কিরীটীর কথা শেষ হয় না, হঠাৎ কালী সরকারের কণ্ঠস্বর শোনা যায়, কিরীটী!
কে?
আমি কালী।
ফিরে চেয়ে দেখি একা কালী সরকার, সঙ্গের সেই ভদ্রলোকটি নেই।
আয়, বস্। কিরীটী আহ্বান জানায়।
ভাই, বসব না। হোটেলে ফিরব।
আচ্ছা কালী–
কি?
তুই আমাকে চিনলি কি করে বল তো, এত বছর পরেও?
বিলক্ষণ! তোকে চিনব না কি রে? দুর্জনেরা যে যাই বলুক, কিন্তু তোকে আজ অস্বীকার করবার ক্ষমতা কার বল্। তা তুই এখানে?
কাজ-কর্ম নেই হাতে। বসে বসে গাঁটে গাঁটে বাত ধরছিল, তাই—
সমুদ্র-সৈকতে! তা বেশ। বাত সারবে হয়তো নোনা হাওয়ায়!
হুঁ, সেই আশাতেই তো এলাম।
কিরীটী এবারে জিজ্ঞাসা করে, তোর সঙ্গে সেই তিনি কে? তাকে তো চিনলাম না?
আমার বিশেষ পরিচিত বন্ধু-নামকরা মুক্তার ব্যবসায়ী, পার্ল-মার্চেন্ট দোলগোবিন্দ শিকদার। হঠাৎ বেড়াতে বেড়াতে সমুদ্রের ধারে এই কিছুক্ষণ আগে এখানে দেখা হয়ে গেল।
তারপর কি করছিস? কিরীটীই কালীপ্রসাদের মুখের দিকে তাকিয়ে প্রশ্নটা করে, বলতে গেলে একটা যুগ পরে দেখা।
বিজনেস মানে ব্যবসা।
কিসের ব্যবসা?
জুয়েলারী-হীরাজহরতের!
তাহলে শেষ পর্যন্ত অঙ্কশাস্ত্র-মাথেমেটিকস্ ছেড়ে ঐ জুয়েলারীর ব্যবসাই করতে গেলি?
উপায় কি বল? আমাদের তিন-জেনারেশন ধরে ঐ জুয়েলারীর ব্যবসা, তুই তো জানতিস ভাই!
তা জানতাম। কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে।
হঠাৎ কিরীটীই প্রশ্ন করে, তা হা রে, তুই তো ঐ সী-সাইড হোটেলটাতেই উঠেছিস, তাই না?
হুঁ। ওই হোটেলের ব্যবস্থাটা দেখলাম বেশ ভাল, তাই ওখানেই উঠলাম। তা তুই কোথায় উঠেছিস?
মিহিরবাবুর পুরী ভিউ হোটেলে।
ঐ যে সামনের হোটেলটা?
হ্যাঁ।
আচ্ছা চলি ভাই—
আহা বস্ না। কতদিন পরে দেখা হল—
তুই তো আছিস, পরে দেখা হবে। আজ উঠি ভাই।
কালী সরকার উঠে পড়ে এবং অন্ধকারে বালুবেলার উপর দিয়ে হোটেলের দিকে এগিয়ে যায়।
মনে হল ভদ্রলোক একটু অন্যমনস্ক।
০২. পরের দিন সূর্যোদয় দেখব বলে
পরের দিন সূর্যোদয় দেখব বলে অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠেছি দুজনেই আমরা। এবং কোনমতে দুজনে গায়ে জামাটা চাপিয়ে সূর্যোদয় দেখব বলে বের হয়ে পড়ি হোটেল থেকে।
রাত্রি শেষ হয়ে এসেছে এবং পাতলা অন্ধকারের একটা পর্দা সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে যেন থিরথির করে কাঁপছে। তার মধ্যে অস্পষ্ট ঝাপসা সমুদ্র দেখা যায় যতদুর সামনের দিকে দৃষ্টি চলে ততদূর পর্যন্ত। একটানা গর্জন করে চলেছে এবং ঢেউ পড়ছে আর আকুল উচ্ছ্বাসে তীরভূমির উপরে এসে ভেঙে গুড়িয়ে ফেনায় লুটিয়ে পড়ছে পারাবারহীন সমুদ্রের জলরাশি।
অনেকেই সূর্যোদয় দেখবার জন্য বের হয়েছে। তাদের ঝাপসা ঝাপসা মূর্তিগুলো দেখা যায় এদিক-ওদিক। ভিজে নরম বালির উপর দিয়ে দুজনে পূর্বমুখে এগিয়ে চলি। একটানা সমুদ্রের গর্জন বাতাসে মমরিত হচ্ছে। একটা ক্রুদ্ধ দৈত্য বন্দী হয়ে যেন অবিশ্রাম মাথা কুটে চলেছে।
আধ মাইলটাক এগিয়েছি, হঠাৎ ঝাপসা ঝাপসা আলো-আঁধারিতে দূরে নজর পড়ল, তীরে একেবারে জল ঘেঁষে অনেকগুলো লোক। এক জায়গায় যেন গোল করে অনেকগুলো লোক ভিড় করেছে, হয়তো জেলেরা মাছ ধরেছে বা ধরছে-তাই ভিড়।
কিন্তু যত কাছে এগোই, সমুদ্রের একটানা গর্জনকে ছাপিয়ে মৃদু একটা অস্পষ্ট গুঞ্জনধ্বনি কানে আসে আমাদের। পূর্ব গগনে সূর্য তখন দেখা দিয়েছে। ঠিক যেখানে আকাশ ও জলে মেশামেশি সেই আকাশ ও জলের মিলন-রেখাটি ছুঁয়ে যেন কোকনদটির মত। আরও কয়েক পা এগুতেই ব্যাপারটা আমাদের চোখে পড়ল। একটি দেহ সমুদ্রের বালুবেলায় পড়ে আছে আর তাকে ঘিরে দু-তিনটি নুলিয়া আর দশ-পনেরজন পুরীর চেঞ্জার।
গুঞ্জনটা তাদেরই কণ্ঠে। বিস্ময়ের গুঞ্জন।
কি ব্যাপার মশাই, পার্শ্ববর্তী একজনকে জিজ্ঞাসা করি আমিই।
মারা গেছে—
কে মরল?
কে জানে, জলে ড়ুবে মারা গেছে বলে মনে হচ্ছে।
জলে ড়ুবে?
তাই মনে হয়। নুলিয়ারা মাছ ধরতে গিয়েছিল, অনেকদূরে মৃতদেহটা ভেসে যাচ্ছে দেখতে পেয়ে তুলে এনেছে।
সমুদ্রতীরে ব্যাপারটা একটা নতুন কিছু নয়, বিস্ময়েরও কিছু নয়, মধ্যে মধ্যে দানব সদ্র দু-একজনকে যে গ্রাস করে না তা নয়। হয়ত তেমনি একজন কেউ। হঠাৎ ঐ সময় কিরীটীর বিস্ময়-ফুরিত কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত হয়, এ কি, এ যে দেখছি আমাদের কালী সরকার।
কালী সরকার।
সঙ্গে সঙ্গে আমি আবার মৃতদেহের দিকে দৃষ্টিপাত করি, দু পা আরও এগিয়ে যাই। তাই তো–মিথ্যা তো নয়, কালী সরকারই তো!
সমুদ্র-সৈকতে ভোরের আলো আরও স্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে তখন। সে আলোয় বালবেলায় শায়িত মৃত কালী সরকারের দেহটির দিকে তাকিয়েই যেন আমরা কয়েকটা মুহূর্ত বোবা হয়ে থাকি। চিৎ করে শোয়ানো বালুবেলার উপর কালী সরকারের মৃতদেহটা। চোখের পাতা বিস্ফারিত-বিস্ময়ের দৃষ্টি যেন স্থির হয়ে আছে নিষ্পলক স্থির দুটো চোখের তারায়। মাথার চুল এলোমেলো। পরিধানে পায়জামা-পাঞ্জাবি। খালি পা। আর বাঁ হাতে সোনার ব্যাণ্ডে রিস্টওয়াচ বাঁধা।
ইতিমধ্যে ভিড় দেখে সেখানে আরও লোক জমতে শুরু করেছে। সবাই বিস্মিত হতচকিত। একই প্রশ্ন সকলের। তার মধ্যে কেউ কেউ সমবেদনা প্রকাশ করে।
কিরীটী পায়ে পায়ে মৃতদেহের একেবারে খুব কাছে এগিয়ে যায়। তীক্ষ্ণ স্থির দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে কি যেন দেখতে থাকে। কি দেখছে কে জানে।