হঠাৎ কিরীটীই আবার কথা বলে, সুত! কি?
কালী সরকার লোকটা নিঃসন্দেহে কোন্ড ব্লডে কাউকে মার্ডার করতে না পারলেও, সঙ্গের ভদ্রলোকটির চোখের চাউনি কেন যেন আমার ভাল লাগল না।
ভাল লাগল না মানে? প্রশ্ন করলাম আমি।
চোখের দৃষ্টিটা দেখলি না ভদ্রলোকের, বেশ যেন বিরক্ত অপ্রসন্ন—মনে হল যেন কালীর আমাদের সঙ্গে আলাপ করাটা আদৌ তার মনঃপুত হয়নি।
হয়তো—
কি?
হয়তো দুজনের মধ্যে বিশেষ কোন জরুরী কথা হচ্ছিল, হঠাৎ সেই সময় আমরা সামনে পড়ায় এবং কালী সরকার আমাদের সঙ্গে কথা বলায় সে বিরক্ত বোধ করছিল–
স্বাভাবিক।
শুধু স্বাভাবিক নয়, তার চাইতে হয়তো—
কি?
কিছু বেশী। যাক গে, মরুক গে কালী সরকার আর তার সঙ্গে সেই অপ্রসন্ন লোকটি–
বলতে বলতে কিরীটী বালুবেলার উপরে টান-টান হয়ে শুয়ে পড়ে, শিথিল অলস ভঙ্গীতে।
কিরীটী যাই বলুক, যাই তার থিয়োরি হোক-কি জানি কেন, লোক-দুটোর চেহারা কিন্তু মন থেকে কোনমতেই আমি মুছে ফেলতে পারি না।
কালীপ্রসাদ সরকার, আর সেই অপ্রসন্ন ভদ্রলোকটি।
সে-সময় সমুদ্র-সৈকতে বায়ুসেনার্থী অনেক বয়সের অনেক স্ত্রী-পুরুষ ছিল এবং আশ্র সেই ভিড়ের মধ্যেও ওদের দুজনকে দূর থেকে দেখেই ওদের দিক থেকে চট করে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে পারিনি, বিশেষ করে কালী সরকারের দিক থেকে।
দুজনেরই পরিধানে সুট ছিল। একজনের দামী সুট, কোনো নামকরা টেইলার্স শপের তৈরী। অন্যজনের বোধ করি সাধারণ কোন দোকান থেকে কেনা রেডিমেড সুট। একটু ঢিলে, ঝলমলে।
পরনে সামী সুট ছিল কালীপ্রসাদ সরকারের।
লোকটার বয়স পঁয়তাল্লিশ থেকে পঞ্চাশের মধ্যে হবে বলেই মনে হয়। বেশ মোটা চর্বিযুক্ত ভারী দেহের গড়ন। রীতিমত কালো গায়ের বর্ণ। ভারী ঈষৎ চৌকো মুখ। মোটা রোমশ ভু। কান দুটো বেশ বড় এবং কান-ভর্তি চুল। সুট পরা থাকলেও টাই না থাকায় খোলা শার্টের ফাঁক দিয়ে বুকের যে অংশটুকু দৃষ্টিগোচর হচ্ছিল সেটা রীতিমত রোমবহুল। বোঝা যায় মানুষটা রোমশ। গায়ে খুব বেশী লোম। হাসলেই উপরের মাড়ির অনেকটা বেরহয়ে পড়ে ও সেই সঙ্গে প্রকাশ পায় ঝকঝকে মোটা মোটা একসারি এলোমেলো দাঁত।
আর হাতের থাবা ও আঙুলগুলোই বা কি-যেমন চওড়া তেমনি মোটা মোটা ও বলাই বাহুল্য রোমশ।
লম্বায় লোকটা কিন্তু খুব বেশী নয়, পাঁচ ফুট দুই থেকে তিন ইঞ্চির বেশী কিছুতেই হবে না—অর্থাৎ পুরুষের পক্ষে বেঁটেই লোকটা। দূরে থেকে মনে হচ্ছিল, যেন ঠিক এক ভল্লুক থপথপ করে হাঁটছিল।
আর তার সঙ্গী! সেই অপ্রসন্ন ভদ্রলোকটি! কম দামের ঢিলে ঝলমলে পোশাকের মধ্য দিয়েও যেন তার রূপ, তার সৌন্দর্য ফুটে বের হচ্ছিল। সত্যিই লোকটা সুন্দর। মাঝামাঝি লম্বা। গায়ের রং বেশ ফর্সা। চকিতের জন্য দেখেছিলাম, তবু মনে পড়ে, বেশ ভাসা-ভাসা পিঙ্গল চোখ। মাথার চুল সামান্য কটা।
কিরীটীর দিকে তাকালাম। সে আকাশের দিকে তাকিয়ে চিৎ হয়ে শুয়ে রয়েছে।
সন্ধ্যার আকাশে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত কতকগুলো তারা। সমুদ্রতীরে বায়ুসেবনার্থীদের ভিড় একটু একটু করে পাতলা হয়ে আসছে। দূরে চোখে পড়ে সী সাইড হোটেলের আলোগুলো জ্বলজ্বল করে জ্বলছে।
আমিই প্রথমে কথা বলি, মনে হচ্ছে তুই যেন কিছু ভাবছিস কিরীটী!
অ্যাঁ! কিরীটী যেন চমকে ওঠে।
কি ভাবছিস?
ঐ কালী সরকারের কথাই ভাবছিলাম রে—
কালী সরকারের কথা!
হ্যাঁ, প্রেসিডেন্সীতে একসঙ্গে দুজনে বছর-তিনেক পড়েছিলাম। সেই সময়ই আলাপ। মনে আছে আজও, ম্যাথেমেটিকসে ওর ব্রেন ছিল অদ্ভুত। ডাঃ সাহা বলতেন, একসেপসন্যাল। অথচ—
থামলি কেন, বল?
কিরীটী আবার বলতে থাকে, কলকাতা শহরের বিখ্যাত ধনী জুয়েলার সরকার ফ্যামিলির ছেলে, যাদের বাড়ির কোনদিন কোন ছেলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম চৌকাঠটিও ডিঙিয়েছে কিনা সন্দেহ, সেই বাড়ির ছেলে ম্যাথেমেটিয়ে দুটো লেটার ও রেকর্ড মাকর্স নিয়ে ম্যাট্রিক পাস করে আই-এস-সি পড়তে এল প্রেসিডেন্সীতে। বিরাট ঝকঝকে ওয়েলার ঘোড়া-বাহিত জুড়িগাড়ি করে আসত কলেজে। পরনে গিলে-করা আদ্দির পাঞ্জাবি, হীরের বোম আংটি, চকচকে তৈরী ঝকঝকে ডার্বি সু পায়ে—যেন জামাইটি। কিন্তু যেমনি লাজুক তেমনি নিরীহ শান্ত গোবেচারা টাইপের। প্রথম প্রথম তো কেউ ওর দিকে ফিরেও তাকায়নি। কিন্তু ডাঃ সাহার স্তুতির পর হঠাৎ যেন ক্লাসের সবার নজর গিয়ে কালীর উপর পড়ল—সার্চলাইটের মত। ও যেন সর্বসমক্ষে আবিষ্কৃত হয়ে গেল।
তারপর?
ইন্টারমিডিয়েটে ফিজিক্স, কেমিস্ত্রী ও ম্যাথেমেটিকস্ তিনটেতেই ও লেটার পেয়েছিল মনে আছে এবং ম্যাথেমেটিকসে রেকর্ড মার্ক। বি-এস-সি পড়তে শুরু করল ম্যাথেমেটিকস্ নিয়ে এবং থার্ড ইয়ার থেকে ফোর্থ ইয়ারে ওঠার মাসখানেক পর–
কি?
হঠাৎ কলেজে আসা বন্ধ করলে।
কেন?
কে জানে?
তারপর?
তারপর দীর্ঘ দশ বছর পরে একবার একটা একজিবিশনে দেখা হয়েছিল। তারপর আর ওর সঙ্গে দেখা হয়নি। বলতে গেলে ওর কথা ভুলেই গিয়েছিলাম। আজ হঠাৎ-আরও কত বছর বাদে হঠাৎ আজ দেখা হল আবার। মনে মনে হিসাব করছিলাম, আরো দশ বছর পরে দেখা হল আজ।
বলিস কি!
তাই ভাবছিলাম। আমি ওকে চিনেছি যেহেতু ওর মুখের গঠনে কিছু peculiarities ছিল—যা আজো আমার মনে আছে, ভুলিনি এবং যে জন্য আজ দেখেই ওকে চিনতে পেরেছিলাম, কিন্তু ও আমায় সঙ্গে সঙ্গে চিনল কি করে তাই ভাবছি। ও বিশেষ তেমন বদলায়নি চেহারায়, কিন্তু আমি