সেরাত্রে আমি আদৌ যাইনি তার ঘরে।
কিন্তু আমি জানি আপনি গিয়েছিলেন।
না।
ইয়েস, গিয়েছিলেন। বলুন, কখন গিয়েছিলেন এবং কতক্ষণ ছিলেন?
আমি তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি আপনার ঐ কথায়, মিঃ রায়! সহসা হরডন বিশ্বাসের কণ্ঠস্বর শোনা গেল!
চমকে আমরা ফিরে তাকালাম দরজার দিকে।
হরডন বিশ্বাস ঠিক দরজার উপর দীড়িয়ে। সে যে ইতিমধ্যে কখন ওখানে এসে দাঁড়িয়েছে আমরা টেরও পাইনি।
আপনি প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। কিরীটী বলে হরডনের দিকে তাকিয়ে।
হ্যাঁ। অত্যন্ত আপত্তিকর কথা।
কিন্তু আপত্তিকর হলেও কথাটা সত্য জানবেন মিঃ বিশ্বাস। কিরীটী শান্তকণ্ঠে জবাব দেয়।
অসম্ভব। কারণ আমি জানি ঐ সময় সে রাত্রে আমার স্ত্রী আমার পাশে শুয়েই নিদ্রা যাচ্ছিল।
কিন্তু আমি যদি বলি মিঃ বিশ্বাস, আপনার স্ত্রী কালী সরকারের ঘরে সে রাত্রে গিয়েছিলেন? আপনি নেশার নিদ্রায় টের পাননি? টের পাবার মত আপনার সে সময় অবস্থাও ছিল না?
রাবিশ!
রাবিশ! আপনি ড্রিঙ্ক করেন না?
করব না কেন? করি। কিন্তু তাই বলে–
মিঃ বিশ্বাস, বিশ্বাস করা না করা ব্যাপারটা আপনার ইচ্ছে। তাছাড়া আপনার স্ত্রীর উপরে কোন রিফ্লেকশন আনবার চেষ্টা করিনি। যা ঘটেছিল সেরাত্রে তাই বলেছি। Mere facts–
আপনি কি বলতে চান মিঃ রায়, আমার স্ত্রী রাতদুপুরে হোটেলের একজন বোর্ডারের ঘরে গেল আমার অজ্ঞাতে আর তার চরিত্রের ওপর সেটা একটা রিফ্লেকশন নয়?
কিন্তু আপনি তো নিশ্চয়ই জানেন, একসময় আপনার স্ত্রীর সঙ্গে ঐ কালী সরকারের যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল?
অল ট্র্যাস! আমি ওকে দীর্ঘ দশ বছর ধরে জানি। তবে হ্যাঁ, একসময় ঐ কালী সরকারের স্কুলে আমার স্ত্রী কিছুদিন কাজ করেছিল। সে সময় একটু আধটু পরিচয় হয়ত ওর সঙ্গে হয়েছিল। কারণ আমি শুনেছিলাম সেক্রেটারী হলেও উনি প্রায়ই স্কুলে আসতেন এবং–
বলুন, থামলেন কেন? কি বলছেন বলুন?
ওঁর নারী সম্পর্কে বরাবরই একটা দুর্বলতা ছিল।
আপনি তাহলে জানতেন ব্যাপারটা মিঃ বিশ্বাস?
জানতাম বৈকি।
বেশ। মিসেস বিশ্বাস, এবারে আপনি বলুন তো সেরাত্রে শেষ কখন চা দিয়ে আসা হয় কালী সরকারকে? কারণ আমি জানি, সে ঘন ঘন চা-পান করত এবং আপনিও সেই কথা বলেছেন।
আমি জানি—হরডন বিশ্বাস বলে ওঠে, রাত তখন পৌনে এগারটা হবে। ও রান্নাঘরে একটু ব্যস্ত ছিল। রামানুজ এসে চায়ের কথা বলায় আমিই নিজে এক কাপ চা তৈরী করে তাকে দিয়ে আসতে বলি ঘরে।
তৈরী করেছিল কে চা-টা? আপনি নিজে?
না। মানে আমার স্ত্রীই করে দিয়েছিল।
নিশ্চয়ই চা-পানের পর খালি চায়ের কাপটা তার ঘর থেকে রামানুজ সেরাত্রে নিয়ে আসেননি?
না। আমি যতদূর জানি চা-টা দিয়েই চলে এসেছিল সে।
তাই যদি হয়, নিশ্চয়ই অত রাত্রে চা খাবার পর আপনারা কেউ কাপটা নিয়ে আসেননি। কাপটা সেখানেই থাকার কথা, কিন্তু আমি পরদিন সকালে গিয়ে তার ঘরেতে কোন কাপ দেখিনি। তবে কে সেই কাপটা নিয়ে এল ঘর থেকে? মিসেস বিশ্বাস, আপনি?
আ-মি–না–আমি কেন আনব। হয়ত কোন চাকর-বাকরই—
কোন্ চাকর সাধারণতঃ তার ঘরে যেত?
রঘুয়া।
ডাকুন তাকে।
সে তো নেই।
কোথায় সে?
কালই তাকে চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছি। হরডন বিশ্বাস বলে।
চাকরি থেকে ছাড়িয়ে দিয়েছেন। কেন?
সে আমার ঘর থেকে পঞ্চাশটা টাকা চুরি করেছিল।
থানায় রিপোর্ট করেছিলেন?
না।
কেন?
গোলমাল হবার ভয়ে। তাছাড়া হোটেলের চাকর চোর-ব্যাপারটা বোর্ডারেরা জানতে পারলে খারাপ হবে তাই।
মিসেস বিশ্বাস, আপনি যখন পরের দিন সকালবেলা আট নম্বর ঘরে যান, চায়ের কাপটা দেখেছিলেন? কিরীটী আবার মিসেস বিশ্বাসকেই প্রশ্ন করে।
না।
হুঁ, আপনার ভাই রামানুজ কোথায়?
ওর মাছ ধরার বাতিক আছে। এ সময়টা প্রায়ই ও নুলিয়াদের সঙ্গে নৌকোয় চেপে সমুদ্রে মাছ ধরতে যায়। আজও গিয়েছে হয়তো।
রামানুজ আপনার নিজের ভাই?
হ্যাঁ।
আপন মায়ের পেটের?
হ্যাঁ, হ্যাঁ।
আপনার চেয়ে বয়সে কত ছোট?
তা অনেক হবে।
কত?
পনের-ষোল তো হবেই।
আপনার এখন বয়স কত?
বিয়াল্লিশ হবে।
ফরটি-টু?
ঐ রকমই হবে। বলে মাথাটা নীচু করল রেণুকা।
১০. অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা
কয়েকটা মুহূর্ত ঘরের মধ্যে। অতঃপর অদ্ভুত একটা স্তব্ধতা যেন থমথম করে, কারও মুখে কোন কথা নেই।
স্তব্ধতা ভঙ্গ করে আবার কিরীটীই।
এখানে আসবার আগে-কিরীটী আবার প্রশ্ন করে, আপনার ভাই কোথায় ছিল?
কলকাতায়। ক্ষীণকণ্ঠে জবাব দেয় মিসেস রেণুকা বিশ্বাস।
কি করত সেখানে?
কোন একটা মিলে কি যেন সামান্য একটা চাকরি করত।
কি চাকরি করত?
বলতে পারি না।
জানেন না বলতে চান?
না, জানি না।
হুঁ। রামানুজ লেখাপড়া কতদূর করেছে?
সামান্যই।
মিঃ বিশ্বাস, সাধন সরকারকে একবার ডাকুন তো?
হরডন বিশ্বাস তখনই গিয়ে সাধন সরকারকে ডেকে নিয়ে এল।
বসুন সাধনবাবু—
সাধন সরকার চেয়ারটায় বসে।
আপনি এখনও শোনেননি বোধ হয় যে আপনার কাকা কালী সরকার—
উনি আমার কাকা নন-জ্যাঠামণি। সাধন বলে।
ও। তা শোনেননি বোধ হয় যে আপনার জ্যাঠামণিকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে!
চমকে উঠে সঙ্গে সঙ্গে সাধন সরকর বলে, সে কি! তবে যে মিসেস বিশ্বাস বলছিলেন জ্যাঠামণি সমুদ্রে সুইসাইড করেছেন।
না, তাঁকে হত্যা করা হয়েছে। নিহুর পৈশাচিক ভাবে গলায় ফাঁস দিয়ে শ্বাসরোধ করে হত্যা করা হয়, তারপর তাঁর দেহটা সমুদ্রের জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছিল এই প্রমাণ করবার জন্য যে, তিনি নিজেই আত্মহত্যা করেছেন।