তাই যদি হয় তো দীপিকার অচৈতন্য দেহটা বাথরুম থেকে বয়ে নিয়ে এল কেন? কি এমন প্রয়োজন ছিল তার? কেনই বা আনতে গেল? বাথরুমে দীপিকা পড়ে থাকলেই বা কি এমন ক্ষতি ছিল? সেটাই তো বরং সকলের চোখে স্বাভাবিক ঠেকত।
দ্রুত একটার পর একটা প্রশ্ন যেন কিরীটীর মনের মধ্যে আসা যাওয়া করতে থাকে। আসে আর যায়, যায় আর আসে।
জানা দরকার কতকগুলো প্রশ্নের উত্তর। তার অবশ্যই জানা দরকার।
(১) রাত এগারটা থেকে পৌনে বারোটা, এই একঘণ্টা সময়ের মধ্যে তিনতলায় নির্বাণীতোষের শয়নঘরে কেউ এসেছিল কিনা? কিংবা ঐ সময়ে কেউ কাউকে তিনতলায় আসতে দেখেছিল কিনা?
(২) শিখেন্দু বীরেন মুখার্জীর কাছে যা বলেছে, তা একেবারে নির্ভুল সত্যু কিনা?
(৩) শিখেন্দুও দীপিকার সহপাঠী, সেও কি ভালবাসত মনে মনে দীপিকাকে! কিংবা দীপিকা সম্পর্কে তার মনের মধ্যে কোথাও কোন দুর্বলতা ছিল কিনা? অসম্ভব নয় ব্যাপারটা!
(৪) দীপিকা তার স্বামীর হত্যার ব্যাপার সম্পর্কে কিছু জানে কিনা? সে ঘরে ঢুকে কাউকে দেখেছিল কিনা?
(৫) সে যদি ঘরে ঢুকে স্বামীকে না দেখে বাথরুমেই গিয়ে তার খোঁজে ঢুকে থাকে এবং তখুনি সে মৃতদেহটা আবিষ্কার করেছিল, না তার চোখের সামনেই হত্যাকাণ্ডটা সংঘটিত হয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে, অর্থাৎ সে বাথরুমে ঢুকেই আবিষ্কার করে থাকে তার স্বামীর মৃতদেহটা, তবে চিৎকার করে উঠে ও সেইখানেই তার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়াটা সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক, ছুটে এসে ঘরের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়বে কেন? প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে মনে, এখনও একটা কথাও বলেনি, সেক্ষেত্রে তার ঘরের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে ঐভাবে পড়ে থাকাটা যেন মন মেনে নিতে চাইছে না!
(৬) স্বামীর মৃত্যুই আঘাতের কারণ, না অন্য কোন কারণ আছে ঐভাবেমূক হয়ে যাওয়ার?
(৭) দীপিকাকে কথা বলতেই হবে। সহজে হয়ত সে মুখ খুলবে না, কিন্তু মুখ তাকে খুলতেই হবে!
(৮) হত্যাকারীর পক্ষে আজ রাত্রে এই বাড়িতে আসাটা এমন কিছু কঠিন ছিল না। উৎসবের বাড়িতে অগণিত অতিথি এসেছে, তাদের সঙ্গে মিলে-মিশে হয়ত সেও এসেছিল কোন এক সময়। তারপর কোন এক ফাঁকে তিনতলায় চলে যাওয়াও তার পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল না। তারপর বাথরুমে হয়ত সুযোগের অপেক্ষায় লুকিয়ে ছিল। কিন্তু তারপর হত্যা করার পর কোন পথে সে গেল? নিশ্চয়ই বাথরুমের মেথরদের যাতায়াতের দরজার পথে-—এখানেও মনের মধ্যে একটা দ্বিধা জাগছে কিরীটীর। কিসের দ্বিধা? কেন দ্বিধা? ঘুরেফিরে আবার শিখেন্দুর কথাই মনে আসছে। শিখেন্দু-দীপিকা-নির্বাণীতোষ। পরস্পরের সহপাঠী। অনেক বছর একসঙ্গে কেটেছে। যার ফলে নির্বাণীতোষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও বিয়ে। ত্রিকোণ কোন প্রেমের মর্মন্তুদ শেষ দৃশ্য নয় তত নির্বাণীতোষের হত্যার ব্যাপারটা?
(৯) শেষ কথা যেটা কিরীটীর মনে হয়, এ হত্যার ব্যাপারে, শিবতোষ মল্লিকের প্রথম পক্ষের মৃত স্ত্রীর সন্তান আশুতোষ মল্লিক। যে মানুষটা তার জন্মদাতার প্রতি একটা প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিদ্বেষ বরাবর পোষণ করে এসেছে। বাপের সাহায্য কখনও এক কপর্দকও নেয়নি। চেষ্টা করেও তাকে শিবতোষ তার গৃহে আনতে পারেননি। বাপের মুখ পর্যন্ত দেখতেও নারাজ। কেন? কিসের এ ঘৃণা, কিসের এ আক্রোশযা এত বছরেও বাপ ও ছেলে পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কটাকে সহজ হতে দিল না? নিজে সামান্য চটকলের একজন মজুর, হয়ত লক্ষপতি বাপকে স্বীকার করল না। তার মাকে তার পিতামহ এ বাড়িতে প্রবেশাধিকার দেয়নি, স্বীকার করেনি কখনও পুত্রবধূ বলে। কিন্তু বাপ তো তার স্ত্রীকে বরাবরই স্বীকার করেছে। তবে এত ঘৃণা ও এত আক্রোশের কারণ কী আশুতোষের তার বাপের প্রতি?
(১০) তিনতলায় নির্বাণীতোষের শয়নঘরের দরজাটা বন্ধ থাকাই তো স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু দেখা যাচ্ছে খোলা ছিল। কেন?
কথাগুলো প্রশ্নের আকারে কিরীটীর মনের মধ্যে আনাগোনা করতে থাকলেও তার দুচোখের দৃষ্টি কিন্তু তখনও বাথরুমের সর্বত্র তীক্ষ্ণ সজাগ হয়ে যোরাফেরা করছিল।
হঠাৎ দেওয়াল ঘেঁষে কিরীটীর চোখ পড়ে। বাথরুমে ঢোকার দরজাটার একটা পাল্লার ঠিক নিচেই কি যেন ঝিকমিক করছে!– কৌতূহলে এগিয়ে গিয়ে মেঝে থেকে জিনিসটা তুলে নিল কিরীটী। ছোট্ট একটি সোনার ফুলের নাভিদেশে মটরদানার মত একটি হীরকখণ্ড।
আসল এবং দামী হীরে দেখলেই বোঝা যায়। বস্তুটা পরীক্ষা করতে করতে কিরীটীর মনে হয়, ওটা কোন অলঙ্কারের অংশবিশেষ।
কম করেও হাজার পাঁচ-ছয় টাকা মূল্য হবে হীরকখণ্ডটির। এটা বাথরুমের মধ্যে কি করে এল!
চিন্তিত মনে সেটি পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল কিরীটী।
বাথরুমে আর কিছু দ্রষ্টব্য আপাততঃ নেই। মৃতদেহটার দিকে শেষবারের মত তাকিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে এল কিরীটী।
শয়নকক্ষটি আর একবার ভাল করে দেখল কিরীটী। শয্যাটি আদৌ ব্যবহৃত হয়নি, বুঝতে কষ্ট হয় না।
মধুরাত্রে মিলনের আগেই মৃত্যু এসে ছোবল হেনেছে। সব কিছুর উপরে সমাপ্তির রেখা টেনে দিয়েছে।
কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে তিনতলা থেকে দোলায় নেমে এল।
শিবতোষবাবু তখনও বসে আছেন মুহ্যমানের মত।
শিবতোষবাবু!
কে? রায়মশাই, আসুন।
আপনার বৌমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।
শিবতোষের খাসভৃত্য গোকুল দরজার বাইরেই ছিল। তাকে ডেকে শিবতোষ বললেন, দেখ তো ছোড়দি কোথায়?
স্বাতীর জবানবন্দি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বড় বোন স্মৃতিকে নিচে পাঠিয়ে দিয়ে সে আবার দীপিকার পাশে গিয়ে বসেছিল। গোকুল তাকে ডেকে নিয়ে এল।