সমুদ্র তো আমার পাশেপাশেই রয়েছে। অপরাহের আলোয় যেন নীল মরকতমণির মত জ্বলছে।
হঠাৎ চমকে উঠলাম।
একেবারে জলের ধার ঘেঁষে কে যেন বালুর উপর বসে আছে। বাতাসে তার আঁচল ও মাথার চুল উড়ছে। সমুদ্রের দিকে তাকিয়ে অপলক বসে আছে এক নারী। কে ঐ নারী।
আরও কিছুটা এগিয়ে যেতেই দ্বিতীয়বার চমকে উঠি : লতিকা গুঁই!
এখানে এই নির্জন সমুদ্রতীরে লতিকা গুঁই!
আরও এগোব কি এগোব না ভাবছি।
লতিকা গুঁইয়ের কিন্তু কোন দিকে নজর নেই। সে যেন নিজ ধ্যানে মগ্ন। আরও একটু এগিয়ে গেলাম। কোন খেয়াল নেই লতিকা গুঁইয়ের। মধ্যে একআধটা ঢেউ এসে পায়ের কাছে একেবারে পড়ছে। সেদিকেও যেন খেয়াল নেই।
অপরাত্নের আলোয় সেই সমুদ্র-তীরবর্তিনী উপবিস্টা নারীকে মনে হল যেন বড় বিষণ্ণ, বড় ক্লান্ত, বড় একা। হঠাৎ যেন চোখে পড়ল, লতিকার দু চোখের কোণ বেয়ে ক্ষীণ অশ্রুর ধারা গড়িয়ে পড়ছে। লতিকা কাঁদছে।
আস্তে আস্তে নিঃশব্দে ফিরে এলাম। আর অগ্রসর হলাম না।
.
হোটেলে ফিরে দেখি কিরীটী আর এক কাপ চা নিয়ে বসেছে।
আমাকে ফিরতে দেখে বলে, মন শান্ত হল?
আমি কোন কথার জবাব দিই না।
তুই যে কুন্তলার ব্যাপারে এতখানি টাচি সুব্রত, জানতাম না তো! ক্ষমা কর ভাই।
আমি সে কথার কোন জবাব না দিয়ে বললাম, লতিকা গুঁইকে দেখলাম।
কোথায়? নিস্পৃহ কণ্ঠে শুধায় কিরীটী।
সমুদ্রের ধারে। বসে বসে মনে হল যেন কাঁদছে।
পুওর গার্ল, কিরীটী বলে, শিক্ষকতা করতে করতেই জীবনটা গেল।
আমাদের কথা শেষ হয় না, দেখি একটা সাইকেল-রিকশা থেকে মহান্তি নামছে হোটেলের সামনে।
মিঃ মহান্তি যে, কি ব্যাপার?
আপনি আমাকে ট্রাঙ্ক কলটার খোঁজ নিতে বলেছিলেন না? সী-সাইড হোটেলে কাল যে ট্রাঙ্ক কল হয়েছে–
হ্যাঁ। খবর পেলেন কিছু?
পেলাম। দুটো ট্রাঙ্ক কল ছিল। একটা কলকাতা থেকে আর একটা রাউরকেল্লা থেকে। কিন্তু–
কি?
দুটো কলেই পি. পি.পার্টিকুলার পারসন ছিল, কিন্তু তার মধ্যে তো কালী সরকারের নাম নেই!
০৮. কিরীটী মহান্তির মুখের দিকে তাকিয়ে
কিরীটী মহান্তির মুখের দিকে তাকিয়ে শুধায়, তবে কার নাম আছে?
একটা কল ছিল এইচ. বিশ্বাসের নামে। আর একটা ছিল কোন্ এক গনেন ব্যানাজীর নামে। লোকটা নিউজ-পেপার রিপোর্টার। লতিকা গুঁই যে ট্রাঙ্ক কলে কালী সরকারের সঙ্গে গতকাল বিকেলে কথা বলেছে বললে, এখন মনে হচ্ছে সেটা মিথ্যা। তাছাড়া
থামলেন কেন বলুন? কিরীটী ওর দিকে তাকিয়ে তাগিদ দেয়।
মনে হচ্ছে লতিকা গুঁই যেন কিছু লুকোচ্ছে।
কি লুকোবে?
আমার যেন মনে হচ্ছে সে অনেক কিছুই হয়ত জানে এ ব্যাপারে।
তা যদি সে লুকিয়েই থাকে তো আমরা ঠিকই জানতে পারব মিঃ মহান্তি। ডোন্ট ওরি। আপনাকে কতকগুলো কথা বলি, মন দিয়ে শুনুন।
বলুন?
এক নম্বর, কিরীটী বলে, ঐ সী-সাইড হোটেলটা তৈরী করতে মোটামুটি কত টাকা আন্দাজ খরচ হয়েছে এবং কত ট্যাক্স হোটেলের বাড়িটার জন্য দিতে হয়—
আর?
শুনুন দু নম্বর, খরচের টাকার অঙ্কটা তো জানতেই হবে, দ্বিতীয়তঃ কি ভাবে কনট্রাকটারকে সে টাকা payment হয়েছে-by cheque or cash এবং তিন নম্বর
বলুন?
বেহালার নার্সারী ও নিউ মার্কেটের ফুলের স্টল কত টাকায় বিক্রী হয়েছিল এবং কে কিনেছিল?
আর কিছু?
কিরীটী বলতে থাকে, চার নম্বর-জগমোহিনী স্কুলের চাকরি রেণুকা বিশ্বাস ছেড়ে দিয়েছিল নিজেই, না তাকে ছাড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যদি ছাড়িয়ে দেওয়া হয়ে থাকে তো কেন? পাঁচ নম্বর-রেণুকা ও হরডনের বিয়ের পরে ও আগে কালী সরকারের সঙ্গে ওদের দুজনের কোন যোগাযোগ ছিল কিনা! ছয় নম্বর-কালীর ভাইপো সাধন সরকারকে একটি ইনটিমেশন দিতে হবে–
আর কিছু?
হ্যাঁ, আর একটা কথা, দোলগোবিন্দ সিকদার নামে একটি লোক-লোকটি দেখতে সুন্দর, ফর্সা রঙ, ভাসা-ভাসা বড় বড় চোখ, চোখের তারা কটা এবং মাথার চুলও কটা। ঝলঝলে একটা স্যুট পরনে—আর বাঁ কপালের উপর আধ-ইঞ্চি পরিমাণ একটি জড়ল আছে। এই লোকটির সন্ধান এই পুরী শহরে করতে পারেন কিনা দেখুন।
কিন্তু–
সম্ভবতঃ লোকটা বিদেশী এবং শুনেছি ব্যবসায়ী। পার্ল-মার্চেন্ট অর্থাৎ মুক্তোর ব্যবসায়ী।
মুক্তো-ব্যবসায়ী!
হ্যাঁ। স্টেশনে একজন পুলিস নিযুক্ত করুন নজর রাখার জন্য।
যদি অলরেডি চলে গিয়ে থাকে পুরী ছেড়ে?
তাহলে আর কি করবেন!
খোঁজ করব কোথায় লোকটার?
আগে হোটেল ও ধর্মশালাগুলোতে করুন, তারপর শহরে করুন।
কিন্তু লোকটা কে?
বললাম তো মুক্তোর ব্যবসায়ী।
তা যেন বুঝলাম, কিন্তু এই মামলার সঙ্গে–
কালী সরকারের সঙ্গে লোকটার পরিচয় ছিল, আর গতকাল সন্ধ্যায় সী-বীচে লোকটাকে কালী সরকারের সঙ্গে আমরা দেখেছি।
তা না হয় খুঁজে দেখব, তবে আমার কিন্তু ধারণা—
কি ধারণা আপনার?
ঐ হোটেলওয়ালী রেণুকা বিশ্বাস স্ত্রীলোকটি আদৌ সুবিধার নয়।
কিন্তু তাতে করে আপনি কি খুব একটা এগুতে পারবেন মিঃ মহান্তি এই হত্যার ব্যাপারে?
মানে?
যদি আমাদের অনুমান সত্যিই হয় যে, তাকে স্ট্যাঙ্গেল করে অর্থাৎ গলা টিপে হত্যা করে পরে জলে ভাসিয়ে দেওয়া হয়েছে আত্মহত্যা প্রমাণ করবার জন্য, সেক্ষেত্রে রেণুকা। বিশ্বাসের মত একজন স্ত্রীলোকের পক্ষে কি–
অর্থাৎ আপনি বলতে চান সম্ভব কিনা? আপনি ঐ মেয়েমানুষটিকে চেনেন না, আমি কিছু কিছু জানি।