জানেন?
হ্যাঁ। এখানে জমি হোটেল ও লাইসেন্সের ব্যাপারে ওই স্ত্রীলোকটি মধ্যে মধ্যে আমার কাছে যেত। সেই সময় কথায় কথায় ওর অনেক পরিচয়ই আমি জানতে পারি।
কি জেনেছেন বলুন না!
সেদিন আপনাকে ঐ স্ত্রীলোকটি সম্পর্কে সব কথা বলিনি কিন্তু আজ বলছি শুনুন–বিয়ের আগে রেণুকা ছিল দাশরেণুকা দাশ নামেই অন্ততঃ পরিচয় ছিল, যদিচ ওর জন্ম মিশ্র রক্তে–
কি রকম?
ওর বাপ ডাঃ আর্থার মূর ছিল সাঁওতাল পরগণার এক মিশনারী হাসপাতালের ডাক্তার। জাতে স্কচ।
কার কাছে শুনলেন একথা?
ও নিজেই বলেছে।
কে, রেণুকা?
হ্যাঁ। কথায় কথায় একদিন ও আমাকে বলেছিল ওর জীবনটা নাকি বড়ই বিচিত্র। ছোটবেলায় ছিল প্রচণ্ড দস্যি মেয়ে। দৌড়, লাফ-ঝাপ, কুস্তি, ছোরা খেলা, লাঠি খেলা, বন্দুক ছোঁড়া–
বলেন কি!
হ্যাঁ। সব তার পালক বাপের উৎসাহে। আসলে ঐ মিশনারী ডাক্তারের ঔরসে রেণুকার জন্ম হলেও লোকে জানত ওর আড়াই বছর বয়সের সময় মা মরে যাওয়ায় ঐ মিশনারী ডাক্তারই তাকে অনুগ্রহ করে পালন করেছে। যা হোক যা বলছিলাম, গায়েও বেশ শক্তি ধরত। ডাক্তার বাপ অবিশ্যি ওকে যে কেবল খেলাধূলা, দৌড়ঝাপেই উৎসাহ দিয়েছে তাই। নয়—লেখাপড়াও কিছু কিছু শিখিয়েছিল। কিন্তু লেখাপড়ায় ওর তেমন মন ছিল না।
তারপর?
পনের কি ষোল বছর বয়স যখন, এক সার্কাস পার্টির সঙ্গে ও পালিয়ে যায়। চার বছর ছিল সেই দলে। নানা ধরনের দৈহিক কসরত দেখাত। তারপর একদিন সার্কাস পার্টির ম্যানেজারকে ছুরি মেরে–
বলেন কি! এ যে রীতিমত এক উপন্যাস! তারপর?
সুব্রতই কথাটা বলে।
হ্যাঁ, ব্রতবাবু। মহান্তি বলতে থাকে, ম্যানেজার রাত্রে ওর তাঁবুতে এসেছিল। ও ছুরি মেরে পালায় সেখান থেকে। ও ফিরে আসে আবার মিশনারী বাপের কাছে। ক্রমে ম্যাট্রিক ও আই-এ পাস করে। ট্রেনে একদিন কলকাতায় যেতে যেতে টি. টি. হারাধন বিশ্বাসের সঙ্গে ওর আলাপ হয়। আলাপ ক্রমে ঘনিষ্ঠতায় পরিণত হয়। ঐ সময় ঐ মিশনারী ডাক্তার মারা যান এবং হারাধনের প্রচেষ্টাতেই জগমোহন গার্লস স্কুলে ও চাকরি পায়।
তারপর?
কিন্তু সেখানে ও এক বছরের বেশী চাকরি করতে পারে না।
কেন?
হোস্টেলে থাকত ও–মানে ঐ স্কুলেরই হোস্টেলে। সেখানে কি একটা চুরির ব্যাপারে জড়িয়ে পড়ে এবং নিজে থেকেই ও চাকরি ছেড়ে দেয়।
সুব্রত বলে ওঠে, এ যে সত্যিই এক উপন্যাস দেখছি! মিশ্ররক্তে-জম্ম—একটি মেয়ে –কিছুদিন সার্কাসে—সেখান থেকে ম্যানেজারকে ছুরি মেরে পালালো-তারপর পড়াশুনা ও হোস্টেল-সেখানেও চুরি–theft–
সত্যিই উপন্যাস সুব্রতবাবু, মোহান্তি বলে—কিন্তু ঐ পর্যন্ত এসেই ওর জীবনের কিছুটা অংশ কেমন যেন ধোঁয়াটে–
মানে? কিরীটী প্রশ্ন করে।
ঐখানে বছর দুয়েকের কথা এলোমেলো ভাবে চলেছে। কেবল একটি কথা স্পষ্ট
কী?
ঐ সময় ও হারাধন বিশ্বাসকে বিয়ে করে। হারাধন তখন তার পালক পিতার মৃত্যুতে বেহুলার নার্সারী ও ফুলের স্টলটা পেয়ে সে দুটো নিয়ে মেতে আছে। তারপর ওদের বিয়ের পর কি হল-হঠাৎ ও চলে এল।
কে চলে এল? রেণুকা বিশ্বাস?
হ্যাঁ। চলে এল কলকাতা থেকে গোপালপুর-অন-সীর এক হোটেলে, চাকরি নিয়ে।
তারপর?
তারপর এক বছর পরে এই পুরী শহরে আবির্ভাব ও এই হোটলের পত্তন-হারাধনের স্টল ও নার্সারী বিক্রি–
একটা কথা মিঃ মহান্তি! কিরীটী প্রশ্ন করে।
বলুন?
আচ্ছা ওর ঐ ভাইটি—
ঐ রামানুজ দাশের কথা বলছেন?
হ্যাঁ। ওর সম্পর্কে কি জানেন?
বিশেষ কিছুই জানি না। ওর সঙ্গে আজকেই তো হেটেলে প্রথম পরিচয় হল বলতে গেলে।
রেণুকা বিশ্বাসের মুখে ওর ভাই সম্পর্কে কিছু শোনেন নি?
না।
কিছু বলেনি সে?
না। তা না-ই বা জানা থাকল, কি জানতে চান ঐ রামানুজ সম্পর্কে বলুন? সব জেনে নেব।
বিশেষ কিছু না, এই হোটেলে ও কতদিন আছে, এর আগে কোথায় ছিল, কি করত।
ও আর এমন কি শক্ত, বলেন তো এখুনি ওকে এখানে ডেকে যা জানবার আমরা জেনে নিতে পারি মিঃ রায়।
না মহান্তি সাহেব, তাড়াহুড়ো নয়, ধীরেসুস্থে জানুন। ও যেন না কোনক্রমে আপনাকে সন্দেহ করতে পারে!
তবে কি মিঃ রায়, ঐ রামানুজকেই আপনি–
সন্দেহের কথা যদি বলেন মহান্তি সাহেব, অত্যন্ত সন্দিগ্ধ মন আমার-হরডন বিশ্বাস, রেণুকা বিশ্বাস, রামানুজ দাশ সকলকেই আমি—এমন কি কালী সরকারের দুপাশের ঘরে যে বোর্ডার দুজন আছে, রামগতি কানুনগো ও সুধাপ্রিয় মল্লিক তাদেরও–
কিরীটীর কথা শুনে বিস্ময়ে মহান্তি মস্ত বড় এক হাঁ করে।
একেবারে বন্ধ, কোন রা নেই। অনেকক্ষণ পরে ঢোক গিলে বলে, তবে—
কি তবে? নিশ্চয়ই। সকলকার উপরেই আপনার নজর রাখতে হবে-যাদের যাদের নাম এইমাত্র আমি করলাম। তারপর একুট থেমে কিরীটী বলে, মিঃ মহান্তি, এই দেখুন সী-সাইড হোটেলের কালী সরকার দুটো ঘর নিয়ে থাকত সেই ঘরের পারিপার্শ্বিকতা নিয়ে মোটামুটি একটা প্ল্যান আমি খাড়া করেছি। বলতে বলতে কিরীটী আমাদের সামনে একটা কাগজ মেলে ধরে।

দেখলাম কাগজটায় একটা নকশা আঁকা আছে।
কিরীটী বলে, সাত ও আট নম্বর ঘর নিয়ে ছিল কালী সরকার। ছয় নম্বর ঘরে ছিল রামগতি কানুনগো, নয় নম্বর ঘরে সুধাপ্রিয় মল্লিক আর তের নম্বর ঘরে থাকেন আমাদের রামানুজ দাশ মশাই।
একটু থেমে আবার কিরীটী বলে, রামগতি কানুনগো আর সুধাপ্রিয় মল্লিক-রামানুজের সঙ্গে সঙ্গে ওদেরও সম্পর্কে যতটা জানা যায় জানতে চেষ্টা করুন, এবং এই যাদের নাম করলুম ইনকুডিং আমাদের লতিকা গুঁই—আপাততঃ এই কয়জনের প্রত্যেকের উপর নজর রাখবেন এবং ওঁদের জানিয়ে দেবেন বিনানুমতিতে কেউ ওঁরা শহর ছেড়ে বাইরে যেতে পারবেন না।