সাধন সরকার একেবার বোবা। বিমূঢ়। বিহ্বল। পাথর।
সাধনবাবু! একটু পরে কিরীটী আবার ডাকল সাধন সরকারকে।
সাধন সরকার মুখ তুলে তাকাল কিরীটীর মুখের দিকে।
রামানুজ দাশকে আপনি চেনেন?
হ্যাঁ।
কতদিন চেনেন?
অনেক দিন। আমাদের কলকাতার বাসায় জ্যাঠামণির কাছে তো প্রায়ই আসা-যাওয়া করত।
প্রায়ই কেন আসা-যাওয়া করত? জানেন কিছু?
না, তা বলতে ঠিক পারব না। তবে জ্যাঠামণিকে মধ্যে মধ্যে রামানুজকে টাকা দিতে দেখেছি।
আর উনি-মিসেস বিশ্বাস? উনি যেতেন না? যেতেন। প্রায়ই?
না, তবে যেতেন। দু-একবার বোধ হয় যেতে দেখেছি।
শেষ কবে ওঁকে দেখেন আপনার জ্যাঠামণির কাছে যেতে?
মাস পাঁচেক আগে বোধ হয় শেষবার ওঁকে দেখেছি।
সে-সময় রামানুজ সঙ্গে ছিল ওর?
না তো।
লতিকা গুঁই নামে কোন মহিলাকে আপনি চেনেন? চিনি।
তাঁকেও কি আপনি আপনার জ্যাঠামণির কাছে যেতে দেখেছেন?
হাঁ।
কোথায়?
আমাদের জুয়েলারীর দোকানে দোতলায় জ্যাঠামণির বিশ্রামের দুটো ঘর ছিল, সেইখানে প্রায় ছুটির দিনেই দুপুরে তিনি আসতেন।
আপনার জ্যাঠামণির কোন উইল আছে জানেন?
উইল?
হ্যাঁ।
ঠিক বলতে পারব না। আমাদের সলিসিটার গিরীন সিংহ বলতে পারবেন। হি ইয়ুজড় টু ডিল উইথ হিস অল ম্যাটার্স।
হুঁ, ঠিক আছে। মিঃ বিশ্বাস, আপনার শ্যালক এলে অতি অবিশ্যি থানায় মহান্তি সাহেবের কাছে একবার পাঠিয়ে দেবেন।
কথাটা বলে কিরীটী যেন কিছুক্ষণ কি ভাবে, তারপর সহসা উঠে দাঁড়ায়।
মহান্তির দিকে তাকিয়ে বলে, চলুন মিঃ মহান্তি।
যাবেন?
হ্যাঁ, আমার যা জানবার জানা হয়ে গিয়েছে। যাবেন? চলুন যাওয়া যাক।
কথাটা বলে আমাকে চোখের ইঙ্গিত করে বের হয়ে যায় সোজা ঘর থেকে। আমি ওকে অনুসরণ করি।
থানাতেই এলাম আমরা।
সারাটা পথ কিরীটী একটা কথাও বলেনি। অসম্ভব গম্ভীর।
বুঝতে পারি ভিতরে ভিতরে কিরীটী অত্যন্ত উত্তেজিত। তা সে যে কারণেই হোক।
থানায় পৌঁছে চেয়ারে বসে কিরীটী বললে, চা বলুন মিঃ মহতি।
নিশ্চয়–
মহাতি হতদন্ত হয়ে উঠে গেল।
চা-পানের পর একটা চুরুট ধরিয়ে ধীরে ধীরে ধূমপান করতে করতে কিরীটী বলে, আপনি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন সেরাত্রে কি ভাবে কালী সরকারকে হত্যা করা হয়েছিল।
না-ঠিক—
এখনও বুঝতে পারেননি? সুব্রত?
পেরেছি কিছুটা। হত্যাকারী প্রস্তুত হয়েই কাজে নেমেছিল।
সত্যিই তাই।
কিরীটী বলে, প্রথমে চায়ের সঙ্গে ঘুমের ঔষধ দিয়ে হত্যাকারী কালী সরকারকে ঘুম পাড়ায়। তারপর সময় বুঝে ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে কালী সরকারের ঘরে প্রবেশ করে। একটা কর্ড বা সিল্কের মজবুত রিবনের মত কিছুর সাহায্যে স্যাঙ্গল করে তাকে ঘুমের মধ্যেই শ্বাস-বন্ধ করে হত্যা করে। তারপর হত্যাকারী নিঃশব্দে ঘর থেকে ডেড বডিটা কাঁধে করে ঐ রাস্তা দিয়েই হোটেল থেকে বের হয়ে এসে সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেয়।
ইট ওয়াজ ডেড অফ নাইট! মধ্যরাত্রি। কেউ কোথাও জেগে নেই। এবং এ থেকে হত্যাকারী সম্পর্কে আমরা কিছু guess করতে পারি–
কি? মহান্তিই প্রশ্ন করে।
প্রথমতঃ, কিরীটী বলতে থাকে, হত্যাকারী strong nerve-এর লোক; দ্বিতীয়তঃ, গায়ে শক্তিও যথেষ্ট ছিল তার–
রজনী বাধা দেয় মহান্তি ঐ সময়, বলে, হত্যাকারী নিশ্চয়ই পুরুষ?
পুরুষ কি নারী সেটা immaterial, কারণ—
কি?
কারণ এমনও হতে পারে, হত্যার পরিকল্পনা বা brainছিল একজনের এবং instrument ছিল অন্য একজন। তেমনি আবার একই ব্যক্তির brain-এ হয়ত বা কাজ হতে পারে। তবে এটা ঠিক, হত্যাকারী যেই হোক, দুটো মারাত্মক ভুল সে করেছিল।
ভুল!
হ্যাঁ।
কি ভুল করেছিল?
প্রথমতঃ ব্যাপারটা সুইসাইড প্রমাণ করার জন্য যেভাবে কালী সরকারকে হত্যা করেছিল, ঠিক সেই ভাবেই মৃতদেহটা জলে ভাসিয়ে দিয়ে। এবং দ্বিতীয়তঃ, ছদ্মবেশ ধরে–
কি—কি বললেন মিঃ রায়?
হ্যাঁ, মিঃ মহান্তি। একবার নয়, আমার অনুমান যদি মিথ্যা না হয় তো দু-দুবার সে ছদ্মবেশ ধরেছে ঐ রাত্রে এবং সেই ছদ্মবেশেই দুজনার সঙ্গে দেখা করেছে। কিন্তু কথা হচ্ছে, একজনের অন্ততঃ তার ছদ্মবেশের আড়ালে সত্য পরিচয়টা জানা উচিত ছিল। কিন্তু তার চাইতেও যেটা বেশী আমার কাছে পাজলিং মনে হচ্ছে এখনও-কেন-কেন হত্যাকারী তাকে হত্যা করল? হোয়াট ওয়াজ দি মোটিভ বিহাইও? কি উদ্দেশ্য ছিল? সেইটা—সেইটা জানতে পারলে–
তাহলে আপনি হত্যাকারী কে তা ধরতে পেরেছেন মিঃ রায়! উত্তেজনায় যেন মহান্তির গলা বুঁজে আসে।
পেরেছি বৈকি। শান্তকণ্ঠে কিরীটী বলে।
কে-কে? মহান্তি যেন উত্তেজনায় ফেটে পড়ে।
চোখ মেলে দেখবার চেষ্টা করুন। দুরেরও নয়। খুব ঝাপসা—অস্পষ্টও নয় সে। কাছের মানুষ–
কিন্তু কিরীটীর কথা শেষ হল না—বাইরে একটা গোলমাল শোনা গেল। তীক্ষ্ণ নারীকণ্ঠঃ ডোন্ট টাচ মি, আমি—আমি নিজেই যাচ্ছি। দরজার দিকে আমরা তিনজনে তাকালাম।
একজন প্লেন ড্রেস অফিসার ও দুজন কনস্টেবল সমভিব্যাহারে লতিকা গুঁই এসে ঘরে প্রবেশ করল।
রুক্ষ মাথার চুল। সমস্ত চেহারা, পোশাক যেন এলোমেলো।
ঘরে ঢুকেই লতিকা গুঁই বলে, আমি জানতে চাই হোয়াট অল দিস? এসবের মানে কি? কেন ওরা আমাকে খুরদা রোড় জংশন থেকে ধরে নিয়ে এল? হোয়াই?
বসুন লতিকা দেবী—কিরীটী বলে, আপনি মিথ্যে চটছেন। ওদের কোন দোষ নেই। দারোগা সাহেবের আদেশমতই ওরা–