- বইয়ের নামঃ বসন্ত রজনী
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গোয়েন্দা কাহিনী
০১. মানুষের চেহারা
মানুষের চেহারা—তার আকৃতি, গঠন এবং তার মুখের গড়ন দেখে কি একটা মানুষকে চেনা যায়- চেনা যেতে পারে?
আমার প্রশ্নের উত্তরে কিরীটী মৃদু কণ্ঠে বলে, তোর কি মনে হয় সুব্রত?
আমি তো জিজ্ঞাসা করছি তোমাকে কিরীটী!
না!
চেনা যায় না—বোঝা যায় না?
না।
তবে যে অনেকে বলে মানুষের মনের ছবিই হচ্ছে তার মুখ?
আমি বিশ্বাস করি না।
কেন?
কারণ মানুষের মনটা এমন একটা বিচিত্র বস্তু যে, বিশেষ কোন একটা formula-র মধ্যে ফেলে তাকে বিচার করতে গেলে আমার মনে হয় ঠিক বিচার করা হবে না। হতে পারে না।
কিন্তু তুই তো অনেক সময় মানুষের বাইরের চেহারাটা দেখেই তার চরিত্রের analysis করেছিস!
করেছি, কিন্তু তাই বলে সেটা যে সর্বক্ষেত্রেই অবধারিত সত্য তাও তো নয়।
কিন্তু আমার মনে হয়—
কি মনে হয় সুব্রত? কিরীটী প্রশ্ন করে আমার মুখের দিকে তাকাল। অনুসন্ধিৎসু দৃষ্টি তার।
চেহারা-মানে বলতে চাই আমি, কারও চেহারা বিশেষভাবে খুঁটিয়ে দেখলে সবটা না হলেও তার চরিত্রের কিছুটা আভাস-বলতে পার মোটামুটি আভাস আমরা পেতে পারি।
কথাটা আমি বলেছিলাম অদূরে একজন লোককে সাগর-সৈকত ধরে আমাদেরই দিকে এগিয়ে আসতে দেখে।
কিরীটীর সেটা নজর এড়ায়নি। বলে, ঐ যে ভদ্রলোকটি এদিকে আসছে, ওকে দেখে তোর কি মনে হয় সুব্রত? নিশ্চয়ই একজন মার্ডারার, নয়?
যদি বলি তাই!
কিরীটী আমার কথায় হো হো করে হেসে ওঠে।
হাসছিস? বললাম আমি, কিন্তু লোকটার দিকে ভাল করে চেয়ে দেখ তো কিরীটী-ওর চেহারার দিকে তাকালে মনে হয় না কি, লোকটা কোল্ড ব্লডে মার্ডার করতে পারে? অত্যন্ত শান্ত ও নির্বিকার ভাবে একজনের পিঠে ছুরি বসাতে পারে, গুলি চালাতে পারে বা চায়ের বা খাদ্যের সঙ্গে কোন তীব্র বিষ মিশিয়ে দিতে পারে?
যেহেতু লোকটার চেহারাটা তোর নয়নতৃপ্তিকর হয়নি। প্রথম দৃষ্টিতেই লোকটার চেহারা তোর বিচ্ছিরি লেগেছে, এটাই তো তোর একমাত্র যুক্তি সুব্রত।
আমি কিরীটীর মুখের দিকে তাকিয়ে বলি, না, না, ঠিক তা নয়–
তাই-অবিশ্যি অস্বীকার করব না যে, এমন চেহারা কারও কারও আছে যার দিকে তাকানো মাত্র মনে হয়, লোকটা বুঝি যে-কোন ক্রাইম অনায়াসেই করতে পারে। এমন কি হত্যাও। মন ঘিনঘিন করে ওঠে। অথচ মজা হচ্ছে, খোঁজ নিলে হয়ত দেখা যাবে-সম্পূর্ণ বিপরীত। যা মনে হয়েছে আদৌ তা নয়। প্রকৃতিতে লোকটা হয়তো যেমন শান্ত, তেমনি নিরীহ, তেমনি ভীতু।
কিন্তু—
কিরীটী আমাকে বাধা দিয়ে বলে, ঠিক তাই সুব্রত। মানুষের চরিত্র বড় বিচিত্র, বড় দুর্বোধ্য। চেহারার ফরমূলায় ফেলে সেই দুর্বোধ্যকে solveকরা যায় না। তারপরই একটু থেমে বলে, ঐ যে ভদ্রলোকটি—যাকে দেখে তোর মনে হচ্ছে কোও নাড়ে লোকটা মার্ডার করতে পারে, মনে হচ্ছে ওকে আমি চিনি–
চিনিস?
হ্যাঁ।
ভদ্রলোক তখন আরও এগিয়ে এসেছেন হাঁটতে হাঁটতে আমাদের দিকে।
কিরীটী তার দিকে চেয়েই বলতে থাকে, ওঁর নাম কালীপ্রসাদ সরকার। নামকরা একজন জুয়েলার বংশের ছেলে। অমন নিরীহ, অমন গোবেচারা লোক বড় একটা দেখা যায় না। তাছাড়া লোকটা পরম বৈষ্ণব। মানুষ মারা তো দূরে থাক, একটা মাছিও কোনদিন মারতে পারবে কিনা সন্দেহ।
আমি আর কোন জবাব দিই না।
কারণ জানি, জবাব দিলেও কিরীটীর মতের এতটুকু পরিবর্তন তো হবেই না, উপরন্তু সে তার থিয়োরি আরো জোরালো কণ্ঠে প্রতিষ্ঠিত করবার চেষ্টা করবে। আমাকে নস্যাৎ করে দেবে।
তার চাইতে সামনে সাগরের দিকে চেয়ে থাকতে বেশ লাগছে।
পুরীর সাগর-সৈকতে স্বর্গদ্বারের কাছাকাছি দুজনে বসে ছিলাম।
সূর্য অনেকক্ষণ অত গিয়েছে, কিন্তু অন্ত গেলেও সাগরের বুক থেকেও আকাশ থেকে আলোটা যেন মুছেও মুছে যায়নি। সমস্ত প্রকৃতি জুড়ে তখনও যেন একটা আলোর রেশ থেমে যাওয়া শীতের রেশের মতই শেষ হয়েও শেষ হয়নি।
একজন নয় দুজন-কালী সরকার ও অন্য একজন। ভদ্রলোকরা আরও এগিয়ে এসেছেন ইতিমধ্যে এবং কিরীটীকে দেখে কালী সরকার হঠাৎ বলে ওঠে, কিরীটী না?
হ্যাঁ তারপর কালী, তুই এখানে এসময়ে?
এলাম। মাঝে মাঝে তো পুরীতে আসি-ঐ যে হোটেলটায়—
একটা হোটেল দেখায় কালী সরকার আঙুল তুলে। হোটেলটা নতুন এবং চোখ-ঝলসানো।
কালী জিজ্ঞাসা করে, উনি?
আমার বন্ধু-সুহৃদ—একমেবাদ্বিতীয় সুব্রত রায়—
নমস্কার। কালী সরকার হাত তোলে।
আমিও হাত তুলে নমস্কার জানাই। অন্য ভদ্রলোকটি কিন্তু আলাপ করলেন না আমাদের সঙ্গে, কেমন যেন অনিচ্ছুক ভাবে আমাদের দিক থেকে মুখ ঘুরিয়ে রইলেন সর্বক্ষণ।
অতঃপর দুজনে বালুবেলা দিয়ে এগিয়ে গেল। একসময় দূরে মিলিয়ে গেল।
.
ক্রমে ক্রমে সেই আলোর শেষ রেশটকু আকাশ থেকে, প্রকৃতি থেকে মুছে যায়।
অন্ধকার নামে চারিদিকে। অন্ধকারে সমুদ্রের ঢেডলোর মাথায় খেত ফেনার পুঞ্জ যেন হিংস্র জন্তুর ধারালো দাঁতের মত মনে হয়। একটানা গর্জনে মনে হয় যেন কোন অবরুদ্ধ জন্তু প্রচণ্ড আক্রোশে ফুঁসছে।
কিরীটীর দিকে তাকালাম। মনে হল সে যেন কেমন একটু অন্যমনস্ক। মনে হল সে বুঝি কিছু ভাবছে। সমুদ্রের হাওয়ায় চুরোটটা বোধ হয় একসময় নিভে গিয়েছিল—কিরীটী ঘুরে বসে নিভে যাওয়া চুরোটটায় আবার অগ্নিসংযোগে তৎপর হয়।