ক্রমেই মানুষের ভিড় একজন দুজন করে বাড়ছে।
হঠাৎ দেখি কিরীটী মৃতদেহের সামনে হাঁটু গেড়ে বসে, ঈষৎ ঝুঁকে মৃতদেহে কি যেন লক্ষ্য করছে।
আমি একটু এগিয়ে যাই।
কিরীটী সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ায় এবং কতকটা যেন আত্মগতভাবেই অত্যন্ত মৃদুকণ্ঠে বলে, হুঁ–
ওর মুখের দিকে সঙ্গে সঙ্গে আমি তাকালাম ও প্রশ্ন করলাম, কি রে?
কিরীটী মৃতদেহের দিকে চোখের ইঙ্গিত করে বলে, দেখ–
কী?
দেখ, লক্ষ্য করে দেখ ভাল করে, কালীর গলায়
কী-বলে তাকাতেই আমারও নজরে পড়ল। কালো একটা আধ-ইঞ্চি চওড়া সরু ফিতের মত দাগ গলায় ঠিক চিবুকের নীচে।
হঠাৎ দেখলে মনে হয় যেন আবছা আবছা একটা কালো ফিতে গলায় জড়ানো। প্রথমে তাৎপৰ্যটা মনের মধ্যে উদয় হয়নি। কিরীটীর দ্বিতীয় কথার সঙ্গে সঙ্গে যেন মনের মধ্যে একটা বিদ্যুৎ ঝলক দেয়।
স্ট্রাঙ্গুলেশন নয় তো!
কিরীটী স্বগতোক্তির মতই যেন ফিসফিস করে কথাটা উচ্চারণ করে। কিন্তু তৎসত্ত্বেও কথাটা কানে আমার প্রবেশ করেছিল।
সত্যিই তো! সঙ্গে সঙ্গে মনে দেখা দেয় সন্দেহটা, গলা টিপে হত্যা করে কেউ কালীকে সমুদ্রের জলে রাতারাতি ভাসিয়ে দেয়নি তো!
সম্ভবতঃ তাই এবং তাহলে তো ব্যাপারটা নিষ্ঠুর একটা হত্যা! কালী সরকার তাহলে নিহত হয়েছে!
হঠাৎ কিরীটীর হাতের স্পর্শে ফিরে তাকাই।
কি?
চল।
ভিড় ছেড়ে দুজনে খানিকটা এগিয়ে এলাম বালুর উপর দিয়ে হেঁটে। সূর্যোদয় আর দেখা হয়নি। ইতিমধ্যে সূর্যদেব অনেকটা উঠে গিয়েছে জলশয্যা ছেড়ে।
কিরীটী দেখি হনহন করে ক্রমশঃ সমুদ্রতীর ছেড়ে পাড়ের দিকে হেঁটে চলেছে। পাড়ে উঠে শহরের দিকে চলেছে।
কোথায় চলেছিস?
বিজয় মহান্তির ওখানে।
সঙ্গে সঙ্গে মনে পড়ল, বিজয় মহান্তির সঙ্গে মাত্র পরশুই ঘটনাচক্রে আলাপ হয়েছে। ওখানকার, ও, সি, বিজয় মহান্তি।
.
রিকশাওয়ালার সঙ্গে ভাড়া নিয়ে গোলমাল হওয়ায় কিরীটী সাইকেল-রিকশাওয়ালাটাকে ধরে নিয়ে সোজা থানায় গিয়েছিল।
সেখানেই বিজয় মহান্তির সঙ্গে আলাপ। লোকটি বেশ ভদ্র ও অমায়িক এবং কিরীটীর
পরিচয়টা আমি দিতে আমাদের সে কি সাদর অভ্যর্থনা!
কী সৌভাগ্য আমার! আপনাদের সঙ্গে আলাপ করে যে কি খুশি হলাম! তারপরই প্রশ্ন করেছিল, নিশ্চয়ই বেড়াতে এসেছেন মিঃ রায় পুরীতে?
হ্যাঁ। এবং সমুদ্র-দর্শন। কিরীটী জবাব দিয়েছিল, বেড়ানোটা গৌণ, সমুদ্রদর্শনটাই মুখ্য।
আসবেন কিন্তু মাঝে মাঝে।
কিরীটী প্রত্যুত্তরে হেসেছিল মৃদু, কোন জবাব দেয়নি।
আমি তো জানি, এতকাল খুন-জখম-চুরি-বাটপাড়ি এবং সেই কারণে থানা-পুলিস ঘেঁটে ঘেঁটে ওর ঐসবের প্রতি একটা বিতৃষ্ণা জন্মে গেছে। পারতপক্ষে আজকাল ঐসব স্থানে ও যেন পা দিতেই চায় না।
তাহলেও সেদিন থানা থেকে বের হয়ে হোটেলের দিকে যেতে যেতে বলেছিল কিরীটী, মিঃ কাগতাভুয়া মনে হল বেশ সজ্জন ব্যক্তি! আর এদের ক্ষেত্রে সাধারণতঃ যা হয় তাও নয়—ঘটে কিছু বুদ্ধি ধরে!
কাগতাড়ুয়া! সে আবার কোথা থেকে এল?
কেন রে! মহান্তি সাহেবকে কাগতাড়য়ার মতই দেখতে মনে হল না!
সত্যিই তো। বিজয় মহান্তির চেহারাটা মানসপটে সঙ্গে সঙ্গে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে।
কাগতাড়ুয়াই বটে!
লম্বা দেহের অনুপাতে মাথাটা যেন বড়ই। বিশাল একজোড়া কনক-চাঁপা গোঁফ। সরু সরু হাত-পা। ঝলঝলে একটা সুট পরিধানে। আবলুশ কাঠের মত কালো গাত্রবর্ণ।
মিথ্যা বলেনি কিরীটী-ক্ষেতের মধ্যে দাঁড় করিয়ে রাখলে কাগতাড়ুয়াই মনে হবে।
.
থানার কম্পাউণ্ডে প্রবেশ করতেই বাঁদিকে মহান্তির কোয়ার্টারের সামনে নজরে পড়ল, মহান্তি তার কোয়ার্টারের সামনে পায়চারি করে বেড়াচ্ছে। পরনে একটা সবুজ লুঙ্গি, গায়ে একটা গেঞ্জি, পায়ে হরিণের চামড়ার চটিজুতো।
আমাদের এত সকালে থানায় আসতে দেখে মহান্তি যেন একটু অবাকই হয়।
তাড়াতাড়ি এগিয়ে এসে অভ্যর্থনা জানায়, আসুন আসুন, কিরীটীবাবু! এত সকালে? কি সৌভাগ্য!
বাইরের বারান্দায় চেয়ার পাতা ছিল। আমরা সেখানেই বসি।
বসুন, চায়ের কথাটা বলে আসি ভিতরে। হন্তদন্ত হয়ে মহান্তি ভিতরে গেল।
চায়ের অর্ডার দিয়ে একটা শার্ট গায়ে চাপিয়ে এসে আমাদের মুখোমুখি একটা চেয়ার টেনে নিয়ে বসতে বসতে বললে, এদিকে বেড়াতে বের হয়েছিলেন বুঝি? তা এ সময়টা সমুদ্রতীর ছেড়ে ঘিঞ্জির মধ্যে এই শহরের দিকে?
আপনাকে একটা খবর দিতে এলাম মহান্তি সাহেব-কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে।
খবর! কী খবর?
সমুদ্রের মধ্যে একটা মৃতদেহ যাচ্ছিল, নুলিয়ারা মাছ ধরতে গিয়ে তুলে এনেছে।
মহান্তি হেসে ফেলে, অ্যাক্সিডেন্ট—দুর্ঘটনা! এ তো এখানে সমুদ্রে আকছারই হয়। নতুন কিছু নয়। তারপরই হঠাৎ যেন থেমে গিয়ে কিরীটীর মুখের দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে বলে, আপনি কি সেইজন্যেই এসেছেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ। কারণ ব্যাপারটা আমার ধারণায় সাধারণ কোন একটা অ্যাক্সিডেন্ট বলে যেন মনে হল না।
কিরীটীর কথায় মিঃ কাগতাড়ুয়া—আমাদের মহান্তি সাহ্নে যেন একটু নড়ে-চড়ে বসল, তারপর কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে শুধালে, কিসে?
হ্যাঁ, তাই।
Simple drowning case নয় বলে আপনার মনে হচ্ছে, মিঃ রায়?
হ্যাঁ।
তবে কী?
মনে হচ্ছে ইটস কেন্স অফ মার্ডার! লোকটাকে হত্যা করে তারপর জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেই যেন আমার ধারণা। অবিশ্যি–