কিন্তু কিরীটী রেণুকাকে কথাটা শেষ করতে দেয় না, তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বলে ওঠে, মিসেস বিশ্বাস, ব্যস্ত হবেন না। চায়ের আপাততঃ আমাদের কোন প্রয়োজন নেই।
কিরীটীর কণ্ঠস্বরে একটা যেন চমকেই রেণুকা বিশ্বাস কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল। আপনি বরং ঘরের দরজা ভেজিয়ে দিন। আপনার সঙ্গে আমাদের কিছু কথা আছে। কথা? আমার সঙ্গে? রেণুকার গলার স্বরে বিস্ময়।
হ্যাঁ।
বলুন?
আপনি নিশ্চয়ই জানেন, আজ সকাল থেকে লতিকা দেবী নিখোঁজ।
না তো—
জানেন না?
না। তাছাড়া লতিকার সঙ্গে আমার সম্পর্কই বা কি? সে নিখোঁজ হল কি না হল সে খবর রাখতে যাব–
কিন্তু একটা খবর আমরা যে পেয়েছি মিসেস বিশ্বাস—
কি খবর পেয়েছেন?
আপনি নাকি কাল লতিকা দেবীর হোটেলে রাত দশটার পর তার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছিলেন। কেন গিয়েছিলেন?
কি বলছেন আবোল-তাবোল? লতিকার সঙ্গে দেখা করতে গিয়েছি আমি কাল রাত্রে দশটার পর?
যাননি আপনি?
নিশ্চয়ই না।
কিন্তু আপনাকে আমাদের লোক দেখেছে। মহান্তি বলে এবারে।
মাথা খারাপ! কাকে দেখতে কাকে দেখেছে আপনার লোক।
কিরীটী কথা বলে, আপনি তাহলে যাননি?
নিশ্চয়ই না।
আর ইউ সিয়ের?
নিশ্চয়ই।
কাল রাত্রে তবে ঐ সময় কোথায় ছিলেন?
কেন, এখানে আমার নিজের হোটলে! রাত আটটা থেকে রাত সাড়ে দশটা পর্যন্ত বোর্ডারদের খাওয়া-দাওয়ার পাট না চোকা পর্যন্ত আমার কি নিঃশ্বাস ফেলবারও সময় থাকে।
সাড়ে দশটার পর?
হোটেলেই ছিলাম।
হঠাৎ এবারে কিরীটী তীক্ষ্ণকণ্ঠে বলে, একটা কথা আপনার জানা দরকার মিসেস বিশ্বাস, কালী সরকারকে সত্যি সত্যিই শ্বাসরুদ্ধ করে হত্যা করা হয়েছে।
তাই নাকি!
হ্যাঁ, কিন্তু সে কথা যাক। আপনাকে আরো আমার জিজ্ঞাস্য আছে।
বলুন?
কালী সরকারের ঘরে রোজ রাত্রে স্টেকে ব্রীজ খেলা হত- কে কে খেলত জানেন?
কালী সরকার ব্রীজ খেলতেন, কথাটা আপনার কাছেই এই প্রথম শুনছি!
তাই নাকি?
কিরীটী মিসেস রেণুকা বিশ্বাসের দিকে তাকাল। আমি তো তাকিয়েই ছিলাম রেণুকার মুখের দিকে। একান্ত নির্বিকার ভাবলেশশূন্য মুখ। কোন একটা রেখার কুঞ্চন বা কম্প মাত্রও সেখানে যেন নেই। কিরীটী একটু থেমে বলে, তাহলে আপনি বলতে চান মিসেস বিশ্বাস, কালী সরকার ব্রীজ কোনদিনই খেলেনি বা জানত না খেলতে?
তা তো আমি বলিনি মিঃ রায়, আমি বলেছি তাকে হোটেলে কখনও খেলতে দেখিনি।
কি করে বুঝলেন? তাকে কি দিবারাত্র সদাসর্বদা পাহারায় রাখতেন নাকি আপনি মিসেস বিশ্বাস যে তিনি হোটেলে তার ঘরে খেলতেন না সে বিষয়ে আপনি এত definite হলেন?
এবারে যেন মিসেস বিশ্বাসকে একটু কেমন ব্রিত বলে মনে হয়। কেমন যেন একটু থমকে গিয়েছেন।
কিরীটী আবার বলে, শুনুন মিসেস বিশ্বাস, সত্যকে গায়ের জোরে কখনও উড়িয়ে দেওয়া যায় না। জানি না বলে আপনি ভান করতে পারেন, কিন্তু জানবেন সত্য যা একদিন তা প্রকাশ পাবেই। যাক, আপনি তার ব্রিজ খেলা সম্পর্কে জ্ঞাত না হলেও একটা কথা কিন্তু সেদিন সত্য বলেননি–
সত্য বলিনি? কী কথা?
একসময় যে আপনার ঐ কালী সরকারের সঙ্গে যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল সেই কথাটা–
কে বললে?
কেন, দুজন বলেছেন!
দুজন?
হ্যাঁ, লতিকা গুঁই ও আপনার হাজব্যাণ্ড মিঃ হরডন বিশ্বাস।
কিরীটীর মুখ থেকে কথাটা উচ্চারিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে রেণুকা বিশ্বাস ওর মুখের দিকে তাকায় এবং কয়েক মুহূর্ত নিঃশব্দে তাকিয়ে থেকে বলে, কি জানতে চান আপনি মিঃ রায়, বলুন তো? হোয়াট আর ইউ ড্রাইভিং অ্যাট?
আমার কথাটা তো অস্পষ্ট নয় মিসেস বিশ্বাস। আপনার সঙ্গে একসময় তার যথেষ্ট হৃদ্যতা ছিল। এবং ছিল কিনা সেটাই আমি জানতে চাইছি।
দেখুন প্রশ্নটা আপনার অত্যন্ত ব্যক্তিগত হয়ে যাচ্ছে না, মিঃ রায়। মিসেস বিশ্বাসের কণ্ঠস্বরে যেন বেশ বিরক্তির সুর।
নিশ্চয়ই হচ্ছে। কিন্তু এটাও নিশ্চয় ভুলে যাবেন না আপনি মিসেস বিশ্বাস, আমরা একটা মার্ডার কেসের তদন্ত করছি। এবং সেই মার্ডারটা আপনারই এই হোটেলের মধ্যে একটা ঘরে হয়েছে। কিরীটীর কণ্ঠস্বরটাও যেন কঠিন বলে মনে হয়।
কি বলতে চান আপনি? আমার হোটেলে মার্ডার হয়েছে মানে?
আপনার হোটেলেই মার্ডারড হয়েছে কালী সরকার সেরাত্রে। তারপর তাকে হত্যা করে মৃতদেহটা সুইসাইড প্রমাণ করবার জন্য সমুদ্রে নিয়ে গিয়ে ভাসিয়ে দেওয়া হয়।
না, না। আপনি–
শুনুন মিসেস বিশ্বাস, সেরাত্রে ঠিক যা ঘটেছে তাই বললাম। এবং আপনিও যে সেটা জানেন না তাও নয়।
আমি–
হ্যাঁ, আপনিও সেটা জানেন। শুনুন, যে রাত্রে কালী সরকার মার্ডার হয়, অনুমান রাত একটায় এবং সম্ভবতঃ তাকে নিদ্রার ঘোরে ফাস দিয়ে নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করা হয়েছিল—
গলায় ফাঁস দিয়ে?
হ্যাঁ। এবং খুব সম্ভবত তাকে পূর্বেই চায়ের সঙ্গে কোন কড়া ঘুমের ঔষধ পান করানো। হয়েছিল, যেটা প্রমাণিত সহজেই হবে হয়ত তার স্টমাক কনটেন্ট-এর কেমিক্যাল। অ্যানালিসিসটা হলেই!
এ-এসব আপনি কি বলছেন?
মিসেস বিশ্বাসের কণ্ঠস্বরে এবার যেন কাঁপুনি টের পাওয়া যায়।
যা বলছি জানবেন তার একটি বর্ণও মিথ্যা নয়। নির্মম সত্য। এবারে আপনি বলুন, সে রাত্রে রাত বারোটা থেকে দুটো—এই দু ঘণ্টা আপনি কি করছিলেন?
কেন-রাত বারোটা থেকে দুটো তো আমি ঘুমোচ্ছিলাম।
ঘুমোচ্ছিলেন?
হ্যাঁ।
বেশ। সেরাত্রে শেষ কখন আপনি কালী সরকারের ঘরে যান?