বেশ, তাই হবে।
অতঃপর মহান্তি বিদায় নিল।
কিরীটী আর এক দফা চায়ের অর্ডার দিল।
চা-পানের পর বললে, চল, সমুদ্রের ধারে গিয়ে খানিকটা ঘোরা যাক। কালী সরকার। সকাল থেকে স্কন্ধারূঢ় হয়ে মাথা ধরিয়ে দিয়েছে। একেই বলে বরাত-বুঝলি সুব্রত! এলাম পুরীর সমুদ্রকে উপভোগ করতে কটা দিন, তা না, পঁচিশ বছর বাদে এক কালী সরকার : এসে আবির্ভূত!
কেন, তুই তো বলিস টেকি স্বর্গে গেলেও ধান ভানে!
যা বলেছিস। নে চল।
কিছুক্ষণ অনির্দিষ্ট ভাবে ভিজে বালুর উপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে একসময় ক্লান্ত হয়ে আমরা বালুবেলার উপরেই বসে পড়ি।
সন্ধ্যা হয়ে গিয়েছিল ইতিমধ্যে। সমুদ্রতীর ঘেঁষে হোটেলগুলোতে সর আলো জ্বলে উঠেছে। রাস্তার আলো কিন্তু জ্বলেনি!
অন্ধকার সমুদ্রতীরে বহু লোক-আবছায়া ঘেরাফেরা করছে।
কিরীটী একটা সিগারেটে অগ্নিসংযোগ করে বলে, লোকটা শুধু ম্যাথমেটিকসই জানত না, অঙ্কশাস্ত্রের মত টাকা-পয়সার হিসেবটাও বুঝত।
হঠাৎ কার কথা বলছিস?
কালী সরকার, আবার কে? তাছাড়া আরও একটা ব্যাপার কালী সরকার সম্পর্কে জানতে পেরেছি–
কি?
লোকটা স্টেকে ব্রীজ খেলত।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। চারজন কালী সরকারের ঘরে বসে খেলত।
কে কে?
মনে হচ্ছে কালী সরকার, হরডন বিশ্বাস ও শ্রীমতী বিশ্বাস তিনজন। বাকি চতুর্থজন যে কে বুঝতে পারছি না।!
রামানুজ নয় তো?
না।
তবে হয়ত হোটেলের বর্তমান বোর্ডারদের মধ্যেই কেউ!
তাই হবে। বলতে বলতে কিরীটী যেন কেমন অন্যমনস্ক হয়ে যায়। অন্ধকারে ওর মুখের দিকে তাকালাম কিন্তু মুখটা ভাল দেখা গেল না। বুঝলাম কালী সরকারের মৃত্যু-ব্যাপারে-একমাত্র তাকে কেউ হত্যা করেছে, এ ছাড়া আর বিশেষ এখনও রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে অগ্রসর হতে পারেনি। অন্ধকারেই এখনও ঘুরছে।
বললাম, হ্যাঁ রে, অঙ্কশাস্ত্রের মত টাকা-পয়সার হিসাবের কথা কি বলছিলি?
হ্যাঁ, একটা লেনদেনের ব্যাপার—
কার সঙ্গে কার?
কালী সরকারের সঙ্গে কারও বলেই মনে হয়!
তোর কি মনে হয়?
আপাততঃ চায়ের পিপাসা পেয়েছে-ওঠ চল্।
অগত্যা উঠতে হল।
০৯. পোস্টমর্টেম রিপোর্ট
পরের দিনই দ্বিপ্রহরে পোস্টমর্টেম রিপোর্ট পাওয়া গেল।
কিরীটীর অনুমান মিথ্যা নয়। শ্বাস-বন্ধ করেই কালী সরকারের মৃত্যু ঘটানো হয়েছে-জলে ড়ুবে তার মৃত্যু হয়নি।
রিপোর্টটা নিয়ে এসেছিল মহান্তিই।
সে বলে, শেষ পর্যন্ত মনের মধ্যে সত্যিই কিন্তু একটু সন্দেহ ছিল মিঃ রায়। হয়ত স্ট্যাঙ্গুলেশান নয়। কিন্তু এখন বুঝতে পেরেছি আপনার অনুমানটা একেবারে নির্ভুল। এবং আরও একটা সংবাদ আছে মিঃ রায়
কী? কিরীটী মহান্তির মুখের দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাল।
লতিকা গুঁই নিরুদ্দেশ হয়েছে।
আমি বলি, সে কি! কোথায় গেল জানতে পারলেন না কিছু?
না। আজ সকাল থেকে তার কোন পাত্তা নেই। কাল রাত্রেও এগারটার সময় হোটেলের চাকর তাকে তার ঘরে দেখেছিল। আজ সকালে আর তাকে নাকি দেখা যায়নি। সুটকেস আর বিছানাটা ঘরের মধ্যে আছে এবং ঘরের বাইরে থেকে তালা দেওয়া।
কিরীটী এবারে কথা বলে, রাত এগারটা পর্যন্ত তাহলে সে হোটেলে ছিল?
হ্যাঁ। রাত দশটার সময় নাকি রেণুকা বিশ্বাস তার সঙ্গে দেখা করতে যায় ঐ হোটেলে।
কে কে গিয়েছিল দেখা করতে? কিরীটী উদগ্রীব হয়ে ওঠে।
রেণুকা বিশ্বাস।
হুঁ। তাহলে রেণুকা বিশ্বাস নিশ্চয় জানে লতিকা গুঁই কোথায়। চলুন, এখনি একবার সী-সাইড হোটেলে যাব।
এখুনি যাবেন?
আরও আগে যাওয়া উচিত ছিল। খবরটা আপনি কখন জানতে পারেন যে লতিকা গুঁই চলে গিয়েছে?
সকালেই। যে লোকটা হোটেলের সামনে প্রহরায় ছিল তার কাছে।
রাত্রে সেই হোটেলের সামনে কেউ প্রহরায় ছিল না। ছিল।
কিন্তু সে বলছে একমাত্র রেণুকা বিশ্বাস ছাড়া রাত দশটার পর কাউকে হোটেলে যেতে বা আসতে দেখেনি।
হোটেল থেকে বেরুবার অন্য কোন রাস্তা নেই?
আছে। পিছনের দিকে মেথরদের যাতায়াতের রাস্তা।
তাহলে সেই রাস্তা দিয়েই সে সরে পড়েছে।
আপনার কোনো রকম কিছু সন্দেহ হয় মিঃ রায়?
সী-সাইড হোটেলের দিকে যেতে যেতে মহান্তি কিরীটীকে প্রশ্নটা করে। কিরীটী চলতে চলতেই বলে, কি সন্দেহ?
ঐ লতিকা গুঁই কালী সরকারের হত্যার ব্যাপারে
সন্দেহের তালিকার মধ্যে লতিকা গুঁই তো অন্যতমা, কথাটা ভুলে যাচ্ছেন কেন মিঃ মহান্তি?
.
হরডন বিশ্বাস হোটেলে ছিল না, বাজারে গিয়েছিল।
তবে রেণুকা বিশ্বাস ছিল।
সে তার ঘরের মধ্যে একটা চেয়ারে বসে কাঁটা দিয়ে লেসের মত কি একটা বুনছিল আর তার পাশে বসেছিল ছাব্বিশ-সাতাশ বৎসরের একটি সুশ্রী যুবক।
মহান্তিই দরজার বাইরে থেকে গলার সাড়া দেয়, ভিতরে আসতে পারি? কে?
আমি মহান্তি।
কে?
আসুন।
আমরা ভিতরে ঢুকতেই যুবকটি উঠে দাঁড়ায়।
এই ছেলেটি কে মিসেস বিশ্বাস? মহান্তিই প্রশ্ন করে।
রেণুকা বিশ্বাস বলে, সাধন সরকার। কালী সরকারের ভাইপো। আমাদের টেলিফোন পেয়ে আজই সকালের এক্সপ্রেসে এসেছে। তুমি যাও সাধন, তোমার ঘরে যাও।
কিরীটী তাড়াতাড়ি বলে ওঠে, সাধনবাবু, হোটেলের বাইরে যাবেন না কিন্তু আপনি, ঘরেই থাকবেন। আপনার সঙ্গে আমাদের কথা আছে। আমরা আপনার ঘরে আসছি একটু পরেই।
সাধন সরকার কোন জবাব দিল না। নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সাধন সরকার ঘর ছেড়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই রেণুকা বিশ্বাসও উঠে দাঁড়ায় এবং বলে, তাহলে আপনারা একটু বসুন মহাতি সাহেব, আপনাদের চায়ের কথাটা বলি