আপনার তাই ধারণা?
হ্যাঁ, কারণ এক হতে পারে লোকটা সমুদ্রের জলে আত্মহত্যা করবার জন্য ঝাপিয়ে পড়েছিল কিংবা স্নান করতে গিয়ে আচমকা ঢেউয়ের টানে অগাধ জলে গিয়ে আর সামলাতে পারেনি। কিন্তু ভাবলে মনে হবে, দুটোই যেন কতকটা অসম্ভব।
কেন—অসম্ভব কেন?
প্রথমতঃ লোকটা আমার পরিচিত ছিল।
বলেন কী!
হ্যাঁ, গতকাল সন্ধ্যায়ও ওর সঙ্গে সমুদ্র-সৈকতে আমার দেখা হয়েছে। আত্মহত্যা যদি সে করতও—সমুদ্রজলে ঝাপিয়ে তার পক্ষে সহজসাধ্য ছিল না আত্মহত্যা করাটা, যেহেতু লোকটা এককালে খুব ভাল চ্যাম্পিয়ান সাঁতারু ছিল। দ্বিতীয়তঃ স্নান করতে গিয়ে যদি স্লিপ করে থাকে-সেও নিশ্চয়ই শেষরাত্রে অন্ধকার থাকতে স্নান করতে যায়নি—কেউ যায় না বিশেষ করে সমুদ্রস্নানে—তাই যেন আমার মনে হচ্ছে ওকে কেউ হত্যা করেছে–
হত্যা করেছে-বলেন কী?
হ্যাঁ। অবিশ্যি হত্যাকারী হয়ত ভেবেছিল, নিঃশব্দে হত্যা করে রাতের অন্ধকারে একবার যদি মৃতদেহটা সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেওয়া যায়—তার কার্যসিদ্ধি হবে এবং হত্যার সমস্ত প্রমাণ সমুদ্রের জল ধুয়ে-মুছে দেবে। কিন্তু–
মহাতি কিরীটীর মুখের দিকে সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাকাল।
কিরীটী বলে, কিন্তু বেচারীর বোধ হয় বিধি বাম। সমুদ্র তো বিশ্বাসঘাতকতা করেছেই–মৃতদেহটা বেশী দূরে টেনে না গিয়ে আশেপাশেই কোথাও ভাসছিল যার ফলে নুলিয়াদের নজরে পড়ে গেল, আর সেই সঙ্গে
কি সেই সঙ্গে?
মহান্তি কাল কিরীটীর মুখের দিকে।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, কিরীটী রায়ের উপস্থিতি পুরীতে—কিন্তু সেজন্যও ঠিক নয় মহাতি সাহেব। আমি এসেছি বিশেষ করে কথাটা আপনাকে জানাতে—একটু আগেই আমি আপনাকে বললাম না—আমি ওকে চিনতাম। লোকটার নাম কালী সরকার-কলকাতা শহরের একজন নামী ও ধনী জুয়েলার।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। মাঝখানে অবিশ্যি অনেকদিন আমার ওর সঙ্গে দেখা হয়নি, তবে দেখা না হলেও কাগজেই হয়ত আপনিও দেখে থাকবেন, ভাইয়ে ভাইয়ে গণ্ডগোল হয়ে বৎসরখানেক আগে সব পাটিশন হয়ে আলাদা আলাদা হয়ে গিয়েছে-পাঁচ ভাইয়ের মধ্যে পার্টিশন–
জাস্ট এ মিনিট মিঃ রায়, মহান্তি বাধা দেয় ঐ সময়, ওরই ভাইরা কি-রাখাল সরকার, বৃন্দাবন সরকার, গোকুল সরকার
হ্যাঁ, কালী রাখাল বৃন্দাবন গোকুল আর দুর্গা সরকার। একদা কালীর সঙ্গে প্রেসিডেন্সীতে বছর তিন পড়েছিলাম। ম্যাথেমেটিকসে খুব মাথা ছিল ঐ কালীর।
তাই বুঝি?
হ্যাঁ। আর দেখতে লোকটা, মানে চেহারাটা, একটা বনমানুষ ও ভিলেনের মত হলেও খুব শান্ত নিরীহ প্রকৃতির ছিল বলেই জানতাম।
কথাগুলো বলতে বলতে কিরীটী আড়চোখে আমার দিকে তাকাল।
তাহলে তো একবার উঠতে হচ্ছে!
হ্যাঁ-চলুন একবার ঘুরে আসবেন।
কিরীটী উঠে দাঁড়াতেই মহান্তি বাধা দেয়, আরে উঠছেন কি, বসুন-বসুন—চা আসুক। আগে চা খান-মৃতদেহ যখন ডানা মেলে উড়ে যাবে না।
কিরীটী মৃদু হেসে বলে, তা অবিশ্যি যাবে না। কিন্তু আপনার একবার যত শীঘ্র সম্ভব মনে হয় সেখানে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে এলে ভাল হয়।
সে তো যাবই। বসুন-বসুন—
অগত্যা আমাদের পুনরায় বসতেই হল।
এবং সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় চা এসে গেল। শুধু চা নয়, তার সঙ্গে প্রচুর জলখাবারও। চা ও জলখাবারের ব্যাপার শেষ করে আরও আধ ঘণ্টা পরে আমরা উঠলাম। আসবার সময় মিঃ মহান্তি বললেন থানায় মৃতদেহ এলেই আমাদের খবর দেবে।
০৩. থানা থেকে আমাদের ডাক
বেলা প্রায় নটা নাগাদ থানা থেকে আমাদের ডাকতে লোক এল। মহান্তি সাহেব ডেকে পাঠিয়েছে।
আমরা প্রস্তুতই ছিলাম। সঙ্গে সঙ্গে রওনা হলাম। থানায় পৌঁছে দেখি মহান্তি সাহেব বসে আছে মৃতদেহের অপেক্ষায়। মৃতদেহ তখনও এসে পৌঁছয়নি।
কালী সরকারের মৃতদেহটা থানায় এসে পৌঁছল যখন তখন বেলা প্রায় সাড়ে দশটা।
একটা স্ট্রেচারে করে—একটা কম্বল দিয়ে ঢেকে মৃতদেহ থানায় বহন করে নিয়ে আসা হয়েছিল। বাহকরা এলে স্ট্রেচারটা সামনের বারান্দায় নামিয়ে রাখল মহাতি সাহেবের নির্দেশে।
ইতিমধ্যে মহান্তি সাহেব সমুদ্রতীরে গিয়ে সরেজমিন তদন্ত করে এসেছিল। এবং সেই। প্রসঙ্গেই ঐ সময় কিরীটীর সঙ্গে মহান্তি সাহেবের আলোচনা চলছিল।
মহান্তি সাহেবের ইঙ্গিতে বাহকদের মধ্যে একজন মৃতদেহের উপর থেকে কম্বলটা সরিয়ে নিল। কিরীটী উঠে দাঁড়ায় এবং স্ট্রেচারে শায়িত মৃতদেহের কাছে এগিয়ে যায়—বোধ করি মৃতদেহটা আর একবার ভাল করে দেখবার জন্য। বলাই বাহুল্য আমিও সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়িয়ে কিরীটীকে অনুসরণ করি।
আবার মৃতদেহের দিকে তাকালাম।
কিরীটীর সন্দেহ মিথ্যা নয়। গলার দাগটা সত্যিই সন্দেহজনক। এবং মনে হয় না। অনেকক্ষণ মৃতদেহটা সমুদ্রের জলে ছিল। খুব জোর ঘণ্টা দেড়েক বা দুই। তার বেশী নয়। এবং মৃতদেহে রাইগার মর্টিস তখনও সেট-ইন করেনি পরীক্ষা করে বোঝা গেল। তাতেই অনুমান হয় রাত বারোটার পরে কোন এক সময় নিহত হয়েছে লোকটা সম্ভবত।
পরীক্ষা করা হয়ে গেলে কিরীটী কম্বলটা আবার টেনে দেয় মৃতদেহের উপরে। ফিরে এসে চেয়ারে বসল।
তাহলে মিঃ রায়, আপনি নিঃসন্দেহ-লোকটাকে হত্যাই করা হয়েছে! মহান্তি কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে আবার প্রশ্নটা করে।
হ্যাঁ, মহান্তি সাহেব। অবিশ্যি লোকটার মৃত্যুর কজ অর্থাৎ স্ট্যাজুলেশান-শাসরোধ হয়ে