বছর তিনেকের কিছু বেশী, মাস দু-তিন হবে।
মাত্র!
হ্যাঁ।
I see-যাকগে সে-কথা। আপনাকে আমি ডেকে ছিলাম একটা কথা জানতে মিঃ বিশ্বাস–
বলুন?
আচ্ছা একজন বেশ সুন্দরমত লোক-ফর্সা রঙ, কটা চুল, কটা চোখ, ঝলঝলে একটা স্যুট পরনে—কোন সময়ে কালী সরকারের কাছে আসতে দেখেছেন কি?
না।
মনে করে দেখুন!
না। কালী সরকার কারও সঙ্গে দেখা করতেন না। বেরুতেন না, সন্ধ্যায় ঘণ্টা দেড়েক দুয়েকের জন্য ছাড়া।
বেশ, কালী সরকারের কাছে না হোক আপনার হোটেলে বর্তমানে যে রকম description একটু আগে দিলাম সেরকম কোন বোর্ডার আছেন বা কেউ–
না, না-কই, সেরকম তত বোর্ডার নেই বর্তমানে আমার হোটেলে—
এবারে একটু যেন সংযত হয়েই কথাগুলো ধীরে ধীরে থেমে উচ্চারণ করে হরডন বিশ্বাস।
আপনি ঐ ধরনের দেখতে কোন লোককে-হোটেলে না হোক পুরী শহরে তো বাজারহাট, এদিক-ওদিক যাতায়াত করেন-আপনার চোখে পড়েছে? কিরীটী আবার প্রশ্ন করে।
কই না! মাথা নাড়ে হরড়ন বিশ্বাস।
হুঁ। আচ্ছা এবারে আপনি তাহলে যেতে পারেন।
যাব?
হ্যাঁ, যান।
হরডন বিশ্বাস চলে যাবার জন্য দরজা-পথে ঘরের বাইরে গিয়েও সঙ্গে সঙ্গে আবার ফিরে আসে। মনে হল সে যেন কি বলতে চায়।
কি হল? কিছু বলবেন? কিরীটীই পুনরায় প্রশ্ন করে।
না—মানে বলছিলাম কি—
বলুন-থামলেন কেন?
আপনাদের এভাবে হোটেলে আসায়, মনে হচ্ছিল যখন এ ঘরে আসি, হোটেলের অন্যান্য বোর্ভারদের মনে হয় কিছুটা সন্দেহ-ভয় দেখা দিয়েছে–
তা একটু তো হবেই, মিঃ বিশ্বাস। তবে পুলিসের দিক থেকে বেশী হৈ-চৈ করা হবে, আপনি নিশ্চিত থাকতে পারেন। কিরীটী আশ্বাস দেয়।
কিন্তু কি বিশ্রী ব্যাপার হল বলুন তো! মাত্র হোটেল এক বছর হল—এত খরচাপত্র করে করলাম–
ভাল কথা মিঃ বিশ্বাস, এই হোটেল খোলবার আগে আপনি কি কাজ করতেন?
ব্যবসা করতাম।
কিসের ব্যবসা?
ফুলের!
ফুলের ব্যবসা?
হ্যাঁ, একটা ফুলের স্টল ও নার্সারী ছিল আমার।
কোথায়?
স্টলটা ছিল নিউ মার্কেটে-নার্সারী বেহালায়।
সে ব্যবসা কতদিন করেছেন?
তা ধরুন বছর পাঁচেক হবেই। সে ব্যবসা করেছিলাম—আসলে ব্যবসাটা ছিল আমাকে যে পাদ্রী মানুষ করেন তারই। তার মৃত্যুর সময় ব্যবসাটা তিনি আমাকেই দিয়ে যান।
ব্যবসাটা লাভের ছিল নিশ্চয়ই?
তা ছিল।
তা সে লাভবান ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে হঠাৎ এই পুরী শহরে এসে হোটেল খুললেন কেন? ইতিমধ্যে মহান্তি ঘরে ফিরে এসেছিল, প্রশ্নটা সেই-ই করল।
আমার স্ত্রীর অনেকদিন থেকে একটা হোটেল খোলবার ইচ্ছা ছিল তাই। স্কুলের চাকরি ছেড়ে দিয়ে কিছুদিন গোপালপুর-অন-সীতে একটা ইউরোপিয়ান হোটেলে সুপারভাইজারের কাজ করেছিল। তাই ধারণা হয়, ভাল কোন জায়গায় সমুদ্রের ধারে বা পাহাড়ে ভাল করে একটা হোটেল খুলতে পারলে প্রচুর আয় হতে পারে।
তাই এই হোটেল?
হ্যাঁ। সেই ব্যবসা বিক্রি করে দিয়ে এই হোটেল করেছি আমরা।
হোটেলের এই বাড়ী আপনাদের?
হ্যাঁ। একটা ছোট বাড়ি ছিল-বাড়ি সমেত জায়গাটা কিনে নিয়ে এক্সটেনশন করিয়ে নিয়েছি।
বেশ খরচা পড়েছে নিশ্চয়ই?
তা পড়েছে। কিন্তু ওসব খবর আমি ঠিক বলতে পারব না মিঃ মহান্তি। আমার স্ত্রীই সব কিছু করেছে—সেই-ই সব জানে-বলতে পারবে।
০৭. সী-সাইড হোটেল
অতঃপর তখনকার মত আমরা বের হয়ে এলাম সী-সাইড হোটেল থেকে। মহান্তির কাছ থেকে বিদায় নিয়ে হোটেলে ফিরে স্নান-খাওয়া সারতে সারতে বেলা প্রায় দেড়টা হয়ে গেল।
আহারাদির পর গোবিন্দলালবাবুর একটা শারদীয়া রহস্য পত্রিকা নিয়ে শয্যায় গিয়ে গা এলিয়ে দিলাম।
পুরী ভিউ হোটেলের একটা বিশেষত্ব হচ্ছে, একেবারে যেন পা বাড়ালেই সমুদ্র। মুহূর্তে মনটা ভরে ওঠে চোখ মেললেই। সামনের দিকে জানালাটা খুলে দিলাম। দুপুরের রৌদ্রে মরকতমণির মত জ্বলছে যেন সমুদ্র।
কী গাঢ় নীল। নীল সমুদ্রের প্রান্তে যেন নীল আকাশ অবগাহন করছে। সেই নীলের বুকে ঢেউয়ের পর ঢেউয়ের ভাঙা আর গড়া। শীর্যে শীর্ষে তার শ্বেতশুভ্র যুইয়ের মত ফেনার মুঠো মুঠো অঞ্জলি। আর একটানা শব্দ-গোঁ-গোঁ-গোঁ। বইটা আর পড়া হল না-বুকের উপর পড়ে রইল। সামনে চোখ মেলে অলস শয্যায় পড়ে রইলাম।
সঙ্গে সঙ্গে মনের পাতায় ভেসে ওঠে কালীপ্রসাদ সরকারের প্রাণহীন দেহটা। মানুষটা কালও বেঁচে ছিল—আজ আর নেই! সমস্ত কিছুর উপরে অকস্মাৎ যেন একটা পুর্ণচ্ছেদ টেনে দিয়েছে মৃত্যু।
সত্যিই কি লোকটার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে? তাকে নিষ্ঠুরভাবে কোন কিছুর সাহায্যে শ্বাসরোধ করে পৈশাচিক ভাবে হত্যা করা হয়েছে?
কিরীটীর ধারণা যখন তাই-নিঃসন্দেহে তাই ঘটেছে।
কিন্তু কেন? কে মারল–হত্যা করল অমন নিষ্ঠুরভাবে শ্বাসরোধ করে মানুষটাকে? বিয়েথা করেনি-ব্যাচিলার-নির্বাট মানুষটাপৃথিবীতে কেউই কি অজাতশত্রুর নয়? শত্রু সবারই আছে? কিংবা কোন পরশ্রীকাতর লোক হিংসার বশবর্তী হয়ে তাকে হত্যা করেছে? কিংবা শত্রুতাও নয়, হিংসাও নয়, কুটিল কোন স্বার্থের জন্য অমন নৃশংস কাজ করেছে কেউ?
কিন্তু কে? কে করল?
হরডন বিশ্বাস—তার স্ত্রী রেণুকা বিশ্বাস রামানুজ-তস্য শ্যালক—কিংবা ঐ স্কুলমিসট্রেস শ্রীমতী লতিকা গুঁই। আপাততঃ তো চোখের সামনে এই পাঁচজনকেই দেখা যাচ্ছে। তিনটি পুরুষ ও দুটি নারী।
যে কেউই কালী সরকারকে হত্যা করতে পারে। হঠাৎ মনে পড়ল আর একজন ক্ষণিক দেখা দিয়ে যে নেপথ্যচারী হয়েছে, সেই কশ্চিৎ মুক্তাব্যবসায়ী কালী সরকারের বিশেষ পরিচিত দোলগোবিন্দ শিকদার।