- বইয়ের নামঃ আদিম রিপু
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃ গল্পের বই
১. ফোনের রিসিভারটা হাতে করে
আদিম রিপু
০১.
ফোনের রিসিভারটা হাতে করেই সুভাষ বসে রইল।
রিসিভারটা যে ফোনের উপর নামিয়ে রাখবে তাও যেন ভুলে গিয়েছিল সুভাষ।
রিসিভারটা হাতের মধ্যে ধরা থাকে। আর সুভাষ শয্যার উপর বসে থাকে।
গীতা মারা গিয়েছে।
প্রতুল বলল, গীতা সুইসাইড করেছে–আত্মহত্যা করেছে গীতা।
কিন্তু কেন?
গীতা সুইসাইড করতে যাবে কেন? মাত্র তো কয়েক ঘণ্টা। রাত বারোটার পর গীতার বাড়ি থেকে ওরা তিন বন্ধু বের হয়ে গেছে হাসিমুখে শুভরাত্রি জানিয়ে।
আকাশটা মেঘাচ্ছন্ন ছিল, টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছিল।
গীতা থাকে বালিগঞ্জে, আর ওরা তিনজনেই থাকে উত্তর কলকাতায়। সুভাষ ফড়িয়াপুকুরে, প্রতুল বিডন স্ট্রীটে, আর কুনাল শ্যামপুকুর স্ট্রীটে।
গতরাত্রে বাস-ট্রাম সবই বন্ধ হয়ে গিয়েছে। সুভাষই তার গাড়িতে করে দুই বন্ধু প্রতুল ও কুনালকে যে যার বাড়িতে পৌঁছে দিয়ে রাত দেড়টায় বাড়ি ফিরে এসে শুয়ে পড়ছে।
গাড়িটা পের্টিকোতেই এখনও পড়ে রয়েছে, গ্যারাজ করা হয়নি।
গ্যারাজ করবে কি গাড়ি, ঘুমে তখন তার দুচোখ জড়িয়ে আসছে। বাড়িতে সবাই তখন ঘুমিয়ে পড়েছে। ভাগ্যি সদরের একটা ড়ুপলিকেট চাবি তার কাছে থাকে। দরজা খুলে সোজা এসে সিঁড়ি দিয়ে দোতলায় উঠে ঘরে ঢুকে শুয়ে পড়ে। তাহলেও সীতারাম টের পেয়ে গিয়েছিল ও যখন ঘরের দরজা খুলছে। ওর ঘরের কাছে বারান্দায় সীতারাম বরাবর শোয়।
সীতারামের ঘুমটাও পাতলা।
দরজা খোলার শব্দ পেয়েই সীতারাম ওকে জিজ্ঞাসা করেছিল, কে, দাদাবাবু?
হ্যাঁ রে।
এত রাত হল ফিরতে?
নিচের ল্যানডিংয়ের গ্র্যান্ডফাদার ক্লকটায় ঢং করে তখন রাত দেড়টা বাজল।
কটা বাজল?
রাত দেড়টা।
সীতারামের প্রশ্নের জবাবে বলেছিল সুভাষ।
অনেক রাত করে কাল শুয়েছিল বলেই বোধ হয় সকাল সকাল ঘুমটা ভাঙেনি সুভাষের।
নচেৎ সাধারণত সাড়ে চারটে থেকে পাঁচটার মধ্যেই ঠিক ঘুম ভেঙে যায় সুভাষের।
আজ অনেকটা বেলা হয়ে গিয়েছে।
খোলা জানালাপথে রোদ এসে ঘরে ঢুকেছে। কালকের মেঘলা আকাশ আর নেই।
মেঘমুক্ত পরিষ্কার নীল আকাশ।
সামনেই টেবিলের উপরে হাতঘড়িটার দিকে তাকাল সুভাষ।
বেলা সোয়া আটটা।
এখনও হয়ত ঘুম ভাঙত না। মাথার কাছে টেরিফোনের ক্রিং ক্রিং শব্দেই ঘুমটা ভেঙেছে।
গীতা নেই।
হঠাৎ কথাটা যেন আবার মনে পড়ে গেল। একটু আগে প্রতুলই তাকে ফোনে সংবাদটা দিল।
গীতাকে তার ঘরে মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে-মনে হচ্ছে সুইসাইড-ই করেছে।
আত্মহত্যা।
পাশেই ছোট একটা টেবিলের উপর বিষের শিশি একটা পাওয়া গিয়েছে। একটা আইলোশনের শিশি। নিচে লেখা পয়জন-বিষ!
প্রতুল ফোনে জিজ্ঞাসা করেছিল, একবার যাবি না ওখানে?
সুভাষ কোন জবাব দেয়নি।
জবাব দেবে কি সে! বিমূঢ়—কেমন যেন বোবা হয়ে গিয়েছে সুভাষ।
একসময় বিমূঢ় ভাবটা যখন কাটে, সুভাষ হাতের রিসিভারটা ধীরে ধীরে নামিয়ে রাখল।
ফোনটা নামিয়ে রাখার সঙ্গে সঙ্গেই আবার বেজে উঠল। আবার রিসিভারটা তুলে নিল সুভাষ।
সুভাষ—
বল।
কি রে, কোন কথা না বলে কনেকশনটা কেটে দিলি? যাবি না গীতার ওখানে?
তুই কার কাছে শুনলি যে গীতা–
গীতার চাকর শম্ভু ফোন করেছিল, সে-ই প্রথমে জানতে পারে ব্যাপারটা। পুলিস এসেছে বাড়িতে। ও আর সৌদামিনী মাসী ছাড়া তো কেউ নেই। ভীষণ ভয় পেয়ে গিয়েছে।
ভয় পেয়েছে! শম্ভু ভয় পেয়েছে কেন? সুভাষ প্রশ্ন করে।
ভয় পাবে না! কি রকম একটা unexpected ব্যাপার। শোন, তুই বরং আমার বাড়িতে চলে আয়, আমি কুনালকেও একটা সংবাদ পাঠাচ্ছি আমার বাড়িতেই আসতে, তিনজনেই যাব।
সুভাষ কোন জবাব দেয় না।
কি রে, আসছিস তো?
আসছি।
প্রতুল ফোন ছেড়ে দেয়। সুভাষ রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।
গীতা সুইসাইড-আত্মহত্যা করেছে!
কিন্তু কেন? তার মত শান্ত ধীর-প্রকৃতির মেয়ে কোনদিন আত্মহত্যা করতে পারে সুভাষের যেন চিন্তারও অতীত ছিল।
গীতাকে তো আর এক-আধদিন নয়, প্রায় গত পাঁচ বছর থেকে চেনে। ওদের দলে গত পাঁচ বছর ধরে একসঙ্গে এক পার্টিতে কাজ করছে।
যেমন শান্ত ধীর গীতা তেমনি কোন সেন্টিমেন্টেরও ধার ধারে না। জীবনটাকে সে সহজ ও অনাড়ম্বর ভাবেই নিয়েছিল।
বড়লোক বাপের একমাত্র মেয়ে।
বাপ ছিল শহরের নামকরা ডাক্তার। বর্তমানে সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে পণ্ডিচেরীতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন বছর তিন হল। গীতার মাও সেখানে।
এক ছেলে এক মেয়ে-শান্তনু ও গীতা। শান্তনু বড় শহরের নামকরা একজন সার্জন।
দিনপাঁচেক হল নেপালে রানা ফ্যামিলির কার একটা অপারেশনের ব্যাপারে গিয়েছে। আজ-কালই ফেরার কথা।
ভাই-বোন কেউ বিয়ে করেনি।
বাড়িতে ঠাকুর, ড্রাইভার, দারোয়ান, বুড়ী ঝি মানদা ও শম্ভুচরণ আর অভিভাবিকা প্রৌঢ়া সৌদামিনী মাসী। সৌদামিনী মাসী নিঃসন্তান বিধবা। বিধবা হবার পর থেকেই গত পনেরো-ষোল বছর বোনের কাছেই আছে। বোন ও ভগ্নীপতি সব ছেড়েছুড়ে দিয়ে পণ্ডিচেরী চলে যাবার পর বাধ্য হয়ে সৌদামিনী মাসীকেই সংসারের হালটা ধরতে হয়েছে।
সংসার তো ভারি!
পয়সার অভাব নেই, কলকাতা শহরে বাড়ি গাড়ি ব্যাঙ্কব্যালেন্স কোন কিছুরই অভাব নেই।
শান্তনুও প্রচুর উপার্জন করে।