ্ছা অমলেন্দু!
কি?
তুমি তো একবারও জিজ্ঞাসা করলে না, আমি হঠাৎ কেন এলাম এতদিন পরে?
তুমি যখন বলনি, নিশ্চয়ই বলবার মত কিছু নেই–তাই জিজ্ঞাসাও করিনি।
না অমলেন্দু, আছে।
কি?
বলবার অনেক কথা আছে, কিন্তু ভাবছি কি বলব? কেমন করে বলব?
এখন ওসব কথা থাক শমিতা।
তুমি জান কিনা জানি না–দাদার বন্ধু গগনবিহারী চৌধুরী নিহত হয়েছেন—
জানি আমি।
জান?
হ্যাঁ।
কেমন করে জানলে?
আজ খবরের কাগজে সংবাদটা প্রকাশিত হয়েছে।
কি–কি লিখেছে তাতে?
লিখেছে–কোন সন্ধান করা যায়নি এখনও হত্যাকারীর–পুলিস হত্যাকারীর অনুসন্ধান করছে–আর বিখ্যাত সত্যান্বেষী কিরীটী রায় পুলিসকে ঐ ব্যাপারে পরামর্শ দিচ্ছেন। পুলিস পারলেও ঐ ভদ্রলোক যখন ব্যাপারটার মধ্যে মাথা গলিয়েছেন, খুনী ধরা পড়বেই!
পড়বেই!
হ্যাঁ, দেখে নিও। অসাধ্যসাধন করতে পারেন ঐ ভদ্রলোক। ওঁর অনুসন্ধানী দৃষ্টিকে ফাঁকি দেওয়া সহজ নয়।
শমিতার বুকটার মধ্যে থেকে একটা ভয়ের স্রোত তার মেরুদণ্ড বেয়ে শিরশির করে যেন নামতে থাকে। গলাটা শুকিয়ে ওঠে।
হঠাৎ শমিতা উঠে দাঁড়ায়। বলে, আমি চলি।
কোথায়? বিস্ময়ে অমলেন্দু শমিতার মুখের দিকে তাকায়, সত্যিই তুমি চলে যাচ্ছ নাকি?
হ্যাঁ।
বস বস শমিতা, মনে হচ্ছে তুমি যেন অত্যন্ত এক্সাইটেড হয়ে পড়েছ–সকাল থেকেই দেখছি তুমি অত্যন্ত চিন্তিত!
আমি যাই—
কি হয়েছে শমিতা, আমাকে সব খুলে বল।
কি–কি বলব?
তোমার যদি কোন চিন্তার কারণ থাকে তো বল। আমি হয়তো তোমাকে সাহায্য করতে পারি।
কি সাহায্য তুমি আমাকে করবে?
ব্যাপারটা না জানলে কি করে বলি! বস–হোয়াই ইউ আর সো মাচ ডিস্টার্বড! অমলেন্দু একপ্রকার যেন জোর করেই শমিতাকে বসিয়ে দিল আবার চেয়ারটায়।
অমলেন্দু!
বল।
একটা কথা তুমি জান না—
কি? গগনবিহারীর সঙ্গে আমার একসময় যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল।
আমি জানি।
জান?
হ্যাঁ।
কেমন করে জানলে?
জেনেছি।
১৩. সুবীর যেন হাঁপিয়ে ওঠে
সুবীর যেন হাঁপিয়ে ওঠে।
থানার ওসি’র কড়া নির্দেশ, আপাতত তারা কেউ বাড়ি থেকে পুলিসের বিনানুমতিতে বের হতে পারবে না।
পরের দিন দুপুরের দিকে সুবীর সুবিনয়ের ঘরে এসে বলে, দিস ইজ সিমপ্লি টরচার সুবিনয়!
সুবিনয় চেয়ারে বসে একটা বই পড়ছিল। সুবীরের দিকে মুখ তুলে তাকাল।
সুবীর আবার বলে, এভাবে আমাদের এখানে বাড়ির মধ্যে নজরবন্দি করে রাখার মানেটা কি? কাকার মৃত্যুর ব্যাপারে কি ওরা আমাদের সন্দেহ করেছে নাকি? ডু দে সাসপেক্ট আস!
কিছু তো সেটা অস্বাভাবিক নয় সুবীরদা! মৃদু কণ্ঠে সুবিনয় জবাব দেয়।
হোয়াট ডু উই মিন?
ভেবে দেখ না।
কি ভাবব?
আমরা কজন ছাড়া তো এ বাড়িতে কেউ পরশু রাত্রে ছিলাম না! কাজেই আমাদের ওপরে যদি পুলিসের সন্দেহ পড়েই–
আমরা আমাদের কাকাকে হত্যা করেছি! হাউ ফ্যান্টাস্টিক! বাট হোয়াই? কেন–আমরা তাকে হত্যা করতে যাব কেন!
আজ সকালে মিঃ সেন–মামার সলিসিটার এসে কি বললেন শুনেছ তো তুমি! মামার
সম্পত্তি ও টাকাকড়ি নেহাৎ কম নয়!
কোম্পানির শেয়ার, ইনসুরেন্স, নগদ টাকা ব্যাঙ্কের ও এই বাড়ি সব মিলিয়ে লাখ দুয়েকের বেশী–
তাই সেই অর্থের জন্য আমরা কাকাকে হত্যা করেছি।
না করলেও লোকে তাই ভাববে সহজেই, কেননা ঐ ধরনের ঘটনা তো বিরল নয়।
তার জন্য হত্যা করবো তাকে? ওর যা-কিছু তো সব আমরাই পেতাম।
না।
তার মানে?
আর দুটো দিন দেরি হলে কিছুই পেতাম না। শুনলে না মিঃ সেন বলছিলেন, মামা একটা উইল করেছিলেন। তাঁর সব কিছু শমিতা দেবীকে দেবার মনস্থ করেছিলেন এবং সেই উইলে এমন কি তাঁর একমাত্র ছেলেকেও বঞ্চিত করে–
দ্যাট বিচ্! দ্যাট হারলট! সুবীর বললে, ঐ মেয়েমানুষটাই যত নষ্টের মূল!
সুবিনয় মৃদু হেসে বললে, মামা তাকে বিবাহ করবেন স্থির করেছিলেন।
কি করে বুঝলে?
আমার তাই ধারণা।
খুব হয়েছে। হি গট হিজ রিওয়ার্ড। কিন্তু তাই যদি হয় তো আমাকে তারা এভাবে নজরবন্দী করেছে কেন? আমি তো আর সেরাত্রে এ বাড়িতে ছিলাম না।
তাতেই বা কি?
তার মানে?
পুলিস হয়ত ভাবতে পারে—
কি? কি ভাবতে পারে?
কোন এক ফাঁকে নিমন্ত্রণ–বড়ি থেকে এসে—
ডোন্ট টক ননসেন্স!
তা তুমি ছটফট করছ কেন সুবীরদা? কটা দিন আমাদের নজরবন্দী করে রাখলেই বা ওরা। চিরদিন তো কিছু আর আমাদের এভাবে রাখতে পারবে না।
কিন্তু আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। কোন ভদ্রলোক চব্বিশ ঘণ্টা এভাবে বাড়ির মধ্যে নজরবন্দী হয়ে থাকতে পারে?
উপায় কি বল! আচ্ছা সুবীরদা?
কি?
রামদেওটা হঠাৎ কোথায় গেল বল তো?
আমার মনে হয় কি জান সুবিনয়!
কি?
ঐ ব্যাটারই কাজ। টাকাপয়সার ব্যাপার নয়–ওর তৃতীয় পক্ষের তরুণী স্ত্রী ঐ রুক্মিণীর সঙ্গে কাকার নটঘট দেখে ও বেটা নিশ্চয়ই ক্ষেপে গিয়েছিল। তারপরই শেষ করে দিয়েছে সুযোগমত কাকাকে।
কিন্তু–
সুবীর বলে, তুমি দেখে নিও সুবিনয়, আমি যা বলছি তাই। ঐ বেটাই দিয়েছে মামাকে খতম করে। তারপর গা-ঢাকা দিয়েছে।
অবিশ্যি অসম্ভব নয় কিছু।
কাকার যেমন রুচি। একটা চাকরের বৌ, তাকে নিয়েও কিনা—
তুমি কি সত্যই মনে কর সুবীরদা, মামার সঙ্গে রুক্মিণীর কোন একটা অবৈধ সম্পর্ক হয়েছিল?
হয়েছিল মানে! চব্বিশ ঘণ্টাই তো ঐ মাগীটা কাকার ঘরে থাকত!
কি জানি! আমার কিন্তু বিশ্বাস হয় না।
লক্ষ্য করে দেখেছ ইদানীং ঐ মাগীটার বেশভূষা–হ্যাকন—ঢ্যাকন—
ওদের কথা শেষ হয় না, বাহাদুর এসে ঘরে ঢুকল, বাবুজী!
কি হয়েছে?
জ্যাকি তো কিছু খাচ্ছে না। আজ দুদিন থেকে সাহেবের ঘরের সামনে বসে আছে, ওঠে না।
বেচারী! অবোধ প্রাণী–প্রভুর শোকটা ভুলতে পারছে না কিছুতেই। সুবিনয় বলে।
কি করব বাবুজী? না খেয়ে থাকলে তো ও মরে যাবে।
সুবীরদা?
কি?
তুমি একবার চেষ্টা করে দেখ না।
আমি? আমার হাতে ও খেয়েছে নাকি কোনদিন?
চেষ্টা করে একবার দেখতে ক্ষতি কি?
বাইরে ঐ সময় জুতোর শব্দ পাওয়া গেল একজোড়া। সুবিনয় আর সুবীর দরজার দিকে তাকাল। অরূপ ও কিরীটী ঘরের মধ্যে এসে ঢুকল। অরূপের হাতে একটা ঝোলা।
সুবীর অরূপের দিকে তাকিয়ে বলে, এই যে অরূপবাবু! আমাদের আর এভাবে কতদিন খাঁচার মধ্যে বন্দী করে রাখবেন বলুন তো?
জবাব দিল কিরীটী, আপনারা যে মুহূর্তে সব সত্যি কথা অকপটে বলবেন তখুনি পুলিসপ্রহরা এখান থেকে উঠিয়ে নেওয়া হবে সুবীরবাবু।
কি বলতে চান আপনি?
বলতে চাই, সব সত্য কথা এখনও আপনারা স্পষ্ট করে বলছেন না কেন?
কোন্ কথাটা আবার বলিনি? সুবীর বলে।
সে-রাত্রে আপনি রাত দশটা থেকে বারোটা পর্যন্ত কোথায় ছিলেন সুবীরবাবু?
বলেছি তো আমার বন্ধুর বোনের বিয়েতে—
আপনার বন্ধু অরিন্দমবাবু বলেছেন—
কি বলেছেন?
রাত সাড়ে নটা নাগাদ আপনি বরযাত্রীদের দেখাশোনা করবার জন্য দুটো বাড়ির পরের বাড়িতে যেখানে বরযাত্রীরা উঠেছিল সেখানে গিয়েছিলেন, কিন্তু সেখানে আপনি পাঁচ-দশ মিনিটের বেশী ছিলেন না।
কে বললে?
আমরা খবর পেয়েছি।
বাজে কথা। আমি রাত পৌনে বারোটা পর্যন্ত সেখানেই ছিলাম। সুবীর দৃঢ়কণ্ঠে বলে।
না, ছিলেন না।
আপনি যদি জোর করে বলেন মশাই যে আমি ছিলাম না—
জিতেনবাবুকে আপনি চেনেন? হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করে।
কোন্ জিতেন? কে সে?
জিতেন ভৌমিক। আপনার অফিসের সহকর্মী।
হ্যাঁ, চিনি।
তিনি আপনাকে সেরাত্রে দশটা থেকে সোয়া দশটার সময় পার্ক স্ট্রীটের একটা হোটেলে দেখেছে। কি, কথাটা মিথ্যে?
সুবীর চুপ।
আপনি হোটেল থেকে কখন বের হয়ে যান?
সুবীর চুপ।
কি সুবীরবাবু, জবাব দিচ্ছেন না কেন?
হ্যাঁ, আমি হোটেলে গিয়েছিলাম।
কেন?
ড্রিঙ্ক করতে।
বেশ। কিন্তু সেরাত্রে হোটেল থেকে কখন আপনি বের হয়ে যান?
রাত সাড়ে এগারোটা নাগাদ।
না। তার আগেই বের হয়ে গিয়েছিলেন। কিরীটী শান্তকঠিন গলায় প্রতিবাদ জানায়। বলুন কখন বের হয়ে গিয়েছিলেন হোটেল থেকে?
মনে নেই।
বেশ। তাহলে বলুন এবার হোটেল থেকে বের হয়ে কোথায় গিয়েছিলেন? বিয়েবাড়িতে।
না। আবারও আপনি সত্য গোপন করছেন। থাকলে কিরীটী অরূপের দিকে তাকিয়ে বললে, অরূপ, জুতোজোড়াটা তোমার ঝোলা থেকে বের কর তো!
কিরীটীর নির্দেশে অরূপ ঝোলা থেকে একজোড়া কালো রংয়ের ক্রেপ সোলর জুতো বের করল। সুবীর আর সুবিনয় জুতোজোড়ার দিকে নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। জুতোর সোলে কাদা শুকিয়ে আছে।
ঐ জুতোজোড়া কোথায় পাওয়া গিয়েছে জানেন সুবীরবাবু? এই বাড়ির পিছনে একটা গাছের নীচে বাগানের মালির ঘরটার কাছে যে ঘরে জ্যাকিকে আটকে রাখা হয়েছিল–এ জুতোর ছাপও সেই ঘরটার কাছেই বাগানের মাটিতে পাওয়া গিয়েছে। ধর্মের কল কেমন বাতাসে নড়ে দেখুন! সেদিন দুপুরের দিকে একপশলা বৃষ্টি হয়েছিল, যার ফলে বাগানের মাটি নরম হয়ে গিয়েছিল এবং মাটিতে জুতোর ছাপ যেমন পড়েছে তেমনি জুতোতেও কাদা লেগেছে।
সুবিনয় ও সুবীর দুজনের কারো মুখেই কোন কথাই নেই। দুজনেই যেন একেবারে বোবা।
কিরীটী ওদের দিকে তাকিয়ে আবার বলে, আপনারা কেউ চিনতে পারছেন এ জুতোজোড়া, সুবিনয়বাবু?
না।
সুবীরবাবু, আপনি?
না।
বাহাদুর! তুমি চিনতে পারছ?
জী সাব।
কার এ জুতো?
সাহেবের।
গগনবাবুর?
জী হাঁ।
অরূপ, এবার কোটটা বের কর।
অরূপ ঝোলা থেকে একটা কালো টেরিউলের প্রিন্স কোট বের করল।
বাহাদুর, এ কোটটা কার জান?
জী।
কার?
সাহেবের।
সুবীরবাবু, সুবিনয়বাবু–এটাও বাগানে পাওয়া গিয়েছে এবং আপনাদের জ্ঞাতার্থে জানাচ্ছি, এই কোটের গায়ে ও হাতায় রক্ত শুকিয়ে ছিল। সে রক্ত কেমিক্যাল অ্যানালিসিসের দ্বারা প্রমাণিত হয়েছে গগনবিহারীর রক্ত বলে।
এতক্ষণে সুবিনয়ই কথা বলে, আপনি এসব কথা আমাদের বলছেন কেন মিঃ রায়? আপনার কি ধারণা আমাদেরই মধ্যে কেউ মামাকে হত্যা করেছি?
না। সেজন্য নয়।
তবে?
আচ্ছা আপনারা সেরাত্রে এ ব্যাপারে কোন চিৎকার বা চেঁচামেচি শোনেননি?
না। তাছাড়া সেরকম কিছু হলে জ্যাকি কি ডাকত না? চুপ করে থাকত?
পুয়োর জ্যাকি ওয়াজ ড্রাগড়! তাকে খাদ্যবস্তুর সঙ্গে কোন ওষুধ খাইয়ে আগে থাকতেই নিস্তেজ করে ফেলা হয়েছিল।
কিন্তু সে তো কারে হাতে খায় না। সুবিনয় বলে, জ্যাকি তো মামা ও রামদেওর হাতে ছাড়া আর কারো হাতেই খেত না।
খেত না ঠিকই। আর সেই যুক্তিতেই হয়ত হত্যাকারী নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করবার সুযোগ খুঁজবে। কিন্তু একটা কুকুরকে কোন কৌশলে একটা ঘুমের ওষুধ খাইয়ে নিস্তেজ করা এমন কিছুই কষ্ট নয় সুবিনয়বাবু।
আমার মনে হয়—
কি বলুন?
আপনার কথাই যদি সত্যি হয় তো রামদেওই সে কাজ করেছিল। তার পক্ষেই সেটা বেশী সম্ভব ছিল।
তা ঠিক।
এবং নিশ্চয়ই এখনও তার কোন পাত্তা পাওয়া যায়নি?
না। তাহলেও তাকে খুঁজে বের করতে পুলিসের অসম্ভব হবে না।
তাই তো আমি ভাবছি, রামদেও নামক রংয়ের তাসটি যখন হঠাৎ টেবিলের উপর এসে পড়বে তখন সত্যিকারের হত্যাকারীর যে বাঁচার আর কোন সম্ভাবনাই থাকবে না।
১৪. সুবীর বলে ওঠে ঐ সময়
সুবীর বলে ওঠে ঐ সময়, আমি হলপ করে বলতে পারি মিঃ রায়, রামদেও-ই কাকাকে সেরাত্রে হত্যা করেছে। আপনারও কি তাই মনে হয় না!
হোয়াই ইউ আর সো সার্টেন সুবীরবাবু? কিরীটী মৃদু হেসে পালটা প্রশ্ন করে।
কারণ কাকার সঙ্গে রামদেওর যুবতী স্ত্রীর ইল্লিসিটু কনেকশন ছিল।
সেই কারণেই আপনাদের মনে হয় সে হত্যা করেছে তার মনিবকে?
নিশ্চয়! কে সহ্য করতে পারে–মানে কোন্ পুরুষ সহ্য করতে পারে বলুন নিজের স্ত্রীকে অন্যের শয্যাসঙ্গিনী হতে দেখলে রাতের পর রাত?
আপনার ভুলও তো হতে পারে সুবীরবাবু?
ভুল! না, ব্যাপারটা খুব স্বাভাবিক। অন্ততঃ আমি রামদেও হলে তো পারতাম না।
খুন করতেন, তাই না?
খুন? সুবীর যেন চমকে ওঠে।
হ্যাঁ–খুন। সুবিনয়বাবু, আপনি?
জানি না।
যাক সে কথা। আপনারও কি সুবীরবাবুর মতই মনে হয় কাজটা রামদেওরই?
সুবীরদা যা বলেছে তাই যদি হয়—
সুবীরদার কথা থাক। আমি আপনার কথা জানতে চাইছি।
মানুষ মনের ঐ অবস্থায়—
হত্যাও করতে পারে। আচ্ছা শমিতা দেবী সম্পর্কে আপনার কি ধারণা সুবিনয়বাবু?
তাঁকে তো আমি চিনি না। মানে তাঁর সঙ্গে আমার তো কোন আলাপ–পরিচয় নেই।
চেনেন না–মানে তাঁর সঙ্গে হয়ত আপনার কোন আলাপ–পরিচয় নেই সত্যি, কিন্তু দেখেছেন তো তাঁকে বহুবার। তাঁর সম্পর্কে অনেক কিছু শুনেছেনও।
এখানে তিনি প্রায়ই আসতেন। কখনও-সখনও দেখেছি।
আপনার মামার সঙ্গে যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল?
ছিল বলেই শুনেছি।
শোনেননি তাঁকে আপনার মামা বিবাহ করবেন বলে স্থির করেছিলেন?
না।
কিন্তু তাঁর সঙ্গে যে গগনবিহারীবাবুর রীতিমত ঘনিষ্ঠতা গড়ে উঠেছে, কথাটা কার কাছ থেকে শুনেছিলেন?
সুবীরদাই বলেছে।
আর কারো মুখে কথাটা শোনেননি?
রামদেওর মুখেও শুনেছি।
রামদেওর সঙ্গে তাহলে আপনার ঐ সব আলোচনাও হত?
কি বললেন?
বলছি হঠাৎ রামদেও সেকথা আপনাকে বলতে গে, কেন? আপনি জিজ্ঞাসা করেছিলেন কখনও?
ঐ–মানে কথায় কথায় হঠাৎ একদিন বলেছিল রামদেও।
হুঁ। রামদেও তাহলে আপনাদের ঘরে আসত?
তা মধ্যে মধ্যে আসত বৈকি।
রামদেওর স্ত্রী রুক্মিণী আসত না?
না।
ভাল কথা সুবিনয়বাবু, আপনি আমার প্রশ্নের জবাবে পুলিসের কাছে জবানবন্দীতে বলেছেন–সেরাত্রে শমিতা দেবী নাকি রাত সাড়ে নটা পৌনে দশটা নাগাদ এ বাড়িতে এসেছিলেন!
হ্যাঁ।
আপনি তাঁকে আসতে দেখেছিলেন, না কারো মুখে শোনা কথা?
দেখেছি।
কেমন করে দেখলেন? কোথায় দেখেছিলেন?
আমি সেদিন অফিস থেকে ফিরে এসে মাথার যন্ত্রণার জন্য শুয়ে ছিলাম, তারপর রাত সোয়া নটা নাগাদ প্রিয়লাল ডাকতে আসে খাবার জন্য
রাত্রে বুঝি খাওয়াদাওয়া তাড়াতাড়ি সারতেন?
না। সেদিন বিকেলে এসে কোন জলখাবার খাইনি, তাই ঠাকুর আমাকে একটু আগেই খাবার জন্য ডাকতে এসেছিল।
তারপর?
খাওয়দাওয়া সেরে ঘরে ঢুকে জানলার কাছে দাঁড়িয়েছিলাম, সেই সময়ই শমিতা দেবীকে একটা ট্যাক্সিতে এসে গেটের সামনে নামতে দেখি।
সেরাত্রে কোন জ্যোৎস্না ছিল না, অন্ধকার রাত্রি–আপনার এ ঘর থেকেও গেটটা বেশ দূর, ঠিক কি করে চিনলেন যে তিনি শমিতা দেবীই?
মনে হল। তাছাড়া অত রাত্রে তিনি ছাড়া আর স্ত্রীলোক কে মামার কাছে আসতে পারে?
যুক্তির মধ্যে আপনার কোন ফাঁক নেই দেখতে পাচ্ছি। কিরীটী মৃদু হেসে কথাটা বলে প্রসঙ্গান্তরে চলে গেল। আচ্ছা সুবিনয়বাবু, আপনি মরালী সঙ্ঘের নাম শুনেছেন?
শুনেছি।
কার কাছে–আপনার মামার কাছে, না শমিতা দেবীর কাছে?
ওদের কারো কাছেই না। তবে শুনেছি। ঠিক কার কাছে শুনেছি মনে পড়ছে না।
গেছেন কখনও সেখানে?
না।
ব্যারিস্টার সত্যেন ঘোষালকে চেনেন?
না।
তিনি মরালী সঙ্ঘের একজন বড় পেট্রন। নামটা তাঁর শোনেননি তাহলে কখনও?
না।
আমি কিন্তু ভেবেছিলাম শুনেছেন।
কেন?
কারণ শমিতা দেবীর সঙ্গে তাঁর যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা ছিল।
থাকতে পারে, কিন্তু সেকথা আমি জানব কি করে?
জানা স্বাভাবিক, কারণ শমিতা দেবীর সঙ্গে আপনার পরিচয় ছিল।
আ–আমার?
হ্যাঁ। আপনি মিথ্যে বলছেন যে তাঁর সঙ্গে আপনার কোন পরিচয় ছিল না।
শমিতা দেবী আপনাকে ঐ কথা বলেছেন? সুবিনয়ের কণ্ঠস্বরে একটা উৎকণ্ঠা প্রকাশ পায়–যেটা সে চাপা দিতে সক্ষম হয় না।
কিরীটী শান্ত গলায় বলে, যেমন করেই হোক আমি জেনেছি কথাটা। বলুন সত্যি কি না?
সেরকম কিছু জানাশোনা নেই, তবে—
তবে?
আমার এক বন্ধুর সুপারিশে আমার লেখা একটা নাটক ওঁরা বছরখানেক আগে ওঁদের মরালী সঙঘ থেকে নিউ এম্পায়ারে অভিনয় করেন। সেই সময় দু–চার দিন আমি রিহাশাল দেখতে গিয়েছি। সেই সময়ই দু–চারদিন দু–চারটে কথা হয়েছিল।
বন্ধুটির নাম কি?
মনোজিৎ ঘোষাল। ঐ ব্যারিস্টার সত্যেন ঘোষালের ছোট ভাই।
তবে একটু আগে যে বললেন ব্যারিস্টার সত্যেন ঘোষালকে আপনি চেনেন না?
মনোজিৎ আমার বন্ধু হলেও তার দাদার সঙ্গে আমার কোন পরিচয় নেই।
হুঁ। তাহলে আপনি একজন নাট্যকারও।
দু–চারটে নাটক লিখেছি।
আপনার মামাবাবু জানতেন কথাটা?
কোন কথা?
যে আপনার সঙ্গে শমিতা দেবীর পূর্ব হতেই পরিচয় ছিল?
না। জানতেন না।
শমিতা দেবীও কখনও বলেননি?
বলতে পারি না। তবে ব্যাপারটা এমন কিছু নয় যে তাঁকে বলতেই হবে!
তা ঠিক। আচ্ছা সুবিনয়বাবু, এবারে আমার আর একটা কথার জবাব দিন।
বলুন?
শমিতা দেবীর প্রতি আপনার কোন দুর্বলতা ছিল?
না, না–এসব কি বলছেন আপনি?
লজ্জার কি আছে এতে? সী ওয়াজ ভলাপচুয়াসলি সেক্সি! যে কোন পুরুষের পক্ষেই তাকে দেখে–বিশেষ করে তার সাহচর্যে তার প্রতি আকৃষ্ট হওয়া খুবই তো স্বাভাবিক। আপনার মনেও সেরকম দুর্বলতা যদি কখনও জেগেও থাকে, আপনাকে নিশ্চয়ই তার জন্য দোষ দেওয়া যায় না। কখনও কোন দুর্বলতা তাঁর প্রতি আপনার জাগেনি বলতে চান? কাম্ অন–আউট উইথ ইট!
না–না—
ঘরের মধ্যে অন্যান্য সকলে নিঃশব্দে একপাশে দাঁড়িয়ে কিরীটী ও সুবিনয়ের প্রশ্নোত্তর শুনছিল। কিরীটী যে তার আলোচনার ধারাটা কোন দিকে নিয়ে চলেছে–সত্যি কথা বলতে কি অরূপ বা সুবীর কেউই বুঝতে পারছিল না।
তীক্ষ্ণবুদ্ধি বাকপটু কিরীটী যে কোন কৌশলে প্রশ্নের পর প্রশ্ন তুলে সহজ স্বচ্ছন্দভাবে কেমন করে সুবিনয়কে একেবারে কোণঠাসা করে এনেছিল ওরা সত্যিই প্রথমটা বুঝতে পারেনি। কিন্তু হঠাৎ কিরীটীর শেষ প্রশ্নে অরূপ যেন সজাগ হয়ে ওঠে।
আপনার চোখমুখ, দ্বিধাগ্রস্ত কণ্ঠস্বরই বলছে সুবিনয়বাবু–শমিতা দেবীর প্রতি আপনার দুর্বলতা ছিল। অবচেতন মনে তাঁকে ঘিরে আপনার একটা আকাঙ্ক্ষাও ছিল হয়ত।
সুবিনয়ও যেন এতক্ষণে হঠাৎ কিরীটীর শেষ প্রশ্নে সজাগ হয়ে ওঠে। শান্ত গলায় বলে, না। আপনি যদি তা ভেবে থাকেন তো মিঃ রায় সেটা আপনার ভুল।
ভুল কিরীটী রায় করেনি সুবিনয়বাবু। যাক গে সেকথা। অরূপ!
অরূপ কিরীটীর দিকে তাকিয়ে বললে, বলুন?
ওঁদের দুজনকে আর নজরবন্দী করে রাখার তোমার প্রয়োজন নেই। সুবীরবাবু, সুবিনয়বাবু–আপনারা ফ্রি।
সুবীর বললে, ধন্যবাদ।
চল অরূপ, একবার গগনবাবুর শোবার ঘরটা ঘুরে যাওয়া যাক। কিরীটী অরূপের দিকে ফিরে বললে।
চলুন।
দুজনে ওরা ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ওরা দুজনে সুবীর ও সুবিনয় যেন প্রস্তরমূর্তির মত দাঁড়িয়ে থাকে কিছুক্ষণ। কারো মুখেই কোন কথা নেই। হঠাৎ সুবীর বলে একসময়, তাহলে তোমার সঙ্গে শ্ৰীমতীর আলাপ ছিল সুবিনয়?
ডোন্ট টক ননসেন্স সুবীরদা!
কিন্তু সত্যি বল তো ব্যাপারটা কী? কিরীটীবাবু যা বলে গেলেন কেমন কেমন যেন মনে হল–
সুবীরদা, তোমারও কি মাথা খারাপ হয়েছে?
আহা, চটছ কেন সুবিনয়! ব্যাপারটা যদি ঘটেই থাকে সেটা তো এমন কিছু অঘটন নয়। বরং বলতে পার স্বাভাবিকই।
ঐ সব কথা উচ্চারণ করাও পাপ সুবীরদা।
পাপ! কেন?
তুমি জান ওঁর প্রতি মামার কি মনোভাব ছিল–
ও, এই কথা! তা কাকার তো সত্যিই মাথা খারাপ হয়েছিল। না হলে ঐ বয়সে ঐ সব কেচ্ছা কেউ করে!
ভালবাসার কোন বয়স নেই সুবীরদা।
ওটাকে ভালবাসা বলে না সুবিনয়, ওটা বিকৃত যৌন-লালসা ছিল কাকার। শ্রদ্ধেয় এবং গুরুজন হলেও কথাটা না বলে আমি পারলাম না।
ওসব আলোচনা থাক সুবীরদা। আমার সত্যিই ভাল লাগছে না।
আমি রাজীবকে বিলেতে সব লিখব।
না, না সুবীরদা। তাছাড়া রাজীবদা একদিন সব নিজে থেকেই জানতে পারবে।
তবু আমাদেরও তো কৃতজ্ঞতা বলে একটা বস্তু আছে—
কৃতজ্ঞতা!
নয়? ভেবে দেখ মামা যদি আমাদের এভাবে আশ্রয় না দিতেন?
আশ্রয় আবার কি? আমরা কিছু ভেসে যাচ্ছিলাম না! বরং এখানে এসে থাকার জন্য মিথ্যা খানিকটা লজ্জার সঙ্গে আমরা জড়িয়ে গেলাম।
লজ্জা!
নয়? ভেবে দেখ, কাকার ব্যাপারটা আর চাপা থাকবে? সবাই একদিন জানবে।
তা জানে জানুক। তাহলেও আমাদের দিক থেকে আমরা কেন অকৃতজ্ঞ হব।
তোমার যুক্তি আমি মেনে নিতে পারছি না সুবিনয়। আমি আর এখানে থাকছি না।
তুমি চলে যাবে সুবীরদা?
নিশ্চয়ই।
কিন্তু কেন?
এখানে থাকার আর কোন অধিকার নেই বলে।
সুবিনয় আর কোন কথা বলে না।
১৫. কিরীটী আর অরূপ দোতলায় উঠে
কিরীটী আর অরূপ দোতলায় উঠে গগনবিহারীর শয়নঘরটার তালা খুলে প্রবেশ করল। ঘরটাতে সেই দিন থেকেই তালা দেওয়া ছিল। ঘরে পা দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই কিরীটী দাঁড়িয়ে পড়ে। ঘরের আলোটা জ্বলছে।
অরূপ দেখতে পায়নি আলোটা। বুঝতে পারেনি কারণ ঘরে জানলায় জানলায় পদা টাঙানো থাকলেও পিছনের কাচের সাসী দিয়ে যে আলো পদা ভেদ করে ঘরের মধ্যে প্রবেশ করছিল। সেটা পযাপ্ত।
কি ব্যাপার মিঃ রায়?
ঘরের আলোটা জ্বলছে—
তাই তো!
সেদিন এনকোয়ারীর শেষে যখন ঘরে তালা-বন্ধ করে যাও, আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যাওনি অরূপ?
গিয়েছিলাম তো। আমি নিজে নিভিয়ে দিয়েছি ঘরের আলো।
কিরীটী তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে চারিদিকে তাকাতে তাকাতে মৃদু কণ্ঠে বললে, গত দুদিনের মধ্যে ঘরে কেউ এসেছিল–
আপনার তাই মনে হচ্ছে?
হ্যাঁ। এবং যে এসেছিল সে তাড়াতাড়িতে আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছে।
কে? কে আসতে পারে?
কিরীটী অরূপের প্রশ্নের কোন জবাব না নিয়ে ঐ শয়নঘর থেকে পাশের ঘরে যাবার জন্য মধ্যবর্তী দরজাটার দিকে এগিয়ে গেল। দরজাটা বন্ধ। দরজার কপাটে হাত দিয়ে ঠেলল কিরীটী। কিন্তু খুলতে পারল না।
ভিতরের দিককার ছিটকিনিটা আটকানো।
কিরীটী ঘরে দাঁড়িয়ে ডাকল, অরূপ!
বলুন?
সেদিন যাবার সময় এই দরজার ছিটকিনিটা কি তুলে দিয়ে গিয়েছিলে?
ঠিক মনে পড়ছে না। অরূপ বলে।
সম্ভবত দাওনি। মনে হচ্ছে এটা খোলাই। দেখা যাচ্ছে দরজাটার দুদিক থেকেই আটকাবার ব্যবস্থা আছে। তুমি পাশের ঘরে গিয়ে ওপাশ থেকে দরজাটা খুলে দাও তো।
অরূপ চলে গেল। একটু পরেই ছিটকিনি নামাবার শব্দ হল অন্য ঘর থেকে এবং দরজাটা খুলে গেল।
পাশের ঘরটাই গগনবিহারীর বসবার ঘর।
বসবার ঘরের দরজাটা খোলাই ছিল।
এখন বুঝতে পারছ অরূপ, কাল বা পরশু কোন একসময় রাত্রে কেউ গগনবাবুর শোবার ঘরে ঢুকেছিল!
মৃদু গলায় কতকটা যেন আত্মগতভাবেই কথাগুলো বললে কিরীটী।
রাত্রে এসেছিল?
হ্যাঁ, এ ঘরের আলোটাই তার সাক্ষী।
কথাটা বলতে বলতে কিরীটী আবার মধ্যবতী দরজাপথে শয়নঘরে এসে ঢুকল। অরূপও ওর পিছনে পিছনে আসে।
অরূপ?
বলুন?
ঐ আলমারির চাবিটা কোথায়?
সেদিন তো কোন চাবি পাইনি।
গগনবিহারীর আলমারি ওয়াড্রোব ও দরজার চাবি নিশ্চয়ই ছিল?
থাকাই তো উচিত।
তবে পাওনি কেন?
চাবির ব্যাপার সকলকেই জিজ্ঞাসা করেছিলাম, কিন্তু কেউ বলতে পারল না।
সুবীর ও সুবিনয়বাবুকে জিজ্ঞাসা করেছিলে? তাঁরা কি বলেন?
সুবীরবাবু বলেছিলেন, গগনবিহারী নাকি তাঁর চাবির রিংটা সর্বদা নিজের কাছেই রাখতেন। হি ওয়াজ ভেরি পাটিকুলার অ্যাবাউট হিজ কীজ।
তবে চাবির রিংটা কি হল?
তারপর একটু থেমে বলে, চাবির রিংটা যে পাওয়া যায়নি তা তো তুমি আমাকে বলনি অরূপ?
তদন্তের রিপোর্টে অবিশ্যি নোট করা আছে ডাইরীতে–তবে আপনাকে বলতে ভুলে গিয়েছিলাম।
এখন তাহলে মনে হচ্ছে চাবিটা যে সরিয়েছিল সে-ই কাল বা পরশু কোন এক সময় রাত্রে এই ঘরে এসেছিল। ভাল কথা, আর একটা খবর শুনেছ?
কি?
গত পরশু রাত থেকে শমিতা দেবী নিরুদ্দিষ্ট!
সে কি, কে বলল?
তাঁর দাদা যোগজীবনবাবু।
কিরীটী অতঃপর সেরাত্রের ঘটনাটা সংক্ষেপে বলে গেল।
মিঃ রায়!
বল?
আচ্ছা ঐ শমিতা দেবীই কি–সেরাত্রে—
গগনবিহারীকে হত্যা করেছে কিনা জানি না, তবে এটা ঠিক সেরাত্রে কোন এক সময় শমিতা দেবী এই ঘরে এসেছিল।
কিন্তু তিনি তো ভেইমেন্টলি–
অস্বীকার করেছেন। ঠিকই। তাহলেও যে প্রমাণ সে রেখে গিয়েছিল ঘরে এবং যে প্রমাণ সে তার দেহে সঙ্গে করে নিয়ে গিয়েছিল–সেই দুটোর যোগফল যে দুয়ে দুয়ে চার সেটা তো আর অস্বীকার করতে পারবে না! কিন্তু কথা হচ্ছে, কখন এসেছিল সে? কত রাত্রে? এবং তখন আর কেউ এ ঘরে ছিল কিনা? শোন অরূপ, শমিতা দেবীকে আমাদের খুঁজে বের করতেই হবে–যেমন করেই হোক।
যদি কলকাতা ছেড়ে তিনি চলে গিয়ে থাকেন?
না, তা যায়নি। আর যাবেও না আমার ধারণা। অন্ততঃ গগনবিহারীর মৃত্যুর ব্যাপারটার উপর একটা সমাপ্তির যবনিকা না নেমে আসছে যতক্ষণ।
গগনবাবুর বন্ধু মানে ঐ যোগজীবনবাবু–ওর দাদা কি বলছেন?
তিনি কিছুই বলতে পারছেন না। কেকে ওখানে? কথাটা বলতে বলতে অত্যন্ত ক্ষিপ্রতার সঙ্গে দুই ঘরের মধ্যবর্তী আধভেজানো দরজাটার দিকে ছুটে যায়, দড়াম করে ঠেলে দরজাটার কপাট দুটো খুলে ফেলে কিরীটী। চকিতে একটা রঙিন বস্ত্র যেন মনে হল পাশের ঘরের বাইরে। যাবার দরজাপথে অদৃশ্য হয়ে গেল।
কিরীটী ছুটে যায় সেই দরজাটার দিকে এবং চেঁচিয়ে ওঠে, রুক্মিণী!
রুক্মিণী দাঁড়াল না। সে তার ঘরে ঢুকে গেল। রুক্মিণীর অপস্রিয়মাণ শাড়ির অঞ্চলপ্রান্তটা অরূপেরও নজরে পড়ল। কিরীটী এগিয়ে গেল রুক্মিণীর ঘরের দিকে–কারণ বসবার ঘরের পরের ঘরটাই রুক্মিণী ও রামদেওর ঘর।
রুক্মিণী তাড়াতাড়িতে দরজাটা বন্ধ করতে পারেনি। কিরীটী খোলা দরজাপথে রুক্মিণীর ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। সঙ্গে সঙ্গে অরূপও। দুজনেই দেখতে পেল শয্যার উপর রুক্মিণী শুয়ে, চোখে-মুখে আঁচল চাপা। তার বুকের কাছটা ঘন ঘন আন্দোলিত হচ্ছে।
কিরীটী নিঃশব্দে মুহূর্তকাল শায়িত রুক্মিণীর দিকে তাকিয়ে শান্ত গলায় ডাকল, রুক্মিণী!
রুক্মিণী সাড়া দেয় না।
রুক্মিণী, উঠে বস। হিন্দীতেই কিরীটী বলে, আমি জানি তুমি জেগে–উঠে বস।
শির মে বহুৎ দরদ বাবুজী। কোঁকাতে কোঁকাতে রুক্মিণী বলে। ওঠে না–চোখও মেলে
না।
ওঠ–ওঠ বলছি!
কিরীটীর তীক্ষ্ণ কণ্ঠের নির্দেশে রুক্মিণী আর শুয়ে থাকে না। উঠে বসে খাটের উপর। ঐ ঘরটাও বেশ সাজানো–গোছানো।
একপাশে একটা কাঠের আলমারি, দেওয়ালে একটা প্রমাণ-আরশি। বড় সাইজের একটা খাট। একটা আলনা। তার উপরে শাড়ি ও জামা ভাঁজ করা। গোটা-দুই প্যান্ট ও শার্টও আছে। একটা স্টীলের ট্রাঙ্ক।
কেয়া বাত বাবুজী! কোঁকাতে কোঁকাতে রুক্মিণী আবার বলে।
পাশের ঘরে গিয়েছিলে কেন?
হায় রাম! আমি তো শুয়েছিলাম শির দরদ করছিল বলে। আমি তো যাইনি।
মিথ্যে কথা বলে কোন লাভ নেই। বল, কেন গিয়েছিলি?
হায় রাম! সচ্ বলছি বাবুজী—
যাসনি তুই?
গঙ্গামাঈকি কসম বাবুজী—
চাবিটা কোথায়?
চাবি?
হ্যাঁ। তোর সাহেবের আলমারির চাবি। কোথায় আছে বের করে দে।
সে হামি কি জানি?
তোর কাছেই আছে। বের কর। নাহলে দারোগা সাহেব এখুনি তোকে থানায় ধরে নিয়ে যাবে।
রুক্মিণী চুপ করে থাকে।
অরূপ যাও, নীচে যে সেপাই পাহারায় আছে তাকে আন। ওকে থানায় নিয়ে গিয়ে হাজতঘরে বন্দী করে রাখ।
রুক্মিণী তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে, কেন বাবুজী–হামার কি কসুর হল?
তুই তোর সাহেবের আলমারির চাবি চুরি করেছিস।
না।
আবার ঝুট বলছিস?
নেহি–ঝুটু নেহি—
ওর ঘরটা সার্চ কর তো অরূপ!
পাওয়া গেল না। রুক্মিণীর ঘরের সবকিছু তন্নতন্ন করে খুঁজেও কোন চাবি পাওয়া গেল। কিন্তু চাবি না পাওয়া গেলেও, রুক্মিণীর ট্রাঙ্কের মধ্যে বেশ ভারি ওজনের একজোড়া সোনার বালা, কিছু দামী প্রসাধন দ্রব্য, গোটা–দুই দামী শাড়ি ও একটা ছোট টিনের কৌটোর মধ্যে পাওয়া গেল একশো ও দশ টাকার নোট মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজারের মত টাকা।
ঐ টাকা কার? কিরীটী প্রশ্ন করে।
হায় রাম! কার আবার–আমার!
তুই তো মাইনে পেতিস না–অত টাকা তুই কোথায় পেলি?
আমি–আমি কেমন থতমত খায় রুক্মিণী।
বল, কোথায় পেলি? তোর সাহেব তোকে দিয়েছিল–তাই না?
না। রামদেও আমার মরদ—
আবার ঝুটু বলছিস! সাহেবের সঙ্গে তোর গোপন আশনাই ছিল–-সাহেব তোকে দিয়েছে।
রুক্মিণী চুপ।
শোন, এখনও সব কথা খুলে বলনা হলে এখুনি তোকে থানায় পাঠাব।
গঙ্গামাঈকী কসম–আমি কিছু জানি না বাবুজী। তোর গোড় লাগি—
রামদেও–তোর মরদ কোথায়?
কেমন করে জানব?
তুই জানিস সে কোথায়?
না, জানি না।
রামদেওর কোন ফটো আছে?
আছে। ছিল তো ঐ ট্রাঙ্কের মধ্যে।
কোথায়? তোর বাক্সের মধ্যে তো পাওয়া গেল না?
তবে আমি জানি না।
ঠিক আছে। অরূপ ওকে নিয়ে গিয়ে হাজতে রাখ। আর খবরের কাগজে রামদেও ও শমিতার নামে বিজ্ঞাপন দাও তাদের বর্ণনা দিয়ে।
.
রুক্মিণী চেঁচামেচি কান্নাকাটি শুরু করে দেয়, তাকে যখন গ্রেপ্তার করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। সুবীর আর সুবিনয় এসে সিঁড়ির নীচে দাঁড়ায়।
সুবীর জিজ্ঞাসা করে, ওকে অ্যারেস্ট করলেন নাকি দারোগাবাবু?
হ্যাঁ। অরূপ জবাব দেয়।
আপনাকে আগেই বলেছিলাম, ও মাগীই যত নষ্টের গোড়া। সুবীর বলে।
সুবিনয় কিন্তু কোন কথা বলে না।
সে একপাশে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকে।
১৬. ঐ ঘটনার চারদিন পরে
ঐ ঘটনার চারদিন পরে।
অরূপ থানায় তার অফিস-ঘরে বসেছিল, বেলা তখন সকাল দশটা হবে।
হাতে ধরা একটা ভাঁজকরা সংবাদপত্র। শমিতা এসে অফিস-ঘরে ঢুকল।
আপনিই তো এ থানার ও.সি. মিঃ মুখার্জী?
হ্যাঁ মিস সান্যাল, আসুন।
কাগজে বিজ্ঞাপন দিয়েছেন আমি নিরুদিষ্ট বলে, কি ব্যাপার? এসবের অর্থ কি?
বসুন মিস সান্যাল।
না! আমি বসতে আসিনি। কাগজে বিজ্ঞাপন দেবার উদ্দেশ্যটা জানতে এসেছি। বলুন কি ব্যাপার?
কিরীটী রায়ই আপনার প্রশ্নের জবাব দিতে পারবেন, কারণ তাঁরই নির্দেশে ডি.সি. বিজ্ঞাপনটা দিয়েছিলেন?
বেশ, আমি তাহলে তাঁর কাছেই যাচ্ছি।
যেতে হবে না, আমি তাঁকে ফোনে ডাকছি। বসুন আপনি।
না। আমি সেখানেই যাচ্ছি।
বসুন, বসুন–ব্যস্ত হবেন না মিস সান্যাল। মনে হচ্ছে বিজ্ঞাপনটা কাগজে দেওয়ায় আপনি একটু ক্ষুব্ধ হয়েছেন!
তা যদি হয়েই থাকি, খুব অন্যায় হয়েছে কি? কোথায় কে খুন হয়েছে সেই ব্যাপারের সঙ্গে একজন ভদ্রমহিলাকে জড়িয়ে কাগজে কাগজে ঐ ধরনের বিজ্ঞাপন দিলে সেটার অর্থ যে কি দাঁড়ায় নিশ্চয়ই সেটা আপনাকে বুঝিয়ে দিতে হবে না?
নিশ্চয়ই না।
হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বর শুনে যুগপৎ দুজনেই দরজার দিকে ফিরে তাকাল।
মিঃ রায়! আপনি এসে গেছেন ভালই হল। আমি আপনাকে আসবার জন্য ফোন করার। কথা ভাবছিলাম। অরূপ বলে।
হ্যাঁ, কিছুক্ষণ আগে অমলেন্দুবাবুর ফোনে জানতে পারলাম শমিতা দেবী তাঁর কাছেই আছেন, তাই এসেছিলাম অরূপ তোমাকে নিয়ে তাঁর ওখানে যাব বলে, তা দেখছি উনি নিজেই এসে গেছেন। কিন্তু মিস সান্যাল, আপনি দাঁড়িয়ে কেন, বসুন। কিরীটী বলল।
না। বসবার কোন প্রয়োজন নেই। আপনি কেন বিজ্ঞাপন দিয়েছেন সেটা জানতে পারলেই আপাতত খুশি হব। একটু যেন কঠিন কণ্ঠেই কথাগুলো বলে শমিতা।
আপনি তাহলে বিজ্ঞাপনটা দেখেই এসেছেন? কিরীটী শুধায় শমিতাকে।
হ্যাঁ। নচেৎ আপনি কি মনে করেন সোস্যাল ভিজিট দিতে এসেছি থানায়?
নিশ্চয়ই না। কিন্তু বিজ্ঞাপনটা তত দিন তিনেক হল বের হয়েছে। আপনি তাহলে আরও আগে আসেননি কেন জানতে পারি কি?
সে প্রশ্নের জবাব আমি দিতে প্রস্তুত নই।
বেশ, দেবেন না। কিন্তু প্রশ্নটা স্বাভাবিক বলেই করেছিলাম।
বাজে কথা রেখে এখন বলুন কেন বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন? আপনি কি মনে করেন আমিই সে রাত্রে গগনবিহারীকে হত্যা করেছি?
যদি সেটা ভাবিই তাহলে কি খুব অন্যায় হবে মিস সান্যাল? শান্ত গলায় কিরীটী উচ্চারণ করল।
কিরীটীর স্পষ্টোক্তিটা হঠাৎ যেন শমিতাকে স্তব্ধ করে দেয়। শমিতা কয়েক সেকেন্ড কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে থেকে বলে, আই সী! তা হঠাৎ আমাকে সন্দেহ করলেন কেন জানতে পারি কি?
প্রথমতঃ আপনি পুলিসের কাছে যে জবানবন্দি দিয়েছেন সেদিন এবং আমাকেও যা বলেছেন সেটা অকপট সত্য নয়।
মানে?
মানে আপনি খুব ভালভাবেই সেটা জানেন এবং দ্বিতীয়তঃ আপনার হঠাৎ নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়া–
নিরুদ্দেশ হয়ে গিয়েছি এ ধারণা আপনার হল কেন?
ব্যাপারটা সাদা চোখে বিচার করতে গেলে তাই কি মনে হয় না? ভয় পেয়ে আপনি হঠাৎ গা–ঢাকা দিয়েছিলেন?
গা-ঢাকা দিয়েই যদি থাকি, নিশ্চয়ই তাহলে আজ নিজে এখানে আসতাম না!
যাক সে-কথা। কয়েকটা প্রশ্নের আমার জবাব দেবেন কি?
কি প্রশ্ন?
এক নম্বর, সেরাত্রে মানে দুর্ঘটনার রাত্রে, আপনি রাত পৌনে দশটা নাগাদ মরালী সংঘ থেকে বের হয়ে কোথায় গিয়েছিলেন?
কোথায়ও আমি বের হইনি ঐ সময়, বের হয়েছিলাম রাত সাড়ে বারোটায়।
না। পৌনে দশটায় বের হয়ে আবার রাত বারোটা নাগাদ আপনি ক্লাবে ফিরে যান। এবং সে প্রমাণও আমাদের হাতে আছে।
প্রমাণ?
হ্যাঁ। আপনি ব্যারিস্টার সত্যেন ঘোষালের গাড়ি চেয়ে নিয়ে, বিশেষ কাজ আছে একটু–বলে রাত পৌনে দশটা নাগাদ ক্লাব থেকে বের হয়ে গিয়েছিলেন। ক্যান ইউ ডিনাই ইট?
শমিতা যেন হঠাৎ কেমন স্তব্ধ হয়ে যায়। বোবা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।
বলুন? কোথায় গিয়েছিলেন সে রাত্রে?
বাড়িতে গিয়েছিলাম একটা জরুরী কাগজ আনতে ক্লাবের–
আবার সত্য গোপন করছেন! আপনি যে কোথায় গিয়েছিলেন আমি জানি।
কোথায়? কেমন যেন থতমত খেয়ে কথাটা উচ্চারণ করল শমিতা।
গগনবিহারীর ওখানে।
ইটস্ এ ড্যাম লাই!
না–ইটস্ এ ফ্যাক্ট। এবং সুবিনয়বাবু আপনাকে দেখেছেন। বলুন কেন গিয়েছিলেন?
আমি যাইনি।
গিয়েছিলেন। নাউ টেস্ মি হোয়াই?
হ্যাঁ, গিয়েছিলাম।
জানি। কিন্তু কেন? সাতদিন পরে হঠাৎ কেন গিয়েছিলেন তাঁর কাছে?
গগনবাবু আমাকে ক্লাবে ফোন করেছিলেন বিশেষ কারণে একবার দেখা করার জন্য।
দেখা হয়েছিল তাঁর সঙ্গে?
না!
কেন?
আমি ঘরে ঢুকে দেখি—
কি?
হি ওয়াজ ডেড। সারা মেঝেতে রক্ত।
আমারও অনুমান তাই। কিন্তু সত্যি কথাটা যদি সেদিন বলতেন তবে হয়ত কটা দিন আমাদের অন্ধকারে হাতড়ে বেড়াতে হত না। হত্যাকারীকে আগেই স্পট আউট করা সম্ভবপর হত।
আপনারা বিশ্বাস করবেন না তাই বলতে সাহস পাইনি।
হুঁ। আচ্ছা এবারে বলুন, গগনবাবু যে সমস্ত সম্পত্তি উইল করে আপনাকে দিতে মনস্থ করেছিলেন তা আপনি জানতেন, তাই না?
জানতাম। কারণ ঐ লম্পটটা আমাকে ঐ সম্পত্তির লোভ দেখিয়ে—
বিয়ে করতে চেয়েছিলেন বোধ হয়?
না।
তবে? হি ওয়ানটেড টু এজয় মি। আর সেটা বুঝতে পেরেই—
ঝগড়া করে বের হয়ে এসেছিলেন সাতদিন আগে!
হ্যাঁ।
আর সুবিনয়বাবু?
সুবিনয়!
হ্যাঁ। তাঁর আপনার প্রতি দুর্বলতা ছিল, না?
হি ইজ অ্যান ইমবেসাইল ফুল, একটা নীরেট গর্দভ। দুটো হেসে কথা বলতাম বলে তার ধারণা হয়ে গিয়েছিল তার প্রেমে আমি মজে গিয়েছি।
আর সত্যেন ঘোষাল?
হি ইজ এ গুড ফ্রেন্ড অফ মাইন।
তাঁর প্রতি আপনার কোন দুর্বলতা ছিল না?
কোনদিনও না। আর কিছু আপনার জানবার আছে?
আছে।
আর কি জানতে চান বলুন?
সেকথা জিজ্ঞাসা করবার আগে আপনাকে নিয়ে একবার গগনবাবুর বাড়িতে আমরা যেতে চাই।
গগনবিহারীর ওখানে! বা হোয়াই? কেন?
সবার সামনে একটা মোকাবিলা হওয়া আমাদের সকলেরই প্রয়োজন, তাই—
মোকাবিলা! কিসের?
সেখানে গেলেই সব জানতে পারবেন। আপত্তি আছে?
না। চলুন।
এখন নয়।
তবে কখন?
আজ রাত ঠিক দশটায়।
রাত দশটায়?
হ্যাঁ। আসতে পারবেন না?
পারব। কিন্তু—
বলুন?
আপনি কি এখনও আমার কথাটা পুরোপুরি বিশ্বাস করতে পারছেন না?
না পারলে নিশ্চয়ই এখন আপনাকে ছেড়ে দিতাম না আমরা। আর আপনাকে আটকাব না, এখন আপনি যেতে পারেন।
শমিতা বের হয়ে যাচ্ছিল, কিরীটী পশ্চাৎ থেকে আবার ডাকল, একটা কথা শমিতা দেবী– বলুন?
অমলেন্দুবাবুকেও সঙ্গে নিয়ে আসবেন।
কেন? তাকে দিয়ে কি হবে?
আপনারা দুজনেই জানেন আপনারা পরস্পর কেউ আপনাদের এখনও ভুলতে পারেন নি। ভুল-বোঝাবুঝি যদি একটা অতীতে হয়েই থাকে সেই ভুলটারই জের টেনে চলতে হবে বাকী জীবনটা তারই বা কি মানে আছে!
শমিতা আর কোন জবাব দেয় না। মাথা নীচু করে বার হয়ে যায়।
শমিতা ঘর ছেড়ে বের হয়ে যাবার পর কিরীটী বললে, সত্যি অরূপ, যোগজীবনবাবুর কাছে যেন আমি নিজেকে অত্যন্ত অপরাধী বোধ করছিলাম ঘটনাচক্রে ব্যাপারটার সঙ্গে আকস্মিক ভাবে জড়িয়ে যাওয়ায়।
আপনি কি জানতেন যে শমিতা দেবী হত্যাকারী নয়?
জানতাম।
জানতেন?
জানতাম বৈকি। নচেৎ প্রথম দিনই তোমাকে বলতাম্ ওকে গ্রেপ্তার করার জন্য।
কিন্তু জানলেন কি করে যে উনি সে-রাত্রে গগনবিহারীর ঘরে গিয়েছিলেন?
মনে পড়ে তোমার, মৃতের হাতে এক টুকরো কাচের চুরি পেয়েছিলাম?
মনে আছে বৈকি।
সেই ভাঙা কাচের চুড়ির টুকরো ও শমিতা দেবীর ডান হাতের কজীতে প্লাস্টার দিয়ে ঢাকা গোপন ক্ষতচিহ্নটাই আমাকে জানিয়ে দিয়েছিল সেরাত্রে শমিতা দেবী গগনবিহারীর ঘরে গিয়েছিল।
কাচের চুড়িটা যে ওর হাতেই ছিল তার প্রমাণ কি?
যোগজীবনবাবুই বলেছিল, দুর্ঘটনার দিন দুই আগে শমিতার এক বান্ধবী কাশী থেকে কিছু কাচের চুড়ি এনে ওকে দেয়। সেগুলো তার হাতেই ছিল। অবিশ্যি প্রশ্ন করে সংবাদটা আমাকে সংগ্রহ করতে হয়েছে যোগজীবনবাবুর কাছ থেকে।
কিন্তু তাই যদি হয় তো শমিতা দেবী যা বলে গেলেন তা কেমন করে সত্য হয়? উনি তো ঘরে ঢুকে তাঁকে মৃত দেখেছিলেন!
না–দেখেনি।
তবে?
গগনবিহারী তখনও বেঁচেই ছিলেন। এবং আমার অনুমান যদি মিথ্যে না হয় তো—
কি?
তার উপস্থিতিতেই গগনবিহারী নিহত হন।
তবে নিশ্চয়ই শমিতাদেবী হত্যাকারীকে দেখেছিলেন সে–রাত্রে?
সম্ভবত দেখেনি।
আমি কিছু বুঝতে পারছি না, কেমন যেন সব গোলমাল হয়ে যাচ্ছে মিঃ রায়।
সব অন্ধকার দূর হয়ে যাবে আজ রাত দশটায়। যে ঘরে হত্যা হয়েছিল সেই ঘরেই হত্যাকারীকে আমার ধারণা আজ রাত্রে আমরা খুঁজে পাব। যা হোক, তুমি কিন্তু প্রস্তুত হয়ে যেও অরূপ।
যাব। কিন্তু—
আর কিন্তু নয় রাত দশটায় আজ। চলি এখন।
কিরীটী উঠে পড়ল।
১৭. সেই গগনবিহারীর গৃহে
রাত দশটায়।
সেই গগনবিহারীর গৃহে। তাঁর শয়নকক্ষে–যে কক্ষে কয়েক রাত্রি আগে আততায়ীর ছুরিকাঘাতে তিনি নিহত হয়েছিলেন।
ঘরের মধ্যে উপস্থিত যোগজীবনবাবু, অমলেন্দুবাবু, শমিতাদেবী, সুবীর, সুবিনয়, বাহাদুর, কিরীটী, অরূপ ও ডাঃ অধিকারী–কিরীটীর পরিচিত একজন ডাক্তার।
কিরীটী সম্বোধন করে বলে, আপনারা সকলেই হয়ত একটু অবাক হয়েছেন কেন এভাবে সকলকে আপনাদের আমরা এ সময় এই ঘরে আসতে বলেছিলাম কথাটা ভেবে। আসতে বলেছিলাম এই কারণেই যে–কিরীটী একটু থেমে আবার বলে, আমরা মানে অরূপবাবু, গগনবিহারীর হত্যাকারী কে জানতে পেরেছেন। হি ওয়ান্টস টু আনমাস্ক হিম্ বিফোর অল অফ ইউ!
সকলেই পরস্পর পরস্পরের মুখের দিকে তাকায়।
একটা ভয়–একটা সন্দেহ যেন সকলেরই দৃষ্টিতে স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
কিন্তু সব কথা বলবার আগে শমিতা দেবী, আপনাকে আমি অনুরোধ করছি, সেরাত্রে গগনবাবুর টেলিফোন পেয়ে এ–ঘরে পা দেবার পর কী আপনি দেখেছিলেন–কী হয়েছিল বলুন?
আমি তো সকালেই বলেছি।
আপনি বলেছেন গগনবাবুকে আপনি মৃত দেখেন। কিন্ত তা তো নয়। হি ওয়াজ স্টীল লিভিং–তখনও তিনি বেঁচেই ছিলেন এবং সে–সময় তিনি ফুললি ড্রাঙ্কড়। বদ্ধ মাতাল। কি, তাই নয়?
শমিতা বোবা। পাথর।
বলুন? আমার কথা কি মিথ্যে?
না, তিনি বেঁচেই ছিলেন।
এবং আপনার উপস্থিতিতেই হি ওয়াজ স্ট্যান্ড।
হ্যাঁ। কিন্তু আমি–আমি হঠাৎ ঘর অন্ধকার হয়ে যাওয়ায় বুঝতে পারিনি কে তাকে ছোরা মেরেছিল।
সব বলুন।
ঘরে ঢুকতেই গগনবাবু বলেন তাঁকে বিয়ে করার জন্য বিয়ে করলে সব সম্পত্তি তিনি আমার নামে লিখে দেবেন।
শমিতার বিবৃতি।
শমিতা ঝড়ের মতই এসে ঘরে ঢুকেছিল, ফোন করেছিলেন কেন?
শমি, এস। গগনবিহারী দু হাত বাড়িয়ে দেন শমিতার দিকে।
ডোন্ট টাচ মি।
ডোন্ট বি কুয়েল মাই ডার্লিং। আই লাভ ইউ। আই ওয়ান্ট ইউ বলে টলতে টলতে গিয়ে গগনবিহারী দু হাতে ঝাঁপটে ধরেন শমিতাকে বুকের উপরে।
দুজনে একটা ধস্তাধস্তি শুরু হয়ে যায়। তারপরই হঠাৎ গগনবিহারী একটা আর্ত চিৎকার করে ওঠেন। ঠিক ঐ সময় ঘরের আলোটা দপ করে নিভে যায়।
গগনবিহারীর আলিঙ্গন শিথিল হয়ে যায়। তিনি মাটিতে পড়ে যান। কয়েটা মুহূর্ত অতঃপর স্তব্ধ হয়ে অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকে শমিতা। তারপর একসময় আলোটা জ্বলতেই তার নজরে পড়ে রক্তের স্রোতের মধ্যে গগনবিহারী পড়ে। ঘরময় কাচের চুড়ি। শমিতার ডান হাতের কজীতেও কেটে গিয়েছে, শমিতা ভয়ে তাড়াতাড়ি ভাঙা চুড়িগুলো মেঝে থেকে কুড়িয়ে নিয়ে ঘর ছেড়ে যখন পালাতে যাবে সিঁড়িতে রামদেওর সঙ্গে তার দেখা হয়ে যায়।
শমিতা থামল।
তারপর? কিরীটী শুধায়।
আমি প্রথমে বাড়ি যাই। সেখান থেকে আবার ক্লাবে ফিরে যাই। এর বেশী কিছু আর আমি জানি না। বিশ্বাস করুন–
অরূপ!
বলুন।
রামদেওকে নিয়ে এস এ ঘরে।
অরূপ বের হয়ে গেল।
রামদেও! অধোস্ফুট কণ্ঠে সুবীর বলে।
হ্যাঁ। সুবীরবাবু, দুভাগ্য খুনীর, রামদেও ধরা পড়েছে পরশু রাত্রে মোকামা জংশনে। বলতে বলতে হঠাৎ কিরীটী সুবিনয়ের দিকে তাকিয়ে কঠিন গলায় বলে, উঁহু সুবিনয়বাবু, দরজার দিকে এগুবার চেষ্টা করে কোন লাভ নেই। দি ক্যাট ইজ অলরেডি আউট অফ দি ব্যাগ! তাছাড়া এ বাড়ির চারদিকে পুলিস।
অরূপ এসে ঘরে ঢুকল রামদেওকে সঙ্গে নিয়ে। মাত্র কটা দিনেই লোকটার চেহারা যেন শুকিয়ে গিয়েছে। একমুখ দাড়ি, রুক্ষ চুল, মলিন বেশ, চোখের কোলে কালি। বিষণ্ণ, ক্লান্ত। অরূপ, তুমি সঙ্গে করে যে লৌহবলয় এনেছ–সে দুটি আমাদের সুবিনয়বাবুর হাতে আপাতত পরিয়ে ওকে নিশ্চিন্ত কর।
কিরীটীর কথায় অরূপ যেন কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে যায়।
সুবিনয় বলে ওঠে, এসবের মানে কি কিরীটীবাবু? আপনার কি ধারণা আমিই মামাকে হত্যা করেছি?
ধারণা নয় সুবিনয়বাবু–ইটস্ এ ক্রুয়েল ফ্যাক্ট! কই অরূপ—
অরূপ এগিয়ে সুবিনয়ের হাতে হাতকড়া পরিয়ে দিল।
সুবীর বলে ওঠে ঐ সময় এতক্ষণ পরে, সুবিনয় তুমি! তুমিই তাহলে কাকাকে খুন করেছ?
এ মিথ্যে মিথ্যে সুবীরদা। চেঁচিয়ে ওঠে সুবিনয়, ইট ইজ প্রিপ্রোস্টারাস!
কিরীটী এবারে রামদেওর দিকে তাকাল, রামদেও!
রামদেও কেমন যেন ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।
ডাঃ অধিকারী?
বলুন।
সঙ্গে আপনার সিরিঞ্জ ওপেথিডিন অ্যামপুল একটা এনেছেন তো– যা আনতে বলেছিলাম?
হ্যাঁ।
রামদেকে একটা পেথিডিন ইনজেকশন দিন।
সবাই নির্বাক।
ডাঃ অধিকারী কিরীটীর নির্দেশে রামদেকে একটা পেথিডিন ইনজেকশন দিয়ে দিলেন।
মিনিট কয়েক পরেই রামদেওর চেহারার পরিবর্তন হয়।
চোখের মণি দুটো চকচক করতে থাকে।
রামদেও? কিরীটী আবার ডাকে।
জী!
বল সে রাত্রে তুমি কেন পালিয়েছিলে? আমি বলছি তুমি তোমার সাহেবকে খুন করনি–তুমি নির্দোষ।
আমি খুন করিনি।
বললাম তো, আমি তা জানি।
আমিও সে রাত্রে বার বার বাবুজীকে (সুবিনয়কে দেখিয়ে বলেছিলাম, আমি কিছু জানি , আমি খুন করিনি কিন্তু উনি বললেন, উনি দেখেছেন আমাকে খুন করতে সাহেবকে। পুলিসকে উনি বলে দেবেন। সেই ভয়েই আমি পালাই।
১৮. রুক্মিণীর যৌবন
কিরীটী বলছিল।
রুক্মিণীর যৌবন তিনজনকে আকর্ষণ করেছিল। প্রৌঢ় গগনবিহারী আর যুবক সুবিনয় ও সুবীর। তবে সুবীর ভীতু প্রকৃতির। কিন্তু রুক্মিণী গভীর জলের মাছ। সে কারও কথা কারও কাছে না বলে দুজনকেই নিয়ে খেলিয়েছে। রামদেও মিলিটারি ফেরতা রগচটা লোক ব্যাপারটা কোনক্রমে জানতে পারলে ছোরা বসিয়ে দেবে বুকে। তাই সুবিনয় কৌশলে রামদেকে পেথিডিনে অ্যাডিক্ট করে ক্রমশঃ তাকে হাতের মুঠোর মধ্যে নিয়ে আসে। সুবীর ভীতু প্রকৃতির আগেই বলেছি–সে বেশীদূর অগ্রসর হবার সাহস পায়নি–কাজেই সুবিনয়ের আরও সুবিধা হয়ে যায়।
তারপর? অরূপ জিজ্ঞাসা করে।
কিন্তু গোপন প্রেমের যা শেষ পরিণতি–শেষ পর্যন্ত তাই হয়েছিল। গগনবিহারী ব্যাপারটা জানতে পেরে গিয়েছিলেন। এবং সে জানাটা আদৌ তাঁর পক্ষে আনন্দের হয়নি। আর কেউ না–তাঁরই আশ্রিত এবং তাঁরই ভাগ্নে তাঁর লালসার ভোগে ভাগ বসাচ্ছে জানতে পেরে নিশ্চয়ই ক্ষেপে উঠেছিলেন তিনি। ফলে তিনি সুবিনয়কে ডেকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেন।
কবে? অরূপ প্রশ্ন করে।
কিরীটী বললে, যে রাত্রে দুর্ঘটনাটা ঘটে সেইদিন সকালে।
জানলেন কি করে?
ঠাকুর প্রিয়লালের কাছে। ঐদিন সকালে অফিস যাবার আগে খেতে বসে সুবিনয় বলেছিল প্রিয়লালকে, পরের দিনই সকালে সে ঐ বাড়ি ছেড়ে চলে যাচ্ছে।
তারপর?
কিন্তু সুবিনয় মুখে যাই বলুক রুক্মিণীর উগ্র রূপ ও যৌবন যার স্বাদ সে পেয়েছিল সেটা ভুলে যাওয়া বা সে লোভ দমন করা সুবিনয়ের পক্ষে তখন আর সম্ভবপর ছিল না। তাছাড়া জগতে বিশেষ একশ্রেণীর নারী আছে যারা পুরুষকে একেবারে কুক্ষিগত করে ফেলে তাদের যৌন আবেগ দিয়ে, একবার কোন পুরুষ তার বাহুবন্ধনে ধরা দিলে। সুবিনয়েরও হয়েছিল তাই–ঐ রুক্মিণীও হচ্ছে সেই শ্রেণীর স্ত্রীলোক। তাই শেষ পর্যন্ত রুক্মিণীকে হারাবার ভয়ে সুবিনয় ডেসপারেট হয়ে ওঠে।
ওরা মন্ত্রমুগ্ধের মত শুনছিল।
অরূপ বলে, আশ্চর্য! মানুষটাকে দেখে একবারও মনে হয় না ঐ প্রকৃতির–
ওরা হচ্ছে বর্ণচোরা আম। তাই তো প্রথমটায় আমার ধোঁকা লেগেছিল। কিন্তু তিনটে ব্যাপার আমার মনকে সন্দিগ্ধ করে তোলে। এক নম্বর, জ্যাকিকে ওষুধ দিয়ে নিস্তেজ করে ফেলা। আর দু নম্বর, সে–রাত্রে সুবিনয়ের গৃহে উপস্থিতি। এবং শেষ তিন নম্বর, যেভাবে গগনবিহারীকে আমূল ছোরা বিঁধিয়ে হত্যা করা হয়েছিল সেটা কোন শক্তিশালী লোক ছাড়া সম্ভব ছিল না। সঙ্গে সঙ্গে আমি মনে মনে সমস্ত ব্যাপারটার অ্যানালিসিস শুরু করি। প্রথমত কার কার পক্ষে গগনবিহারীকে হত্যা করা সম্ভব ছিল ভাবতে গিয়ে এবং সমস্ত ব্যাপারটা ও গগনবিহারীর চরিত্র বিশ্লেষণ করে মনে হয়েছিল চারজনের পক্ষে সেটা সম্ভব ছিল–রুক্মিণী, শমিতা, রামদেও ও সুবিনয়। রুক্মিণীকে বাদ দিয়েছিলাম হিসাব থেকে এই কারণে যে তার কাছে গগনবিহারী ছিল স্বর্ণডিম্বপ্রসবকারী হংস। কাজেই সে গগনবিহারীকে হত্যা করতে পারে না। শুধু তাই নয়, ঐভাবে আমূল ছোরা বিঁধিয়ে তার মত একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে হত্যা করাও সম্ভব ছিল না। তারপর শমিতা। গগনবিহারীর হাতের মুঠোয় ভাঙা চুড়ি ও শমিতার হাতের ক্ষত যদিও উভয়ের মধ্যে একটা স্ট্রাগলের সম্ভাবনা আমার মনে উঁকি দিয়েছিল কিন্তু সেও নারী। একই কারণে রুক্মিণীর মত তাকেও আমি হিসাব থেকে বাদ দিয়েছিলাম।
তারপর?
তারপর রামদেও। গগনবিহারীকে এত বোকা ভাবতে পারি না যে তিনি রামদেওর চোখের উপরেই তার বৌকে সম্ভোগ করবেন। তাছাড়া সে গগনবিহারীকে হত্যা করলে তার বিশ্বাসঘাতিনী স্ত্রীকেও বাদ দিত না। তাকেও ঐ একই সঙ্গে শেষ করে দিত। তাহলে বাকি থাকে সুবিনয়। সন্দেহটা সুবিনয়ের উপর পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই তার চেহারা, তার উপস্থিতি সে রাত্রে ও সে একজন মেডিকেল রিপ্রেজেনটেটিভ–সব মিলিয়ে আমার মনকে সজাগ করে তোলে। তারপর জ্যাকিকে ওষুধ দিয়ে নিস্তেজ করা–রামদেও ধরা পড়বার পর সেও অ্যাডিক্টেড জানতে পেরে আমার কোন সন্দেহের আর অবকাশ রইল না। অবিশ্যি তার আগেই শমিতা দেবীর কিছুটা সত্য বিবৃতিও সেদিন থানায় আমার সন্দেহকে ওর ওপরে আরও দৃঢ় করে তুলেছিল। যাক, এবারে আসল ঘটনায় আসি।
কিন্তু একটু থেমে আবার শুরু করল, সুবিনয় সম্ভবত রুক্মিণীর মুখেই গগনবিহারী ও শমিতার সব ব্যাপারটা ও ঝগড়ার ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল আর সেইটাই সে শেষ মুহূর্তে কাজে লাগায়।
কি ভাবে? অরূপ শুধায়।
সুবিনয় ফোন করেছিল শমিতাকে ক্লাবে। গগনবিহারী নয়। আমার ধারণা–কারণ সে শমিতার উপরে দোষটা চাপাবার জন্য তাকে অকুস্থলে টেনে নিয়ে আসে। শমিতা আসতেই তারপর যা যা ঘটেছিল সেও শমিতার মুখেই তোমরা শুনেছ। যখন দুজনে ঝটাপটি চলেছে তখন পশ্চাৎ দিক থেকে সুবিনয় গগনবিহারীকে ছোরা মেরেই ঘর ছেড়ে যাবার আগে ঘরের আলোটা নিভিয়ে দেয়। কাজেই শমিতা সুবিনয়কে দেখতে পায়নি। সব ব্যাপারটা রুক্মিণী জানতে পেরেছিল অবিশ্যি, কিন্তু সেও ভয়ে মুখ খোলেনি। গগনবিহারীর কোট ও জুতোটা আগে থাকতেই সরিয়ে রেখেছিল সুবিনয়। একটা গায়ে ও একটা পায়ে দিয়ে হত্যা করেছিল যাতে পুলিসের কুকুর ও জ্যাকিকেও ধোঁকা দিতে পারে। সর্বশেষে পেথিডিনে অ্যাডিক্টেড, সম্পূর্ণ তার হাতের কজীতে, রামদেকে ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দেয়। সম্পূর্ণ আটঘাট বেঁধেই প্ল্যান করে সব কিছু করেছিল সুবিনয়, কিন্তু এত করেও সে নিজেকে বাঁচাতে পারল না, সে নিজের ভুলের ফাঁদেই নিজে আটকে পড়ল।
হ্যাঁ। এমনিই হয়। সবার চোখের আড়ালে একজন যিনি সর্বক্ষণ চোখ মেলে বসে আছেন তাঁকে ফাঁকি দেওয়া শেষ পর্যন্ত যায় না। সুবিনয়ও পারল না। ভুলের কথা বলছিলাম না! প্রথম ভুল সে করেছিল জ্যাকিকে ঘুমের ওষুধ দিয়ে ঘুম পাড়াবার চেষ্টা করে। যদিও তা পুরোপুরি। সম্ভবপর হয়নি। দ্বিতীয় ভুল রামদেওকে ভয় দেখিয়ে সরিয়ে দিয়ে। পাছে নিজে ধরা পড়ে যায় এবং সে যে আগে রামদেকে পেথিডিনে অ্যাডিক্টেড করেছে সেটা কোনক্রমে প্রকাশ। হয়ে পড়ে।
রামদেওকে খুন করে ফেললেই তো একেবারে ল্যাঠা চুকে যেত! অরূপ বলে।
তা যেত—কিরীটী বলে, কিন্তু তখন আর সেটা হয়ত সম্ভবপর ছিল না। অবিশ্যি সে যদি আগে রামদেকে শেষ করত, তবে চট করে হয়ত রামদেওর প্রবলেম তার সামনে এসে দাঁড়াত না। কিন্তু সেরকম পরিকল্পনা হয়ত ওর মাথায় আসেনি। রামদেও পুরোপুরি তার হাতের মুঠোর মধ্যে ছিল বলে রামদেওর ব্যাপারটা পরে কোন একসময় মেটাবে মনে করে রামদেকে তখনও হয়ত শেষ করেনি। এবং তৃতীয় ও মারাত্মক ভুল যেটা করেছিল সুবিনয় সেটা হচ্ছে গগনবিহারীর জামা ও জুতো চুরি করে হত্যার সময় সেটা ব্যবহার করে। ঐ দুটো বস্তুই আমাকে। স্থিরনিশ্চিত করেছিল হত্যাকারী ঐ বাড়িরই কেউ, যার পক্ষে ঐ দুটি বস্তু হাতানো সম্ভবপর ছিল। সর্বশেষে ঐ দুটি বস্তুর ব্যবহার থেকেও আমার যে কথাটি মনে হয়েছিল সেটা হচ্ছে হত্যাকারী রামদেও নয়—হয় সুবিনয়, না হয় সুবীর—দুজনের একজন।
তাহলে যত নষ্টের মূল রুক্মিণীই দেখতে পাচ্ছি! অরূপ বলে।
হ্যাঁ। রুক্মিণী নয়, বল বনমরালী। গগনবিহারীর সাধের বনমরালীই শেষ পর্যন্ত তাঁর মৃত্যুর কারণ হল।
কিরীটী থামল।
.
পরের দিন প্রত্যুষে লেকে দেখা হল যোগজীবনবাবুর সঙ্গে কিরীটীর। এই কদিন ভদ্রলোক লজ্জায় বেড়াতেও আসেননি লেকে সকালে বোধ হয়।
রায় সাহেব।
যোগজীবনের ডাকে কিরীটী ফিরে তাকায়।
শমিতা দেবীর খবর কি সান্যাল মশাই?
সে অমলেন্দুর ওখানেই আছে।
মিটে গিয়েছে তাহলে?
তাই তো মনে হচ্ছে।
যাক। পাশ থেকে যোগেশবাবু বলে উঠলেন, তাহলে শেষ পর্যন্ত মধুরেণ সমাপয়েৎ!
ফণীবাবু বললেন, আজকালকার পোলাপান কি যে ভাবে আর কি যে করে—
কিরীটী শেষ করে কথাটা, বোঝাই যায় না!
সকলে হেসে ওঠে।