তার পদবী যাই থাক, সবাই রামানুজ বলেই জানে এবং ডাকে। রামানুজই হোটেলের সুপারভাইজার ও কেয়ারটেকার।
রামানুজই আমাদের অভ্যর্থনা করে নিয়ে গিয়ে ম্যানেজারের ঘরে বসাল, কাম-কাম, ওয়ান্ট রুম-সিঙ্গল-ডবল-ভেরি চিপ স্যার-ভেরি চিপ।
রামানুজের বয়স আটাশ-ত্রিশের বেশী হবে না।
অনর্গল ভুল ইংরাজী বলা তার মুদ্রাদোষ একটা। তবে সত্যিই সুশ্রী। লম্বা ঢ্যাঙা চেহারা। টকটকে রঙ-কটা চুল, কটা চোখ।
পরিধানে একটা স্ন্যাক-হাওয়াই শার্ট চিত্র-বিচিত্র অ্যামেরিকান টাইপের এবং পায়ে হাওয়াই চপ্পল। মুখে ধূমায়মান সিগারেট।
মিঃ মহান্তি শুধায়, মিঃ বিশ্বাস কোথায়?
হোয়াই স্ট্যাডিং? বসুন না বসুন, মিঃ বিশ্বাস মনে হয় থানাতেই গন। এখুনি আসবেন-কামিং সুন।
কথাটা শুনে আমরা পরস্পরের মুখ চাওয়া-চাওয়ি করি।
মহান্তি বলে, মিসেস বিশ্বাস নেই?
হ্যাঁ–কিচেনে আছে-কল হার?
হ্যাঁ, তাকে খবর দিন।
রামানুজ চলে গেল এবং মিনিট দশেক পরেই রেণুকা বিশ্বাস এসে ঘরে ঢুকল। নমস্কার মিঃ মহান্তি—কি খবর? মিঃ বিশ্বাস তো থানাতেই গিয়েছেন আপনার কাছে। দেখা হয়নি?
না। তার আগেই আমরা বের হয়ে পড়েছি।
ও, তাই বুঝি—
হ্যাঁ।
তবে বসুন না, এখুনি হয়ত এসে পড়বেন।
আমরা বসলাম।
একটু চায়ের কথা বলে আসি!
না, না-আপনাকে এই দুপুরে ব্যস্ত হতে হবে না। আপনি বসুন মিসেস বিশ্বাস—
মৃদু হেসে মিসেস বিশ্বাস একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসল।
পরে পরিচয় জেনেছিলাম মহান্তিরই মুখে ঐদিনই-মিসেস বিশ্বাসের মিশ্র রক্তে জন্ম।
ওর মা ছিল আদিবাসী সাঁওতাল, আর বাপ একজন স্কচ মিশনারী ডাক্তার। জম্মস্বত্বে কিন্তু স্কচ বাপের সব বৈশিষ্ট্যই পেয়েছিল মহিলা।
০৪. বেঁটেখাটো গড়ন রেণুকা বিশ্বাসের
বেঁটেখাটো গড়ন রেণুকা বিশ্বাসের। এবং বয়স চল্লিশের নিচে নয় বলেই মনে হয়।
কিন্তু বয়েস হলেও বোঝবার উপায় নেই, কারণ ছেলেপিলে না হওয়ার দরুনই বোধ হয় দেহের গড়ন এখনও এ বয়সেও বেশ আঁটসাঁট এবং যৌবন যেন সমস্ত দেহে ছড়িয়ে আছে এখনও।
রীতিমত ফর্সা গাত্রবর্ণ। রামানুজের মতই কটা চুল, কটা চোখ। পরিধানে কিন্তু বাঙালী মেয়েদের মত ড্রেস করে একটি ভাল শাড়ি পরা। মাথার চুল পরিপাটি করে আঁচড়ানো। খোঁপায় একটি ফুল গোঁজা। হাতে চারগাছা করে সোনার চুড়ি।
কথাটা মহান্তিকে তুলতে হল না-মিসেস বিশ্বাসই উত্থাপন করল। বললে, একটা বড় স্যাড ব্যাপার ঘটে গিয়েছে!
কি হল?
আমাদের হোটেলেরই একজন বোর্ডার মনে হচ্ছে গতরাত্রে সমুদ্রের জলে সুইসাইড করেছিল
সুইসাইড! মহান্তি তাকাল মিসেস বিশ্বাসের মুখের দিকে।
তাছাড়া আর কি! কিন্তু বুঝতে পারছি না ভদ্রলোক হঠাৎ ওভাবে সুইসাইড করতে গেলেন কেন? অথচ পাঁচ-সাতদিন এখানে আছেন, খুব সোবার ধীর-স্থির বলেই তো মনে হয়েছে ভদ্রলোককে।
তবে হঠাৎ সুইসাইড করতে গেলেন কেন?
তাই তো বলছি-কিছু মাথামুণ্ডু বোঝাই যাচ্ছে না। বলেছিলেন এক মাস থাকবেন–
কোন্ ঘরে থাকতেন? মহান্তি আবার প্রশ্ন করে।
দোতলার দুটো পাশাপাশি ঘর নিয়ে ছিলেন।
সঙ্গে আরও কেউ ছিল বুঝি?
না, একাই ছিলেন। বড়লোক মানুষ, তাই হয়তো একটু হাত-পা ছড়িয়ে থাকা অভ্যাস। দুটো ঘর হয়ত সেইজন্যই নিয়েছিলেন। কিন্তু এঁদের তো চিনতে পারছি না—আপনার সঙ্গে এরা–
আমার বিশেষ বন্ধু—
ও—তা আপনি কি মিঃ বিশ্বাসের সঙ্গে দেখা করতেই এসেছেন?
হ্যাঁ। আপনার হোটেলের বোর্ডার কালী সরকারের ব্যাপারেই–
কথাটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে লক্ষ্য করলাম, রেণুকা বিশ্বাসের কটা চোখের চাউনি যেন হঠাৎ তীক্ষ্ণ হয়ে উঠল এবং পর্যায়ক্রমে আমাদের সকলের মুখের উপর দিয়ে দ্রুত একবার ঘুরে গেল।
বুঝলাম ভদ্রমহিলাটি বুদ্ধি ধরে এবং সজাগ। অতঃপর রেণুকা বিশ্বাস একটু যেন নিজেকে গুছিয়ে নিয়ে বললেন, কি ব্যাপার বলুন তো মিঃ মহান্তি? কোন রকম সন্দেহজনক কিছু কি?
তা একটু সন্দেহের কারণ ঘটেছে বৈকি মিসেস বিশ্বাস!
মিঃ মহান্তি, এটা আমার হোটেল, দশজন আসা-যাওয়া করছে সর্বক্ষণ এবং দশজনকে নিয়ে ব্যাপার। সেরকম কিছু হলে বুঝতেই পারছেন হোটেলের একটা দুর্নাম ছড়িয়ে পড়বে।
ব্যস্ত হবেন না মিসেস বিশ্বাস-কিরীটীই এবার কথাটা বললে, মিঃ মহান্তি যথাসাধ্য। গোপনেই ব্যাপারটা অনুসন্ধান করবেন এবং আপনার যাতে করে কোন ক্ষতি না হয় সেটাও
উনি দেখবেন বৈকি। তবে
কী বলুন?
বুঝতেই তো পারছেন একটা সন্দেহজনক মৃত্যুর ব্যাপার—
সন্দেহজনক মৃত্যু! কি বলছেন আপনি?
দুঃখিত আমরা মিসেস বিশ্বাস, মহান্তিই এবারে বলে, কালী সরকারের মৃত্যুর ব্যাপারে সত্যিই খানিকটা সন্দেহ রয়েছে, আমাদের ধারণা।
সন্দেহ! দুর্ঘটনা—মানে সুইসাইড নয় বলেই তাহলে আপনাদের ধারণা?
হ্যাঁ, দুর্ঘটনা অবশ্যই-তবে সুইসাইড কিনা সত্যি-সত্যিই এখনও সেটা প্রমাণসাপেক্ষ।
মানে?
বুদ্ধিমতী আপনি-কিরীটী বলে, আপনিই ভেবে দেখুন না, আপনি যা যা একটু আগে কালী সরকার সম্পর্কে বললেন, তাতে করে লোকটা হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই সুইসাইড করে বসবে, সেরকম কিছু বলে কি আপনার মনে হয়?
না।
তাছাড়া কালী সরকারকে—কিরীটী বলে, আমি এককালে ভাল করে চিনতাম। আমার সহপাঠী ছিল।
হ্যাঁ। লোকটা অবস্থাপন্ন নিঝঞ্জাট শান্ত স্থির বিবেচক বুদ্ধিমান।
কিন্তু–