- বইয়ের নামঃ অহল্যা ঘুম
- লেখকের নামঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত
- বিভাগসমূহঃগোয়েন্দা কাহিনী
০১. তখনও সানাইয়ে বাজছে মধুর ইমন কল্যাণ
তখনও সানাইয়ে বাজছে মধুর ইমন কল্যাণ। মধ্যরাত্রির স্তব্ধতায় সানাইয়ের ক্লান্ত রাগিণী মিলন-রাত্রির কথাই জানিয়ে দিচ্ছিল।
নিমন্ত্রিতের দল একে একে চলে গিয়েছে। শূন্য বিরাট প্যাণ্ডেলটায় জ্বলছে চোখ-ধাঁধানো শক্তিশালী বিদ্যুত্বাতিগুলো। সারি সারি তখন সাজানো রয়েছে টেবিল-চেয়ারগুলো। এখানে-ওখানে ফুলের মালা আর ছিন্ন পাপড়ি ছড়িয়ে রয়েছে, উৎসবের চিহ্ন।।
সন্ধ্যার আগে থাকতেই সারি সারি যে গাড়িগুলো বাড়ির সামনের রাস্তাটায় ভিড় করেছিল, সেগুলো আর এখন নেই, রাস্তাটা একেবারে খালি।
কেবল বাড়ির সামনে রাস্তার উপরে এঁটোপাতা-কাগজ-গ্লাস-প্লেটগুলো নিয়ে গোটা দুই কুকুর মহোৎসব লাগিয়েছে। আর কিছু ভিখারী—তারাও যোগ দিয়েছে সেই ভোজন-উৎসবে।
বাড়ির সবাই প্রায় তখন ক্লান্ত, কেউ কেউ শোবার ব্যবস্থা করছে।
বাড়ির কর্তা শিবতোষবাবু তাঁর শয়নঘরে পাখার হাওয়ার নীচে বসে একটা সিগারেট টানছিলেন।
হঠাৎ একটা দীর্ণ চিৎকার যেন সানাইয়ের রাগিণী ছাপিয়ে শিবতোষবাবুর কানের গোড়ায় এসে আছড়ে পড়ল। জ্বলন্ত অর্ধদগ্ধ সিগারেটটা আঙুলের ডগা থেকে খসে নীচে পায়ের কাছে কার্পেটের উপর পড়ে গেল শিবতোষের।
চিৎকারটা একবারই শোনা গেল। সানাই তখনো বেজে চলেছে। সোফা থেকে উঠে পড়ে তাড়াতাড়ি কোনমতে স্লিপারটা পায়ে গলিয়ে বের হয়ে এলেন ঘর থেকে সামনের বারান্দায় শিবতোষবাবু।
সামনেই পড়ে গেল শিখেন্দু।
কে অমন করে চিৎকার করল শিখেন্দু!
ধরতে পারলাম না কাকাবাবু, শিখেন্দু বললে,মনে হল, যেন তিনতলা থেকেই—
যারা তখনও জেগেছিল দোতলায়, তাদেরও কারও কারও কানে চিৎকারের শব্দটা পৌঁছেছিল—শিবতোষবাবুর বোন রাধারাণী দেবী, তাঁর স্ত্রী কল্যাণী, বড় মেয়ে স্মৃতি–
শিবতোষবাবুর একমাত্র ছেলে নির্বাণীতোষের বৌভাত ছিল।
ফুলশয্যার ব্যবস্থা হয়েছিল তিনতলায় নির্বাণীতোষেরই ঘরে।
সবাই যেন কেমন হতম্ব, কেমন যেন অকস্মাৎ বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। কেউ কোন কথা বলে না, কিন্তু সকলেরই চোখেমুখে যেন একটা প্রশ্ন স্পষ্ট, কিসের চিৎকার শোনা গেল? কে চিৎকার করে উঠেছিল একটু আগে?
শিখেন্দুই স্তব্ধতা ভঙ্গ করে বললে, আমি দেখে আসি একবার তিনতলাটা।
কথাগুলো বলে শিখেন্দু আর দাঁড়াল না, এগিয়ে গিয়ে সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে তিনতলায় উঠে গেল।
ওরা সকলে দাঁড়িয়েই থাকে। একটা অজ্ঞাত বোবা ভয় যেন ওদের সকলের মনকে আচ্ছন্ন করে ফেলেছে অকস্মাৎ। কিসের ভয়, কেন ভয়—তা জানে না ওরা। বোধ হয় ভাবতেও পারে না কেউ কথাটা। ভয় বস্তুটা এমনিই একটা ব্যাপার। এমনই সংক্রামক—এক মন থেকে অন্য মনে ছড়িয়ে পড়ে।
পাঁচ মিনিট দশ মিনিট পনেরো মিনিট প্রায় হতে চলল, এখনও কই শিখেন্দু তো উপর থেকে নীচে নেমে এল না, কি করছে এখনো ও উপরে! সকলেই যেন ঐ প্রশ্নটা করতে চায়, কিন্তু কেউ করছে না কাউকে। কারও মুখেই কোন কথা নেই তখনও।
শেষ পর্যন্ত স্মৃতিই যেন অপেক্ষা করে করে অধৈর্য হয়ে প্রশ্নটা উচ্চারণ না করে আর পারে না। বললে, শিখেন্দু কি করছে ওপারে? আসছে না কেন? ওপরে গিয়ে দেখে আসব আমি একবার বাবা?
শিবতোষবাবু যেন কেমন অসহায় দৃষ্টিতে মেয়ের মুখের দিকে তাকালেন একবার, তারপর কোন কথা না বলে নিজেই পায়ে পায়ে এগুলেন সিঁড়ির দিকে।
ঝকঝকে চওড়া মোজাইক করা সিঁড়ি। সিঁড়ির পথ উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত। কিন্তু ক্ষণপূর্বের সেই ভয়টা যা তখনও আচ্ছন্ন করে রেখেছিল, সেটাই যেন পায়ে পায়ে জড়িয়ে যাচ্ছে, তাঁর গতি শ্লথ করে দিচ্ছে প্রতি পদবিক্ষেপে।
উপরে তিনতলাতেও ঠিক দোতলার মতই টানা বারান্দা—আগাগোড়া ডিজাইন টালিতে সব তৈরী। উপরের বারান্দাতেও আলো জ্বলছিল।
বারান্দাটা পূর্ব থেকে পশ্চিমে চলে গিয়ে বাঁয়ে বাঁক নিয়েছে, উপরের তলায় চারখানি ঘরের মধ্যে, শেষের দুটি ঘর নিয়েই নির্বাণীতোষ থাকত। তার শয়নকক্ষেই ফুলশয্যার ব্যবস্থা হয়েছিল।
ঘরের দরজাটা খোলা।
কোন সাড়া শব্দ নেই, কেবল সানাই তখনও বেজে চলেছে, ইমন কল্যাণের সুর।
খোলা দরজাপথে ভিতরে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ালেন শিবতোষ।
শিখেন্দু স্তব্ধ হয়ে পিছন ফিরে দাঁড়িয়ে আছে, আর তার ঠিক সামনেই দামী কার্পেটে মোড়া মেঝের উপরে পড়ে আছে নববধূ, নির্বাণীতোষের সদ্যবিবাহিতা স্ত্রী দীপিকা।
পরনে দামী আকাশ-নীল রংয়ের বেনারসী, হাতে চুড়ি, জড়োয়ার চূড়। কানে হীরের দুল-সিঁথিতে সিঁথিমৌর।
কাত হয়ে পড়ে আছে দীপিকা।
একটা হাত তার প্রসারিত, অন্য হাতটা দেহের নীচে চাপা পড়েছে, ঘোমটা খুলে গিয়েছে, জরির ফিতে দিয়ে বাঁধা বেণীটা কার্পেটের উপরে লুটোচ্ছে।
দুটি চক্ষু বোজা। কপালে চন্দন, সিঁথিতে সিঁদুর।
পদশব্দে ফিরে তাকাল শিখেন্দু। কি ব্যাপার বৌমা, কথাটা শেষ করতে পারলেন না শিবতোষ। গলাটা তাঁর কাঁপতে কাঁপতে থেমে গেল। শেষ কথাটা উচ্চারিত হল না।
বুঝতে পারছি না কাকাবাবু। ঘরে ঢুকে দেখি এখানে এইভাবে দীপিকা পড়ে আছে—
খোকা—খোকা কোথায়?
তাকে তো ঘরের মধ্যে দেখি নি। ঘরের দরজা ভেজানো ছিল, হাত দিতেই খুলে যেতে ভেতরে ঢুকে দেখি ঐভাবে দীপিকা পড়ে আছে–।
কিন্তু খোকা! খোকা কোথায় গেল? এবারে যেন আরও স্পষ্ট করে প্রশ্নটা উচ্চারণ করলেন। শিবতোষ।
তার বন্ধুরা শেষ ব্যাচ খেয়ে চলে যাবার পরই, রাত তখন পৌনে এগারটা হবে, নির্বাণী আমাকে বললে মাথাটা বড় ধরেছে, আমি ওপরে চললাম। সেও ওপরেই চলে এসেছিল। ধীরে ধীরে বললে শিখেন্দু।
তবে কোথায় গেল সে? কেমন যেন অসহায়ভাবে আবার প্রশ্নটা করলেন শিবতোষ।
বাথরুমের দরজাটা তো খোলাই দেখছি, আলো জ্বলছে ভিতরে, ওখানে কেউ আছে বলে। তো মনে হচ্ছে না কথাটা বলতে বলতেই শিখেন্দু বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল।
বাথরুমে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গেই একটা অস্ফুট চিৎকার করে উঠল।
কি! কি হল শিখেন্দু! শিবতোষ তাড়াতাড়ি এগিয়ে গেলেন। এবং বাথরুমের মধ্যে পা দিয়েই থমকে দাঁড়ালেন।
নির্বাণীতোষের দেহটা উপুড় হয়ে পড়ে আছে বাথরুমের মেঝের উপরে। ঠিক বেসিনের নিচে, সামনে পিঠের বাঁ দিকে একটা ছোরা সমূলে বিদ্ধ হয়ে আছে। গায়ে গরদের পাঞ্জাবিটা রক্তে লাল। হাত দুটো ছড়ানো।
প্রথম বিহ্বল মুহূর্তটা কাটবার পরই দীর্ণ কষ্ঠে চিৎকার করে উঠলেন শিবতোষ, খোকা—তারপরই দুম করে বাথরুমের মেঝেতেই পড়ে গেলেন অজ্ঞান হয়ে।
আরো ঘণ্টা দুই পরে।
রাত তখন দুটো সোয়া দুটো হবে।
সানাই থেমে গিয়েছে।
শিবতোষের জ্ঞান ফিরে এসেছে। তাঁকে ধরাধরি করে আগেই নিচে তাঁর দোতলার ঘরে নিয়ে আসা হয়েছিল। কেমন যেন প্রস্তরমূর্তির মত নিষ্প্রাণ বসেছিলেন শিবতোষ সোফাটার উপরে।
একটা কান্নার সুর ভেসে আসছে রাত্রিশেষের স্তব্ধতার উপর থেকেও। করুণ। কল্যাণী কাঁদছে। শিবতোষের স্ত্রী কল্যাণী কাঁদছে। নির্বাণীর মা।
দীপিকারও জ্ঞান ফিরে এসেছে, কিন্তু সে যেন একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে। একটি প্রশ্নেরও জবাব এখন পর্যন্ত তার কাছ থেকে পাওয়া যায়নি।
শিখেন্দু এ-বাড়ির ছেলে নয়, শিবতোষের বন্ধু সুখেন্দুর ছেলে। সুখেন্দু বিশ্বাস ভারত সরকারের একজন পদস্থ কর্মচারী, বর্তমানে দিল্লী রাজধানীতেই তাঁর কর্মস্থল।
শিখেন্দু তাঁর তৃতীয় পুত্র, কলকাতার মেডিকেল কলেজে পড়াশুনা করবার জন্য অনেক দিন থেকেই সে কলকাতায় আছে।
হস্টেলে থাকে। গত বছর ডাক্তারী পাস করে বর্তমানে হাউস স্টাফ, কয়েক মাসের মধ্যেই সে আবার উচ্চশিক্ষার জন্য বিলাতে যাবে, সব ব্যবস্থা পাকা হয়ে গিয়েছে।
কলেজ-জীবন থেকেই শিবতোষ ও সুখেন্দুর মধ্যে বন্ধুত্ব এবং দুই পরিবারে ঘনিষ্ঠতা। শিবতোষ সুখেন্দুর চাইতে কয়েকমাসের ছোট, তাই সুখেন্দুর ছেলেমেয়েরা শিবতোষকে কাকাবাবু বলে আর শিবতোষের ছেলেমেয়েরা সুখেন্দুকে জ্যাঠাবাবু বলে ডাকে।
শুধু বন্ধুত্বই নয়, সুখেন্দু ও শিবতোষের মধ্যে পরস্পরের ভাইয়ের মতই প্রীতির ও ভালবাসার সম্পর্ক একটা গড়ে উঠেছিল।
নির্বাণীতোষ শিবতোষের একমাত্র পুত্র, শিখেন্দুরই সমবয়সী, সেও শিখেন্দুর সঙ্গেই গত বৎসর ডাক্তার হয়ে বের হয়েছে এবং তারও একই সঙ্গে বিলেত যাবার কথা ছিল।
বিবাহের ব্যাপারে আজ দিন দশ বারো থেকেই, বেশীর ভাগ সময়েই শিখেন্দু শিবতোষের বাড়িতেই আছে। সব কাজে সাহায্যও করেছে, পরিশ্রম করেছে।
নির্বাণীতোষের স্ত্রী অর্থাৎ শিবতোষের পুত্রবধূ দীপিকাও ছিল নির্বাণীতোষ ও শিখেন্দুর সহপাঠিনী, সেও ডাক্তার। গত বৎসর একই সঙ্গে পাস করেছে সে।
পড়তে পড়তেই উভয়ের আলাপ ও ঘনিষ্ঠতা, নির্বাণীতোষ ও দীপিকা প্রায় সমবয়সী, তাই শিবতোষের ইচ্ছা ছিল না খুব একটা দীপিকা তাঁর পুত্রবধূ হয়ে আসে।
শিবতোষ বলেছিলেনও ছেলেকে কথাটা, কিন্তু নির্বাণী কান দেয়নি বাপের কথায়।
সেকেণ্ড ইয়ারে পড়তে পড়তেই আমরা ঠিক করেছিলাম বিয়ে করব। অতএব আজ আপনি যা বলছেন তা সম্ভব নয় বাবা। স্পষ্ট করেই নির্বাণীতোষ তার সিদ্ধান্তের কথাটা শিবতোষকে জানিয়ে দিয়েছিল।
একটি মাত্র ছেলে এবং বরাবরই অতিরিক্ত প্রশ্রয়ে একটু বেশী জেদী ছিল নির্বাণীতোষ, তাই শিবতোষ অনিচ্ছা এবং আপত্তি থাকলেও বিবাহে আর বাধা দেননি।
তাছাড়া স্ত্রী কল্যাণীও বলেছিল, ছেলে যখন বিয়ে করতে চাইছে করুক, আপত্তি করো না।
শিবতোষ জবাবে বলেছিলেন, তোমাদের মা ও ছেলের যখন ইচ্ছে হাক বিয়ে, করুক বিয়ে ওকেই, তবে বলে রাখছি এ-বিয়ে সুখের হবে না।
লে হবে না শুনি? কল্যাণী বলেছিল। কেন হবে না, অত কথা বলতে পারব না। তবে হবে না বলে রাখলাম, দেখে নিও।
অমতের কারণ ছিল শিবতোষের, কারণ দীপিকারা ঠিক তাদের সমতুল্য পাল্টিঘর নয়। শিবতোষ ধনী, কলকাতা শহরের একজন ধনী ব্যক্তি। চার-পাঁচটা কয়লাখনির মালিক। পৈতৃক সূত্রেই খনিগুলির মালিক হয়েছিলেন শিবতোষ অবিশ্যি। এবং কেবল ওই খনিই নয়, শিবতোষের বাবা রায়বাহাদুর প্রিয়তোষ মল্লিক কলকাতা শহরে খান পাঁচেকবাড়িও করেছিলেন। সেগুলো থেকেও বৎসরের ভাড়া আদায় বেশ মোটা অঙ্কের টাকাই হয়। ব্যাঙ্কেও মজুত টাকা অনেক।
আর দীপিকার বাবা, সদানন্দ রায় বেসরকারী কলেজের সাধারণ একজন অধ্যাপক মাত্র, খুবই সাধারণ মধ্যবিত্ত ঘর। চার মেয়ে, দুই ছেলে—ঐ দীপিকাই বড় মেয়ে, অত্যন্ত মেধাবী ছিল দীপিকা বরাবর, বৃত্তি নিয়েই পড়ে এসেছে।
শ্যামবাজার অঞ্চলে ছোট একটা ভাড়াটে বাড়িতে থাকেন সদানন্দ রায়। সামান্য মাইনে। যত্র আয় তত্র ব্যয়। নির্বাণীতোষের মত ছেলের সঙ্গে তাঁর মেয়ের বিয়ে হবে বা কোনদিন হতে পারে স্বপ্নেরও অগোচর ছিল তাঁর।
তাছাড়া তিনি ব্রাহ্মণ, আর নির্বাণীতোষ কায়স্থ। তবু বিয়ে হয়ে গেল, বিয়েতে তিনি বাধা দেননি—মেয়ের কথা ভেবেই। ঘটনার আকস্মিকতায়, বীভৎসতায় ও বেদনায় বাড়ির সকলেই বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল। সবাই বোবা, কেবল কল্যাণী কাঁদছিল। সমস্ত বাড়ির মধ্যে কেবল তার করুণ বিলাপধ্বনি একটানা সকলের কানে এসে বাজছিল।
কাকাবাবু!
শিখেন্দুর ডাকে শিবতোষ মুখ তুললেন।
পুলিসে তো একটা খবর দেওয়া দরকার।
পুলিস! কেমন যেন বোকার মতই কথাটা উচ্চারণ করে ফ্যালফ্যাল্ করে তাকিয়ে রইলেন শিবতোষ শিখেন্দুর মুখের দিকে, কথাটা যেন তাঁর আদৌ বোধগম্য হয়নি।
হ্যাঁ, পুলিস,মানে থানায় একটা খবর দেওয়া তো দরকার।
কেন?
মানে, যে ভাবে ওর মৃত্যু হয়েছে, বোঝাই তো যাচ্ছে কেউ ওকে খুন করে গেছে।
খুন করে গিয়েছে, কেন, কে করল? সমস্ত বুকটা নিংড়ে যেন অসহায় বিমূঢ় শিবতোষের মুখ থেকে কথাগুলো বের হয়ে এল কেঁপে কেঁপে।
কেন খুন করল, কে খুন করল নির্বাণীতোষকে তা শিখেন্দুই বা কেমন করে বলবে!
তবু সে বললে, অস্বাভাবিক মৃত্যু, থানায় তো একটা খবর দিতেই হবে।
বেলতলা রোডে শিবতোষের বাড়ি মল্লিক ভিলা, ভবানীপুর থানার আণ্ডারেই পড়ে এবং সেখানকার থানার বড়বাবু অর্থাৎ ও.সি.বীরেন মুখার্জীর সঙ্গে শিবতোষের আলাপও আছে। এদিন রাত্রে বীরেন মুখার্জীও এসেছিলেন উৎসবে নিমন্ত্রিত হয়ে।
শিবতোষের বীরেন মুখার্জীর কথা মনে পড়ল, তিনি বললেন, তাহলে বীরেন বাবুকে একটা ফোন করে দাও, শিখেন্দু।
শিখেন্দু আর কালবিলম্ব করে না, বারান্দায়ই ফোন ছিল, দেয়ালের গায়ে ব্রাকেটের উপর বসানো। এগিয়ে গিয়ে থানায় ফোন করল।
ফোন ধরল থানার ছোটবাবু, ভবানীপুর থানা—
ও.সি, আছেন?
তিনি ওপরে ঘুমোচ্ছেন।
তাঁকে একটু বলবেন এখুনি একবার বেলতলা রোডে মল্লিক ভিলায় আসতে।
ছোটবাবু রণজিৎ সিনহার মল্লিক ভিলাটা ও তাঁর অধিকারী শিবতোষ মল্লিক অপরিচিত নয়। তাই তিনি প্রশ্ন করলেন, কেন? কি দরকার?
দেখুন এ বাড়িতে একটা দুর্ঘটনা ঘটে গিয়েছে—
ঐ বাড়িতে তো আজ উৎসব ছিল—
হ্যাঁ, তাঁর ছেলের বৌভাত ছিল—
তা হঠাৎ আবার কি দুর্ঘটনা ঘটল?
তাঁর ছেলে—
কি হয়েছে তাঁর?
সে মারা গেছে।
মারা গেছে নির্বাণী–তোষবাবু! শিবতোষবাবুর একমাত্র ছেলে!
হ্যাঁ।
কি করে মারা গেল? কি দুর্ঘটনা ঘটল? কখন?
সে তো বলতে পারব না—ঘণ্টা দুই আগে তিনতলায় তার শোবার ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যে তাকে ছোরাবিদ্ধ মৃত অবস্থায় পাওয়া গিয়েছে—
সে কি–কি বলছেন!
হ্যাঁ। ও.সি.-কে পাঠিয়ে দিন, না হয় আপনিই একবার আসুন।
এখুনি আসছি।
শিখেন্দু ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখল।
কেউ বারান্দায় নেই।
সবাই শিবতোষবাবুকে ঘিরে তখনও তাঁর ঘরের মধ্যেই নির্বাক দাঁড়িয়ে আছে।
মিনিট কুড়ির মধ্যেই বীরেন মুখার্জী, থানার ও.সি. নিজেই এসে হাজির হলেন। ভদ্রলোকের বয়স চল্লিশ থেকে বিয়াল্লিশের মধ্যে, অত্যন্ত কর্মঠ ও তৎপর একজন অফিসার। এতদিন তাঁর প্রমোশন হওয়া উচিত ছিল, বিশেষ একটি রাজনৈতিক দলের সুনজরে না থাকার দরুন আজ পর্যন্ত কোন প্রমোশনই হয়নি। তার জন্য বীরেন মুখার্জীর অবিশ্যি কোন দুঃখও নেই। লম্বা চওড়া বেশ বলিষ্ঠ গঠন।
জীপের শব্দ শুনে শিখেন্দুই নীচে নেমে এসেছিল, তার সঙ্গেই প্রথমে মুখোমুখি দেখা হয়ে গেল বীরেন মুখার্জীর, গেটের ভিতরে ঢুকে জীপ থেকে নামতেই।
দুপাশে বিরাট লনে তখনও প্যাণ্ডেলের মধ্যে আলো জ্বলছে।
বীরেন মুখার্জী বললেন, শিবতোষবাবু কোথায়?
চলুন ওপরে দোতলায়, তাঁর ঘরে— আপনি কে?
আমি এ বাড়ির কেউ নই—শিবতোষবাবুর বাল্যবন্ধু সুখেন্দু বিশ্বাসের ছেলে আমি আমার নাম শিখেন্দু বিশ্বাস।
উৎসবের ব্যাপারেই বোধ হয় এসেছিলেন আপনি?
নির্বাণীতোষ আমার ক্লাসফ্রেণ্ড, একসঙ্গেই আমরা ডাক্তারী পাস করেছি। গত দশদিন থেকেই এ বাড়িতে আমি আছি।
নির্বাণীতোষবাবু আপনার ক্লাসফ্রেণ্ড ছিলেন?
হ্যাঁ।
ফোন করেছিল কে থানায়?
আমিই।
চলুন–বীরেন মুখার্জী একজন কনস্টেবলকে নীচে রেখে অন্য একজনকে নিয়ে সিঁড়ির দিকে এগুলেন।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতেই বীরেন মুখার্জী প্রশ্ন করলেন, মৃতদেহ ডিসটার্ব করা হয়নি তো?
না। তিনতলায় তার ঘরের সংলগ্ন বাথরুমের মধ্যেই এখনও আছে, শিখেন্দু বললে।
দুদিনের খাটাখাটুনির ক্লান্তিতে যারা হাঁপ ছেড়ে বিশ্রামের জন্য শয্যা নিয়েছিল, তারা সবাই একে একে জেগে উঠেছে ততক্ষণে। বাড়িতে উৎসব উপলক্ষে দুই মেয়ে এসেছে, বড় মেয়ে স্মৃতি—তার জামাই বীরেন, ছোট মেয়ে স্বাতী—তার জামাই ভবেশ, শিবতোষের একমাত্র বোন রাধারাণী—তার ছোট ছোট দুই মেয়েকে নিয়ে এসেছে, ভগ্নীপতি সমরবাবু আসতে পারেন নি।
তাছাড়া চাকর ও দাসীরা। তাদের মধ্যে দুজন ভৃত্য অনেক দিন ধরেই শিবতোষের গৃহে আছে, গোকুল আর রাজেন। দাসী বেলা, রাঁধুনীবামুন নরেন আর শিবতোষের গৃহ-সরকার যতীশ সামন্ত।
যতীশ সামন্তও বছর দশেক আছেন ঐ বাড়িতে। বয়েস হয়েছে তা প্রায় পঞ্চাশ বাহান্ন। অকৃতদার মানুষ, ঐ বাড়ির নীচের তলাতেই একটা ঘরে থাকেন।
অন্যান্য দূর ও নিকট-সম্পর্কের আত্মীয় যারা এসেছিল, তারা উৎসব চুকে যাবার পর যে যার গৃহে চলে গিয়েছিল।
সবাই জেগে উঠেছিল। সবাই দুঃসংবাদটা শুনেছিল।
সবাই যেন সংবাদটা শুনে একেবারে স্তব্ধ হয়ে গিয়েছে। তাই বাড়িটাও একেবারে স্তব্ধ।
যতীশ সামন্তই সংবাদটা পেয়ে সানাইওয়ালাদের থামিয়ে দিয়েছিলেন।
বাড়িতে কে কে আছেন? বীরেন মুখার্জী জিজ্ঞাসা করলেন।
শিখেন্দুই বলে গেল কে কে আছে।
শিবতোষবাবুর সঙ্গে দেখা করবেন? শিখেন্দু প্রশ্ন করে।
না। আগে চলুন ডেডিটা দেখে আসি। বীরেন মুখার্জী বললেন।
সিঁড়ি দিয়ে উঠে তিনতলার বারান্দা অতিক্রম করো দুজনে গিয়ে নির্বাণীতোষের শয়নকক্ষে প্রবেশ করল।
বিরাট একটা খাট, দামী শয্যা বিছানো। খাটটা ফুলে ফুলে সাজানো। রজনীগন্ধার মৃদু সুবাস ঘরের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে।
ঘরে কেউ ছিল না।
দীপিকার জ্ঞান হবার পর তাকে স্বাতী ও স্মৃতি নীচে দোতলায় নিয়ে গিয়েছিল।
শিবতোষ মল্লিক শহরের একজন বিশিষ্ট ধনী ব্যক্তি। তাঁর যে কেবল অর্থ ও সম্পদের জন্যই সমাজে তিনি পরিচিত ছিলেন তা নয়, নানা সমাজকল্যাণ প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেও তিনি নানাভাবে জড়িত বলে ঐ অঞ্চলে তাঁর একটা বিশেষ পরিচয়ও আছে।
মানুষটিনিরহংকারী সদালাপী ও সহৃদয় বলেপাড়ার সকলেই তাঁকে শ্রদ্ধা করেও ভালবাসে। বীরেন মুখার্জীর সেটা জানা ছিল ঐ তল্লাটে থানা-অফিসার হিসাবে। ঐ থানায় বীরেন মুখার্জী বছর দুই হল এসেছেন।
ব্যক্তিগতভাবে শিবতোষ মল্লিকের সঙ্গে বীরেন মুখার্জীর বেশ আলাপও আছে। আজ তাঁর একমাত্র ছেলের বৌভাত উৎসবে নিমন্ত্রিতও হয়েছিলেন, এসেওছিলেন। কিন্তু বেশীক্ষণ থাকতে পারেননি। রাত দশটা নাগাদ চলে গিয়েছিলেন।
নির্বাণীতোষ নিজেই তাঁকে অভ্যর্থনা করে দাঁড়িয়ে থেকে খাইয়েছিল।
ঘরের মধ্যে ঢুকে থমকে দাঁড়ালেন মুহূর্তের জন্য যেন বীরেন মুখার্জী। এই সুন্দর স্নিগ্ধ পরিবেশে এমন একটি উৎসবের রাত, তারই মধ্যে নিষ্ঠুর মৃত্যু রক্তক্ষরণ করেছে।
পুলিস অফিসার হিসাবে বহুবার তাঁকে এই ধরনের পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়েছে, কিন্তু আজ যেন ঐ ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে চারিদিকে দৃষ্টিপাত করে হঠাৎ কেমন বিব্রত বোধ করেন।
শিখেন্দুর মুখের দিকে তাকালেন বীরেন মুখার্জী, শিখেন্দু বাথরুমের খোলা দরজার দিকে
তাকাল।
বীরেন মুখার্জী এগিয়ে গেলেন বাথরুমের দিকে, একটা জল পড়ার শব্দ শোনা গেল।
নিবার্ণীতোষের মৃতদেহটা ঠিক তেমনি ভাবেই পড়েছিল। উপুর হয়ে পড়ে আছে মৃতদেহটা, মুখটা বাঁদিকে কাত করা। কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন মৃতদেহটার দিকে বীরেন মুখার্জী।
ছোরা প্রায় আমূল বিদ্ধ হয়ে আছে বাঁ দিকের পৃষ্ঠদেশে ঠিক স্ক্যাল্লার বর্ডার ঘেঁষে। ছোরাটার বাঁটটা কাঠের।
পকেট থেকে রুমাল বের করে ছোরার বাঁটটা ধরে শক্ত করে একটা হ্যাঁচকা টান দিয়ে ছোরাটা বের করে আনলেন বীরেন মুখার্জী।
ধারাল ছোরার ফলাটা তীক্ষ্ণ।
ছোরাটা টেনে বের করতে গিয়েই বুঝলেন বীরেন মুখার্জী, কত জোরে ছোরাটা বেচারীর পৃষ্টদেশে বেঁধানো হয়েছিল যার ফলে ফলাটার সবটাই প্রায় ঢুকে গিয়েছিল দেহের মধ্যে, হয়ত আঘাতের প্রচণ্ডতার সঙ্গে সঙ্গেই মৃত্যুও হয়েছে।
কিন্তু যে-ই ছোরাটা মেরে থাকুক, তার হাতের কক্তির জোর নিশ্চয়ই আছে। ছোরাটা খুব ছোট নয়—একেবারে ফলাটা ছ-ইঞ্চি মত হবে, বাঁটটা চার ইঞ্চির মত। সর্বমোট বারো ইঞ্চি মত লম্বা। তীক্ষ্ণ ধার, ইস্পাতের তৈরী ছোরাটা, ফলাটা ঝক্ঝক্ করছে।
বেসিনের ঠিক সামনাসামনিই হাত দেড়েক ব্যবধানে মৃতদেহটা পড়ে আছে। বেসিনের দিকে তাকালেন বীরেন মুখার্জী।
বেসিনের কলটা খোলা, জল পড়ে যাচ্ছে। বেসিনের মধ্যে শূন্য একটা কাঁচের গ্লাস, গ্লাসটা তুলে পাশে রাখলেন বীরেন মুখার্জী। বীরেন মুখার্জী কলের প্যাঁচটা ঘুরিয়ে কলটা বন্ধ করে দিলেন।
বড় সাইজের বাথরুম। বাথরুমের দেওয়ালে চারপাশে একমানুষ সমান উঁচু ইটালীয়ান টাইলস্ বসানো, মেঝেটা মোজাইক করা, বেসিনের সামনে একটা আশী লাগানো দেওয়ালে। তারই নীচে একটা শেফে নানাবিধ পুরুষের প্রসাধন দ্রব্য ও সেভিং সেট সাজানো।
দুটি দরজা বাথরুমের। একটা ঘরের সঙ্গে, অন্যটা বোধ হয় মেথরদের যাতায়াতের জন্য। দরজাটা লক করা ছিল ভিতর থেকে। খুলে বাইরে উঁকি দিয়ে দেখলেন বীরেন মুখার্জী একবার। তাঁর অনুমান মিথ্যে নয়, দরজার বাইরেই সরু বারান্দা এবং ঘোরানো লোহার সিঁড়ি।
নীচে তাকালেন বীরেন মুখার্জী, বাড়ির পশ্চাৎ দিক সেটা, উৎসবের জন্য সেখানেও প্যাণ্ডেল করা হয়েছিল। নীচের প্যাণ্ডেলে তখনও আলো জ্বলছে।
আবার বাথরুমের মধ্যে এসে ঢুকলেন বীরেন মুখার্জী। দরজাটা বন্ধ করে দিলেন। হঠাৎ ঐ সময় তাঁর নজরে পড়ল ছোট একটা সেলোফেন কাগজের টুকরোর মত বেসিনের নীচেই পড়ে আছে।
কৌতূহলী হয়ে ঝুঁকে পড়ে কাগজটা তুলতেই দেখলেন, দুটো কোড়োপাইরিনের বড়ির একটা ছেড়া স্ট্রীপ। স্ট্রীপটা পকেটে রেখে দিলেন বীরেন মুখার্জী।
বীরেন মুখার্জী বুঝতে পারলেন, ব্যাপারটা যা বোঝা যাচ্ছে নিষ্ঠুর একটা হত্যাই। আততায়ী যে-ই হোক, আজ রাত্রে বাড়িতে উৎসব ছিল, বহু লোকের সমাগম ঘটেছিল, যাওয়া আসার দ্বারও অবারিত ছিল—আততায়ীর পক্ষে কোনই অসুবিধা হয়নি। হয়ত কোন এক ফাঁকে সুযোগ মত ঐ বাথরুমের মধ্যে এসে আত্মগোপন করে থাকতে পারে, তারপর যেই নির্বাণীতোষ বাথরুমে ঢুকেছে, তাকে পিছন থেকে ছোরা মেরে খতম করে আবার এক ফাঁকে ভিড়ের মধ্যে অনায়াসেই সরে পড়েছে।
কাজেই আততায়ীকে খুঁজে বের করা তত সহজ হবে না। তাহলে ও কানুন অনুযায়ী একটা অনুসন্ধান ও এ-বাড়ির সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করতেই হবে।
তবে এটা ঠিক হত্যাকারী যে-ই হোক, এ-বাড়ি সম্পর্কে সে যথেষ্ট ওয়াকিবহাল। সে জানত এ-বাড়ির সব কিছু। শুধু তাই নয়, আরও একটা কথা মনে হয় বীরেন মুখার্জীর, সম্ভবতঃ আততায়ী বা হত্যাকারী হয়ত এ-বাড়ির বিশেষ একজন পরিচিত জনই। অনুসন্ধান সেদিক দিয়েও শুরু করা যেতে পারে।
বাথরুম থেকে বের হয়ে এলেন বীরেন মুখার্জী। শিখেন্দু তখনও ঘরের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। শিখেন্দু বীরেন মুখার্জীর দিকে তাকাল।
শিখেন্দুবাবু? বলুন!
এ-বাড়ির সঙ্গে যখন বিশেষ আপনার পরিচয় অনেক দিন থেকেই আছে এবং আপনি যখন নির্বাণীতোষবাবুর ক্লাসফ্রেণ্ড ছিলেন, ঘটনার সময়ও এখানে উপস্থিত ছিলেন—আপনাকে কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই।
কি জানতে চান বলুন।
যতদূর জানি শিবতোষবাবুর তো ঐ একমাত্রই ছেলে?
লোকে অবিশ্যি তাই জানে, তবে ব্যাপারটা ঠিক তা নয় কিন্তু—
কি রকম? আর কোন ছেলে আছে নাকি শিবতোষবাবুর?
শিবতোষবাবুর দুই বিয়ে। অবিশ্যি অনেকেই তা জানে না এবং যারা জানত তারাও হয়ত ভুলে গিয়েছে আজ।
সত্যি নাকি!
হ্যাঁ–তাঁর প্রথমা স্ত্রী অবিশ্যি বহুদিন আগেই গত হয়েছেন, এবং শুনেছি, তাঁর মৃত্যুর বছরখানেক পরেই নির্বাণীর মাকে কাকাবাবু দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন।
প্রথমা স্ত্রী তাহলে নেই?
না। শুনেছি কাকাবাবুর এক সহপাঠীর বোন সান্ত্বনাদেবীকে লুকিয়ে বাবা রায়বাহাদুরকে জানিয়ে বিবাহ করেছিলেন।
কার কাছে শুনেছেন কথাটা?
নির্বাণীই একদিন কথায় কথায় বলেছিল।
হুঁ, তারপর?
তারা ছিল অত্যন্ত গরীব মধ্যবিত্ত ছাপোষা গৃহস্থ, কিন্তু সান্ত্বনাদেবী নাকি অপরূপ সুন্দরী ছিলেন। সেই সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়েই–
বুঝেছি–
তাঁর একটি ছেলে হয়—
তাই নাকি!
হ্যাঁ।
তা সে ছেলেটি জীবিত আছে?
আছে—তবে—
তবে?
সে লেখাপড়া কিছুই করেনি—
কি নাম তার?
আশুতোষ। শুনেছি কাকাবাবু তাকে পড়াবার, মানুষ করবার অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু সে কাকাবাবুর কোন সাহায্যই গ্রহণ করেনি। কাকাবাবুর কাছে আসেওনি কখনও। বরাবর সে তার মামাদের কাছেই থাকত।
কি করে আশুতোষ?
শুনেছি জগদ্দলের জুট মিলে কাজ করে এবং সেখানেই মিলের একটা কোয়াটারে থাকে বর্তমানে।
তা আশুবাবুর—তার বাপ শিবতোষবাবুর ওপরে এত বিরাগের কারণই বা কি?
বলতে পারব না।
এ উৎসবে নিশ্চয়ই সে আসেনি?
না।
তাকে দেখেছেন কখনও আপনি?
না।
আপনার বন্ধু নির্বাণীতোষবাবু কখনও দেখেছিলেন তাকে?
সম্ভবতঃ না।
আশুবাবুর প্রতি তার মনোভাব কেমন ছিল জানেন কিছু?
নির্বাণীর মত ছেলে হয় না মিঃ মুখার্জী! যেমন নিরহঙ্কার, তেমনি সরল, তেমনি মিশুঁকে প্রকৃতির মানুষ ছিল সে।
তার মানে, বলতে চান কারুর সঙ্গে কোন শত্রুতারও সম্ভাবনা ছিল না।
না। ঝগড়াঝাঁটি সে কারুর সঙ্গে করেনি। করতে কখনও দেখিনি। তাই তো বুঝে উঠতে পারছি না এখনও মিঃ মুখার্জী, তার মত মানুষের এমন কে শত্রু থাকতে পারে যে তাকে এমন করে খুন করে গেল!
আচ্ছা এ-বাড়ির চাকরবাকররা নিশ্চয়ই সন্দেহের বাইরে?
গোকুল আর রাজেন–না, ওদের দ্বারা এ কাজ সম্ভব নয়। তাছাড়া এ বাড়িতে অনেক বছরই ওরা আছে।
তাঁর বন্ধু-বান্ধব তত ছিল?
তা ছিল।
তাদের মধ্যে বেশী ঘনিষ্ঠতা কার কার সঙ্গে ছিল নির্বাণীতোষবাবুর বলতে পারেন?
সকলের সঙ্গেই ও মিশত, সকলেই ওকে লাইক করত। তবে ঘনিষ্ঠতার কথা যদি বলেন, সঞ্জীব, পরেশ আর নির্মলকান্তির সঙ্গে একটু বেশীই ঘনিষ্ঠতা ছিল বোধ হয়। তারা সবাই আমাদের ক্লাসফ্রেণ্ড। তবে ওদের মধ্যে নির্মল আমাদের সিনিয়র ছিল, এখনও ফাইন্যাল এম.বি. পাস করতে পারেনি। শিখেন্দু বললে।
আর সঞ্জীব ও পরেশবাবু?
তারাও পাস করতে পারেনি।
তারা আজ আসেনি উৎসবে?
সঞ্জীব ও পরেশ এসেছিল, নির্মলকান্তি আসেনি বোধ হয়। কারণ তাকে দেখেছি বলে মনে পড়ছে না।
কেন? আসেননি কেন নির্মলবাবু?
তা বলতে পারব না।
ঠিক আছে, নীচে চলুন। দীপিকাদেবীকে আমি কিছু প্রশ্ন করতে চাই।
জ্ঞান হওয়া অবধি সে তো কোন কথাই বলছে না।
কিছুই বলেননি?
না। কোন প্রশ্ন করলে কেবল ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে।
স্বাভাবিক, খুব শক্ পেয়েছেন তো!
বুঝতেই পারছেন একসঙ্গে পড়েছে, দীর্ঘদিনের জানা-শোনা, ঘনিষ্ঠতা—
দীপিকাদেবীও ডাক্তার নাকি?
হ্যাঁ—আমাদের সঙ্গেই পাস করেছে।
চলুন দেখা যাক।
দুজনে নীচে নেমে এল।
স্বাতীর ঘরে একটা চেয়ারের উপরে দীপিকা বসেছিল। পরনে তার এখনও সেই দামী বেনারসী শাড়ি আকাশ-নীল রংয়ের, মাগার সিঁথিতে সিঁদুর, সামনের কিছু বিশৃঙ্খল চুল চন্দন-চৰ্চিত কপালের উপরে এসে পড়েছে, গা-ভর্তি গহনা।
মাথার উপরে পাখাটা বনবন করে ঘুরছে, দাঁড়িয়ে স্বাতী। তার একটা হাত দীপিকার পিঠের উপর ন্যস্ত।
ওদের ঘরে ঢুকতে দেখে স্বাতী চোখ তুলে তাকাল।
দীপিকা কিন্তু তাকাল না।
স্বাতী!
আসুন শিখেন্দুদা, স্বাতী বললে।
০২. থানার ও সি এসেছেন
থানার ও সি এসেছেন, শিখেন্দু বললে, দীপাকে কিছু প্রশ্ন করতে চান উনি স্বাতী।
বীরেন মুখার্জী তাকালেন দীপিকার মুখের দিকে।
কেমন যেন অন্যমনস্কভাবে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে দীপিকা।
বীরেন মুখার্জী দুপা এগিয়ে গিয়ে একেবারে সামনা-সামনি দাঁড়িয়ে ডাকলেন, দীপিকাদেবী?
দীপিকা কোন সাড়া তো দিলই না, তাকালও না বীরেন মুখার্জীর দিকে, যেন শুনতেই পায়নি সে, কোন শব্দই তার কর্ণকুহরে প্রবেশ করেনি যেন।
দীপিকাদেবী, আমি বুঝতে পারছি, আপনার বর্তমান মনের অবস্থা কি! এও বুঝতে পারছি, আপনাকে এ সময় বিরক্ত করা সমস্ত মানবিকতার বাইরে, তবু বুঝতেই পারছেন আপনার স্বামীর হত্যাকারীকে খুঁজে বের করবার জন্যই আপনাকে, মনের বর্তমান অবস্থাতেও, বিরক্ত করতে হচ্ছে, কারণ আপনিই প্রথম আবিষ্কার করেন যে আপনার স্বামী ছুরিকাবিদ্ধ হয়ে মৃত রক্তাক্ত অবস্থায় বাথরুমের মেঝেতে পড়ে আছেন।
কিন্তু তথাপি কোন সাড়াই পাওয়া গেল না দীপিকার মধ্যে যেন। কথাগুলো যেন তার কানে প্রবেশই করেনি, প্রস্তরমূর্তির মত যেমন বসেছিল দীপিকা, তেমনই বসে রইল।
দীপিকাদেবী!
বাধা দিল এবারে স্বাতীই, নির্বাণীতোষের বোন। বললে অসহিষ্ণু কষ্ঠে, কেন ওকে বিরক্ত করছেন দারোগাবাবু এভাবে! ওকে এখন প্রশ্ন করে লাভ নেই। কোন প্রশ্নেরই জবাব পাবেন না ওর কাছ থেকে।
আপনার কথাঠিকইস্বাতীদেবী, কিন্তু বুঝতেই পারছেন, আইনের দিক থেকে আমি নিরুপায়।
না, প্লিজ, ওকে এখন বিরক্ত করবেন না। আমাদের যা-সর্বনাশ হবার তো ইয়েই গিয়েছে, ওকে এখন উত্ত্যক্ত করবেন না।
ঠিক আছে, কাল সকালে আমি কোন এক সময় না হয় আসব, চলুন শিখেন্দুবাবু, বীরেন মুখার্জী বললেন।
শিবতোষের ঘরে এসে যখন ওরা ঢুকল, শিবতোষ তখন কাকে যেন ফোন করছেন।
নির্বাণীতোষের আকস্মিক মৃত্যুটা শিবতোষকে প্রথমটায় সত্যিই বিমূঢ় করে দিয়েছিল। প্রত্যেককেই একদিন না একদিন মরতে হবেই, মৃত্যু আসবেই, কিন্তু স্বাভাবিকভাবে না এসে সেই মৃত্যু যখন অচিন্ত্যনীয় আকস্মিকভাবে এসে পড়ে, তখন সত্যিই যেন কেমন বিহুল বিমূঢ় করে দেয়। আবার সেই মৃত্যু যদি স্বাভাবিক না হয়ে নিষ্ঠুর হত্যা হয়, তাহলে যেন কোথাও কোন সান্ত্বনাই খুঁজে পাওয়া যায় না। একটা অসহায় শূন্যতা যেন চারিদিক থেকে ঘিরে ধরে।
শিবতোষের মনের অবস্থাটাও ঠিক সেই রকমই হয়েছিল।
কিন্তু সহজে একেবারে ভেঙ্গে পড়বার মত মানুষ ছিলেন না শিবতোষ। বরাবরই তাঁর অসাধারণ মনবল।
অনেকখানি আশা ছিল শিবতোষের নির্বাণীতোষের ওপরে। সেই নির্বাণীতোষ চলে গেল গেল না, কেউ নিষ্ঠুরভাবে তাকে হত্যা করেছে।
কে? কে এমন করে তাকে হত্যা করে গেল? নিঃসন্দেহে তার কোন শত্রু। কিন্তু নির্বাণীতোষের কোন শত্রু ছিল, কথাটা যেন আদৌ বিশ্বাসযোগ্য নয়।
ছেলেকে আর শিবতোষ ফিরে পাবেন না ঠিকই, কিন্তু যেমন করেই হোক তাঁকে খুঁজে বের করতেই হবে—এ কাজ কার! কে হত্যা করেছে নির্বাণীতোষকে!
কথাটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ একসময় একজনের কথা মনের মধ্যে উদয় হয় শিবতোষের। পুলিস হয়ত কোনদিনই হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে পারবে না, তারা হয়ত নিয়মমাফিক খানিকটা অনুসন্ধান চালাবে, তারপর সাধারণত যা ঘটে থাকে তাই ঘটবে, সমস্ত ব্যাপারটাই ফাইল-চাপা পড়ে যাবে।
কিন্তু শিবতোষের তা হলে তো চলবে না। তাঁকে জানতেই হবে হত্যাকারী কে? কেন। সে হত্যা করল? কি অপরাধ করেছিল নির্বাণীতোষ যে তাকে নিহত হতে হল?
কিন্তু কেমন করে হত্যাকারীকে তিনি খুঁজে বের করবেন! ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ সেই মানুষটির কথা মনে পড়ে। বছর দুই পূর্বেপরিচয় হয়েছিল মানুষটির সঙ্গে ঘটনাচক্রেশিবতোষের। তাঁরই এক কর্মচারী তাঁর চেকের, সই জাল করে অনেকগুলো টাকা তাঁর ব্যাঙ্ক থেকে তুলে নিয়েছিল। একবার নয়, চার-পাঁচ মাস ধরে থোকে থোকে প্রায় হাজার ত্রিশেক টাকা তুলে নিয়েছিল।
যে ব্যাঙ্ক থেকে দ্বিজেন অথাৎ সেই কর্মচারীটি টাকা তুলেছিল তাঁর সই জাল করে, সে ব্যাঙ্ক থেকে বড় একটা টাকা তুলতেন না শিবতোষ। মধ্যে মধ্যেই জমা দিতেন কেবল টাকা। শিবতোষের বিশেষ এক পরিচিত ভদ্রলোকের ছেলে ঐ দ্বিজেন দত্ত। সেই ভদ্রলোক হঠাৎ হাইপারটেনশনে অন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং শিবতোষকে অনুরোধ করায় তিনি দ্বিজেনকে নিজের অফিসে চাকরী দিয়েছিলেন, বছর দেড়েক অত্যন্ত সততার পরিচয় দিয়েছিল দ্বিজেন, যাতে করে শিবতোষের বিশ্বাস জন্মায় দ্বিজেনের ওপর।
দ্বিজেনের হাত দিয়ে অনেক সময় টাকা জমা দিয়েছেন এবং ব্যাঙ্ক থেকেও টাকা তুলেছেন চেক দিয়ে, হঠাৎই ব্যাপারটা জানতে পেরেছিলেন শিবতোষ সেই ব্যাঙ্কের স্টেটমেন্ট অফ অ্যাকাউন্ট থেকে, অনেক টাকা থোকে থোকে তোলা হয়েছে ঐ ব্যাঙ্ক থেকে অথচ গত আট-ন মাসের মধ্যে ঐ ব্যাঙ্ক থেকে কোন টাকাই তিনি তোলেননি, সবই ছিল বেয়ারার চেক, এবং খোঁজ নিতে গিয়ে ব্যাঙ্কের কর্তৃপক্ষ যখন চেকগুলো পেশ করল, তখন তিনি তো হতবাক। অবিকল তাঁরই সই।
মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়লেন শিবতোষ। কে তাঁর সই জাল করে টাকা তুলল। সেই সময়ই এক পরিচিত ভদ্রলোক তাঁকে কিরীটী রায়ের সন্ধান দেন এবং কিরীটী রায়ই শেষ পর্যন্ত জালিয়াতকে ধরে দেয়।
সেই থেকেই জানা-শোনা ও পরিচয়। মানুষটির অদ্ভুত তীক্ষ্ণ বুদ্ধি ও কর্মদক্ষতায় মুগ্ধ হয়েছিল শিবতোষ। হঠাৎ তাঁরই কথা মনে পড়ল, সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়লেন এবং তাঁর ঘরে যে নিজস্ব ফোন ছিল, তার রিসিভার তুলে ডায়েল করলেন।
রাত তখন প্রায় তিনটে।
কিছুক্ষণ রিং হবার পরই অপর প্রান্ত থেকে সাড়া এল, কিরীটী রায় কথা বলছি।
কিরীটীবাবু, আমি শিবতোষ মল্লিক—
এত রাত্রে কি ব্যাপার মল্লিক মশাই!
একবার এখুনি দয়া করে আমার বেলতলার বাড়িতে আসবেন?
ব্যাপার কি? হঠাৎ কি হল এখন? আজ রাত্রে তো আপনার বাড়িতে নিমন্ত্রণ খেয়ে এলাম আপনার একমাত্র ছেলের বৌভাতের—
সেই ছেলে—
কি হয়েছে!
তাকে কেউ খুন করে গেছে।
সে কি!
হ্যাঁ, একবার দয়া করে আসুন, পুলিসও এসেছে—
ঐ সময়ই বীরেন মুখার্জী ও শিখেন্দু ঘরে প্রবেশ করে।
দেরি করবেন না মিঃ রায়, যদি বলেন তো গাড়ি পাঠিয়ে দিচ্ছি। বললেন শিবতোষ মল্লিক।
না না, তার কোন প্রয়োজন নেই, আমি আসছি।
শিবতোষ ফোনের রিসিভারটা নামিয়ে রাখলেন। এবং ঘুরে দাঁড়াতেই বীরেন মুখার্জী ও শিখেন্দুর সঙ্গে চোখাচোখি হল।
বীরেনবাবু দেখলেন? শিবতোষ প্রশ্ন করলেন।
হ্যাঁ।
কিছু বুঝতে পারলেন?
আজ তো এ বাড়িতে উৎসব ছিল, অপরিচিত অনেক লোক আসা-যাওয়া করেছে, হত্যাকারী তাদেরই মধ্যে কেউ
সেটা বুঝতে কষ্ট হবার কথা নয় বীরেনবাবু, কিন্তু কে কখন ওকে খুন করে গেল?
বাড়ির সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ না করে এবং আরও অনুসন্ধান না করে এই মুহূর্তে সেটা বলা তো সম্ভব নয় শিবতোষবাবু। বীরেন মুখার্জী বললেন।
শুনুন বীরেনবাবু, ছেলেকে আর আমি ফিরে পাব না কোনদিনই জানি, কিন্তু কে এ কাজ করল সেটা আমাকে যেমন করে যে উপায়ে হোক জানতেই হবে।
আমাদের যথাসাধ্য চেষ্টা আমরা করব শিবতোষবাবু, কিন্তু একটু আগে ফোনে আপনি কার সঙ্গে কথা বলছিলেন?
কিরীটী রায়।
তাঁর সঙ্গে আপনার পরিচয় আছে নাকি?
আছে। তাই তাঁকে আসতে বললাম।
ভদ্রলোকের সঙ্গে আমার সাক্ষাৎ পরিচয় হবার সৌভাগ্য আজ পর্যন্ত যদিও হয়নি, কিন্তু ওঁর নাম আমি শুনেছি, শুনে খুব খুশি হলাম তিনি আসবেন।
এ বাড়িতে যাকে যা জিজ্ঞাসা করবার আপনি করতে পারেন বীরেনবাবু, শিখেন্দু আপনার সঙ্গে থাকবে, ঐ আপনাকে সাহায্য করবে। শিখেন্দু আমার বন্ধু-পুত্রই নয় কেবল, ও এ-বাড়ির ছেলের মত, আমার ছেলের ক্লাস-ফ্রেণ্ড। এ বাড়ির কোন কিছুই ওর অজানা নেই। কোন কিছু যদি জানবার দরকার হয় আপনার, ওকে জিজ্ঞাসা করলেই জানতে পারবেন।
হ্যাঁ, উনি যে আপনার বন্ধু-পুত্র এবং এ-বাড়ির সঙ্গে বিশেষ পরিচিত, আপনার ছেলের ক্লাস-ফ্রেণ্ড, সবই ওঁর কাছ থেকে আমি জেনেছি। বীরেন মুখার্জী বললেন। তারপর একটু থেমে বীরেন আবার বললেন, আপনাকেও আমার কিছু জিজ্ঞাস্য আছে—
বলুন কি জানতে চান?
আপনার আর এক স্ত্রী ছিলেন, তিনি আজ মৃত—
একটু যেন চমকে উঠলেন শিবতোষ। বললেন, কার কাছে শুনলেন?
কথায় কথায় শিখেন্দুবাবু বলছিলেন একটু আগে, আগের স্ত্রীর একটি পুত্রসন্তানও আছে আপনার।
শিবতোষ শিখেন্দুর মুখের দিকে তাকিয়ে একবার তাকালেন। তাঁর চোখের দৃষ্টিতে বেশ বিরক্তি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে যেন সামলে নিয়ে বীরেন মুখার্জীর দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনি ঠিকই শুনেছেন, কিন্তু সে ঘটনার সঙ্গে বর্তমান ঘটনার কোন সম্পর্ক আছে বলে আপনার মনে হচ্ছে নাকি?
কোন ঘটনার সঙ্গে কোন্ ঘটনার যে কি সম্পর্ক থাকে বা থাকতে পারে, সে কি কেউ বলতে পারে শিবতোষবাবু?.
শিবতোষ গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, বিয়ের পর সে স্ত্রী আমার বছর কয়েক মাত্র বেঁচেছিল, আর তার একটি ছেলেও আছে। নির্বাণীর চেয়ে সে বছর চারেকের বড়, কিন্তু সে ছেলের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
কেন?
ছেলে যদি বাপের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখতে চায়–তো বাপ কি করতে পারে?
তা ঠিক, কিন্তু তার কি কোন কারণ আছে?
আমার দিক দিয়ে অন্ততঃ জানি কিছু নেই, তার দিক থেকে থাকতে পারে।
কিছু অনুমান করতে পারেন না?
না।
একটা কথা—
বলুন?
সে যখন আপনারই ছেলে, আপনার সম্পত্তিতে নিশ্চয়ই তার অধিকার আছে?
সে-সব কথা আমি আজ পর্যন্ত ভাবিনি।
কেন?
ভাববার প্রয়োজন হয়নি বলে। কিন্তু এ-সব অবান্তর প্রশ্ন কেন করছেন সেটাই বুঝতে পারছি না।
এনকোয়ারীর ব্যাপারে আমাদের সব কিছুই জানা দরকার।
ঠিক আছে। আপনার আর কি জিজ্ঞাস্য আছে বলুন?
আপনার প্রথম পক্ষের সেই ছেলে কখনও এ বাড়িতে আসেনি?
সে আমার সঙ্গে কোন সম্পর্ক রাখেনি, একটু আগেই তো সে কথা আপনাকে বললাম।
সে না এলেও আপনি তার কোন খোঁজখবর রাখেন না?
না।
বড় হবার পর তাকে দেখেছেন? মানে কখনও আপনাদের পরস্পরের দেখা সাক্ষাৎ হয়েছে?
না না, যেন একটু ইতস্ততঃ করেই কথাটা উচ্চারণ করলেন শিবতোষবাবু।
তারপরই যেন একটু রূঢ় অসহিষ্ণু কণ্ঠে বললেন, নিশ্চয়ই। আর কিছু আপনার জিজ্ঞাসা করার নেই দারোগাবাবু আমার অতীত জীবন সম্পর্কে! প্লিজ, আমাকে যদি একটু একা থাকতে দেন
স্পষ্টভাবে না বললেও একপ্রকার যেন বললেনই শিবতোষবাবু বীরেন মুখার্জীকে অতঃপর ঘর ছেড়ে যাবার জন্য।
বীরেন মুখার্জী শিখেন্দুকে চোখের ইশারা করে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। শিখেন্দুও তাঁকে অনুসরণ করল।
বারান্দায় পা দিয়ে বীরেন মুখার্জী বললেন, মিঃ মল্লিক আমাদের পুলিসকে যেন ঠিক বিশ্বাস করতে পারছেন না।
না না, সে-রকম কিছু নয়, বুঝতে পারছেন পুত্রের আকস্মিক মৃত্যুতে উনি অত্যন্ত আঘাত পেয়েছেন।
তা হয়ত পেয়েছেন শিখেন্দুবাবু, কিন্তু উনি ওঁর ব্যালেন্স হারাননি, যা এক্ষেত্রে খুবই স্বাভাবিক।
বরাবরই লক্ষ্য করেছি, অতি বড় বিপর্যয়েও উনি যতই বিচলিত হোন না কেন, ধৈৰ্য্য ও বিচারবুদ্ধি উনি হারান। অদ্ভুত স্ট্রেংথ অব মাইশু!
তাই মনে হল। যাক গে, বাড়ির সকলকেই আমি কিছু কিছু প্রশ্ন করতে চাই।
তাহলে নীচে চলুন, নীচের পারলারে বসেই আপনি যাকে যা জিজ্ঞাসা করবার জিজ্ঞাসাবাদ করতে পারবেন।
তাই চলুন। সিঁড়ি দিয়ে নেমে ওরা এসে পারলারে বসল।
বেশ প্রকাণ্ড আকারের একটি হলঘর। দামী সোফা সেট, মেঝেতে পুরু কার্পেট বিছানো। উৎসবের জন্য বোধহয় আরও অনেক চেয়ার পাতা হয়েছিল পারলারে। সেগুলো সরানো হয়নি। যেমন ছিল তেমনি আছে।
আলোও জ্বলছিল ঘরে। গোটা দুই সিলিং ফ্যান তখনও বন্ধ করে ঘুরছিল। ঘরের এক কোণে একটা বিরাট গ্র্যাণ্ডফাদার ক্লক, সেকেলে। রাত সাড়ে তিনটে। ফানের মাঝামাঝি সময়টা, এখনও রাত্রি-শেষের দিকে একটু ঠাণ্ডা-ঠাণ্ডা লাগে।
একটা সোফায় বসলেন বীরেন মুখার্জী।
কাকে কাকে ডাকব বলুন? শিখেন্দু শুধাল।
সবাইকেই, তবে এক সঙ্গে নয়, এক এক করে—
বেশ, বলুন কার্কে প্রথমে ডাকব?
স্বাতীদেবীকে আগে ডাকুন, তারপর তাঁর দিদি স্মৃতিদেবীকে ডাকবেন।
আপনি বসুন, আমি ডেকে নিয়ে আসছি স্বাতীকে। শিখেন্দু ঘর থেকে বের হয়ে গেল। এবং একটু পরেই স্বাতীকে নিয়ে ঘরে ঢুকল। বসুন স্বাতীদেবী, বীরেন মুখার্জী বললেন।
আমি দাঁড়িয়েই আছি, আপনি কি জানতে চান? স্বাতীর কণ্ঠস্বর অসহিষ্ণু ও বিরক্ত মনে হল।
আজ রাত্রে বৌকে কোথায় বসানো হয়েছিল?
দোতলার একটা ঘরে। স্বাতী বললে।
সেখান থেকে কখন বৌকে ওপরে নিয়ে যাওয়া হয়?
বোধ হয় রাত পৌনে বারোটা কি বারোটা হবে তখন।
কে নিয়ে গিয়েছিল বৌকে ওপরে?
আমিই দরজা পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে চলে আসি নীচে নেমে।
সে-সময় বারান্দার তিনতলায় কাউকে দেখেছিলেন?
স্বাতী জবাব দেবার আগেই কিরীটী এসে পারলারে ঢুকল। সকলেই কিরীটীর দিকে তাকাল এক সঙ্গে।
কিরীটী ঘরের মধ্যে উপস্থিত তিনজনের মুখের দিকেই পর্যায়ক্রমে একবার তাকিয়ে নিল। তারপর শিখেন্দুর দিকেই তাকিয়ে বললে, শিবতোষবাবুকে একটা খবর দিতে পারেন?
চলুন ওপরে, কাকাবাবু ওপরে তাঁর ঘরের মধ্যেই আছেন। শিখেন্দু বললে কিরীটীর কথাটা শেষ করার আগেই। বীরেন মুখার্জীর পরনে ইউনিফর্ম ছিল, তাই তাঁর সঙ্গে পরিচয় না থাকলেও কিরীটী অনুমানেই বুঝতে পারে তিনি একজন পুলিসেরই অফিসার। এবং সেই অনুমানের ওপরেই নির্ভর করে বীরেনের দিকে তাকিয়ে বললে, মনে হচ্ছে আপনি এ এলাকার থানা অফিসার!
জবাব দিল শিখেন্দুই, হ্যাঁ মিঃ রায়, উনিই এখানকার থানা-অফিসার বীরেন মুখার্জী।
নমস্কার, আমি কিরীটী রায়। কিরীটী বললে।
নমস্কার। বীরেন বললেন, আপনার সঙ্গে সাক্ষাৎ পরিচয় হবার সৌভাগ্য আমার হয়নি বটে, তাহলেও আপনার নাম আমি অনেকই শুনেছি আমাদের ডি.সি, চাটুয্যে সাহেব তো আপনার প্রশংসায় একেবারে উচ্ছ্বসিত–
শিবতোষবাবু আমার বিশেষ পরিচিত, তাঁর ছেলে ডাঃ নির্বাণীতোষ মল্লিককেও আমি চিনতাম—আজ এখানে আমি নিমন্ত্রণে এসেছিলামও।
আমিও এসেছিলাম কিরীটীবাবু।
আপনিও এসেছিলেন?
হ্যাঁ–বসুন না।
কিরীটী বীরেন মুখার্জীর আহ্বানে তাঁর সামনেই একটা সোফায় উপবেশন করল। তারপর প্রশ্ন করল, মৃতদেহ দেখেছেন?
হ্যাঁ-মোটামুটি যা দেখবার দেখেছি, ভাবছিলাম এবারে এ-বাড়ির লোকদের জবানবন্দি নেব। বীরেন মুখার্জী অতঃপর যা দেখেছিলেন ও শুনেছিলেন, সংক্ষেপে বলে গেলেন।
সব শুনে কিরীটী কেবল একটা কথাই বললে, শিবতোষবাবুর দুই বিয়ে? আগের স্ত্রীর একটি সন্তানও আছে?
তাই তো শুনছি। প্রথমা স্ত্রী সান্ত্বনাদেবীর মৃত্যুর বছরখানেক বাদে দ্বিতীয়বার বিবাহ করেন।
প্রথমা স্ত্রী কি এ বাড়িতে কখনও আসেননি? কিরীটী প্রশ্ন করল।
জবাব দিল শিখেন্দু, না, আসেননি।
চার বছর তো বেঁচেছিলেন—
তা ছিলেন, তবে রায়বাহাদুর প্রিয়তোষ মল্লিক কাকাবাবুর প্রথমা স্ত্রীকে কোনদিনই স্বীকার করেননি।
স্বাভাবিক। তাঁকে যতটুকু আমি দেখেছিলাম, আভিজাত্য ও অর্থের অহঙ্কার একটু বেশী মাত্রাতেই ছিল। কাজেই তাঁর পক্ষে তাঁর পুত্রের—তাঁর, জ্ঞাতে ও অজ্ঞাতে বিশেষ করে, এক সাধারণ গরীবের ঘরের মেয়েকে পুত্রবধূ বলে স্বীকার করে নেওয়া একটু কষ্টকর বৈকি।
আপনি তাঁকে দেখেছিলেন কিরীটীবাবু? বীরেন মুখার্জী প্রশ্ন করলেন।
দেখেছি, মাত্র বছর কয়েক আগেই তো তিনি মারা গেছেন। কিরীটী বললে।
আমার মনে হয়, শিবতোষবাবুর অতীত জীবনের ব্যাপারে কোথায়ও একটা জট পাকিয়ে ছিল–নচেৎ তাঁর ছেলে জীবনে কখনও এ-বাড়িতে পদার্পণ করল না কেন? বীরেন মুখার্জী বললেন।
থাকাটা কিছু অসম্ভব নয় বীরেনবাবু! যাক, আপনি তাহলে আপনার কাজ করুন। আমি এবার শিবতোষবাবুর সঙ্গে দেখা করে তিনতলায় মৃতদেহটা দেখে আসি।
ঠিক আছে, আপনি যান। আপনি না আসা পর্যন্ত আমি অপেক্ষা করব।
না না—আমার জন্য আপনাকে বসে থাকতে হবে না। আমি না হয় কাল দিনের বেলায় কোন এক সময়ে আপনার সঙ্গে গিয়ে দেখা করব। শিবতোষবাবু আমার বিশেষ পরিচিত, তাছাড়া আপনার সাহায্য ছাড়া আমার পক্ষে কিছু করাই সম্ভবপর নয়। বীরেন মুখার্জীর মুখের ভাব দেখে মনে হল কিরীটীর শেষের কথায় তিনি যেন একটু খুশিই হয়েছেন। আমি তাহলে ওপর থেকে ঘুরে আসি!
আসুন।
চলুন শিখেন্দুবাবু, কিরীটী বললে।
চলুন।
বাড়িটা তেমনি স্তব্ধ। সর্বত্র তেমনি তখনও আলো জ্বলছে।
নির্বাণীতোষের মা কল্যাণীদেবীর কান্নার শব্দটা তখন আর শোনা যাচ্ছে না। বারান্দা অতিক্রম করে কিরীটী শিখেন্দুর পেছনে পেছনে এসে শিবতোষবাবুর শয়নকক্ষে প্রবেশ করল। শিবতোষ তখনো তেমনি করেই তাঁর ঘরের মধ্যে আরামকেদারাটারওপর বসে আছেন মুহ্যমানের মত।
সমস্ত মুখে একটা অসহায় বেদনার ক্লান্তি। পদশব্দে মুখ তুলে তাকালেন শিবতোষ, আসুন কিরীটীবাবু
আপনি উঠবেন না। বসুন মল্লিক মশাই।
শিবতোষ উঠে দাঁড়াচ্ছিলেন কিন্তু কিরীটীর কথায় আর উঠলেন না, বসেই রইলেন।
আমি জানি কিরীটীবাবু, আপনি বের করতে পারবেন—কে অমন নিষ্ঠুরভাবে খোকাকে খুন করে গিয়েছে। শিখেন্দু—শিবতোষের গলাটা যেন কান্নায় বুজে এল।
আজ্ঞে? শিখেন্দু তাকাল শিবতোষের মুখের দিকে।
দারোগাবাবু চলে গেছেন?
না । নীচে এখন সকলের জবানবন্দি নেবেন। স্বাতীর জবানবন্দি নিচ্ছেন।
তুমি তাহলে নীচেই যাও।
শিখেন্দু নিঃশব্দে ঘর থেকে বের হয়ে গেল। শিখেন্দু ঘর থেকে বের হয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গেই শিবতোষ বললেন, ভদ্রলোক একটু বেশী মাত্রায়ই যেন ইকুইজিটিভ। যেটা আমার একেবারেই ভাল লাগেনি কিরীটীবাবু!
পুলিস তো সব কিছুই একটু সন্দেহের চোখে দেখবে—প্রশ্ন করবে শিবতোষবাবু!
তা করে করুক না, তাই বলে আমার ব্যক্তিগত জীবনে অতীতে কার কি ঘটেছে সে ব্যাপারে এত অনাবশ্যক কৌতূহল কেন? আর আমার নিজের অতীতের ব্যক্তিগত জীবনের সঙ্গে খোকার খুনের সম্পর্কই বা কি! আর ঐ শিখেন্দুই বা যে কেন বলতে গেল আমি আমার বাড়ির অমতে এবং বাবাকে না জানিয়ে প্রথমবার বিয়ে করেছিলাম, সে স্ত্রী নেই—
হয়ত কিছু ভেবেই দারোগাবাবু প্রশ্নটা করেছেন। তারই উত্তর দিয়েছেন শিখেন্দুবাবু। কিরীটী শান্ত গলায় জবাব দিল।
তবু বলব—অহেতুক, অনাবশ্যক কৌতূহল। আমি আমার সম্পত্তির কি ব্যবস্থা করব, সে-বিষয়ে কিছু কখনও ভেবেছি কিনা
সেটাও হয়ত আপনার আর একটি সন্তান আছে জেনেই করেছিলেন তিনি।
সে আমাকে তার বাপ বলেই জীবনে কখনও স্বীকার করেনি, কোন সম্পর্কই আমার সঙ্গে রাখেনি–কাজেই সে থাকা না-থাকা দুই সমান–
তাহলেও আইনের দিক দিয়ে আপনার দুই ছেলে যখন, তখন আপনার সমস্ত সম্পত্তির সমান অংশীদার দুজনে।
আপনি জানেন না কিরীটীবাবু, দিলেও যে একটি সম্পদও সে আমার কখনও স্পর্শ করবে না, আমি খুব ভাল করেই জানি সে আমাকে ঘৃণা করে। তার মামারা, তার মামাদের মধ্যে যেমন সে বড় হয়েছে, একটু একটু করে একটা ধারণা বদ্ধমূল করে দিয়েছে যে, তার মায়ের মৃত্যুর জন্য আমিই দায়ী। অবহেলা করে তার মাকে আমি মৃত্যুর মধ্যে ঠেলে দিয়েছি। হ্যাঁ, এটা ঠিক, বাবা তাকে কখনও স্বীকার করে নেবেন না বলে, এ-বাড়ির বধূর যোগ্য মর্যাদা দিয়ে, এখানে তার নিজস্ব গৌরবে, তাকে বিয়ে করা সত্ত্বেও, এনে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি কিন্তু তার মৃত্যু
কিরীটী বাধা দেয় না কোনরূপ মন্তব্যও প্রকাশ করে না। কারণ সে বুঝতে পেরেছিল, সম্পূর্ণ ঝোঁকের মাথাতেই জীবনের এক গভীরতম শোকের মুহূর্তে বিহুল বিমূঢ় শিবতোষ মল্লিক তাঁর অতীত জীবনের দুঃখের কথা বলে চলেছেন। যে ব্যথাটা হয়ত নিরুপায়, এত বছর ধরে তাঁর বুকের নিভৃতে গুমরোচ্ছে-আজ জীবনের এক চরম শোকের বিহ্বলতায় সেটা আপনা থেকেই বের হয়ে আসছে।
এ তো কান্নারই নামান্তর ছাড়া কিছুই নয়।
অসাধারণ মনের বল ও সংযম ভদ্রলোকের, তাই এখনও হাউ হাউ করে না চেঁচিয়ে স্থির হয়ে আছেন, যদিও প্রথম মুহূর্তে ঘটনার আকস্মিক আঘাতে সহসা জ্ঞান হারিয়েছিলেন।
শিবতোষ যেমন বলছিলেন তেমনি বলতে লাগলেন, সান্ত্বনার মৃত্যুটামানে একটু একটু করে তাকে নিঃশেষ হয়ে যেতে, সেদিন আমাকে একপ্রকার যেন নিরুপায় হয়ে বসে বসেই দেখতে হয়েছিল।
কি হয়েছিল তাঁর?
সারকোমা–বাঁ হাতের হাড়ে সারকোমা। জানি সে রোগের কোন চিকিৎসাই ছিল না, তবু টাকা হাতে থাকলে তাকে আমি বিদেশে নিয়ে গিয়ে শেষ চিকিৎসাটুকু অন্ততঃ করাতে পারতাম, কিন্তু বাবা তখন বেঁচে, সব তাঁর হাতের মুঠোর মধ্যে। সামান্য মাসোহারা ছাড়া তখন আর কিছুই আমি পাই না। কিন্তু সে আর কত, চার-পাঁচশো টাকা মাত্র!
তারপরই বোধ হয় অতীত স্মৃতির বেদনায় কয়েকটা মুহূর্তের জন্য স্তব্ধ হয়ে থেকে আবার উদাস কণ্ঠে বলতে লাগলেন শিবতোষ, তবুমাকে দিয়ে আমি বাবাকে বলিয়ে চেষ্টা করেছিলাম, কিন্তু লোহার মত কঠিন মন তাঁর কিছুতেই গলল না।
আপনার স্ত্রীও তো নিজে আসতে পারতেন এ-বাড়িতে, তাঁর অধিকারকে জোর করে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য!
যেমন ভীরু তেমনি কোমল প্রকৃতির ছিল সান্ত্বনা, তা সত্ত্বেও সে দু-দুবার এসে বাবার সঙ্গে দেখা করবার চেষ্টা করেছে আমাকে না জানিয়েই, প্রথমবার তার ভাইদের সঙ্গে, কিন্তু বাবা দূর-দূর করে সান্ত্বনাকে তাড়িয়ে দিয়েছেন, শেষবারও অসুস্থ অবস্থাতেই মরার মাস দুই আগে এসেছিল এবং সেবারে আমিও সঙ্গে ছিলাম, ঢুকতে দিলেন না বাড়িতে। সান্ত্বনার ছেলের বয়স, মানে আমার সেই বড় ছেলে, তার বয়স তখন আড়াই বৎসর। তার মামাদেরও আমি দোষ দিই না কিরীটীবাবু। সান্ত্বনার বড় ভাই শশী, আমারই ক্লাসফ্রেণ্ড ছিল, সেও আমাকে বুঝল না।
একটু থেমে শিবতোষ আবার বলতে লাগলেন, সান্ত্বনার মৃত্যুর প্র আমি আমার কর্তব্য করতে পারিনি কয়েক বছর। বাবাকে অনেক বলেছিলাম, কিন্তু কিছুতেই আমার প্রথম সন্তানকে গ্রহণ করতে সম্মত হলেন না। শেষটায় একবার বলেছিলেন, বেশ কিছু অর্থ সাহায্য তাকে করতে পারি, কিন্তু এ বাড়িতে তার স্থান হবে না।
আশ্চর্য কঠিন মন তো ছিল রায়বাহাদুরের!
সে যে কি কঠিন আমিই জানি। তারপর নিজের ইচ্ছেমত যখন খরচ করবার সুযোগ এল আমার জীবনে, ছেলের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম, কিন্তু সে দেখাও করল না। ভাবতে পারেন কিরীটীবাবু, লক্ষপতি শিবতোষ মল্লিকের ছেলে লেখাপড়া করল না, কিছু না, সাধারণ একটা জুট মিলের শ্রমিক, অর্ডিনারী লেবারার—শিবতোষের গলার স্বর যেন বুজে এল।
চোখে জল নেই, কিন্তু কিরীটীর মনে হচ্ছিল, কান্নায় যেন ভদ্রলোকের বুকের ভেতরটা তোলপাড় করছে।
বাবা!
শিবতোষের বড় মেয়ে স্মৃতি এসে ঘরে ঢুকল।
ডাক্তার চৌধুরীকে একবার ফোন করলে হতো না—
কেন?
বৌদি যে জ্ঞান ফিরে আসার পর থেকে বোবা হয়ে বসে আছে, এখন পর্যন্ত একটা কথাও বলল না। এক ফোঁটা চোখের জলও নেই, আমার যেন কেমন ভাল লাগছে না। বাবা।
বেশ ফোন করে দাও।
কি বলব ফোনে?
আমি ডেকেছি তাই বলল। তোমার মা?
মার তো ঘন ঘন ফিট হচ্ছে।
আমিই ফোন করছি, শিবতোষ উঠে গিয়ে ফোন করতে লাগলেন।
ফোন করে আবার ফিরে এসে বললেন, তোমার মার কাছে গিয়ে বসে থাক।
স্মৃতি ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
আমি একবার তিনতলাটা ঘুরে আসি শিবতোষবাবু।
যান।
কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে গেল!
নির্বাণীতোষের ঘরের সামনে যে পুলিসটি প্রহরায় নিযুক্ত ছিল, সে চিনত কিরীটীকে, ওকে দেখে বললে, সাব—আপ!
ব্রিজনন্দন, তোমারা ডিউটি হ্যায় হিঁয়া?
জী সাব–আপ অন্দর যায়েঙ্গে?
হ্যাঁ।
যাইয়ে সাব।
কিরীটী ঘরের মধ্যে গিয়ে ঢুকল। দুটি নরনারীর জীবনে প্রথম মিলন-উৎসব রাত্রি, আয়োজনের কোন ক্রটিই রাখেননি শিবতোষ। দুটি হৃদয়ও উন্মুখ হয়ে ছিল পরস্পর পরস্পরকে গ্রহণ করবার জন্য, কিন্তু অকস্মাৎ মৃত্যু এসে সে মিলনেছেদটেনে দিয়েছে। পরস্পর পরস্পরের দীর্ঘদিনের পরিচিত, তবে তাদের জীবনের আকাঙিক্ষত রাতটি এমন করে ব্যর্থ হয়ে গেল কেন?
নির্বাণীতোষ আর দীপিকা, তারা কি একবারও টের পায় নি তাদের পেছনে পেছনে মৃত্যু কালো ছায়া ফেলে এগিয়ে আসছে।
ঘরের চতুর্দিকে একবার দৃষ্টিনিক্ষেপ করল কিরীটী। শুধু শয্যাই নয়, সমস্ত ঘরটাই ফুলে ফুলে সাজানো। এখনও ফুল ও ফুলের মালাগুলো বাসি হয়নি, শুকিয়ে যায়নি। এখনও রজনীগন্ধার গন্ধ ঘরের বাতাসে ছড়িয়ে আছে। ঘরের দক্ষিণ দিকে মহার্ঘ্য একটি পালঙ্ক, তার ওপরে দামী শয্যা বিস্তৃত। অন্যদিকে একটি তিন আয়মাওয়ালা ড্রেসিং-টেবিল, নানা প্রসাধন দ্রব্য তার ওপর সাজানো। একপাশে একটি সোফা-কাম-বেড। দুদিককার দেওয়ালে সুদৃশ্য ব্র্যাকেট আলো বসান, টিউব আলো। উজ্জ্বল আলোয় ঘরটা যেন ঝলমল করছে। ঘরের দেওয়াল হালকা ক্রিম কালারের প্লাস্টিক ইমালশন করা, দেওয়ালেগোটা দুইল্যান্ডস্কেপ! আর বাঁ দিককার দেওয়ালে একটি যুগল ফটো। দুটি হাসিভরা মুখ পাশাপাশি।
নির্বাণীতোষ আর দীপিকা।
খোলা জানলাপথে রাত্রিশেষের হাওয়া ঝিরঝির করে এসে ঢুকছে। বাথরুমের দিকে তাকাল কিরীটী-দরজাটাখোলা, ভেতরে আলো জ্বলছেতখনও। আলোটানেভানো হয়নি। নেভানোর কথা হয়তো কারও মনেও হয়নি।
বাথরুমের দিকে এগিয়ে গেল কিরীটী। ভিতরে পা দিতেই নজরে পড়ল নির্বাণীতোষের নিষ্প্রাণ রক্তাক্ত দেহটা। পাঞ্জাবীর উপর থেকেই একটা ক্ষতস্থান নজরে পড়ে।
কয়েকটা মুহূর্ত তাকিয়ে রইল কিরীটী ভূলুণ্ঠিত নিষ্প্রাণ দেহটার দিকে।
বেসিনের ঠিক সামনেই দেহটা একেবারে উপুড় হয়ে পড়ে আছে। বেসিনের ট্যাপটার মুখটা খোলা ছিল, বীরেন মুখার্জী বন্ধ করে দেন, কাঁচের গ্লাসটা বেসিনের ওপরেই রয়েছে। একবার বেসিন ও একবার ভূলুণ্ঠিত দেহটার দিকে তাকাল কিরীটী। গ্লাসটা হাতে তুলে নিয়ে, পরীক্ষা করতে গিয়ে নজরে পড়ল গ্লাসটার গায়ে চিড় খেয়ে ফেটে গেছে, গ্লাসটা নামিয়ে রেখে আবার সামনে তাকাল কিরীটী।
বেসিনের ওপরে একটা আয়না বসানো। কিন্তু বেসিনটা ঘরের দেওয়ালে এমনভাবে বসানো যে শয়নঘর থেকে কেউ বাথরুমে প্রবেশ করলেও বেসিনের সামনে আয়নায় কোন প্রতিচ্ছবি পড়বে না, মেথরদের যাতায়াতের দরজাটার দিকে তাকাল একবার কিরীটী, দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ। সে দরজাপথে কেউ এলেও আয়নায় প্রতিচ্ছবি পড়বে না।
মৃতদেহের অবস্থান দেখে মনে হয়, এই বাথরুমের মধ্যে কেউ নির্বাণীতোষকে পশ্চাৎদিক থেকে ছোরার সাহায্যে চরম আঘাত হেনেছে।
বাথরুমের মেঝেতে একটা কোডোপাইরিন ট্যাবলেটের স্ট্রিপ পাওয়া গিয়েছে। বেসিনের ওপরে একটা কাঁচের গ্লাসও আছে, মাথার যন্ত্রণা হচ্ছিল বলে বন্ধুদের শেষ ব্যাচ খাবার পর নির্বাণীতোষ ওপরে চলে এসেছিল। রাত তখন পৌনে এগারটা। অন্ততঃ শিখেন্দুর কথা যদি ঠিক হয়, ঐ ঘরে তখন কেউ ছিল না, মানে বাড়ির কেউ ছিল না, নতুন বৌ নিচের তলায় তখনও ছিল এবং সেখানেই নতুন বৌকে ঘিরে ছিল ভিড়।
নতুন বৌকে স্বাতী ওপরে ঘরের সামনে যখন ছেড়ে দিয়ে যায়, রাত তখন পৌনে বারোটা কি বারোটা। তার মানে প্রায় একঘণ্টা সময়, পৌনে এগারটা থেকে পৌনে বারোটা, যা কিছু ঘটবার ঘটেছিল, ঐ এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যে কেউ ওপরে এসেছিল কিনা! যদি কেউ এসে থাকে তো সে কে? তারপর শিখেন্দু কখন ওপরে আসে? সম্ভবতঃ বারোটার কয়েক মিনিট পরে ও ওপর থেকে চিৎকারের শব্দটা শোনার পর। শিখে ওপরে এসেও জানায়নি কিছু। চেঁচামেচি বা ডাকাডাকি করেনি কাউকে। শিবতোষ ওপরে এসে দেখেন শিখেন্দু দাঁড়িয়ে আর মেঝেতে পড়ে আছে জ্ঞান হারিয়ে দীপিকা।
০৩. শিখেন্দু কেন চেঁচিয়ে সকলকে ডাকল না
শিখেন্দু কেন চেঁচিয়ে সকলকে ডাকল না!
হতভম্ব বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল? স্বাভাবিক, হওয়াটা এমন কিছু বিচিত্র নয়। দীপিকাকে ঐভাবে অচৈতন্য অবস্থায় ঘরের কার্পেটের ওপরে পড়ে থাকতে দেখে তার হতবুদ্ধি হয়ে যাওয়াটা এমন কিছু বিচিত্র নয়।
তবু একটা প্রশ্ন যেন কিরীটীর মনের মধ্যে উঁকি দেয়। শিবতোষের সঙ্গে একত্রে বাথরুমে প্রবেশ করার আগে শিখেন্দু বাথরুমে ঢুকেছিল কিনা, সে আগেই দুর্ঘটনাটা আবিষ্কার করতে পেরেছিল কিনা। যদি পেরে থাকে, পারাটা এমন কিছু অসম্ভব নয়। এমনও হতে পারে, হয়ত ঘরে ঢুকে মেঝের ওপরে অচৈতন্য দীপিকাকে পড়ে থাকতে দেখে, সে বাথরুমে আলো জ্বলতে দেখে (?) ঢুকেছিল, তারপর সেখানে বন্ধুর মৃতদেহটা আবিষ্কার করবার পর কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে পড়েছিল কিছুক্ষণের জন্য।
বুঝে উঠতে পারেনি হয়ত, কি করবে এখন সে? কি করা উচিত? মনেও হয়ত পড়েনি কথাটা ঐ মুহূর্তে। কিংবা এও হতে পারে, ঘরে ঢুকে কাউকে সে দেখতে পায়নি। তখন ওদের খোঁজে বাথরুমে এসেঢোকে। ঐবাথরুমের মধ্যেই দুজনকে পড়ে থাকতে দেখে—একজন মৃত, অন্যজন অচৈতন্য। তখন সে দীপিকার অজ্ঞান দেহটা তুলে এনে সবে যখন ঘরের মেঝেতে নামিয়ে রেখেছে, শিবতোষ ঘরের ভিতরে গিয়ে ঢোকেন।
তাই যদি হয় তো দীপিকার অচৈতন্য দেহটা বাথরুম থেকে বয়ে নিয়ে এল কেন? কি এমন প্রয়োজন ছিল তার? কেনই বা আনতে গেল? বাথরুমে দীপিকা পড়ে থাকলেই বা কি এমন ক্ষতি ছিল? সেটাই তো বরং সকলের চোখে স্বাভাবিক ঠেকত।
দ্রুত একটার পর একটা প্রশ্ন যেন কিরীটীর মনের মধ্যে আসা যাওয়া করতে থাকে। আসে আর যায়, যায় আর আসে।
জানা দরকার কতকগুলো প্রশ্নের উত্তর। তার অবশ্যই জানা দরকার।
(১) রাত এগারটা থেকে পৌনে বারোটা, এই একঘণ্টা সময়ের মধ্যে তিনতলায় নির্বাণীতোষের শয়নঘরে কেউ এসেছিল কিনা? কিংবা ঐ সময়ে কেউ কাউকে তিনতলায় আসতে দেখেছিল কিনা?
(২) শিখেন্দু বীরেন মুখার্জীর কাছে যা বলেছে, তা একেবারে নির্ভুল সত্যু কিনা?
(৩) শিখেন্দুও দীপিকার সহপাঠী, সেও কি ভালবাসত মনে মনে দীপিকাকে! কিংবা দীপিকা সম্পর্কে তার মনের মধ্যে কোথাও কোন দুর্বলতা ছিল কিনা? অসম্ভব নয় ব্যাপারটা!
(৪) দীপিকা তার স্বামীর হত্যার ব্যাপার সম্পর্কে কিছু জানে কিনা? সে ঘরে ঢুকে কাউকে দেখেছিল কিনা?
(৫) সে যদি ঘরে ঢুকে স্বামীকে না দেখে বাথরুমেই গিয়ে তার খোঁজে ঢুকে থাকে এবং তখুনি সে মৃতদেহটা আবিষ্কার করেছিল, না তার চোখের সামনেই হত্যাকাণ্ডটা সংঘটিত হয়েছে? যদি তা না হয়ে থাকে, অর্থাৎ সে বাথরুমে ঢুকেই আবিষ্কার করে থাকে তার স্বামীর মৃতদেহটা, তবে চিৎকার করে উঠে ও সেইখানেই তার অজ্ঞান হয়ে পড়ে যাওয়াটা সঙ্গে সঙ্গে স্বাভাবিক, ছুটে এসে ঘরের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়বে কেন? প্রচণ্ড আঘাত লেগেছে মনে, এখনও একটা কথাও বলেনি, সেক্ষেত্রে তার ঘরের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে ঐভাবে পড়ে থাকাটা যেন মন মেনে নিতে চাইছে না!
(৬) স্বামীর মৃত্যুই আঘাতের কারণ, না অন্য কোন কারণ আছে ঐভাবেমূক হয়ে যাওয়ার?
(৭) দীপিকাকে কথা বলতেই হবে। সহজে হয়ত সে মুখ খুলবে না, কিন্তু মুখ তাকে খুলতেই হবে!
(৮) হত্যাকারীর পক্ষে আজ রাত্রে এই বাড়িতে আসাটা এমন কিছু কঠিন ছিল না। উৎসবের বাড়িতে অগণিত অতিথি এসেছে, তাদের সঙ্গে মিলে-মিশে হয়ত সেও এসেছিল কোন এক সময়। তারপর কোন এক ফাঁকে তিনতলায় চলে যাওয়াও তার পক্ষে কষ্টসাধ্য ছিল না। তারপর বাথরুমে হয়ত সুযোগের অপেক্ষায় লুকিয়ে ছিল। কিন্তু তারপর হত্যা করার পর কোন পথে সে গেল? নিশ্চয়ই বাথরুমের মেথরদের যাতায়াতের দরজার পথে-—এখানেও মনের মধ্যে একটা দ্বিধা জাগছে কিরীটীর। কিসের দ্বিধা? কেন দ্বিধা? ঘুরেফিরে আবার শিখেন্দুর কথাই মনে আসছে। শিখেন্দু-দীপিকা-নির্বাণীতোষ। পরস্পরের সহপাঠী। অনেক বছর একসঙ্গে কেটেছে। যার ফলে নির্বাণীতোষের সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা ও বিয়ে। ত্রিকোণ কোন প্রেমের মর্মন্তুদ শেষ দৃশ্য নয় তত নির্বাণীতোষের হত্যার ব্যাপারটা?
(৯) শেষ কথা যেটা কিরীটীর মনে হয়, এ হত্যার ব্যাপারে, শিবতোষ মল্লিকের প্রথম পক্ষের মৃত স্ত্রীর সন্তান আশুতোষ মল্লিক। যে মানুষটা তার জন্মদাতার প্রতি একটা প্রচণ্ড ঘৃণা ও বিদ্বেষ বরাবর পোষণ করে এসেছে। বাপের সাহায্য কখনও এক কপর্দকও নেয়নি। চেষ্টা করেও তাকে শিবতোষ তার গৃহে আনতে পারেননি। বাপের মুখ পর্যন্ত দেখতেও নারাজ। কেন? কিসের এ ঘৃণা, কিসের এ আক্রোশযা এত বছরেও বাপ ও ছেলে পরস্পরের মধ্যে সম্পর্কটাকে সহজ হতে দিল না? নিজে সামান্য চটকলের একজন মজুর, হয়ত লক্ষপতি বাপকে স্বীকার করল না। তার মাকে তার পিতামহ এ বাড়িতে প্রবেশাধিকার দেয়নি, স্বীকার করেনি কখনও পুত্রবধূ বলে। কিন্তু বাপ তো তার স্ত্রীকে বরাবরই স্বীকার করেছে। তবে এত ঘৃণা ও এত আক্রোশের কারণ কী আশুতোষের তার বাপের প্রতি?
(১০) তিনতলায় নির্বাণীতোষের শয়নঘরের দরজাটা বন্ধ থাকাই তো স্বাভাবিক ছিল, কিন্তু দেখা যাচ্ছে খোলা ছিল। কেন?
কথাগুলো প্রশ্নের আকারে কিরীটীর মনের মধ্যে আনাগোনা করতে থাকলেও তার দুচোখের দৃষ্টি কিন্তু তখনও বাথরুমের সর্বত্র তীক্ষ্ণ সজাগ হয়ে যোরাফেরা করছিল।
হঠাৎ দেওয়াল ঘেঁষে কিরীটীর চোখ পড়ে। বাথরুমে ঢোকার দরজাটার একটা পাল্লার ঠিক নিচেই কি যেন ঝিকমিক করছে!– কৌতূহলে এগিয়ে গিয়ে মেঝে থেকে জিনিসটা তুলে নিল কিরীটী। ছোট্ট একটি সোনার ফুলের নাভিদেশে মটরদানার মত একটি হীরকখণ্ড।
আসল এবং দামী হীরে দেখলেই বোঝা যায়। বস্তুটা পরীক্ষা করতে করতে কিরীটীর মনে হয়, ওটা কোন অলঙ্কারের অংশবিশেষ।
কম করেও হাজার পাঁচ-ছয় টাকা মূল্য হবে হীরকখণ্ডটির। এটা বাথরুমের মধ্যে কি করে এল!
চিন্তিত মনে সেটি পকেটের মধ্যে ঢুকিয়ে রাখল কিরীটী।
বাথরুমে আর কিছু দ্রষ্টব্য আপাততঃ নেই। মৃতদেহটার দিকে শেষবারের মত তাকিয়ে বাথরুম থেকে বের হয়ে এল কিরীটী।
শয়নকক্ষটি আর একবার ভাল করে দেখল কিরীটী। শয্যাটি আদৌ ব্যবহৃত হয়নি, বুঝতে কষ্ট হয় না।
মধুরাত্রে মিলনের আগেই মৃত্যু এসে ছোবল হেনেছে। সব কিছুর উপরে সমাপ্তির রেখা টেনে দিয়েছে।
কিরীটী ঘর থেকে বের হয়ে তিনতলা থেকে দোলায় নেমে এল।
শিবতোষবাবু তখনও বসে আছেন মুহ্যমানের মত।
শিবতোষবাবু!
কে? রায়মশাই, আসুন।
আপনার বৌমার সঙ্গে একবার দেখা করতে চাই।
শিবতোষের খাসভৃত্য গোকুল দরজার বাইরেই ছিল। তাকে ডেকে শিবতোষ বললেন, দেখ তো ছোড়দি কোথায়?
স্বাতীর জবানবন্দি শেষ হয়ে গিয়েছিল। বড় বোন স্মৃতিকে নিচে পাঠিয়ে দিয়ে সে আবার দীপিকার পাশে গিয়ে বসেছিল। গোকুল তাকে ডেকে নিয়ে এল।
ডাকছ বাবা!
হ্যাঁ। কিরীটীবাবুকে একবার বৌমার কাছে নিয়ে হ্যাঁ।
বৌদি তো এখনও তেমনি বোবা হয়ে আছে বাবা, স্বাতী বললে। কথাটা বলে স্বাতী যেন একটু বিরক্তির সঙ্গেই কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল।
কিরীটী সস্মিতভাবে বললে, আপনার ভয় বা চিন্তার কোন কারণ নেই স্বাতীদেবী, ওঁকে আমি কোনরকম বিরক্ত করব না।
স্বাতী নিরাসক্ত কণ্ঠে বলল, আসুন। .
দুখানা ঘরের পরের ঘরটার মধ্যেই দীপিকা ছিল। কিরীটী স্বাতীর সঙ্গে সঙ্গে সেই ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল। বিবাহের পূর্বে স্বাতী এই ঘরটাতেই থাকত, বিবাহের পর যখন এখানে আসে এই ঘরেই থাকে।
দীপিকার জ্ঞান হবার পর সকলে দীপিকাকে স্বাতীর ঘরেই নিয়ে এসেছিল। বীরেন মুখার্জী যেমন দেখে এসেছিলেন, ঠিক সেইভাবেই বসে ছিল তখনও দীপিকা, মাথাটা নীচু করে। দৃষ্টি ভূমির ওপরে নিবদ্ধ।
তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে কিরীটী একবার দীপিকাকে দেখে নিল। এবং তার অভিজ্ঞ দৃষ্টিতাকে বুঝিয়ে দেয়, দীপিকার জ্ঞান ফিরে এলেও সে তার স্বাভাবিক চেতনা ফিরে পায়নি। এও বুঝতে পারে কিরীটী, নিদারুণ কোন মানসিক আঘাতেই তার মানসিক চেতনা লুপ্ত হয়েছে। তাকে। প্রশ্ন করে কোন লাভই হবে না। কিরীটী লক্ষ্য করে আরও, দীপিকার কপালের বাঁদিকে একটা কালসিটা।
সামনের কিছু চূর্ণ বিপর্যস্ত কুন্তল স্থানভ্রষ্ট হয়ে কপালের ওপর এসে পড়েছে।
কিরীটী পকেট থেকে হীরকখণ্ডটি বের করে স্বাতীর দিকে এগিয়ে ধরে বললে, স্বাতী দেবী, দেখুন তো এটা চিনতে পারেন কিনা?
স্বাতী সোনায় বসানো হীরকখণ্ডটি হাতে নিয়ে দেখেই বলল, কোথায় পেলেন এটা?
জানেন এটা কার?
এটা তো বৌদির সিঁথি-মৌরের সঙ্গে ছিল। মা দিয়েছিলেন এটা বিয়ের পর আশীর্বাদে।
সিঁথি-মৌরটা কোথায়?
খুলে রেখেছি।
কোথায় দেখি?
স্বাতী এগিয়ে গিয়ে আলমারি থেকে সিঁথি-মৌরটি বের করে আনল। দেখা গেল স্বাতীর ধারণা মিথ্যে নয়। সিঁথি-মৌরের সঙ্গে যে ছোট্ট সোনার এস দিয়ে এটা লাগানো ছিল, সেই এটা আছে তখনও।
স্বাতী আবার বলল, হ্যাঁ, এটার সঙ্গেই লাগানো ছিল হীরেটা। কোথায় পেলেন এটা? ওপরের ঘরে?
কিরীটী স্বাতীর প্রশ্নের কোন জবাকনা দিয়ে কেবল বলল, এটা রেখে দিন। আপনাকে কয়েকটা কথা জিজ্ঞাসা করতে পারি স্বাতী দেবী?
কি?
আপনিই তো আজ রাত্রে আপনার বৌদিকে ওপরে পৌঁছে দিয়ে আসেন?
হ্যাঁ।
ঘরে ঢুকেছিলেন?
না। সিঁড়ি থেকেই আমি চলে এসেছিলাম।
সিঁড়ি দিয়ে নামবার সময় কোন শব্দ বা চিৎকার শুনেছিলেন?
না।
কতক্ষণ বাদে চিৎকার শোনেন?
মিনিট পনের-কুড়ি বাদে বোধ হয়।
কি রকম চিৎকার?
ভয় পেলে যেমন চিৎকার করে।
বিয়ের আগে দীপিকাদেবী এ বাড়িতে আসেননি?
কতবার এসেছে—দাদার ক্লাস-ফ্রেণ্ড ছিল তো বৌদি।
জানি। আচ্ছা আপনাদের এক সভাই আছেন, জানেন?
জানি।
দেখেছেন তাঁকে কখনও?
না। তিনি কখনও এখানে আসেননি।
ঐ সময় শিবতোষের বড় মেয়ে স্মৃতি এসে ঘরে ঢুকল।
ইনি? কিরীটী প্রশ্ন করে।
আমার দিদি, স্মৃতি।
আমার নাম কিরীটী রায়।
কিরীটী কথাটা বলারসঙ্গেসঙ্গেই স্মৃতি কিরীটীরমুখের দিকে তাকাল। একটুযেনশ্রদ্ধামিশ্রিত তার দৃষ্টি। কিরীটী রায় নামটা স্মৃতির অপরিচিত নয়। তার বাপের মুখে শুনেছে এবং শুনেছে ভদ্রলোকের প্রতি তাদের বাবার কি অগাধ শ্রদ্ধা।
আপনি কোন্ ঘরে থাকেন স্মৃতিদেবী?
পাশের ঘরেই।
আপনার দাদার ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের বোধ হয় আপনি সকলকেই চেনেন?
যাঁরা এ বাড়িতে আসতেন তাঁদেরই কেবল চিনি। আর ঘনিষ্ঠতা দাদার কার সঙ্গে ছিল—একমাত্র শিখেন্দুদা ছাড়া বলতে পারব না।
এ বাড়িতে আপনার দাদার কাছে আর কে কে আসত?
নির্মলবাবু আর সঞ্জীববাবু।
তারা আপনার দাদারই সমবয়সী ছিল বোধ হয়?
নির্মলবাবু বোধ হয় একটু বয়সে বড় হবেন দাদার চাইতে, কারণ শুনেছিলাম—
কি শুনেছিলেন?
অনেকবার নাকি ফেল করেছেন নির্মলবাবু। মানুষটা যেমন হাসিখুশি, তেমনি আমুদে।
আচ্ছা তাঁরা এসেছিলেন নিশ্চয়ই উৎসবে?
স্বাতী বলতে পারে। কারণ যে-ঘরে বৌদিকে বসানো হয়েছিল,—দাদার বন্ধুরা কে কে প্রেজেনটেশন দিতে এসেছিলেন, ওই বলতে পারে। স্মৃতি বলল।
স্বাতীদেবী!
নির্মলবাবুকে দেখেছি, তাঁকে চিনতামও। কিন্তু আর যাঁরা এসেছিলেন, অনেকেই তো এসেছিলেন, কাউকেই আমি চিনতে পারিনি।
সঞ্জীববাবুকে দেখেননি?
মনে পড়ছে না।
ঠিক আছে, আপনাদের আর বিরক্ত করব না। আমি নিচে যাচ্ছি।
নিচের পারলারে যখন এসে কিরীটী প্রবেশ করল, বীরেন মুখার্জী তখন গোকুল ভৃত্যকে প্রশ্ন করছেন।
তাহলে গোকুল, তুমি বরাবরই দোতলায় ছিলে?
আজ্ঞে কাবাবুর হুকুম ছিল দোতলায় যেন সর্বক্ষণ আমি থাকি।
হঠাৎ ঐ সময় কিরীটী প্রশ্ন করল, গোকুল, তোমার দাদাবাবুর বন্ধু যারা এ বাড়িতে আসত, তাদের নিশ্চয়ই তুমি চেন?
সকলকে তো চিনি না আজ্ঞে,—গোকুল বলল, তবে দু-একজনকে চিনি।
তারা কে? কিরীটী আবার প্রশ্ন করল।
নির্মলবাবু, সঞ্জীববাবু, পরেশবাবু—আর শিখেন্দুবাবু তো এ বাড়ির লোক একরকম।
নির্মলবাবু, পরেশবাবু, সঞ্জীববাবু এসেছিলেন আজ?
আজ্ঞে নির্মলবাবু আর পরেশবাবু এসেছিলেন।
আর সঞ্জীববাবু আসেননি?
কই, তাঁকে তো দেখিনি।
পরেশবাবু আর নির্মলবাবু বৌকে যে-ঘরে বসানো হয়েছিল, সে ঘরে যাননি?
গিয়েছিলেন তা আজ্ঞে।
দেখেছ তাঁদের–বৌ যে-ঘরে ছিল সে-ঘরে ঢুকতে দুজনকেই?
দেখেছি বইকি বাবু।
কখন কে এসেছিলেন—একসঙ্গেই কি?
আজ্ঞে না। রাত আটটা সোয়া আটটা নাগাদ পরেশবাবুকে দেখেছি। আর নির্মলবাবু এসেছিলেন রাত তখন সাড়ে নটা কি পৌনে দশটা হবে।
নির্মলবাবুকে বের হয়ে যেতে দেখেছ?
ঠিক লক্ষ্য করিনি বাবু, মিথ্যে বলব কেন।
কিরীটী আবার প্রশ্ন করল, রাত্রে কাকে তুমি তিনতলায় যেতে দেখেছ—মনে করে বলতে পার গোকুল?
বড়দিদিমণি বার দুই, ছোটদিদিমণি একবার উপরে গিয়েছিলেন। তাছাড়া শিখেদাদাবাবুও এবার গিয়েছিলেন। আর একজন বৌ, নীল রঙের দামী শাড়ি পরনে, মাথায় ঘোমটা ছিল, উপরে যেতে দেখেছি।
শিখেন্দুদাদাবাবু কখন তিনতলায় গিয়েছিলেন গোকুল?
রাত দশটা হবে তখন কি তার দু-চার মিনিট পরেও হতে পারে।
তাঁকে নেমে আসতে দেখেছিলে?
না। কখন আবার নেমে এসেছেন দেখিনি।
আর সেই বৌটি?
শিখেন্দুদাদাবাবুর উপরে যাবার বোধ হয় আধ ঘণ্টাখানেক পরে।
ঠিক সময়টা তোমার মনে আছে?
আজ্ঞে না। তবে ঐরকমই মনে হয়।
তাঁকে নেমে আসতে আবার দেখেছিলে?
না।
দেখনি?
না।
দাদাবাবু ওপরে যাবার পরেও নেমে আসতে দেখনি?
না।
দাদাবাবু কখন ওপরে গিয়েছিলেন?
ঐ বৌটি ওপরে যাবার কিছু আগেই।
রাত পৌনে এগারোটা—তারও আগে?
ঐ রকমই হবে বোধ হয়, ঠিক আমার মনে নেই।
হুঁ। আচ্ছা গোকুল, যে বৌটি ওপরে গিয়েছিল, তাকে দেখলে চিনতে পারবে?
আজ্ঞে না। মাথায় ঘোমটা ছিল। ওপরে উঠবার সময় পিছন থেকে দেখেছি, ঠিক দেখতে পাইনি।
এ বাড়িতে উৎসবে যোগ দিতে বাবুর আত্মীয়-পরিজন যাঁরা এসেছেন, তাঁদের মধ্যে কেউ কি?
বলতে পারব না, তাঁদের তো আমি সকলকে চিনি না—একমাত্র প্রায়ই আসা-যাওয়া করেন যাঁরা তাঁদের ছাড়া। গতকাল আর আজ তো অনেকেই এসেছেন, গিয়েছেন।
একপাশে দাঁড়িয়েছিল শিবতোষের সরকার ও প্রাইভেট সেক্রেটারী যতীশ সামন্ত।
কিরীটী তার দিকে তাকাল, যতীশবাবু।
কিছু বলছিলেন?
এ-বাড়িতে আত্মীয়-পরিজনদের মধ্যে অল্পবয়সী বৌ অনেক আছেন, তাই না?
সে-রকম কেউ আছেন বলে তো আমি জানি না—যাঁরা সাধারণত এসে থাকেন মধ্যে মধ্যে তাঁদের মধ্যে—তবে আজ তো অনেক আত্মীয়-পরিজনই এসেছিলেন উৎসবে, তাঁদের মধ্যে কেউ হতে পারেন।
কিরীটী যেন কি ভাবছিল, অন্যমনস্কভাবে মৃদু কণ্ঠে বললে, তা অবশ্যই হতে পারে। কিন্তু সে বৌটি যে-ই হোক, সে তিনতলায় গিয়েছিল কেন? তিনতলায় তো যাবার কথা নয় কারো! ঠিক আছে মিঃ মুখার্জী, অ্যাম সরি টু ডিসটাব ইউ, আপনি আপনার কাজ করুন।
বীরেন মুখার্জী মধ্যখানে কিরীটীর প্রশ্নোত্তরে একটু বিরক্তই হয়েছিলেন, কিন্তু মুখে সেটা প্রকাশ করলেন না। আরও কয়েকটা মামুলী প্রশ্ন করে অন্য ভৃত্য রাজেনকে ডেকে দেবার জন্য গোকুলকে বললেন।
গোকুল চলে গেল।
রাজেন একটু পরেই ঘরে এসে ঢুকল।
গোকুলের চেহারাটা মোটাসোটা বেঁটে। একটু গোলগাল এবং রং কালো। রাজেন ঢ্যাঙা, লম্বা, রোগা। শুকনো পাকানো চেহারা। গোকুলের চোখের চাউনি ভাসা-ভাসা, একটু যেন বোকা-বোকা মনে হয় ওকে চোখের দিকে তাকালে, কিন্তু রাজেনের চোখের দৃষ্টিতেই বোঝ যায় লোকটা চালাক-চতুর। গোকুলের মত নিরীহ সরল হাবাগবা নয়।
তোমার নাম রাজেন? বীরেন মুখার্জী প্রশ্ন করলেন।
আজ্ঞে–রাজেন সাধু।
এ বাড়িতে কতদিন কাজ করছ?
তা আজ্ঞে—দশ বছরের কিছু বেশি হবে।
কিরীটী সোফার উপরে বসে পাইপে অগ্নিসংযোগ করে টানতে থাকে।
তুমিও কি সন্ধ্যে থেকে ওপরেই ছিলে?
আজ্ঞে না—আমি নিচের প্যাণ্ডালে ছিলাম। দাদাবাবু আমাকে সেখানেই থাকতে বলেছিলেন।
রাজেন, নিমন্ত্রিত পুরুষ ও মহিলারা কি সব এক প্যাণ্ডালে বসেই খেয়েছেন?
আজ্ঞে না। মেয়েদের জন্য পৃথক ব্যবস্থা ছিল। সামনের দিকের প্যাণ্ডালে পুরুষরা খেয়েছেন, পিছনের প্যাণ্ডালে মেয়েরা।
তুমি কোন্ প্যাণ্ডালে ছিলে?
দুপ্যাণ্ডালেই আমি ছুট ছুটে বেড়িয়েছি দাদাবাবুর সঙ্গে সঙ্গে।
দাদাবাবু তাহলে দুপ্যাণ্ডালেই যাতায়াত করছিলেন?
আজ্ঞে।
ওই সময় কিরীটী পাইপটা হাতে নিয়ে প্রশ্ন করল, রাজেন, তুমি যখন দাদাবাবুর সঙ্গে সঙ্গেই ছিলে, তখন নিশ্চয়ই তোমার মনে আছে কখন দাদাবাবু প্যাণ্ডাল ছেড়ে চলে যান?
বোধ হয় রাত এগারটায়, তাঁর বন্ধুদের শেষ ব্যাচ খেয়ে চলে যাবার পর,–রাজেন বললে।
আর শিখেন্দুদাদাবাবু?
আরও আধঘণ্টা পরে।
শিখেন্দুবাবু তখন কোথায় ছিলেন?
দাদাবাবুর পাশেই।
রাজেন, নীল রঙের দামী শাড়ি পরা কোন অল্পবয়সী বৌকে দেখেছ?
আজ্ঞে অনেকের পরনেই নীল শাড়ি ছিল, আর অল্পবয়সী বৌও অনেক এসেছিল।
তোমার দাদাবাবুর মাথা ধরেছিল জান?
আজ্ঞে না।
তোমার দাদাবাবুর মাথা ধরেছিল বলেই তো শিখেন্দুদাদাবাবু তাঁকে ওপরে চলে যেতে বলেছিলেন!
আমি বলতে পারব না বাবু।
রাত্রি শেষ হয়ে এসেছিল ইতিমধ্যে। জানলাপথে প্রথম ভোরের আলো ঘরে এসে প্রবেশ করে।
বীরেনবাবু, কিরীটী বললে, আমি এবার যাব। আমি ওপরে যাচ্ছি। শিবতোষবাবুকে একবার বলে আসি। কিরীটী উঠে পড়ল।
বীরেন মুখার্জী কোন কথা বললেন না।
সিঁড়ি দিয়ে উঠতে উঠতেই শিখেন্দুর সঙ্গে মুখখামুখি হয়ে গেল কিরীটীর। শিখেন্দু নেমে আসছিল।
আমি আপনার সঙ্গেই দেখা করতে যাচ্ছিলাম শিখেন্দুবাবু। কিরীটী বললে।
আমার সঙ্গে!
হ্যাঁ। কোথাও আমরা বসতে পারি? কিছু কথা ছিল আমার।
কথা?
হ্যাঁ। একটু নিরিবিলি হলেই ভাল হয়। কিরীটী বললে।
নিচে কাকাবাবুর অফিসঘরে আমরা বসতে পারি। আর ওপরের কোন ঘরে যদি বসতে–
না। ওপরে নয়। নিচেই চলুন।
বেশ চলুন। শিখেন্দু বললে।
নিচের তলায় একেবারে দক্ষিণপ্রান্তে শিবতোষের অফিসঘর। কিন্তু দরজাটা আটকানো দেখা গেল।
আপনি এখানে একটু দাঁড়ান কিরীটীবাবু, যতীশবাবুর কাছে বোধ হয় ঘরের চাবি আছে—তাঁকে বলছি ঘরটা খুলে দিতে।
কিরীটী দরজার সামনে দাঁড়িয়ে রইল, শিখেন্দু পালারের দিকে চলে গেল। যতীশ সামন্ত তখনও পালারেই ছিল, শিখেন্দু তাকে ডেকে এনে শিবতোষের অফিসঘরটা খুলিয়ে নিল।
আসুন!
আগে শিখেন্দু, পশ্চাতে কিরীটী অফিসঘরে প্রবেশ করল এবং শিখেন্দু ঘরের আলোটা জ্বালাতে চাইলে, কিরীটী তাকে বাধা দিয়ে বললে, ভোর হয়ে গিয়েছে শিখেন্দুবাবু, ঘরের জানলাগুলো খুলে দিন বা পদগুলো সরিয়ে দিন—আলো জ্বালাতে হবে না।
শিখেন্দু আলো আর না জ্বালিয়ে ঘরের জানলার পর্দাগুলো সরিয়ে দিতেই জানলার কাঁচের সার্শিপথে দিনের আলো এসে ঘরে প্রবেশ করল। দেখা গেল কিরীটীর অনুমান মিথ্যে নয়। ঘরের মাঝখানে বিরাট একটি সেক্রেটারিয়াট টেবিল, গোটা দুই ফোন, কলমদানী, অ্যাশট্রে আর ছোট দামী একটা ফটোর ফ্রেমে এক মহাত্মার ফটো, শিবতোষের গুরুদেব। ঘরের চারপাশে গোটাচারেক স্টিলের আলমারি, দেয়ালে গাঁথা একটি আয়রন-সেফ। টেবিলের উপরে কিছু ফাইল-পত্র রয়েছে।গোটাসাতেকচেয়ার একদিকেছটাচেয়ার ও অন্যদিকে একটি রিভলবিং চেয়ার। বোঝা গেল, শিবতোষ ঐ চেয়ারটাতেই বসেন। ঘরের সংলগ্ন বাথরুম। বাথরুমের দরজা বন্ধ।
বসুন শিখেন্দুবাবু!
শিখেন্দু বসল। কিরীটীও পাশেই একটা চেয়ারে বসল।
পাইপটা কিরীটীর নিভে গিয়েছিল। লাইটারের সাহায্যে পুনরায় পাইপের মাথায় অগ্নিসংযোগ করে মৃদু একটা টান দিয়ে বললে, বুঝতেই পারছেন শিখেন্দুবাবু, ব্যাপারটা র্যাদার ডেলিকেট, তাই একটু নিরিবিলিতে আপনাকে নিয়ে এলুম।
শিখেন্দু কোন জবাব দিল না। ক
য়েকটি প্রশ্ন আপনাকে আমি করতে চাই।
বেশ তো করুন।
কাল রাত্রে ফুলশয্যার ব্যবস্থা তিনতলায় নির্বাণীতোষবাবুর শোবার ঘরেহ য়েছিল দেখলাম—
হ্যাঁ। ও তো তিনতলাতেই থাকত, তাই।
তিনতলায় বুঝি কেউ থাকে না?
পাঁচটা ঘরের তিনটে ঘর খালিই পড়ে থাকে তিনতলায়। দুটো ঘর পাশাপাশি নির্বাণীতোষ ব্যবহার করত বেল।
বৌ বসানো হয়েছিল নিচের সামনে দোতলার একটি ঘরে?
হ্যাঁ।
তার মানে তিনতলায় কারো কোন দরকারই ছিল না যাবার?
কারো বলে কোন কথা নয়, বরাবরই নির্বাণীতোষ তিনতলায় কারো যাওয়া পছন্দ করত। তাই কেউ বড় একটা যেত না।
কেন? পছন্দ করত না কেন?
ও চিরদিনই একটু নির্জনতাপ্রিয় ছিল। গোলমাল হৈচৈ পছন্দ করত না।
তাহলে তো পছন্দ না হবারই কথা। বলেইহঠাৎ যেন প্রশ্নটা করল.কিরীটী, আপনি কাল রাত্রে তিনতলায় কবার গিয়েছিলেন?
আমি—তিনতলায়?
হ্যাঁ।
একবার মাত্র গিয়েছিলাম।
মনে করে দেখুন তো শিখেন্দুবাবু! একবার নয়, অন্ততঃ দুবার নিশ্চয়ই গিয়েছিলেন। কিরীটীর গলার স্বর যেন অদ্ভুত শান্ত, অদ্ভুত নির্লিপ্ত। প্রশ্নটা করে কিরীটী তাকিয়ে থাকে শিখেন্দুর মুখের দিকে।
আমি কাল রাত্রে একবারই গিয়েছিলাম তিনতলায় চিৎকার শোনবার পর, মনে আছে আমার। তার আগে আমি তিনতলায় একবারও যাইনি।
যাননি?
না।
না শিখেন্দুবাবু, মনে পড়ছে না আপনার, আপনি আগেও একবার তিনতলায় গিয়েছিলেন।
গিয়েছিলাম!
হ্যাঁ।
কখন? কে বললে? কেউ বলেছে আপনাকে কথাটা?
কেউ বলেছে বা ওপরে যেতে কেউ আপনাকে দেখেছে কিনা, সেটাও নিছক সত্য-মিথ্যে যাচাইয়ের প্রশ্ন শিখেন্দুবাবু। তার মধ্যে যেতে চাই না। আমি শুধু জিজ্ঞাসা করছি, কখন আপনি ওপরে গিয়েছিলেন?
বলছি তো ওপরে আমি আগে যাই-ই নি। চিৎকার শোনবার পরই গিয়েছিলাম।
রাত সাড়ে নটা নাগাদ একবার যাননি?
না।
নির্বাণীতোষবাবু আপনার অভিন্ন-হৃদয় বন্ধু ছিলেন, সেদিক দিয়ে নিশ্চয়ই আপনি চান তাঁর হত্যাকারী ধরা পড়ুক?
নিশ্চয়ই চাই।
শুধু তাই নয়, দীপিকাও আপনার বান্ধবী—শুধু বন্ধুপত্নীই নয়।
নিশ্চয়ই তাই।
তাহলে তো আমাকে এই নিষ্ঠুর হত্যার তদন্তের ব্যাপারে সাহায্য করা আপনার কেবল কর্তব্যই নয়, আপনার মানবিকতার কাছে সেটা সত্যের একটা দাবিও। কথাগুলো এমন শান্ত গলায় ধীরে ধীরে উচ্চারণ করল কিরীটী যে স্পষ্টতই শিখেন্দুকে একটু যেন বিমূঢ়ই করে দিয়েছে বলে কিরীটীর মনে হল।
শিখেন্দু বললে, আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন আমি বুঝতে পারছি না।
দীপিকা তো আপনার সহপাঠিনী? তাঁর প্রতি কি, ক্ষমা করবেন, কথাটা আপাতত রূঢ় হলেও না বলে পারছি না, কোনদিন আপনার কোন দুর্বলতাই দেখা দেয়নি?
শিখেন্দু এবার মাথা নীচু করল।
জবাব দিন আমার প্রশ্নের শিখেন্দুবাবু? এখানে এই ঘরের মধ্যে আমরা ছাড়া আর তৃতীয় ব্যক্তি কেউ নেই এবং এও আপনাকে কথা দিচ্ছি, কেউ একথা জানবে না, জানতে পারবে না।
শিখেন্দু একেবারে চুপ।
বুঝলাম। জবাব আমি পেলাম।
কিন্তু আপনি বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, দীপিকা আর নির্বাণীতোষ পরস্পরকে ভালবাসে এ-কথা জানতে পারার পর–
আপনাকে আপনি গুটিয়ে নিয়েছিলেন। বন্ধুত্বের দুর্লভ পরিচয়ই দিয়েছেন।
আমি চেয়েছিলাম, ওরা পরস্পর পরস্পরকে যখন ভালবাসে ওরা সুখী হোক। কি
রীটীর মনে হল, শিখেন্দুর গলার স্বরটা যেন বুজে এল।
শিখেন্দুবাবু!
কিরীটীর ডাকে শিখেন্দু ওর দিকে মুখ তুলে তাকাল।
০৪. আর একটা প্রশ্নের জবাব চাই
আর একটা প্রশ্নের জবাব চাই।
কিসের জবাব?
চিৎকার শুনে আপনিই সবার আগে তিনতলায় যান। তাই তো?
এবং বোধ হয় নির্বাণীতোষের শয়নঘরের দরজা খোলা দেখে সোজাই গিয়ে ঘরের মধ্যে ঢুকেছিলেন?
হ্যাঁ।
সেটাই আমার কাছে যেন কেমন আশ্চর্য মনে হচ্ছে—
কেন?
দীপিকা দেবী ঘরে ঢুকেও ঘরের দরজা খুলে রেখে দিয়েছিলেন, সেটা একটু অস্বাভাবিক নয় কি!
এতক্ষণে যেন শিখেন্দুর কাছে কিরীটীর কথার তাৎপর্যটা স্পষ্ট হয়ে ওঠে। সেও বলে ওঠে, সত্যিই তো, ঠিকই তো আপনি বলেছেন কিরীটীবাবু, ঘরের দরজাটা তো খোলা থাকার কথা নয়—
অথচ আপনি খোলাই আছে-দেখেছিলেন?
হ্যাঁ।
যাক সে কথা, তারপর ঘরে ঢুকে আপনি কি দেখেছিলেন?
দীপিকা মেঝের ওপর অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে।
না।
কি বলছেন?
বলছি এই যে, দীপিকাদেবী ঘরের মেঝেতে পড়ে ছিলেন না।
তবে কোথায় ছিল সে? কথাটা বলে কেমন যেন একটু বোকার মতই চেয়ে থাকে শিখেন্দু কিরীটীর মুখের দিকে।
বাথরুমের মধ্যে। সেখান থেকে তাঁর অচৈতন্য দেহটা আপনি বুকে করে তুলে এনে পরে ঘরের মেঝেতে শুইয়ে দিয়েছিলেন, তাই নয় কি?
কিন্তু–
আমি জানি শিখেন্দুবাবু, আমার অনুমান মিথ্যে নয়। আমি যা বললাম সেই রকমই ঘটেছিল।
শিখেন্দু নীরব।
তাহলে মনে হচ্ছে, অবিশ্যি এবারেও আমার অনুমানই দ্বিতীয় অনুমান, দীপিকাদেবী ঘরে ঢুকবার পর দরজা বন্ধ করে দেন ঘরের, কিন্তু নির্বাণীতোষকে ঘরের মধ্যে দেখতে পান না। খুঁজতে খুঁজতেই তখন গিয়ে বাথরুমে ঢোকেন, বাথরুমের আলোটা নেভানো ছিল সম্ভবত, আলোটা জ্বালবার পর তাঁর স্বামীর মৃতদেহটা তাঁর দৃষ্টিতে পড়ে, সঙ্গে সঙ্গে চিৎকার করে তিনি মুহূর্তে জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যান। আর তাই যদি হয় তো ঘরের দরজাটা খুলে দিয়েছিল কে?
কে? প্রতিধ্বনির মতই যেন শিখেন্দু কথাটার পুনরাবৃত্তি করল।
একজনের পক্ষেই সেটা খুলে দেওয়া সম্ভব ছিল—
কে? কার কথা বলছেন?
হত্যাকারী। শান্ত নির্লিপ্ত কণ্ঠে কিরীটী কথাটা যেন উচ্চারণ করল।
হত্যাকারী!
হ্যাঁ, অথচ তাকে আপনি দেখেননি
না।
তাহলে সে কোন্ পথে এ বাড়ি থেকে বের হয়ে গেল? এবং কখন? শুধু তাই নয় শিখেন্দুবাবু, ওই সঙ্গে আরও তিনটে প্রশ্ন আসছে
প্রশ্ন! আরও তিনটে?
তাই-ই। প্রথমত হত্যাকারী তখনও উপরেই ছিল, কিন্তু কেন? কেন সে হত্যা করার পরও চলে গেল না? দ্বিতীয়, হত্যাকারীকে সম্ভবত দীপিকাদেবী দেখেছেন, দেখতে পেয়েছিলেন; কথা হচ্ছে হত্যাকারী দীপিকাদেবীর পরিচিত কেউ, না কোন তৃতীয় অপরিচিত ব্যক্তি? এবং তৃতীয়ত, আকস্মিকভাবে স্বামীর মৃতদেহটা আবিষ্কার করা মাত্রই জিনি চিৎকার করে উঠে অজ্ঞান হয়ে পড়েছিলেন, না হত্যাকারীকে চিনতে পেরেই, চিৎকার করে জ্ঞান হারিয়েছিলেন?
শিখেন্দু যেন একেবারে বোবা। তার মুখে কোন কথাই নেই।
শুনুন শিখেন্দুবাবু, যতদূর আমি বুঝতে পারছি, অবিশ্যি কোন বিশেষ চিকিৎসকই দীপিকাদেবীকে পরীক্ষা করে বলতে পারবেন, বর্তমানে ঘটনার আকস্মিকতায় বা নিষ্ঠুরতায় যাই হোক, তাঁর সম্পূর্ণ স্মৃতি বিলুপ্ত হয়েছে। এবং হত্যাকারীকে খুঁজে বের করতে হলে সর্বাগ্রে ওঁর স্বাভাবিকতা, স্বাভাবিক চেতনা ফিরে আসা একান্ত দরকার এবং আমার মনে হয় সে ব্যাপারে আপনিই সবচাইতে বেশি সাহায্য করতে পারবেন।
আমি?
হ্যাঁ, আপনি।
কিন্তু কেমন করে?
আপনার ভালবাসা দিয়ে, যে ভালবাসা এতকাল ধরে এবং এখনও নিঃশব্দে ফন্তুর মত আপনার মনের মধ্যে বয়ে চলেছে।
না, না–সহসা যেন অস্ফুট চিৎকার করে ওঠে শিখেন্দু, পারব না—আমি পারব না কিরীটীবাবু, ক্ষমা করুন, আপনি যা বলছেন সে আমার দ্বারা হবে না।
হবে। হতেই হবে। নির্বাণীতোষ আপনার বন্ধু, আর ফিরে আসবে না কোনদিনই, কিন্তু একবার দীপিকার কথা ভাবুন তো, এখন না হয় তিনি বেঁচেও মরে আছেন, কিন্তু যখন তাঁর মনের ঐ বর্তমান কুয়াশা কেটে যাবে, তখন তাঁর অবস্থাটা কি হবে! আপনার ভালবাসাই যে আজ তাঁর জীবনের একমাত্র আশা। বাঁচবার একটিমাত্র পথ। আপনার ভালবাসা—আপনার স্নেহ দিয়ে ওঁর ঐ অহল্যার ঘুম আপনাকেই ভাঙাতে হবে। যা হবার তা তো হয়েছেই, কিন্তু ওঁকে জানতে দিন, ও যেন জানতে পারে, পৃথিবীটা আজও ওঁর কাছে শুকিয়ে যায়নি। জীবনের সব কিছু নির্বাণীতোষের সঙ্গে সঙ্গেই নিঃশেষ হয়ে যায়নি। সমস্ত অর্থ মিথ্যে হয়ে যায় নি।
আপনি জানেন না কিরীটীবাবু, দীপু কি গভীরভাবে ভালবাসত নিবুকে। যে মুহূর্তে ও সজ্ঞানে উপলব্ধি করতে পারবে নিবু নেই, ওর কাছে বেঁচে থাকার প্রশ্নটাই মিথ্যে হয়ে যাবে।
কিরীটী শান্ত গলায় প্রত্যুত্তর দিল, না, শিখেন্দুবাবু, যাবে না। মানুষই মানুষকে চরম দুঃখ দেয় আর মানুষই চরম দুঃখকে বুক পেতে নেয়। আর তাই আজও জীবন এত দুঃখ এত বিপর্যয় ও এত আঘাতের পরও মিথ্যে হয়ে যায় নি। আজও মানুষ তাই বাঁচার চেষ্টা করে, পৃথিবীতে তারা বেঁচে আছে, শেষ হয়ে যায়নি। আপনার কাছে তাই আমার অনুরোধ, দীপিকার এতবড় দুর্দিনে আপনি ওঁর কাছ থেকে দূরে সরে থাকবেন না।
শিখেন্দুর দুই চোখের কোল বেয়ে তখন নিঃশব্দে দুটি ধারা তার গণ্ড ও চিবুককে প্লাবিত করে দিচ্ছে।
আমি এবারে উঠব শিখেন্দুবাবু, শিবতোষবাবুকে বলে দেবেন, এ নিষ্ঠুর হত্যারহস্যের মীমাংসা করবার আমি যথাসাধ্য চেষ্টা করব। আর আমার বাড়ির ঠিকানা তো আপনি জানেন, ফোন নম্বরটাও গাইড় থেকে দেখে নেবেন। আমি কিন্তু আপনার পথ চেয়েই থাকলাম।
কিরীটী উঠে ঘরের দরজা ঠেলে বের হয়ে গেল।
পারলারে আর প্রবেশ করল না। সোজা পোর্টিকোতে গিয়ে গাড়িতে উঠে বসে হীরা সিংকে বলল, নিজের কোঠী চল।
বীরেন মুখার্জী তখনও তাঁর জবানবন্দি নেওয়া শেষ করতে পারেন নি।
বাড়ির সকলেরই জবানবন্দি দেওয়া হয়ে গিয়েছিল, সে-সময় তিনি যতীশ সামন্তকে নিয়ে পড়েছিলেন।
কিরীটী ঘর ছেড়ে চলে যাবার পরও অনেকক্ষণ শিখেন্দু চেয়ারটার উপর স্তব্ধ হয়ে বসে রইল।
কিরীটী রায়ের কথাই সে ভাবছিল, কি করে মানুষটা জানতে পারল যে সে-ই বাথরুম থেকে অচৈতন্য দীপিকাকে বুকে করে ঘরের মধ্যে নিয়ে এসেছিল!
মুখে স্বীকার না করলেও কথাটা তো মিথ্যা নয়। সে-ই সর্বপ্রথমে তিনতলায় গিয়েছিল, ঘরের দরজাটা খোলা দেখে ভিতরে গিয়ে ঢোকে সোজা। দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ থাকলে কি করত সে জানে না, তবে খোলা পেয়েও তার মনে ঐ মুহূর্তে কোন প্রশ্নই জাগেনি, কেন দরজাটা খোলা রয়েছে! ঘরে ঢুকে ঘরের মধ্যে কাউকে না দেখতে পেয়ে এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে ওর নজরে পড়ে বাথরুমের দরজাটা খোলা, ভিতরে আলো জ্বলছে।
কোন রকম চিন্তা বা ইতস্তত না করেই সে গিয়ে বাথরুমে ঢুকেছিল। ঢুকেই য়ে দৃশ্যটা তার চোখে পড়ে, নিবণীতোষের ছোরাবিদ্ধ রক্তাক্ত দেহটার পাশেই দীপিকার দেহটা পড়ে আছে অচৈতন্য।
ঘটনার আকস্মিকতায় ও ভয়াবহতায় সে যেন হঠাৎ বিমূঢ় নিশ্চল হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটু পরেই তার স্বাভাবিক বিচারবুদ্ধি ফিরে আসে, তখন সে প্রথমে নির্বাণীতোষকে পরীক্ষা করে, সে মৃত দেখে তার পর পরীক্ষা করে দীপিকাকে। সে জ্ঞান হারিয়েছে।
কয়েকটা মুহূর্ত অতঃপর সে ভেবে পায় না কি করবে। তারপর নীচু হয়ে গভীর মমতায় দীপিকার অচৈতন্য শিথিল দেহটা বুকের উপর তুলে নিয়ে শোবার ঘরে এসে ঢোকে। সেই সময়ই সিঁড়িতে পায়ের শব্দ পায়, তাড়াতাড়ি তখন সে দীপিকার অচৈতন্য দেহটা মেঝেতেই নামিয়ে দেয়, আর ঠিক সেই মুহূর্তেই শিবতোষবাবু এসে ঘরে প্রবেশ করেন এবং জিজ্ঞাসা করলেন, কি ব্যাপার, বৌমা….
একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল শিখেন্দু প্রথমটায়, কিন্তু পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিয়ে বলেছিল, বুঝতে পারছি না কিছু কাকাবাবু, ঘরে ঢুকে দেখি দীপিকা পড়ে আছে।
কিন্তু কিরীটীবাবু সত্যটা অনুমান করলেন কি করে? আগের একটা কথা যা কিরীটীবাবু বলে গেলেন, নির্বাণীতোষের শয়নঘরের দরজাটা খোলা ছিল কেন? সত্যিই তো, কেন খোলা ছিল? স্বাভাবিকভাবে তো বন্ধ থাকারই কথা। তবে কি ক্লান্ত দীপিকা দরজাটা ঘরে ঢুকবার পর তাড়াতাড়িতে বা অন্যমনস্কতায় ভিতর থেকে লক্ করতে ভুলে গিয়েছিল! না, সেই সময়ই সন্দেহজনক কিছু তার চোখে পড়ায় বা শব্দ শোনায় সে দরজাটা লক্ করবার কথা ভাববারও সময় পায়নি!
কিন্তু এ সবই তো গেল যুক্তিতর্কের কথা। হত্যা রহস্যের মীমাংসার ব্যাপারে যুক্তিতর্কের কথা—স্বভাবতই যাকিরীটীবাবুর মত তীক্ষ্ণবুদ্ধি লোকের মনে উদয় হয়েছে, হওয়াটা স্বাভাবিক।
হত্যাকারী কে?
কে হত্যা করল নির্বাণীতোষকে? আর কেনই বা হত্যা করল? নির্বাণী চিরদিনই সাদাসিধে সরল প্রকৃতির মানুষ, কারও সঙ্গে কখনও মনোমালিন্য হয়নি, ঝগড়া বিবাদও করেনি। সবাই তাকে বরাবরই ভালবেসেছে। তবে তাকে এইভাবে হত্যা করল কেন?
সকাল হয়ে গিয়েছে, প্রায় সাড়ে ছটা বাজল।
অফিসঘর থেকে বেরুতেই যতীশ সামন্ত সামনে এসে দাঁড়াল, শিখেন্দুবাবু!
বলুন।
দারোগাবাবু আপনাকে একবার ডাকছেন।
কেন?
বোধ হয় আপনার জবানবন্দি নেবেন।
চলুন।
আপনি যান, কর্তাবাবু ডাকছেন, আমি একবার ওপরে যাব। সামন্ত বললে।
কাকাবাবুকে বলে দেবেন কিরীটীবাবু চলে গেছেন।
আচ্ছা।
শিখেন্দু এগিয়ে গিয়ে পারলারে প্রবেশ করল।
শিখেন্দুকে ঘরে প্রবেশ করতে দেখে বীরেন মুখার্জী মুখ তুলে তাকালেন, আসুন শিখেন্দুবাবু, বসুন।
শিখেন্দু বসল।
বীরেন মুখার্জী প্রশ্ন করলেন, আপনি আর শিবতোষবাবুই মৃতদেহ প্রথমে আবিষ্কার করেন?
হ্যাঁ।
এঁদের মানে শিবতোষবাবুর ফ্যামিলির সঙ্গে আপনার দীর্ঘদিনের পরিচয়,তাই না?
হ্যাঁ, আমি ওঁর বন্ধুর ছেলে।
আচ্ছা, আপনি তো নির্বাণীতোষবাবুর সহপাঠী ছিলেন, তাঁর কোন শত্রু ছিল বলে জানেন?
না।
কখনও কারও সঙ্গে মনোমালিন্য, ঝগড়াঝাঁটি বা মারামারি হয়নি তাঁর?
না।
তবে যে কেন লোকটাকে অমন ক্রুয়েলি হত্যা করা হল বুঝতে পারছি না! কাউকে আপনার এ ব্যাপারে সন্দেহও হয় না?
না।
ব্যাপারটা দেখছি যেমন স্যাড তেমনি জটিল। তারপর একটু থেমে বললেন বীরেন মুখার্জী, মসেস মল্লিক তো কোন প্রশ্নের জবাবই দিলেন না আর দীপিকাদেবী তো মনে হচ্ছে প্রচণ্ড শোকে মেমারিই হারিয়েছেন! ঠিক আছে ওঁরা সুস্থ হয়ে উঠুন, তারপর এক সময় মাসা যাবে। বিশেষ করে দীপিকাদেবীকে আমি কয়েকটা প্রশ্ন করতে চাই। এখন তাহলে মামি উঠব।
একটা অনুরোধ আছে আপনার কাছে মিঃ মুখার্জী। শিখেন্দু বললে।
বলুন?
সংবাদপত্রে যেন ব্যাপারটা না ছাপা হয়। বুঝতেই পারছেন এত বড় একটা ফ্যামিলির প্রেসটিজ
না না—আমরা কিছু বলব না। কিন্তু পাড়াপড়শীরা তো আছে, সংবাদপত্রের নিউজরিপোর্টারদের কি আর কিছু জানতে বাকি থাকবে!
আর একটা কথা—
বলুন?
ডেড বডি কখন পেতে পারি?
বুঝতেই পারছেন তো, ব্যাপারটা মাডার কেস-তদন্ত না হলে তো পাবেন না দেহ। একটু পরেই এসে ডেড বডি নিয়ে যাবে। তবে চেষ্টা করব আজই যাতে পান। শিবতোষবাবুর সঙ্গে তো ডি.সি.-র পরিচয় আছে, তাঁকেই একবার বলতে বলুন না ওঁকে ফোনে। আচ্ছা চলি।
শিখেন্দুরও নিজেকে অতিশয় ক্লান্ত লাগছিল।
সারাটা রাত চোখের পাতা এক করতে পারেনি, চোখ দুটো জ্বালা করছিল, ঘর থেকে বেরুতেই রাজেনের সঙ্গে দেখা হল।
রাজেন, আমি একবার মেসে যাচ্ছি, ঘণ্টা-দেড়েকের মধ্যেই ফিরব–কেউ খোঁজ করলে বোলো।
যে আজ্ঞে।
বড় রাস্তায় আসতেই একটা খালি ট্যাক্সি পেয়ে গেল শিখেন্দু। ট্যাক্সিতে উঠে বসে বললে, শিয়ালদার দিকে চলিয়ে সদারজী।
কলেজের কাছাকাছিই সারকুলার রোডের ওপরে একটা মেসেছাত্রজীবন কাটিয়েছে শিখেন্দু। কলেজ-হোস্টেলে কখনও সে থাকেনি। পাশ করার পরও ঐখানেই রয়ে গিয়েছে।
ওরা তিনজনই নীলরতন সরকার মেডিকেল কলেজের ছাত্র।
নির্বাণীতোষ বরাবর বাড়িথেকেই পড়াশুনা করেছে। দীপিকাথেকেছেকলেজেরকম্পাউণ্ডের মধ্যে, লেডিজ হোস্টেলে।
দিন পনের হল তার বাবা বিয়ের ব্যাপারে সপরিবারে দিল্লী থেকে এসে বালিগঞ্জ অঞ্চলেই বাড়ি ভাড়া করে আছেন, ইদানীং দীপিকা সেখানেই ছিল।
হোস্টেলে পাশাপাশি দুটো ঘরে ওরা চারজন থাকে; ও আর সঞ্জীব একটা ঘরে, পাশের ঘরে নির্মল ও পরেশ।
ঘরে ঢুকে দেখে জানলাপথে রোদ এসে পড়েছে, সঞ্জীব তখনও শয্যায় শুয়ে ঘুমোচ্ছে। পাশবালিশটা জড়িয়ে।
সঞ্জীব—এই সঞ্জীব!
শিখেন্দুর ডাকে সঞ্জীব চোখ মেলে তাকাল, কে?
ওহ—ওহ—
বিরক্ত করিস না শিখেন্দু, একটু ঘুমোতে দে। সঞ্জীব আবার চোখ বুজলে।
এদিকে খবর শুনেছিস?
পরে শুনব, সঞ্জীব ঘুম-জড়ানো গলায় কথাটা বলে আবার ঘুমোবার চেষ্টা করে।
ওঠ–শোন্-নির্বাণী মারা গেছে, এই–
সঙ্গে সঙ্গে যেন লাফিয়ে উঠে বসল শয্যার উপরে সঞ্জীব, অ্যাঁ! কি বললি? কে মারা গেছে?
নির্বাণী মারা গেছে, নির্বাণীতোষ মল্লিক।
কি যা-তা জোক্ করছিস এই সকালবেলা! সঞ্জীব বললে।
জোক নয়, সত্যি—হি হ্যাজ বিন ব্লুটালি মাডারড, সঞ্জীব।
মার্ডারড! সঞ্জীব কথাটি বলে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে থাকে যেন শিখেন্দুর মুখের দিকে।
হ্যাঁ।
সত্যি–সত্যি বলছিস শিখেন্দু? সঞ্জীব যেন কথাটা তখনও বিশ্বাসই করতে পারছে না।
শিখেন্দু তার খাটের ওপর বসে সঞ্জীবের মুখের দিকেই চেয়ে থাকে। সঞ্জীব চিরকালই পাতলা, বোগা। গায়ের রংটা যেমন টকটকে ফর্সা, মুখখানিও তেমনি সুন্দর, যেন একটা মেয়েলী ছাপ আছে মুখে। পরনে লুঙ্গি, গায়ে একটা গেঞ্জি। চোখেমুখে প্রসাধনের চিহ্ন, ঠোঁটে লিপস্টিকের রক্তিমাভা।
কাল তুই বৌভাতের নিমন্ত্রণে যাসনি? শিখেন্দু জিজ্ঞাসা করল।
কখন যাব! থিয়েটারই তো শেষ হল রাত সাড়ে বারোটায়! বলেই তো ছিলাম, কাল আমাদের পাড়ার ক্লাবে থিয়েটার আছে। বহ্নিশিখা নাটকে আমাকে কল্যাণীর রোল করতে হয়েছে।
পাড়ার ক্লাব মানে পাইকপাড়ায় ওরা দীর্ঘদিন ধরে আছে, মানে ওর বাবা রাধিকা বসু মশাই। ঐ পাড়াতেই সঞ্জীবের জন্ম, পাড়ার ক্লাবের থিয়েটারে ও বরাবর ফিমেল রোল করে এসেছে। মানায়ও ওকে ফিমেল রোলে চমৎকার এবং অভিনয়ও করে খুব ভাল।
সঞ্জীব বলল, অত রাত্রে কেউ কোথাও নিমন্ত্রণ খেতে যায়! তাছাড়া ভীষণ টায়ার্ড লাগছিল, ফিরে এসে দেখ না মুখের মেকআপও ভাল করে তুলতে পারিনি, কোনমতে একটু মেকআপ তুলেই শুয়ে পড়েছি। কিন্তু এইমাত্র তুই যা বললি তা সত্যি!
হ্যাঁ, আমাকে এখুনি আবার স্নান করে বেরুতে হবে। দীপা একেবারে বোবা হয়ে গিয়েছে, বোধ হয় স্মৃতিভ্রংশ হয়েছে।
হবেই তো, বেচারী! হাউ স্যাড, ফুলশয্যার রাত্রেই!
কি করে মেরেছে বেচারীকে জানিস সঞ্জীব!
কি করে?
একটা ছোরা একেবারে পিঠের বাঁ দিকে আমূল বসিয়ে দিয়েছে।
বলিস কি! কি করে মারল, বাড়িভর্তি লোক ছিল—কে মারল কেউ কিছু জানতেই পারল না!
শিখেন্দু সংক্ষেপে তখন সমস্ত ঘটনাটা বলে গেল।
সঞ্জীব যেন একেবারে হতবাক। বললে, সত্যি আমি যেন এখনও ভাবতেই পারছি না ব্যাপারটা শিখেন্দু।
কেবল তুই কেন, কেউই আমরা ভাবতে পারছি না! নির্মল কোথায়? নির্মলকে ডাক—
সঞ্জীব নির্মলকে নাম ধরে ডাকতেই সে পাশের ঘর থেকে এসে এদের ঘরে ঢুকল। গালে শেভিং ক্রিম লাগান, হাতে সেফটি রেজার, অর্ধেক কামাতে কামাতেই ওদের ডাকে ঘরে এসে ঢুকল, কি ব্যাপার? শিখেন্দু কখন ফিরলি?
নির্বাণীতোষ খুন হয়েছে কাল রাত্রে, জানিস? শিখেন্দু বললে আবার।
খুন হয়েছে—নির্বাণী? কি কি বলছিস তুই শিখেন্দু?
এবারে সঞ্জীবই ব্যাপারটা বললে নির্মলকে।
তুই কাল রাত্রে কখন নির্বাণীদের বাড়ি থেকে চলে এসেছিলি? শিখেই প্রশ্নটা করল।
আ—আমি তো—মানে আমি তো বোধ হয় দশটার পরই চলে এসেছি, তখন তো নির্বাণী প্যাণ্ডেলেই ছিল। নির্মল বলল।
হ্যাঁ, নির্বাণী আগাগোড়াই প্যাণ্ডেলে ছিল। রাত পৌনে এগারটা নাগাদ আমাকে বলল তার বড় মাথা ধরেছে। তাই আমি বললাম, আমাদের বন্ধু বান্ধবরা তো সবাই এসে গেছে, এক সঞ্জীব বাকি; সে এলে আমি খাইয়ে দেবখন, তুই যা, ওপরে চলে যা, শিখেন্দু বলল।
তারপর? সঞ্জীব শুধাল।
নির্বাণী ওপরে চলে যায়।
তারপর?
আর পৌনে বারোটা নাগাদ দীপা ওপরে গিয়েছিল, তারপরেই ব্যাপারটা জানা গেল! শিখেন্দু বলল।
ওঃ! নির্মল বলল।
তাহলে মনে হচ্ছে পৌনে এগারটা থেকে রাত পৌনে বারোটা, ঐ একঘন্টা সময়ের মধ্যেই কোন এক সময় নির্বাণীকে কেউ খুন করে গিয়েছে। সঞ্জীব বলল।
ইতিমধ্যে পরেশও এসে ঘরে ঢুকেছিল এবং সব শুনেছিল, ওরা তিনজন কেউ লক্ষ্য করেনি; হঠাৎ ঐ সময় পরেশ বলল, নির্মল তো অনেক রাত্রে ফিরেছিস, রাত বোধ হয়। তখন সাড়ে বারোটারও বেশী হবে, আমি পৌনে বারোটায় প্রায় শুয়েছি, কিন্তু ঘুমোই নি। দশটার পরই যদি তুই নির্বাণীদের বাড়ি থেকে চলে এসে থাকিস তো তোর ফিরতে এত দেরি হল কেন রে?
বাসে যা ভিড়! নির্মল বলল।
অত রাত্রে বাসে ভিড়! পরেশ কথাটা বলে নির্মলের মুখের দিকে তাকাল এবং বলল, দেখ বাবা, চালাকি করো না, অতক্ষণ কোথায় ছিলে বল।
০৫. পরেশ চিরদিনই ডিটেকটিভ বইয়ের পোকা
পরেশ চিরদিনই ডিটেকটিভ বইয়ের পোকা। ইংরাজী বাংলা কোন ডিটেকটিভ বই-ই সে বাদ দেয় না এবং সুযোগ পেলেই ডিটেকটিভগিরি করে।
নির্মল কিন্তু চটে যায়। বললে, কি ইয়ার্কি হচ্ছে, এমন একটা সিরিয়াস ব্যাপার–
সেইজন্যই তো সিরিয়াসলি আমি প্রশ্নটা করেছি। পরেশ গম্ভীর হয়ে বলে।
শিখেন্দু এবারে বললে, নিবার্ণীর বাবা কিরীটী রায়কে ডেকেছেন তদন্ত করবার জন্য।
বলিস কি! পরেশ বললে।
হ্যাঁ, মনে হচ্ছে যেভাবেই হোক তিনি জানবেনই কে তাঁর ছেলেকে অমন করে খুন করে গেল।
ও আর দেখতে হবে না শিখেন্দু, কিরীটী রায়ের যখন আবির্ভাব ঘটেছে, আততায়ীর আর নিস্তার নেই। ইস, কাল রাত্রে অমন একটা ব্যাপার ঘটবে যদি জানতাম, তাহলে এত তাড়াতাড়ি নেমন্তন্ন খেয়ে ওখান থেকে চলে আসি!
শিখেন্দু উঠে পড়ল, স্নান সেরেই তাকে বেরুতে হবে। জামা কাপড় খুলে মাথায় তেল মেখে তোয়ালেটা কাঁধে ফেলে শিখেন্দু একতলার দিকে চলে গেল।
নির্মল আর সঞ্জীব দুজনই চুপচাপ বসে। কারও মুখে কোন কথা নেই।
পরেশ একবার ওদের মুখের দিকে তাকাল, তারপর পকেট থেকে চারমিনারের প্যাকেটটা। বের করে একটা সিগারেট ধরালো নিঃশব্দে।
সিগারেটে গোটা-দুই টান দিয়ে পরেশ বললে, ব্যাপারটা তোদের কি মনে হয় সঞ্জীব, নির্মল?
ওরা দুজনেই যুগপৎ পরেশের মুখের দিকে তাকাল। কেউ কোন কথা বললে না।
পরেশ আবার বললে, নির্বাণীকে কে অমন করে খুন করতে পারে বলে মনে হয় তোদের?
নির্মল ক্ষীণ গলায় বললে, কি করে বলব?
দেখ বাবা, সত্যি কথা বলি, আমরা সবাই অথাৎ তুই নির্মল সঞ্জীব শিখেন্দু আমি শ্রীমান পরেশ ইন্টারেসটেড পার্টি ছিলাম
মানে! নির্মল বললে।
মানে, সবাই আমরা মনে মনে চেয়েছি দীপাকে, কিন্তু মাঝখান থেকে দীপা হয়ে গেল নির্বাণীর। দীপা নির্বাণীর গলাতেই শেষ পর্যন্ত মালা দিল।
নির্মল চেচিয়ে ওঠে, হোয়াট ননসেন্স! বোকার মত কি সব যা-তা বলছিস পরেশ!
বোকা নয় বন্ধু। গোপন প্রেম, প্রেম থেকেই লালসা, লালসা থেকেই হিংসা এবং হিংসা থেকেই আক্রোশ ও তার পরিণতি হত্যা, দীপাকে না পাওয়ার জন্য–
তুই থামবি পরেশ! নির্মল আবার খিঁচিয়ে ওঠে।
আমি থামলেও কিরীটী রায় থামবে না বন্ধু। পরেশ বললে।
সঞ্জীব বললে, এমন একটা সিরিয়াস মুহূর্তে তোর ওই সব ভণ্ডামি আমার একটুও ভাল লাগছে না পরেশ, সত্যি!
কিন্তু তবু এটা সত্যি সঞ্জীব, তুই আমি নির্মল শিখে সবাই নির্বাণীর মত দীপাকে মনে মনে কামনা করেছি। দোষ নেই অবিশ্যি তাতে। একটি সুন্দরী আকর্ষণীয়া তরুণীর প্রতি আমাদের মত তরুণদের আকর্ষণ জাগাটা এমন কিছু দোষের নয়, র্যাদার ন্যাচারাল। তাছাড়া আমার কথাটা যে মিথ্যে নয়, সেটা নিশ্চয়ই তোমরা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
সঞ্জীব বললে, তার মানে পরেশ তুই কি বলতে চাস! সঞ্জীবের গলার স্বরটা যেন একটু কেঁপে গেল।
বলতে চাই যা একটু আগেই তা তোদের বললাম।
ঐ সময় শিখেন্দু তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে ঘরে পুনরায় প্রবেশ করে বললে, কি বললি রে পরেশ!
বলছিলাম, পরেশ বললে, তুই আমি নির্মল সঞ্জীব আমরা এই চারজনের মধ্যে—
কি? হাতে চিরুনিটা নিয়ে পরেশের মুখের দিকে তাকাল শিখেন্দু।
যে কেউ একজন, পরেশ বললে, কাল রাত্রে নির্বাণীকে হত্যা করতে পারি।
হাতের চিরুনি থেমে যায় শিখেন্দুর, সে যেন বজ্রাহত, পরেশের মুখের দিকে তাকিয়ে ক্ষীণ বোজা গলায় প্রশ্ন করলে, আমরাই কেউ কাল রাত্রে নির্বাণীকে হত্যা করেছি?
করেছি তা তো আমি বলিনি শিখেন্দু, তবে করতে পারতাম।
তোর কি মাথা খারাপ হয়েছে! শিখেন্দু বললে।
মাথা আদৌ খারাপ হয়নি, আমরা সকলেই মনে মনে দীপাকে চেয়েছি, নির্বাণীও চেয়েছিল এবং শেষ পর্যন্ত সে-ই পেল দীপাকে—তাতে করে নির্বাণীর ওপরে একটা আক্রোশ আমাদের হওয়া স্বাভাবিক, যে আক্রোশের বশে হত্যাও করা যায়।
শিখেন্দু চুপ। একেবারে যেন বোবা।
হাতের চিরুনি হাতেই ধরা আছে তখন তার, সে ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে আছে পরেশের মুখের দিকে, পরেশ যেন হিংস্র নখর দিয়ে ওদের প্রত্যেকের মনের উপর থেকে একটা পদা ছিড়ে ওদের প্রত্যেককে নিজেদের মুখখামুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
পরেশ বলতে থাকে, দেখ, একমাত্র সঞ্জীব ছাড়া আমরা সকলেই কাল রাত্রে উৎসবে উপস্থিত ছিলাম। আমরা সকলেই ছিলাম নির্বাণীর বন্ধু, কাজেই আমাদের দ্বার ঐ বাড়িতে অবারিত ছিল। আমরা যদি ইচ্ছা করতাম, অনায়াসেই আমরা যে কেউ একজন আমাদের মধ্যে কোন এক ফাঁকে তিনতলায় গিয়ে বাথরুমের মধ্যে সুযোগর অপেক্ষায় আত্মগোপন করে থাকতে পারতাম।
তারপর? ক্ষীণ গলায় বলে উঠল সঞ্জীব ও শিখেন্দু।
তারপর কাজ শেষ করে, অনায়াসেই বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে পারতাম।
কিন্তু–, শিখেন্দু বললে, গোকুল দোতলার বারান্দায় ছিল, তিনতলায় কাল রাত্রে যে যে গিয়েছে সে বলেছে।
কারো পক্ষেই এটা সম্ভব নয় বন্ধু, সর্বক্ষণ সিঁড়ির দিকে নজর রাখা। আর এও সম্ভব নয়, র্যাদার অ্যাবসার্ডভাবো যে গোকুল সর্বক্ষণই তিনতলার সিঁড়ির দিকে চেয়ে ছিল! যেতে আসতে প্রত্যেককেই দেখেছে!
কিন্তু সঞ্জীব তো কাল উৎসব-বাড়িতে যায়ইনি।
শিখেন্দু বললে, তবে তাকে কি করে সন্দেহ করা যেতে পারে?
যায়নি সেটা সঞ্জীব বলেছে।
সঞ্জীব ঐ সময় বললে, আমি কি মিথ্যা বলেছি?
মিথ্যা তুমি বলেছ কি না বলেছ সেটাও প্রমাণসাপেক্ষ।
তার মানে? সঞ্জীব বেশ যেন একটু বিরক্তই হয়েছে মনে হল। আমি তো রাত্রে সে-সময় থিয়েটার করছিলাম।
কিরীটীবাবু শুনলে হয়ত বলবেন, ওটা তোমারমানে, তোমার ঐ সময়ে অনুপস্থিতিটার স্রেফ একটা অ্যালিবি, মানে
দেখ পরেশ, তোর ডিটেকটিভ বই পড়ে পড়ে মাথাটাই দেখছি বিগড়ে গেছে। নির্মল বললে, এই ধরনের সব লুজ টকস্ সময়বিশেষে কত সাংঘাতিক মারাত্মক হয়ে উঠতে পারে জানিস!
সে তুই যাই বল্ নির্মল, সন্দেহের তালিকা থেকে আমরা তিনজন—বিশেষ করে নির্বাণীর বন্ধুদের মধ্যে বাদ পড়ব না।
ইডিয়ট! নির্মল বললে।
পরেশ কিন্তু নির্মলের গালাগালিটা গায়ে মাখে না। হাসতে থাকে।
মেসের ভৃত্য চরণ এসে ঘরে ঢুকল, আমাকে ডাকছিলেন শিখেন্দুবাবু?
হ্যাঁ, সামনের রু হটার কেবিন থেকে গরম দুটো টোস্ট আর এক কাপ চা নিয়ে এসো তো চরণ।
ঐ সঙ্গে আমার জন্যও এক কাপ চরণদাস, সঞ্জীব বললে।
চরণদাস ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
ঘরের আবহাওয়াটা যেন হঠাৎ কেমন থমথমে হয়ে গিয়েছে। কারও মুখেই কোন কথা নেই। এমন কি পরেশও যেন চুপচাপ।
আসলে পরেশের কথাগুলো যেন কেউই একেবারে উড়িয়ে দিতে পারছে না, মন থেকে একেবারে মুছে ফেলতে পারছে না।
সকলের মনের উপরেই যেন একটা কালো সন্দেহের ছায়া ফেলেছে। ছায়াটা কালে-কালো। শিখেন্দুর একটা কথা মনে পড়ল, কিরীটী তখন বারবার প্রশ্ন করেছিল, একবার নয় দুবার, সে গত রাত্রে তিনতলায় গিয়েছিল কিনা? সত্যিই সে যায়নি, তবে কিরীটীবাবু কেন ঐ প্রশ্নটা বার বার করেছিলেন। তবে কি পরেশের কথাই ঠিক!
কিরীটীবাবু তাকেও সন্দেহ করছেন।
শিখেন্দুর ভিতরটা যেন সহসা ঠাণ্ডা হিম হয়ে আসে। একটা অজ্ঞাত ভয় যেন তার মনের ওপর চেপে বসে। সে তার বন্ধুকে হত্যা করতে পারে ভাবতে পারলেন কি করে কিরীটীবাবু!
হ্যাঁ, দীপাকে সে ভালবেসেছিল, কিন্তু যে মুহূর্তে সে বুঝতে পেরেছিল নির্বাণী দীপাকে চায় এবং দীপাও নির্বাণীকে চায় সে তো সরে এসেছিল ওদের মধ্যে থেকে। খুশি মনেই সে বিয়ের উৎসবে যোগ দিয়েছিল।
পরেশই স্তব্ধতা ভঙ্গ করল, বেচারী নির্বাণীতোষ! প্রেমের পূজোয় একেবারে নির্বাণলাভ করে বসে রইল।
নির্মল চেঁচিয়ে ওঠে হঠাৎ অস্বাভাবিক গলায়, তুই থামবি পরেশ!
পরেশ বলল, একটা সিগারেট দে, গলাটা শুকিয়ে উঠেছে, একটু ধোঁয়া দেওয়া দরকার।
গলায় নয়, তোর মনে আগুন দেওয়া দরকার। নির্মল বললে।
সে সকলেরই একদিন দিতে হবে। পরেশ নির্বিকার কণ্ঠে বললে।
০৬. শিবতোষ মল্লিকের বেলতলার গৃহে
শিবতোষ মল্লিকের বেলতলার গৃহে যে রাত্রে দুর্ঘটনাটা ঘটে তার দিন দুই পরে।
অথাৎ রবিবার রাত্রে দুর্ঘটনাটা ঘটেছিল, মঙ্গলবার সন্ধ্যার কিছু পরে জগদ্দল মিল ওয়াকার্সদের ঘিঞ্জি পাশাপাশি কোয়াটার্সগুলোর মধ্যে পনের ঘরের কোয়াটারটা খুঁজতে খুঁজতে একসময় এসে যখন পনের নম্বরের সামনে কিরীটী দাঁড়াল, ধোঁয়ায় ও সন্ধ্যার অন্ধকারে তখন সেখানে যেন শ্বাসরোধ হবার যোগাড়।
হাত দুই আড়াই প্রস্থে হবে খোয়া-বিছানো কাঁচা রাস্তা এবং রাস্তায় যে আলোর ব্যবস্থা আছে তা এত অপ্রতুল যে চট করে কোন কিছু নজরেই আসে না। ভাগ্যিস একজন ওয়াকার পনের নম্বর কোয়াটারটা দেখিয়ে দিয়েছিল—ঠিক দেখিয়েও নয়, বলে দিয়েছিল, রাস্তাটা যেখানে শেষ হয়েছে, একটা পোড়ো জমি, তারই সামনে একটা নিম গাছ, সেই নিম গাছের কাছেই শেষ কোয়াটারটাই পনের নম্বর কোয়ার্টার, আশুর। অথাৎ আশু মল্লিকের।
বিয়ে-থা করেনি লোকটা। দুটো ছোট ঘোট ঘর নিয়ে একাই থাকে আশু মল্লিক, সে-ই বলেছিল। যে লোকটি খোঁজ দিয়েছিল আশু মল্লিকের, বিনোদ দস্তিদারতার কাছেই মোটামুটি আশু সম্পর্কে জানতে পেরেছিল কথায় কথায় কিরীটী।
লেবার ইউনিয়নের আশু মল্লিক একজন কর্তাব্যক্তি। লোকটার গায়েও যেমন শক্তি তেমনি দুর্দান্ত সাহস। মারপিট করতে ওস্তাদ। তবে হ্যাঁ, নোকটার দিল আছে। ইউনিয়নের জন্য প্রাণ পর্যন্ত দিতে পারে। মিলের কর্তাব্যক্তিরা ও বাবুরা সবাই তাকে ভয় করে রীতিমত। রাস্তার পাশেই কাঁচা ড্রেনটা থেকে দুর্গন্ধ ছড়াচ্ছে, তারই কিছু দূরে একটা বারোয়ারী জলের কল, সেখান থেকেই সবাই জল নেয়।
বাড়ির দরজাটা বন্ধ থাকলেও খোলা জানলাপথে কিরীটীর নজরে পড়ে, ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে।
কিরীটী বেশ উঁচু গলাতেই ডাকল, আশুবাবু আছেন–? আশুবাবু!
বার-দুই ডাকতেই সাড়া এল, কে?
একবার বাইরে আসবেন?
আসছি,–বলতে বলতেই প্রায় দরজা খুলে গেল। ঘরের মধ্যে আলো জ্বলছে খোলা দরজাপথে প্যান্ট ও শার্ট পরিহিত লম্বা-চওড়া এক ব্যক্তি এসে দাঁড়াল, কে?
আশুবাবু আছেন? আশুতোষ মল্লিক? এটা কি তাঁরই কোয়াটার?
আপনি কে?
আপনিই কি আশুবাবু?
হ্যাঁ।
আমাকে আপনি চিনবেন না। আপনার সঙ্গে আমার একটু দরকার ছিল।
কি দরকার, কোথা থেকে আসছেন? দরজার উপর দাঁড়িয়েই প্রশ্ন করল আশু মল্লিক।
আপনি তো নাম বললে বা কোথা থেকে আসছি বললেও আমাকে চিনবেন না!
আসুন।
কিরীটী ভিতরে প্রবেশ করল।
ওয়াকার্সদের ছোট ছোট কোয়াটার, তবে ইলেকট্রিক আলোর ব্যবস্থা আছে। ছোট ছোট দুটো ঘর পাশাপাশি। মধ্যখানে যাতায়াতের দরজা এক ঘর থেকে অন্য ঘরে।
ঘরের মধ্যে একটা চৌকি পাতা, খান-দুই বেতের চেয়ারও আছে। দেওয়ালে একটা ক্যালেণ্ডার ও একটি মহিলার এনলার্জ করা ফটো।
এক কোণে ছোট একটা কাঁচের আলমারিতে কিছু বই আছে।
বসুন।
কিরীটী একটা চেয়ারে বসল। বসে আশুতোষের দিকে তাকাল। দস্তিদার আশুর যেমন বর্ণনা দিয়েছিল ঠিক তেমনিই দেখতে আশুতোষ।
বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা, গায়ের রংটা ফসাই, একটু যেন বেশীই ফসা। বোধ হয় তার মার গায়ের রংই পেয়েছে ছেলে।
পরনে মিলেরই প্যান্ট ও শার্ট, বোধ হয় ফিরে এসে তখনও জামা কাপড় বদলাবারও সময় পায় নি। শিবতোষের গায়ের বর্ণ বেশ কালোই বলতে হবে, কিন্তু আশুর মুখের গঠন, চোখ মুখ নাক চোয়াল ঠিক যেন তার বাপেরই মত।
কোথা থেকে আসছেন? কি নাম আপনার-আমার কাছে কি প্রয়োজন বলুন তো?
কিরীটী হেসে ফেললে, আমি কোন খারাপ উদ্দেশ্য নিয়ে আসিনি আশুবাবু। আমার নাম কিরীটী রায়। কলকাতা থেকে আসছি।
কলকাতা থেকে–তা আমার কাছে কি প্রয়োজন বলুন তো? চিনলাম না আপনাকে—
আপনি শিবতোষ মল্লিকের—
কিরীটীকে তার কথা শেষ করতে দিল না আশু, রুক্ষ কণ্ঠে প্রতিবাদ করে বলে উঠল, কে শিবতোষ মল্লিক আমি চিনি না, তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই। আপনি আসতে পারেন। গলার স্বরে রুক্ষতা ও রীতিমত বিরক্তিই যেন ঝরে পড়ল।
শিবতোষ মল্লিকের প্রথম পক্ষের সন্তান আপনি। আপনি সেটা স্বীকার না করলেও লোকে তাই বলবে।
লোকে কাকে কি বলল না বলল তা নিয়ে আমার এতটুকু মাথাব্যথা নেই মশাই। আমি জানি সে আমার কেউ নয়, তার সঙ্গে আমার কোন সম্পর্কই নেই। বলুন তো সত্যিই কি জন্য আমার কাছে আপনি এসেছেন?
আমি জানি আশুবাবু, আপনার স্বর্গীয়া জননীর প্রতি অবিচার এবং অত্যাচার হয়েছে—
অবিচার! অত্যাচার! কোন ভদ্রলোক যে কোন ভদ্রমহিলার সঙ্গে, বিশেষ করে যিনি সে-বাড়ির বধূ—অমন জঘন্য কুৎসিত ব্যবহার করতে পারে, যা অতিবড় ছোটলোক, অশিক্ষিতেরাও করে না—
আমি জানি।
কিছুই জানেন না আপনি—
অবিশ্যি লোকের মুখে যা শুনেছি।
কি শুনেছেন?
তাঁকে তাঁর শ্বশুর রায়বাহাদুর প্রিয়তোষ মল্লিক স্বীকার করে নেননি।
কিন্তু অপরাধটা কোথায়? তার ছেলেই তো–
জানি পছন্দ করে বিয়ে করেছিলেন আপনার মাকে–
তাই বুঝি আমার নমাসের গর্ভবতী মা যখন তার দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, চার মাস স্বামীর কোন রকম সংবাদ বা চিঠিপত্র না পেয়ে, রায়বাহাদুর বাপ মুখের ওপর তার দরজা বন্ধ করে দিল! ছেলে-তাঁর স্বামী দোতলার জানালায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখল। আমার মা তো আশ্রয়ভিক্ষা করতে সেখানে যাননি, কেবলমাত্র স্বামীর সংবাদ নিতেই গিয়েছিলেন
সত্যি বলছেন আপনি আশুবাবু?
কিরীটী বুঝতে পারছিল, শিবতোষ মল্লিক সব সত্যি কথা বলেননি তাকে।
হ্যাঁ, একবর্ণও মিথ্যা নয়। সেই কাপুরুষ-মহাপুরুষকেই আপনি জিজ্ঞাসা করবেন, ঐ ভণ্ডটাকে আমি একদিন গলা টিপে হত্যা করব, তারপর ফাঁসি যাব। একটা আগ্নেয়গিরির মতই যেন ফুঁসতে লাগল আশু।
আপনি বোধ হয় তাই কখনও তাঁকে স্বীকার করেননি এবং তাঁর গৃহেও যাননি!
যে বাড়ির দরজা থেকে আমার নিরপরাধিনী মাকে অপমান আর লজ্জা মাথায় করে নিয়ে আসতে হয়েছে, সে বাড়ির দরজাও আশুতোষ মাড়ায় না।
তবু আইনে বলে, আপনিই তাঁর একমাত্র বংশধর এখন—
কোন দুঃখে! তার দ্বিতীয় পক্ষের ছেলেই তার বংশধর। আমি তাকে স্বীকারও করি, আমার সঙ্গে তার কোন সম্পর্কই নেই।
আপনি জানেন একটা কথা, তাঁর সে ছেলেটি রবিবার খুন হয়েছে?
হয়েছে, ঠিক হয়েছে—এবার ওকেও হতে হবে। আপনি কি ঐ সংবাদটি দিতেই এখানে এসেছেন কলকাতা থেকে? তাহলে জেনে যান, আমি খুব খুশি হয়েছি।
কিন্তু নির্বাণীতোষবাবু তো আপনার কখনও কোন ক্ষতি করেননি আশুবাবু! তাছাড়া তাঁর বাপের কর্মের জন্যও নিশ্চয়ই তিনি দায়ী নন। এবং শুনলে বিশ্বাস হয়ত করবেন না , তিনি আপনাকে দাদার মতই শ্রদ্ধা করতেন, ভালবাসতেন।
কিরীটীর ঐ কথায়, বিশেষ করে তার শেষের সম্পূর্ণ বানানো কথাগুলিতে হঠাৎ যেন মনে হল আশুতোষ একটু বিমূঢ় হয়ে পড়েছে। কোন কথা বলে না। চুপ করে থাকে।
আরও আপনি হয়ত জানেন না, দুর্ঘটনার মাত্র দুদিন আগে নির্বাণীতোষবাবু বিয়ে। করেছিলেন। রবিবার রাত্রে তিনি খুন হন, সে রাত্রে ছিল বৌভাত ও ফুলসজ্জা তাঁর।
আশুতোষ পূর্ববৎ নির্বাক।
হঠাৎ কিরীটী প্রশ্ন করল, আপনাকে নিমন্ত্রণ করেননি?
করেছিল।
করেছিলেন নিমন্ত্রণ?
হ্যাঁ।
কে নিমন্ত্রণ করেছিলেন?
রায়বাহাদুর প্রিয়তোষ মল্লিকের ছেলে, আপনাদের শিবতোষ মল্লিক নন—
তবে কে?
নির্বাণীতোষই একট চিঠি পাঠিয়েছিল।
নির্বাণীতোষবাবু আপনাকে চিঠি পাঠিয়েছিলেন নিজে?
হ্যাঁ।
আছে সে চিঠি?
আছে বোধ হয়।
দেখতে পারি চিঠিটা একবার?
আলমারিটা খুলে–বইয়ের উপরে রাখা ছিল চিঠিটা, সেটা বের করে দিল আশুতোষ কিরীটীর হাতে।
ডাকে এসেছে, খামের চিঠি।
খামটা থেকে চিঠিটা বের করে পড়ল কিরীটী। সংক্ষিপ্ত চিঠি। চিঠির তারিখ দিন-পাঁচেক আগের।
শ্রীচরণেষু দাদা,
আপনি আমাকে কখনও স্বীকার না করলেও চিরদিন আপনাকে আমি আমার জ্যেষ্ঠ বলেই জেনে এসেছি। আর পাঁচদিন পরে—শুক্রবার আমার বিয়ে। আপনি আসবেন না আমি জানি, তাই এই পত্রে আপনার আশীর্বাদ চেয়ে নিচ্ছি। প্রণত—নির্বাণীতোষ।
চিঠিটা পড়া শেষ হলে পুনরায় সেটা খামের মধ্যে ভরতে ভরতে কিরীটী বললে, কবে এ চিঠি পেয়েছেন আপনি?
গত শনিবার।
চিঠির জবাব—
না, দিইনি। তাদের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্কই নেই।
আপনি তো শুনেছেন আশুবাবু, রায়বাহাদুর প্রিয়তোষ মল্লিক কি প্রকৃতির লোক ছিলেন। আপনার জন্মদাতা হয়তো নিরুপায় হয়েই
একটি ভদ্রঘরের নিরপরাধ মেয়েকে বিয়ে করবার সময় সেকথা তার মনে ছিল না? মেরুদণ্ডহীন অথর্ব পশু একটা! আবার যেন আশুতোষ আক্রোশে ফেটে পড়ল।
তাহলে তাঁরও তো কিছু বলবার থাকতে পারে—
থাকুক, তা দিয়ে আমার কোন দরকার নেই।
হঠাৎ ঐ সময় প্রশ্ন করল কিরীটী, তাহলে আপনি সে-রাত্রে কলকাতায় যান নি?
না—না।
তবে কোথায় ছিলেন রবিবার রাত্রে? আপনি তো রবিবার বিকেলেই বের হয়ে গিয়েছিলেন?
কে বললে?
জানি আমি, যার সঙ্গে ট্রেনে আপনার দেখা হয়েছিল রবিবার—
আমি টালিগঞ্জে আমার এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়েছিলাম।
কি নাম তাঁর? ঠিকানা কি তাঁর?
কেন বলুন তো? অত সংবাদে দরকারটা কি আপনার? আপনি কি পুলিসের লোক?
না, সে-সব কিছু নয়, এমনিই জিজ্ঞাসা করছিলাম।
ঐ কথাটা জিজ্ঞাসা করবার জন্যই কি এসেছেন আজ?
না না।
দেখুন মশাই, আমি ঘাস খাই না। এতক্ষণে আপনার এখানে আগমনের হেতুটা আমি বুঝতে পেরেছি। আশা করি আপনার যা জানবার ছিল জানা হয়ে গিয়েছে। এবারে দয়া করে উঠবেন কি-আমার এটা বিশ্রামের সময়।
কিরীটী বুঝতে পারে, আশু মল্লিক আর মুখ খুলবে না। ঝোঁকের মাথায় যতটুকু বলেছে—আর সে কিছু বলবে না।
আচ্ছা, তাহলে উঠি। নামটা আমার নিশ্চয়ই মনে থাকবে আপনার, কিরীটী রায়। নমস্কার। কিরীটী চেয়ার ছেড়ে উঠে ঘর থেকে বের হয়ে এল।
বাবা শিবতোষ মল্লিকের প্রতি তাঁর সন্তান আশুতোষ মল্লিকের ঘৃণা ও আক্রোশের। সত্যিকারের কারণটা যেন আর অতঃপর অস্পষ্ট থাকে না কিরীটীর কাছে। ঘৃণা আর আক্রোশের মূলে কত বড় যে একটা ব্যথা পুঞ্জীভূত হয়ে রয়েছে আশু মল্লিকের বুকের মধ্যে, আজ কিরীটী সেটা উপলব্ধি করার সঙ্গে সঙ্গে এটাও বুঝতে পারছিল বাপ আর ছেলের মধ্যে আবার মিলন ঘটানো সহজসাধ্য হবে না।
শিবতোষ মল্লিকের জন্য কিরীটীর দুঃখই হয়।
গাড়িটা অনেকটা দূরে বড় রাস্তার উপর একটা গাছের নিচে পার্ক করা ছিল। ফিরে এসে গাড়িতে উঠে হীরা সিংকে বললে, চল সর্দারজী।
কোঠি তো সাব?
হ্যাঁ।
চলমান গাড়িতে বসে একটা সিগারে অগ্নিসংযোগ করে কিরীটী নতুন করে আবার যেন নির্বাণীতোষের হত্যারহস্যের ব্যাপারটা ভাববার চেষ্টা করে। নিঃসন্দেহে নির্বাণীতোষের নিষ্ঠুর হত্যার পিছনে একটা উদ্দেশ্য রয়েছে এবং সেটা বেশ জটিলই সেই জটিলতারই একটা সূত্র ছিল আশু মল্লিককে ঘিরে জট পাকিয়ে।
আশু মল্লিকের জটটা খুলবার জন্যই আজ সে আশু মল্লিকের সঙ্গে দেখা করতে এসেছিল। জটটা সবটা না খুললেও কিছুটা খুলেছে। এবং যতটুকু খুলেছে তাতেই আপাতত কিরীটী অন্যদিকে দৃষ্টি ফেরাতে পারে।
নির্বাণীতোষের সহপাঠীদের একবার যাচাই করে দেখা দরকার। বিশেষ করে তিনজনকে, শিখেন্দুকে আপাতত বাদ দিলে সঞ্জীব, নির্মল ও পরেশ। ওদের মধ্যে একজন উৎসবের রাত্রে বেলতলার বাড়িতে আসেনি—সঞ্জীব।
বাকি দুজন এসেছিল। পরেশ ও নির্মল। অবিশ্যি স্বাতী বা স্মৃতি কেউই পরেশের কথা বলেনি। বলেছে সঞ্জীব ও নির্মলের কথাই। তারা নাকি নির্বাণীদের বাড়িতে নিয়মিত যাতায়াত করত।
কিন্তু গোকুল চিনতে পেরেছে পরেশকে। কেমন করে চিনল? হয়ত আগে না গেলেও, ইদানীং দু-একবার পরেশ নির্বাণীতোষদের বাড়িতে গিয়েছে, নচেৎ গোকুল তাকে চিনবে কি করে?
শিখেন্দুকে একবার গোকুল তিনতলায় যেতে দেখেছিল এবং তা যদি সত্য হয়, তাহলে শিখেন্দু দুবার উপরে গিয়েছিল সে-রাত্রে। অথচ শিখেন্দু অস্বীকার করেছে। সে বলেছে, একবারই নাকি সে উপরে গিয়েছে।
গোকুলের কথাটা কিরীটীর মিথ্যা বলে মনে হয় না। তারও ধারণা, শিখেন্দু দুবারই উপরে গিয়েছিল। কেন তবে অস্বীকার করছে শিখেন্দু প্রথমবার উপরে যাবার কথাটা! গোকুলের জবানবন্দি সত্য হলে, রাত দশটা কি তার দু-চার মিনিট আগে প্রথমবার শিখেন্দু উপরে গিয়েছিল। এবং গোকুল শিখেন্দুকে নেমে আসতে দেখেনি। আরও একটা ব্যাপার, শিখেন্দু উপরে যাবার মিনিট পনের কুড়ি পরে নটা চল্লিশে সেই নীল শাড়ি পরা বৌটি উপরে গিয়েছিল। গোকুল তার কোন পরিচয় দিতে পারেনি, চিনতেও পারেনি তাকে মাথায় ঘোমটা থাকার দরুন। এবং গোকুল সেই নীল শাড়ি পরা মেয়েটিকে নেমে আসতে দেখেনি। কে সেই নীলবসনা নারী!
দুজনেই—শিখেন্দু ও সেই নারী আগে-পিছে উপরে গিয়েছিল। অথচ তাদের কাউকেই গোকুল নিচে নেমে আসতে আবার দেখেনি।
সেই নীলবসনা নারীর কথা বাদ দিলেও শিখেন্দু নেমে এসেছিলই, কারণ পৌনে এগারটা নাগাদ সে প্যাণ্ডেলে উপস্থিত ছিল ও নির্বাণী তার মাথা ধরেছে বলায় তাকে উপরে চলে যেতে বলেছিল।
শিখেন্দু তাহলে কখন নীচে নেমে এসেছিল এবং কোন্ পথে?।
০৭. কিরীটীর মনের মধ্যে চিন্তাস্রোত
কিরীটীর মনের মধ্যে চিন্তাস্রোত অব্যাহত থাকে।
পৌনে এগারোটা থেকে পৌনে বারোটার কিছু আগেই মনে হচ্ছে নির্বাণীতোষকে হত্যা করা হয়। খুব সম্ভবত এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টও সেই রকমই বলেছে। ঐ সময়ের মধ্যেই নাকি নির্বাণীতোষের মৃত্যু হয়েছে বলে তাদের অনুমান। হত্যাকারীর পক্ষে উৎসবের রাত্রে বিশেষ যে সুবিধা দুটি ছিল তা হচ্ছে : প্রথমত সে রাত্রে বাড়িতে উৎসবের জন্য দ্বার ছিল অবারিত। কত লোক যে এসেছিল তার সঠিক বিবরণ কারও পক্ষেই দেওয়া সম্ভব নয়। এবং সকলকে চেনাও সকলের পক্ষে সম্ভব ছিল না। সেই ভিড়ের মধ্যে হত্যাকারী চেনা হোক বা অচেনা হোক, কারও মনেই কোন সন্দেহ জাগবার হেতু ছিল না। অন্ততঃ সেদিক দিয়ে হত্যাকারী খুবই নিশ্চিত ছিল, কেউ তাকে সন্দেহ করবে না। অনায়াসেই সে কাজ হাসিল করে চোখের সামনে দিয়েই বের হয়ে যেতে পারবে সে জানত আর তাই সে সম্ভবত গিয়েছেও।
দ্বিতীয়ত, উৎসবের রাত্রে হত্যা যেখানে সংঘটিত হয়েছে সেই তিনতলায় কেউ বড় একটা যায় নি। যারার প্রয়োজনও ছিল না। সেদিক দিয়েও হত্যার স্থানটি নিরিবিলি এবং সবার চোখের আড়ালেই ছিল। কাজেই হত্যাকারীর পক্ষে নিঃশব্দে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করে চলে যাওয়া আদৌ কোন কষ্টসাধ্য ব্যাপার ছিল না।
খুব কৌশলে এবং নিশ্চিন্তে হত্যাকারী তার কাজ শেষ করেছে ঠিকই, কিন্তু তথাপি দুটি অসঙ্গতি যেন কিরীটীর প্রথম থেকেই মনের মধ্যে তাকে কেবলই কোন কিছুর ইঙ্গিত দিচ্ছে প্রথমত শিখেন্দুর জবানবন্দি থেকেই জানা যায়, চিৎকার শুনে ওপরে গিয়ে ওঠবার পর সে নির্বাীতোষের শয়নঘরের দরজা খোলা দেখতে পেয়েছিল। নিশ্চয়ই দরজাটা ঐ সময় খোলা ছিল, নচেৎ সে ভিতরে প্রবেশ করতে পারত না। দ্বিতীয়ত, বাথরুমের দরজাটা ভিতর থেকে বন্ধ ছিল। একটা অবিশ্যি এর মধ্যে কথা থাকতে পারে, প্রথমটা দ্বিতীয়টার পরিপূরক হতে পারে। কিন্তু তাও তো প্রমাণসাপেক্ষ এবং সে প্রমাণ একমাত্র দিতে পারে দীপিকাদেবী, অর্থাৎ সে ঘরে ঢোকার পর ঘরের দরজা বন্ধ ছিল কিনা, যদিও সেটাই স্বাভাবিক, কিন্তু দীপিকা তার পূর্ণ স্মৃতি হারিয়েছে নিদারুণ মানসিক আঘাতে।
শিবতোষের ফ্যামিলি-ফিজিসিয়ান ডাঃ চৌধুরীরই অনুরোধে সিকায়াট্রিস্ট ডাঃ বর্মণকে আনা হয়েছিল। তিনি দীপিকাকে পরীক্ষা করে সেই অভিমতই নাকি প্রকাশ করেছেন। যদিও বলেছেন ডাঃ বর্মণ, দীপিকার পূর্ণ স্মৃতি আবার ফিরে আসবে, তবে কবে কখন হবে সে সম্পর্কে কোন ভবিষ্যদ্বাণীই তিনি করতে পারেননি। সেটা নাকি সম্ভবও নয়।
ডাঃ বর্ষণের কথা অবিশ্যি ঠিক, কোন নিদারুণ আকস্মিক মানসিক আঘাতের ফলেই দীপিকার ঐ মনের মানসিক বিপর্যয় ঘটেছে। কিন্তু সেটা কি তার স্বামীকে আকস্মিক মৃত আবিষ্কার করার জন্যই, না তার সঙ্গে আরও কিছু ছিল?
কিরীটীর অনুমান আরও কিছু ছিল। এবং সে ব্যাপারটা, ওর স্বামীর আকস্মিক মৃত্যুর আঘাতের মতই অনুরূপ আঘাত হেনেছিল তার মনে, যার ফলে বেচারী আর তার মানসিক ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে নি। অজ্ঞান হয়ে গিয়েছিল সে ও স্মৃতিশক্তিও লোপ পেয়েছে তার। এবং কিরীটীর আরও অনুমান, সবই বাথরুমের মধ্যে ঘটেছিল। ঐ বাথরুমের মধ্যেই হত্যারহস্যের মীমাংসার আসল সূত্রটি অন্ধকারে দৃষ্টির অগোচরে জট পাকিয়ে আছে। এবং সে জট খুলতে হলে সর্বাগ্রে জানা প্রয়োজন, কে কে সে রাত্রে তিনতলায় গিয়েছিল? কখন গিয়েছিল? শিখেন্দু, নির্বাণীর বোন স্মৃতি, আর সেই নীলবসনা নারী।
পরের দিন সকালে সারকুলার রোডে শিখেন্দুদের মেসে গিয়ে হাজির কিরীটী। সকাল সাতটার মধ্যেই গিয়েছিল কিরীটী। কারণ সে জানত দেরী করে গেলে তাদের সঙ্গে দেখা হবে না, সবাই হাসপাতালে বের হয়ে যাবে।
শিখেন্দু বরাবরই সকালে ওঠে, তার স্নান পর্যন্ত হয়ে গিয়েছিল। হাসপাতালে ডিউটিতে যেতে হবে বলে তখন সে জামাকাপড় পরছে। সঞ্জীব সদ্য সদ্য ঘুম ভেঙ্গে একটা সিগারেট ধরিয়ে এক পেয়ালা চা নিয়ে বসেছে।
শিখেন্দুবাবু!
কিরীটীর ডাকে শিখেন্দু চোখ তুলে দরজার ওপরে দেখে বললে, কিরীটীবাবু! আসুন, আসুন। সঞ্জীব, ইনি কিরীটী রায়।
সঞ্জীবও কিরীটীর দিকে তাকাল।
নির্বাণীতোষের অন্যান্য ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের সঙ্গে একটু পরিচিত হতে এলাম।
বসুন। শিখেন্দু বললে।
আপনি সঞ্জীববাবু?
কিরীটীর প্রশ্নে তার মুখের দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে সম্মতিসূচক ঘাড় হেলাল সঞ্জীব।
আপনি তো বোধ হয় সে-রাত্রে বেলতলার বাড়িতে উৎসবে যান নি?
না।
বন্ধুর বৌভাতে গেলেন না?
আমাদের ক্লাবে সে-রাত্রে থিয়েটার ছিল।
আপনি অভিনয় করেছিলেন?
হ্যাঁ।
শিখেন্দু বললে, ও খুব ভাল অভিনয় করে কিরীটীবাবু।
তাই বুঝি? তা সে-রাত্রে আপনাদের কি নাটক অভিনয় হল?
বহ্নিশিখা। শিখেন্দু বললে।
কল্যাণীর পার্ট করেছি। সঞ্জীব বললে।
শিখেন্দু বললে, ও খুব চমৎকার ফিমেল রোল করে কিরীটীবাবু।
কিরীটী মৃদু হেসে বললে, সে ওঁর গলার স্বর ও চেহারা থেকেই বোঝা যায়। আজকাল তো ফিমেল বোল সর্বত্র মেয়েরাই করে শুনেছি।
আমাদের ক্লাবে এখনও কোন ফিমেল নিয়ে আমরা অভিনয় করিনি।
সঞ্জীবের কথা শেষ হবার আগেই বাইশ-তেইশ বছরের এক তরুণ ছোকরা ঘরে এসে ঢুকলীরোগা পাতলা চেহারা, মাথায় বড় বড় চুল, মুখের গঠনটা যেন ঠিক মেয়েদের মত।
সঞ্জীববাবু!
কে–ও তপনবাবু?
আমার পুরো টাকাটা তো সে-রাত্রের এখনও পেলাম না।
কেন, হিমানীশ দিয়ে দেয়নি?
না। বললেন, আপনার সঙ্গে আগে কথা বলবেন তারপর। কিন্তু আপনার সঙ্গে আমার কথা ছিল সেই রাত্রেই টাকাটা মিটিয়ে দেবেন।
ছেলেটির গলার স্বর অবিকল মেয়েদের মত।
সঞ্জীব বললে, কত বাকি আছে?
পঞ্চাশ।
সঞ্জীব উঠে গিয়ে জামার পকেট থেকে পার্সটা বের করে দশ টাকার পাঁচখানা নোট তপনকে দিয়ে বললে, এই নিন, এখন যান, আমরা একটু ব্যস্ত আছি।
ধন্যবাদ, নমস্কার।
তপন চলে গেল। শুধু চেহারা এবং কণ্ঠস্বরই নয়, চলার ভঙ্গীও তপনের ঠিক মেয়েদের মত। কিরীটী নির্বাক দৃষ্টিতে চেয়ে ছিল তপনের গমনপথের দিকে। তপন ঘর থেকে বের হয়ে যাবার পর কিরীটী সঞ্জীবের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করলে, ভদ্রলোক কে?
তপন শিকদার। যাত্রাদলে অভিনয় করে। মৃদুকণ্ঠে বললে সঞ্জীব।
কোন্ যাত্রার দলে?
নবীন অপেরায়।
কিরীটী আবার শিখেন্দুর মুখের দিকে তাকাল, শিখেন্দুবাবু, পরেশবাবু আর নির্মলবাবু কোন্ ঘরে থাকেন?
পাশের ঘরেই, ডাকছি তাদের। শিখেন্দু গলা তুলে ডাকল, নির্মল পরেশ একবার এ ঘরে আয়। দুজনেই যেন হাসপাতালে বেরুবার জন্য প্রস্তুত হয়েছিল, শিখেন্দুর ডাক শুনে ওদের ঘরে ঢুকল।
কিরীটীবাবু, এর নাম পরেশ আর ও নির্মল বলে ওদের দিকে তাকিয়ে কথা শেষ করল শিখেন্দু। পরেশ, ইনি কিরীটী রায়।
নির্মল কোন কথা বলল না। পরেশ মৃদু কণ্ঠে বললে, না বললেও ওঁকে ঘরে ঢুকেই আমি চিনতে পেরেছিলাম শিখেন্দু,কাগজে ওঁর ছবি আমি দেখেছি।
কিরীটী কথা বললে, আপনারা তো দুজনেই সে-রাত্রে আপনাদের বন্ধুর বৌভাতে গিয়েছিলেন?
হ্যাঁ। দুজনেই বললে।
দুজনেই আপনারা পাশের ঘরেতেই থাকেন?
হ্যাঁ।
সে রাত্রে দুজনে একসঙ্গেই গিয়েছিলেন, একসঙ্গেই ফিরেছিলেন কি?
না। পরেশ বললে, আমি রাত নটা নাগাদ গিয়েছিলাম। কারণ আমার এক পিসিমার বাড়িতে ভবানীপুরে যেতে হয়েছিল, সেখান থেকে যাই বেলতলায়, তারপর দশটার দু-চার মিনিট পরেই চলে এসেছি, নির্বাণী তখনও প্যাণ্ডেলে ছিল।
কি করে বুঝলেন রাত তখন দশটা বেজে দু-চার মিনিট হবে? আপনার হাতে কি ঘড়ি ছিল? ঘড়ি দেখেছিলেন?
সঞ্জীব বললে, ওর তো হাতঘড়িটা কিছুদিন আগে হাসপাতালে খুলে রেখে টেবিলে কাজ করছিল, চুরি গেছে। তার পর তো তুই ঘড়ি কিনিস নি পরেশ!
না, কিনিনি। কেমন যেন বোজা গলায় কথাটা উচ্চারণ করল পরেশ।
তবে? তবে সময়টা বুঝলেন কি করে? কিরীটী প্রশ্ন করল।
মানে আন্দাজ, ঐরকমই হবেভেবেছিলাম। পরেশবললে আবার পূর্ববৎ নিস্তেজ গলাতেই।
তারপর আপনি কোথায় যান? কিরীটীর প্রশ্ন।
কোথায় আর যাব, এখানেই ফিরে আসি।
আপনাদের এ ঘরে টেবিলের ওপরে তো দেখছি একটা ছোট ক্লক রয়েছে, কার ওটা?
শিখেন্দুর।
ফিরে এসে ঘড়িটা দেখেছিলেন?
দেখেছি।
রাত তখন কটা?
পৌনে বারোটা, মানে—
দশটা বাজার দু-চার মিনিট পরেই যদি বের হয়ে থাকেন তো ফিরতে আপনার প্রায় দুঘন্টার মত সময় লাগল কেন? হেঁটে নিশ্চয়ই আসেননি?
না, বাসে।
বাসে! ঐ সময় রাত্রে এই পথটুকু আসতে অত সময় লাগতে পারে না পরেশবাবু। পারে কি?
না না।
তবে? রাস্তায় জ্যাম ছিল?
জ্যাম!
হ্যাঁ। তাহলে অবিশ্যি দেরি হতে পারে কিছুটা,–তাহলেও প্রায় দুঘন্টা।
হঠাৎ পরেশ যেন একটু চটে ওঠে, বললে, আপনি কি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না?
কেন করব না! কিরীটী মৃদু হাসল।
তবে?
সত্যি বললে, বিশ্বাসযোগ্য হলে নিশ্চয়ই আপনার সব কথাই বিশ্বাস করব, পরেশবাবু।
মানে?
মানে আপনি সত্যি বলছেন না!
আমি মিথ্যা বলছি? মিথ্যা বলে আমার লাভ?
লাভ যদি সত্যিই কিছু থাকে, সেটা তো আমার চাইতে আপনারই বেশী জানার কথা পরেশবাবু! কিরীটীর গলার স্বর যেমন ঠাণ্ডা তেমনিই শান্ত।
আপনার তাহলে কি ধারণা নির্বাণীকে আমিই হত্যা করেছি?
পরেশবাবু, উত্তেজিত হবেন না। নির্বাণীতোষবাবু আপনাদের সকলেরই বন্ধু ছিলেন এবং আপনাদের পাঁচজনের মধ্যে একটু বেশীই ঘনিষ্ঠতা ছিল। শুধু তাই নয়, দীপিকাও আপনাদের বান্ধবী। আপনারা সকলেই তাঁকে ভালবাসেন, তাঁর এত বড় দুর্দিনে আপনাদের প্রত্যেকেরই কি কর্তব্য নয় সেক্ষেত্রে নির্বাণীতোষের হত্যাকারীকে যাতে আমরা খুঁজে বের করতে পারি সে ব্যাপারে সাহায্য করা!
কেন করব না। নিশ্চয়ই করব। পরেশ বললে।
নির্মলবাবু আপনি? সহসা কিরীটী নির্মলের দিকে ফিরে প্রশ্ন করল, আপনি কি বলেন?
নিশ্চয়ই তো, পরেশ ঠিকই বলেছে।
আপনি কখন ফিরেছেন সে-রাত্রে নির্মলবাবু? কখন সেখান থেকে বের হয়েছিলেন?
কিরীটীর প্রশ্নে সকলেরই চোখের দৃষ্টি একই সঙ্গে যেন নির্মলের মুখের উপরে গিয়ে স্থির হল। এবারও সঞ্জীবই বললে, ও ফিরেছে রাত তখন বোধ হয় সোয়া বারোটা হবে।
বেলতলার বাড়ি থেকে আপনি বের হয়েছিলেন কখন সে-রাত্রে নির্মলবাবু? কিরীটীর প্রশ্ন।
ও সেদিন বলছিল রাত দশটার পরেই নাকি বের হয়ে এসেছিল বেলতলার বাড়ি থেকে। আবার সঞ্জীব বললে।
তার মানে আপনারও প্রায় দুঘণ্টার কিছু বেশী সময়ই লেগেছিল ফিরতে সে-রাত্রে। কিরীটী বলে।
নির্মল কোন জবাব দেয় না, চুপ করে থাকে।
শিখেন্দুবাবু আপনি জানেন, উনি কখন বের হয়ে এসেছিলেন বেলতলার বাড়ি থেকে? কিরীটী আবার প্রশ্ন করল।
না, দেখিনি।
আপনি তো পৌনে এগারোটা পর্যন্ত প্যাণ্ডেলেই ছিলেন শিখেন্দুবাবু, আপনি তবু জানেন না?
শিখেন্দু ম্লান গলায় জবাব দিল, লক্ষ্য করিনি কখন নির্মল বের হয়ে এসেছে!
আর আমি যদি বলি শিখেন্দুবাবু, দশটার কিছু আগে থাকতেই, সাড়ে দশটা পর্যন্ত আপনি প্যান্ডেলে ছিলেন না বলেই ব্যাপারটা জানতে পারেননি!
না না। আমি তো তখন প্যাণ্ডেলেই ছিলাম।
না, ছিলেন না। কিরীটীর গলার স্বর ঋজু ও কঠিন শোনাল।
তবে কোথায় ছিলাম?
সেটা আপনিই ভাল জানেন। আমার পক্ষে সেটা তো জানা সম্ভব নয়।
সবাই চুপ। সবাই যেন বিব্রত কেমন।
সঞ্জীববাবু!
কিরীটীর ডাকে এবার সঞ্জীব ওর দিকে তাকাল।
আপনি তো থিয়েটার করছিলেন?
হ্যাঁ।
কখন থিয়েটার শুরু হয়েছিল?
একটু দেরী হয়েছিল, রাত পৌনে আটটায়—
কখন শেষ হল?
রাত সোয়া এগারটায়।
তারপরেই আপনি বোধ হয় চলে আসেন?
হ্যাঁ।
মাঝখানে মানে থিয়েটার চলাকালীন সময়ে আপনি কোথাও যাননি?
না।
আপনাদের ক্লাবের নাম কি?
পাইকপাড়া স্পোর্টস ইউনিয়ন।
কিরীটী অতঃপর কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। পরে শান্ত গলায় বললে, শিখেন্দুবাবু নির্মলবাবু পরেশবাবু সঞ্জীববাবু—আমার মনে হয় আপনাদের সকলেরই দুর্বলতা ছিল দীপিকার ওপরে!
কি বলছেন আপনি? সঞ্জীব প্রতিবাদ জানায়।
কথাটা যে মিথ্যা নয়, আমার অনুমান হলেও সেটা আপনারা প্রত্যেকেই জানেন। আর এও আমি বলছি, আপনাদের মধ্যে কেউ একজনও এও জানেন—নির্বাণীতোষের হত্যাকারী কে।
সঞ্জীব আবার প্রতিবাদ জানায়, আমরা জানি?
হ্যাঁ। তার প্রমাণ, কেউ আপনারা সত্যি কথা বলতে নারাজ। এবং কতকটা ইচ্ছা করেই সত্যি কথা প্রকাশ করছেন না। রাত দশটা থেকে এগারোটা পর্যন্ত আপনারা কে কোথায় ছিলেন? আজ আমি উঠছি, আপনাদের আর ডিটেন করব না, কিন্তু আবার আমাদের দেখা হবে। নমস্কার।।
০৮. কিরীটী কথাগুলো বলে
কিরীটী কথাগুলো বলে সহসা কতকটা যেন নাটকীয়ভাবেই চেয়ার থেকে উঠে হঠাৎ ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। আর ওরা চারটি প্রাণী স্তব্ধ অনড় হয়ে যেমন বসে বা দাঁড়িয়ে ছিল তেমনই রইল।
হঠাৎ একসময় ঘরের অসহনীয় স্তব্ধতা ভঙ্গ করে পরেশই বলে উঠল, ফ্যানটাসটিক্–রিডিকুলাস! ভদ্রলোকের ওপরে আমার সত্যিই কিছুটা শ্রদ্ধা ছিল, এখন দেখছি মানুষটা একটা পুরোপুরি হামবাগ! শেষ পর্যন্ত কিনা ধারণা হল তার—আমরাই, মানে আমাদের মধ্যে কেউ একজন সে-রাত্রে নির্বাণীকে হত্যা করেছি আর আমাদের মধ্যে একজন তাকে চেনে বা দেখেছে।
ক্ষীণ গলায় শিখেন্দু বললে, কিন্তু এটা তো ঠিক, কেউ আমরা সত্যি স্টেটমেন্ট দিইনি!
মানে? আমরা মিথ্যে বলেছি? পরেশ রাগত কণ্ঠে শুধাল।
তোমরা বলেছ কিনা তোমরাই জান, তবে আমি বলেছি—
কি?
দশটার আগে একবার আমি ওপরে গিয়েছিলাম।
ওপরে মানে? পরেশ শুধাল।
তিনতলায় নির্বাণীর ঘরে—
সে কি? কেন?
নির্বাণী বরাবর স্পেশাল ব্রা স্টেট এক্সপ্রেস ৫৫৫ খেত তোরা তো জানিস। ওর সিগারেট ফুরিয়ে গিয়েছিল, অথচ সঞ্জীব তখনও যায়নি, তাই নির্বাণী আমাকে বলেছিল তিনতলায় গিয়ে তার ঘর থেকে দু প্যাকেট সিগারেট নিয়ে আসতে, নির্বাণী প্যাণ্ডেল ছেড়ে যেতে চায়নি।
তারপর?
হঠাৎ কিরীটীর কণ্ঠস্বরে চমকে সকলেই ফিরে তাকাল দরজার দিকে। কিরীটী চলে যায়নি ঘর থেকে বের হয়ে দরজার আড়ালেই চুপটি করে দাঁড়িয়েছিল কারণ সে অনুমান করেছিল তার ঐ কথাগুলো বলে ঘর ছেড়ে চলে যাবার পর চার বন্ধু ব্যাপারটা নিয়ে কোন-না-কোন মন্তব্য হয়তো করবেই। এবং তার অনুমানটা যে মিথ্যা নয় সেটা একটু পরেই প্রমাণিত হওয়ায় সে কান খাড়া করে ওদের কথা শুনছিল।
শিখেন্দুর শেষ কথার সঙ্গে সঙ্গেই সে সাড়া দিয়ে ঘরে এসে ঢুকল।
কিরীটীর অভাবিত অতর্কিত আর্বিভাবে চারজনই যেন বিমূঢ় হয়ে গিয়েছিল কয়েকটা মুহূর্তের জন্য।
পরেশই বলে, কিরীটীবাবু আপনি তাহলে যাননি?
না, পরেশবাবু। হামবাগ হলে অবিশ্যি চলেই যেতাম, কিন্তু শিখেন্দুবাবু—আপনি থামলেন কেন? একটু আগে যা বলছিলেন শেষ করুন। তারপর কখন কোন্ পথে আপনি আবার নীচের প্যাণ্ডেলে ফিরে আসেন সে-রাত্রে? প্লিজ বলুন, চুপ করে থাকবেন না!
শিখেন্দু যেন কেমন যোবাদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে কিরীটীর মুখের দিকে।
বলুন!
সিঁড়ি দিয়ে নেমে এসেছিলাম। আস্তে আস্তে থেমে থেমে কথাগুলো বলল শিখেন্দু।
কতক্ষণ পরে?
মিনিট দশ-বারো পরেই
তবে গোকুল আপনাকে নেমে আসবার সময় দেখতে পেল না কেন?
বলতে পারব না—
কখন গিয়েছিলেন ওপরে?
রাত দশটা বোধ হয় তখন।
তাহলে নিশ্চয়ই আপনার সঙ্গে সেই নীলবসনা রহস্যময়ী নারীর দেখা হয়েছিল?
নীলবসনা রহস্যময়ী নারী! সে আবার কে? পরেশ হঠাৎ প্রশ্ন করল।
নির্বাণীতোষবাবুর হত্যাকারী।
কি বলছেন আপনি কিরীটীবাবু? নির্মল বলল, তাহলে কোন মহিলাই খুনী?
আপাতদৃষ্টিতে তাই বলতে পারেন।….কি শিখেন্দুবাবু, কোন স্ত্রীলোককে দেখেননি তিনতলায়, সে তো আপনার পরে-পরেই ওপরে গিয়েছিল, দেখেননি?
না—না তো বলে শিখেন্দু সকলের মুখের দিকে পর্যায়ক্রমে তাকাল।
না, সত্যি বলছি মিঃ রায়, সে-সময় তিনতলায় কাউকে আমি দেখিনি।
তবে কেন আপনি ওপরে আরো একবার গিয়েছিলেন, আমার বার বার জিজ্ঞাসা করা সত্ত্বেও স্বীকার করেননি? কেন?
ভয়ে–
ভয়–কিসের ভয়?
যদি আপনি—
আপনাকে সন্দেহ করি, তাই?
হ্যাঁ।
কিরীটী কিছুক্ষণ অতঃপর তাকিয়ে রইলো শিখেন্দুর মুখের দিকে। তারপর বলল, চলুন—আপনি তো বেরুবেন, হাসপাতালে যাবেন?
হ্যাঁ।
চলুন আপনাকে আমি হাসপাতালে নামিয়ে দিয়ে যাব।
শিখেন্দু আর প্রতিবাদ জানাতে পারল না। কিরীটীর সঙ্গে সঙ্গে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
গাড়িতে বসে যেতে যেতে কিরীটী শিখেন্দুকে কতকগুলো কথা বলল।
শিখেন্দু শুনে গেল।
হাসপাতালের গেটের সামনে নামিয়ে দেবার সময় কিরীটী বললে, সংবাদগুলো আমার চাই যত তাড়াতাড়ি পারেন দেবেন। সোজা আমার বাড়িতে চলে আসবেন।
শিখেন্দু তখন অনেকটা আবার স্বাভাবিক বোধ করছে নিজেকে। বললে, যাব।
কিরীটীর গাড়ি চলে গেল।
ফেরার পথে কিরীটী ভবানীপুর থানায় নেমে বীরেন মুখার্জীর সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বলল। বাড়িতে এসে যখন গোঁহল, বেলা তখন সাড়ে দশটা।
ওকে ঘরে ঢুকতে দেখে কৃষ্ণা শুধাল, কি ব্যাপার, সক্কাল বেলাতেই কিছু না খেয়েই কোথায় বের হয়েছিলে?
সারকুলার রোডে শিখেন্দুদের মেসে—
কিছু খাবে তত এখন?
না, এক কাপ কফি নিয়ে এস।
কৃষ্ণা ঘর থেকে বের হয়ে যেতেই কিরীটী সোফা-কাম-বেডটার উপর টান-টান হয়ে শুয়ে পড়ল। দীপিকার কথাই মনের মধ্যে আনাগোনা করছিল কিরীটীর। এই সময় কিন্তু দীপিকার কাছে গিয়ে কোন লাভই নেই। অতীতের সমস্ত স্মৃতি বর্তমানে তার মন থেকে মুছে গিয়েছে। ডাঃ বর্মণ যেমন বলেছেন, দীপিকার পূর্ণ স্মৃতি আবার ফিরে আসবে, কিন্তু কবে কেমন করে আসবে,তা তিনি বলতে পারেন না; তার ওপর নির্ভর করে বসে থাকলে কিরীটীর চলবে না, তাই সে মনে মনে গাড়িতে আসতে আসতেই সঙ্কল্প করেছিল, দীপিকার পূর্বস্মৃতি ফিরে আসে কিনা সে-সম্পর্কে সে একবার চেষ্টা করে দেখবে।
কারণ কিরীটীর মন কেন যেন প্রথম থেকেই বলছে, দীপিকা হয় হত্যাকারীকে দেখেছিল বা সে বাথরুমে এমন কিছু দেখেছিল যেটা তার মানসিক ভারসাম্য হারাবার কারণ হয়েছিল।
হত্যাকারী কি তখনো বাথরুমের মধ্যেই ছিল? তাই যদি হয় তো, ময়না তদন্ত রিপোর্টে যেমন নিবণীতোষের মৃত্যুর সময় বলছে—সেটা ঠিক নয়, হয়তো দীপিকা ঘরে ঢোকার পরই হত্যাকারী নির্বাণীতোষকে হত্যা করেছে। কিন্তু তাহলে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, হত্যাকারী বাথরুমের মেথরদের যাতায়াতের দরজাটা খুলে পালাল না কেন? আর তা যদি না পালিয়ে থাকে তো কোন্ রাস্তা দিয়ে সে পালাল? সিঁড়িপথ দিয়ে নিশ্চয়ই নয়?
কৃষ্ণা এসে ঘরে ঢুকল, হাতে কফির কাপ।
কফির কাপটা কিরীটীর হাতে তুলে দিয়ে সামনের সোফাটার উপরে বসতে বসতে কৃষ্ণা বলল, দেখ, আমার একটা কথা কাল রাত্রে শুয়ে শুয়ে মনে হচ্ছিল—
কি কথা? কিরীটী স্ত্রীর মুখের দিকে তাকাল।
হত্যাকারীকে দীপিফা বোধ হয় দেখতে পেয়েছিল, শুধু তাই নয়, চিনতে পেরেছিল তাকে।
তার মানে তুমি বলতে চাও কৃষ্ণা, হত্যাকারী দীপিকার কোন পরিচিত জন?
মনে হয় তাই।
হওয়াটা অসম্ভব নয়। তবে পোস্টমর্টেমের রিপোর্ট যদি সত্যি বলে ধরে নিই, তাহলে হত্যাকারীর তখন সেখানে উপস্থিত থাকাটা কোন যুক্তিবিচারেই গ্রহণযোগ্য নয়।
কেন?
কারণ দীপিকা ওপরে গিয়েছিল পৌনে বারোটা নাগাদ, তারপর ব্যাপারটা আবিষ্কৃত হয় এবং পোস্টমর্টেম রিপোর্ট বলছে পৌনে এগারোটা থেকে পৌনে বারোটা ঐ এক ঘণ্টা সময়ের মধ্যেই কোন এক সময় নির্বাণীতোষকে হত্যা করা হয়েছে। খুব সম্ভবত এগারোটা থেকে সাড়ে এগারোটার মধ্যে। তাই যদি হয়, তবে হত্যার পর আধ ঘণ্টা পনের কুড়ি মিনিট হত্যাকারী বাথরুমে থাকবে কেন?.কাজ শেষ হবার পর তো তার চলে যাওয়াটাই স্বাভাবিক।
তা স্বাভাবিক, তবে এমনও তো হতে পারে—
কি?
কোন্ পথে পালাবে, কোন্ পথে পালালে যে কারো নজরে পড়বে না সেটা ভাবতে তার কিছু সময় গেছে।
তারপর? পালাল কোন্ পথে? বাথরুমের মেথরদের যাবার দরজা তো বন্ধ ছিল, আর সিঁড়ি দিয়ে পালালে সবার চোখে পড়ে যেত তখন।
পাশের ঘরের সংলগ্ন বাথরুম নেই?
কিরীটী যেন কৃষ্ণার কথায় চমকে উঠে বললে, ঠিক বলেছ! সে ঘরটা তো দেখিনি! বলেই সঙ্গে সঙ্গে উঠে পড়ে কিরীটী শিবতোষের বাড়িতে ফোন করল।
শিবতোষ বাড়িতে ছিলেন না। ফোন ধরল তাঁর ছোট মেয়ে স্বাতী, কে?
আমি কিরীটী রায়, আপনি কে?
স্বাতী।
স্বাতী দেবী, আমাকে একটা সংবাদ দিতে পারেন?
কি বলুন?
আপনার দাদা তিনতলায় যে পাশাপাশি দুটি ঘর ব্যবহার করতেন, তার দুটো ঘরেই কি সংলগ্ন বাথরুম আছে?
আছে। ওপরের সব ঘরেই সংলগ্ন বাথরুম আছে, একটা ঘর বাদে।
সে বাথরুমেও নিশ্চয়ই মেথরদের যাতায়াতের ব্যবস্থা আছে?
পেছনের দিকে একটা সরু ফালি বারান্দা আছে, সেই বারান্দা দিয়েই প্রত্যেকে বাথরুমে ঢোকে, মেথরের সিঁড়িটা লোহার ঘোরানো।
ওপরে গিয়ে চট্ করে একবার দেখে আসবেন, সেই পাশের ঘরের বাথরুমের দরজাটা খোলা মা বন্ধ?
ধরুন, দেখে এসে বলছি।
মিনিট দশেক বাদেই স্বাতী এসে বলল, দরজাটা বন্ধ আছে।
আর একটা কথা, সে রাতের পর কেউ কি তিনতলায় আর গিয়েছে?
না। কেউ যায় না আর ওপরে। মেথররাও না?
না।
কেন?
বাবা বারণ করে দিয়েছেন। ওপরের সব ঘরেই এখন তালা দেওয়া।
বৌদি কেমন আছেন?
সেই রকম।
কিছুই মনে করতে পারছেন না?
না।
ধন্যবাদ। কিরীটী ফোনটা রেখে দিল।
উঃ কৃষ্ণা, তোমার জন্যই রহস্যের রীতিমত শক্ত জট খুলে গেল। কেবল সেদিন থেকে অন্ধকারে হাতড়ে মরছিলাম, অথচ একবারও দ্বিতীয় ঘটনার কথা মনে হয়নি, আশ্চর্য! এতবড় একটা ভুল হল লে আমার? মাথার বস্তুগুলো বোধ হয় সব ফসিল হয়ে গিয়েছে আমার কৃষ্ণা Must retire now, কিরীটীর ছুটি এবারে—
না, কিছুই হয়নি—সব ঠিক আছে।
তবে কথাটা মনে পড়ল না কেন? বুড়ো হয়ে গিয়েছি কৃষ্ণা-বুড়ো হয়ে গিয়েছি, সকলকে প্রণাম জানিয়ে এবারে ছুটি নেব।
হয়ত পরে মনে পড়ত, কৃষ্ণা মৃদু হেসে বলে।
স্বামীকে স্তোক দিচ্ছ?
না গো না। কিরীটী রায় তার জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত কিরীটী রায়ই থাকবে, কিন্তু কফিটা যে ঠাণ্ডা হয়ে গেল!
যাক। জটটাও খুলেছে, আর সেই সঙ্গে এখন যেন অন্ধকারে একটু একটু করে আলোও ফুটে উঠেছে।।
০৯. ঐদিনই বিকেলের দিকে
ঐদিনই বিকেলের দিকে।
খোলা জানলাপথে মৃদু মৃদু প্রথম বসন্তের হাওয়া আসছে।
কৃষ্ণা আর কিরীটী তাদের বসবার ঘরে বসে গল্প করছিল। জংলী এসে ঘরে ঢুকল, বাবুজী!
কিরে?
একজন ভদ্রমহিলা আর একজন ভদ্রলোক আপনার সঙ্গে দেখা করতে এসেছেন।
কোথা থেকে এসেছে? নাম কি?
বলতে বললেন শিবতোষবাবুর মেয়ে।
যা, এই ঘরে নিয়ে আয়।
একটু পরে ঢুকল স্বাতী ও দামী সিল্কের সুট-পরিহিত সুদর্শন এক ভদ্রলোক, বয়স আটাশ-ঊনত্রিশ হবে।
আসুন।
নমস্কার। আমার নাম পরেশভৌমিক, স্বাতী আমার স্ত্রী,কলকাতা হাইকোর্টে আমি প্র্যাকটিস করি। বার-এট-এল। আপনিই তো মিঃ রায়!
হ্যাঁ বসুন, নমস্কার।
ওঁরা দুজন বসলেন। তারপর পরেশ ভৌমিক বললেন, দেখুন মিঃ রায়, আপনি হয়ত আমাদের দুজনের এভাবে আসায় একটু অবাকই হয়েছে, ভাবছেন কেন এলাম—
না না, তা কেন—
এসেছি এইজন্য যে, আমার স্ত্রী স্বাতী সেদিন আপনার কাছে যে স্টেটমেন্ট দিয়েছিল তার মধ্যে একটা মিথ্যা ছিল, শুনে আমি ওকে নিয়ে এলাম, মিথ্যাটা সংশোধন করে নেবার জন্য।
মিথ্যা স্টেটমেন্ট! কিরীটী তাকাল পরেশ ভৌমিকের মুখের দিকে।
হ্যাঁ, স্বাতীয়ে বলেছিল, ওদের বৈমাত্রেয় ভাই, ঐদিন উৎসবের রাত্রে—
কিরীটী বাধা দিয়ে বললে, হ্যাঁ, উনি বলেছিলেন ওঁদের বৈমাত্রেয় ভাই আশু মল্লিককে কখনও উনি বেলতলার বাড়িতে আসতে দেখেননি। উনি যে সত্য গোপন করেছিলেন সেটা আমি বুঝতে পেরেছি পরে।
পেরেছেন বুঝতে?
হ্যাঁ, আগের কথা বলতে পারি না, তবে উৎসবের রাত্রে যে আশু মল্লিক এসেছিলেন সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। আর এও বুঝেছিলাম, অন্য কোনদিন না দেখলেও সে রাত্রে উনি বুঝতে পেরেছিলেন ঐ অচেনা আগন্তুকই ওঁর বৈমাত্রেয় ভাই। আপনার যদি আপত্তি না থাকে স্বাতীদেবী, এবার বলুন সে-রাত্রে কখন কোথায় দেখেছিলেন তাঁকে আর চিনতেই বা পারলেন কি করে তাঁকে যে তিনি আপনাদের বৈমাত্রেয় ভাই?
বল স্বাতী, আমাকে যা বলেছ তা ওঁকে বল। ব্যাপারটা একটা জঘন্য মাডার কেস, প্রত্যেক সমাজ-সচেতন ব্যক্তিরই কর্তব্য দেশের আইনকানুনকে সাহায্য করা নিজ নিজ সাধ্যমত। ইট ইজ ইওর ডিউটি, স্পিক আউট!
স্বাতী তখন যা বললে—
রাত সাড়ে দশটা নাগাদ সে একবার উপরে গিয়েছিল, দু-চার-পাঁচ মিনিট হয়ত আগেই। দীপিকার চশমাটা আনতে ওপরের ঘর থেকে। বৌ সাজাবার পর দীপিকা চশমাটা পরতে ভুলে গিয়েছিল। পরে তাকে ঘরে এনে বসিয়ে দেবার ঘন্টা-তিনেক পরে কষ্ট হতে থাকায় শেষ পর্যন্ত স্বাতীকে বলে ওপরে গিয়ে চশমাটা নিয়ে আসার জন্য। সেই চশমাটা আনতেই স্বাতী ওপরে গিয়েছিল। ঘরের দরজা খোলা এবং ঘরে আলো জ্বলতে দেখে স্বাতী একটু অবাকই হয়। হঠাৎ ওর কানে আসে ঘরের মধ্যে তার দাদা যেন কার সঙ্গে কথা বলছে।
দাদার কথা নিশ্চয়ই শুনেছিলেন আপনি? কিরীটীর প্রশ্ন।
হ্যাঁ, দাদা যেন কাকে বলছিল, নিশ্চয়ই দেব দাদা, তোমার আশীর্বাদ দীপাকে আমি নিজেই পরিয়ে দেব। কিন্তু তুমিও তো নিজের হাতে তাকে দিতে পার, সে সব জানে—তাকে ডেকে আনব নীচে থেকে?
তারপর?
জবাব এল ভারী গম্ভীর গলায়, না না—তার কোন দরকার নেই ভাই। তুমি তাকে দিও আমার নাম করে। এ বাড়িতে কোনদিনই আমি আসতাম না, আসব না-ই ভেবেছিলাম, কিন্তু তোমার চিঠি পেয়ে আসতেই হল।
এবার আমি যাব। বড়দা বললেন শুনতে পেলাম।
দাদা?
বল? বড়দার গলা।
বাবাকে তুমি ত্যাগ করেছ বড়মার ওপরে অন্যায় করেছিলেন বলে। সে ব্যাপারে আমি কিছুই বলতে চাই না, কিন্তু আমরা ভাইবোনেরা তো কোন অপরাধ করিনি তোমার কাছে?
আমাদের কেন ত্যাগ করলে?
বড়দার গলা শোনা গেল আবার, তোমাদের তো আমি ত্যাগ করিনি ভাই। ত্যাগ করলে কি আসতাম আজ তোমার চিঠি পেয়ে। কিন্তু আর নয় ভাই, এবারে আমি যাব।
স্বাতী বললে, তখনি দরজার পাশ থেকে উঁকি দিয়ে বড়দাকে আমি দেখি। দাদা বড়দাকে প্রণাম করল। বড়দা দাদার মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করলেন।
তারপর?
বড়দা বললেন দাদাকে, আসার কথা যেন কেউ না জানতে পারে নির্বাণী।
কেউ জানবে না দাদা।
না, বোনেদেরও বলল না।
না, বলব না। আমি তুমি আসবে ফোনে সেদিন হাসপাতালে বলার পরই এই ঘরের রাথরুমের দরজাটা খুলে রেখে দিয়েছিলাম আজ সন্ধ্যাবেলাতেই। চল ঐ পথ দিয়েই তোমায় বের করে দেব। স্বাতী তার কথা শেষ করে একটু থামল, তারপর আবার বললে, আর একটা কথাও আপনার জানা দরকার কিরীটীবাবু।
বলুন?
বড়দা বৌদিকে দেবার জন্য দাদার হাতে যে প্রেজেনটেশনটা দিয়ে গিয়েছিলেন, একটা সোনার হার, সেটা আমার কাছেই আছে।
আপনার কাছে?
হ্যাঁ, দাদা বড়দাকে নিয়ে বের হয়ে যাবার পর ঘরে ঢুকে আমি একটা ভেলভেটের কেস বিছানার ওপর পড়ে থাকতে দেখে সেটা তুলে নিই।
তারপর?
নীচে নিয়ে এসেছিলাম বৌদির গলায় পরিয়ে দেব বলে, কিন্তু লোকজনের আসা-যাওয়ার জন্য সুযোগ পাইনি। সেটা আমার কাছেই আছে। কথাগুলো বলে স্বাতী কেমন যেন ইতস্তত করতে থাকে। মনে হয় কিরীটীর, স্বাতীর যেন আরো কিছু বলার আছে কিন্তু বলতে পারছে না।
আর কিছু বলবেন স্বাতীদেবী?
কিরীটীবাবু!
বলুন?
দাদাকে বড়দা খুন করতে পারে বলে আপনার বিশ্বাস হয়?
না। আপনার দাদাকে আশুবাবু খুন করেননি।
আঃ, আপনি আমাকে বাঁচালেন কিরীটীবাবু। আমার স্বামীর ধারণা বিষয়ের লোভে বড়দাই দাদাকে–
পরেশবাবু, নির্বাণীবাবুর হত্যাকারী আশু মল্লিক নন।
আপনি বুঝতে পেরেছেন কে হত্যাকারী? পরেশ ভৌমিক জিজ্ঞাসা করলেন।
পেরেছিলাম গতকালই, এখন নিঃসন্দেহ হলাম।
কে–কে হত্যাকারী?
ক্ষমা করবেন মিঃ ভৌমিক, সবটাই আমার অনুমান এখনও। অনুমানের ওপর নির্ভর করে তো একজনের হাতে হাতকড়া পরানো যায় না। প্রমাণ-প্রমাণের দরকার, কাজেই যতক্ষণ না সেই প্রমাণ আমার হাতে আসছে কিছুই বলতে পারব না।
অতঃপর স্বাতী ও পরেশ ভৌমিক বিদায় নিল। একটু পরে কৃষ্ণা ঘরে ঢুকে দেখল, কিরীটী ঘরের মধ্যে পায়চারি করছে।
ওরা কি বলতে এসেছিল গো? কৃষ্ণা শুধাল।
ওরা যা বলে গেল, মানে স্বাতীদেবী, অর্থ হচ্ছে হতভাগ্য নির্বাণীতোষ নিজেই তার হত্যাকারীর আসবার পথটা খুলে রেখেছিল।
সে কি!
হ্যাঁ। সত্যিই ভাগ্যের নির্মম পরিহাস! জান সে রাত্রে আশু মল্লিক তার ভাতৃবধূকে আশীর্বাদ করতে এসেছিল।
আশু মল্লিক, সত্যি-সত্যিই এসেছিল তাহলে?
হ্যাঁ, কিন্তু—
কি?
দুভাগ্যই বলতে হবে। বাপ ও ছেলের মধ্যে পুনর্মিলনের যে ক্ষীণ সম্ভাবনাটুকু ছিল, নির্বাণীতোষের মৃত্যুতে তাও আর রইল না। বাপ ও ছেলের মধ্যে যে সেতুটা গড়ে উঠছিল, সেটা বোধ হয় চিরদিনের মতই ভেঙে গেল।
তোমার মুখ দেখে মনে হচ্ছে যেন আরও কিছু সংবাদ আছে! কৃষ্ণা বলল।
হ্যাঁ কৃষ্ণা, হত্যাকারী আর অস্পষ্ট নেই—সে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে আমার সামনে এতক্ষণে। সন্দেহটা আমার গোড়া থেকেই হয়েছিল–কিন্তু ঐ নীলবসনা নারী, সে-ই সব যেন কেমন গোলমাল করে দিচ্ছিল।
নীলবসনা নারী কে ছিল বুঝতে পেরেছ?
অনুমান করতে পেরেছি বৈকি, এবং তার আইডেনটিফিকেশানেরও সব ব্যবস্থা করেছি। অহল্যার ঘুম ভাঙানোর জন্য কিন্তু এখন মনে হচ্ছে—
কি গো?
অহল্যার ঘুম ভাঙা মানেই তো নিদারুণ আর এক আঘাত তার বুক পেতে নিতে হবে।
তোমার কি মনে হয় হত্যাকারীকে সে চিনতে পেরেছিল?
সম্ভবত নয়। কারণ হত্যাকারী সে-সময় তার ধারেকাছেও ছিল না।
তবে?
ঐ ভাবে আকস্মিক স্বামীর রক্তাক্ত ছোরাবিদ্ধ মৃতদেহটাই তাকে এমন আঘাত হেনেছিল যে সেটা সে সহ্য করতে পারেনি। জ্ঞান হারিয়ে পড়ে যায় ওঁ মনের ভারসাম্য হারায়।
ঐ সময় ঘরের কোলে টেলিফোনটা বেজে উঠল।
কিরীটী এগিয়ে গিয়ে ফোনের রিসিভারটা তুলে নিল, কিরীটী রায়—
আমি শিখেন্দু বলছি।
হ্যাঁ, হ্যাঁ বলুন! সংবাদ পেয়েছেন?
হ্যাঁ।
নবীন অপেরাতেই দেখা পেলেন?
না। সেখান থেকে তার ঠিকানা যোগাড় করে কুমোরটুলিতে তার বাসায় গিয়ে দেখা করি। পাইকপাড়া স্পোর্টস ইউনিয়ন ক্লাবের এক সময় মেম্বার ছিল তপন শিকদার। সে-সময় ওদের ক্লাবে বরাবরই রোল করেছে। তারপর বছর দুই হল তপন নবীন অপেরায় জয়েন করেছে
আপনি সে-রাত্রির কথা বলুন।
সে-রাত্রে সঞ্জীব তাদের ক্লাবের বহ্নিশিখা বইতে আদৌ নামেনি—
তাই নাকি!
হ্যাঁ। অথচ প্লের দিন স্থির হয়ে গিয়েছে, তাই তখন সে তপন শিকদারকে গিয়ে ধরে রোলটা করে দেবার জন্য।
তারপর?
তপন একশো পঁচিশ ডিমাণ্ড করে। শেষটায় একশোতে রাজী করায় সঞ্জীব কে পঞ্চাশ টাকা অ্যাডভান্স করে দেয়, কথা ছিল বাকি টাকা সে প্লে শেষ হবার পর পাবে। ওদের ক্লাবের সেক্রেটারী সেকথা জানত না। তিনি ভেবেছিলেন, তপন শিকদার ক্লাবের একসময় মেম্বার ছিল, বিনি পয়সাতেই একটা রাত্রি প্লে করে দিচ্ছে—তাই প্লের পর টাকা চাওয়ায় সেক্রেটারী তাকে টাকা দেয়নি। বলেছিল, সঞ্জীবের সঙ্গে কথা বলে টাকা দেবে—
ঠিক আছে, বাকি যা বলেছিলাম তার ব্যবস্থা করেছেন?
হ্যাঁ।
নীল শাড়ি যোগাড় হয়েছে?
সে হয়ে যাবে।
তা হলে মনে থাকে যেন, কাল রাত দশটায় যেমন বলেছি, তপনবাবুকে নীল শাড়ি পরিয়ে নিয়ে আসবেন শিবতোষবাবুর বেলতলার বাড়িতে।
বেশ।
শুধু আপনি একা নয় কিন্তু—
তবে?
সঞ্জীববাবু, নির্মলবাবু ও পরেশবাবুকেও সঙ্গে আনবেন।
তাদের কি বলব?
বলবেন আমি আসতে বলেছি, কাল রাত দশটায় নির্বাণীবাবুদের বেলতলার বাড়িতে। আরও একটা কথা, সদর দিয়ে কিন্তু বাড়ির মধ্যে প্রবেশ করবেন না।
তবে? কোথা দিয়ে ঢুকব?
বাড়ির পেছনে যে গোপন লোহার সিঁড়িটা আছে, সেই সিঁড়ি দিয়ে সোজা আপনারা নির্বাণীবাবুর শোবার ঘরে গিয়ে ঢুকবেন তিনতলায়। বাথরুমের দরজা খোলা থাকবে, বারান্দার ভেতর দিয়ে ঢুকবেন।
শিখেন্দু কোন সাড়া দেয় না।
শিখেন্দুবাবু, বুঝতে পেরেছেন প্ল্যানটা আমার?
পেরেছি। কিন্তু এসব কেন করছেন তা তো বললেন না!
আমার স্থির বিশ্বাস—
কি?
যে আয়োজন আমরা করেছি, তাতে করে অহল্যার ঘুমও ভাঙবে–হত্যাকারীর মুখোশটাও তার মুখ থেকে খুলে যাবে।
আপনি সত্যিই তাই মনে করেন কিরীটীবাবু?
এখন আর কথা নয় শিখেন্দুবাবু, আমার কিন্তু কাজ এখনো বাকি আছে। সেগুলো আমায় শেষ করতে হবে। কাল দেখা হবে রাত দশটায়।
১০. পরের দিন রাত্রে
পরের দিন রাত্রে। দশটা বাজতে তখনও কিছু সময় বাকি আছে।
বেলতলায় শিবতোষের বাড়ির তিনতলার সেই ঘর। আসবাবপত্র যেমন যেখানে ছিল তেমনি আছে। কেবল সে-রাত্রের মত ফুলের সমারোহ নেই। ঘরের মধ্যে যেন একটা করুণ স্তব্ধতা বিরাজ করছে। ঘরের মধ্যস্থলে একটি চেয়ারের উপরে দীপিকা উপবিষ্ট। এবং সে-রাত্রে ঘরে ছিল উজ্জ্বল আলোআজ একটি মাত্র আলো ঘরের কোণে জ্বলছে। দীপিকার পূর্বস্মৃতি এখনো ফিরে আসেনি। সে এখনো নিজীব। নিজের থেকে কোন কথা বলে না, হাসে না, কাঁদে না, এমন কি ক্ষুধা পেলে খাওয়ার কথাও বলতে পারে না। ডাঃ বর্মণ শিবতোষকে পরামর্শ দিয়েছিলেন, দীপিকাকে কোন নার্সিং হোমে ভর্তি করে দেবার জন্য। শিবতোষও অসম্মত ছিলেন না, কিন্তু কিরীটী তাঁকে বলেছিল, কটা দিন অপেক্ষা করুন, তারপর ডাঃ বর্মণ যেমন বলেছেন তাই করা যাবে। তাছাড়া দীপিকাও সর্বক্ষণ শান্ত চুপচাপই রয়েছে, বরং কিছুদিনের জন্য কিরীটীর পরামর্শে দীপিকার দেখাশোনার জন্য দুজন নার্স রাখা হয়েছিল রাত্রি ও দিনের জন্য। আর স্বাতীকেও যেতে দেয়নি কিরীটী। স্মৃতি দিল্লীতে থাকে, সে তার স্বামীর সঙ্গে দিল্লী চলে গিয়েছে।
পরেশ ভৌমিক নিজেও বলেছেন, কিরীটীবাবু যতদিন বলবেন তুমি বরং তোমার বৌদির সঙ্গে এই বাড়িতে থাক।
ঘরের মধ্যে চেয়ারে উপবিষ্ট দীপিকার পাশেই দাঁড়িয়েছিল রাত্রির নার্স ও স্বাতী। কিরীটী ঘরের মধ্যে পায়চারি করছিল আর ঘন ঘন নিজের হাতঘড়ির দিকে তাকাচ্ছিল।
বাথরুমের মধ্যে আলো জ্বলছে—মেথরের যাতায়াতের দরজাটা বাথরুমের মধ্যে খোলাই রাখা হয়েছে—কিরীটীর নির্দেশমত।
বাথরুমের মধ্যে মৃদু পদশব্দ শোনা গেল।
কিরীটী বাথরুমের দরজার দিকে তাকাল, শিখেন্দু এসে ঘরে প্রবেশ করল।
আসুন, শিখেন্দুবাবু! পরেশবাবু নির্মলবাবু সঞ্জীববাবু তাঁরা আসেন নি? কিরীটী প্রশ্ন করল।
বলে দিয়েছি, সবাই তো বলেছে আসবে ঠিক দশটাতেই। শিখেন্দু মৃদু গলায় জবাব দিল। ঘরের কোণে রক্ষিত স্ট্যাণ্ডের একটিমাত্র আলোর জন্য অত বড় ঘরটা যেন ঠিক ভালভাবে আলোকিত হয়ে উঠতে পারেনি। দীপিকা যেখানে বসেছিল, তারই অল্প দূরে চারটি চেয়ার রাখা ছিল। কিরীটী শিখেন্দুকে বলল, ঐ যে শিখেন্দুবাবু, চেয়ার রয়েছে, বসুন।
শিখেন্দু একবার কিরীটীর মুখের দিকে তাকাল, তারপর নিঃশব্দে এগিয়ে গিয়ে ডানদিককার শেষ চেয়ারটায় বসল।
বাথরুমের আলোটা কিন্তু উজ্জ্বল।
শিখেন্দু আসবার মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পরেশ আর নির্মল এসে ঘরে ঢুকল। তারা ঘরে ঢুকেই যেন থমকে দাঁড়াল। দুজনেই চারদিকে তাকাল।
বসুন। পরেশবাবু নির্মলবাবু, শিখেন্দুবাবুর পাশেই বসুন। সঞ্জীববাবু কই? তিনি এলেন না?
জবাব দিল পরেশ, সে তো আমাদের আগেই বের হয়েছে। এখনও এল না কেন বুঝতে পারছি না তো। কিন্তু আমাদের আজ রাত্রে এভাবে সকলকে আসতে বলেছেন কেন কিরীটীবাবু?
আজ এখানে এই ঘরে সনাক্তকরণ করব।
নির্মল শুধাল যেন প্রায় বোজা গলায়, সনাক্ত করবেন!
হ্যাঁ।
কাকে?
হত্যাকারীকে—
কিরীটীর ওপ্রান্ত হতে শব্দটা উচ্চারিত হবার সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় সঞ্জীব এসে ঘরে প্রবেশ করল। কথাটা তারও কানে যায়। সঙ্গে সঙ্গেই সে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে।
বসুন, সঞ্জীববাবু!
সঞ্জীব চারদিকে একবার তাকাল, তারপরই নজরে পড়ল অল্প দূরে চারটি চেয়ার। তার তিনটিতে পাশাপাশি বসে শিখেন্দু, পরেশ ও নির্মল। নির্মলের পাশের চেয়ারটা খালি।
সঞ্জীব বসে না, কেমন যেন ইতস্তত করে।
কি হল সঞ্জীববাবু, বসুন! নির্মলবাবুর পাশের চেয়ারটায় বসুন। ওটা আপনার জন্যই রাখা আছে।
সঞ্জীব কেমন যেন শিথিল পায়ে এগিয়ে গিয়ে চেয়ারটার উপর বসে পড়ল।
শিখেন্দুবাবু পরেশবাবু নির্মলবাবু সঞ্জীববাবু আপনারা চারজন নির্বাণীতোষের ঘনিষ্ঠ বন্ধু ছিলেন, কিরীটী বলতে থাকে, আর আপনাদের পাঁচজনেরই সঙ্গে পরিচয় ছিল ঐ যে সামনে বসা দীপিকা দেবী আজ যিনি নির্মম এক নিষ্ঠুরতায় অতীতের স্মৃতি হারিয়ে একেবারে বলতে পারেন বোবা হয়ে গিয়েছেন, বেঁচে নেই—জীবন্মৃত–
সবাই চুপ, কারো মুখেই কথা নেই।
কিরীটী আবার বলল, আমি আশা করেছিলাম হত্যাকারীকে আপনারা ধরিয়ে দেবেন, কারণ দীপিকাকে আপনারা সকলেই মনে মনে এক সময় বাসনা করেছেন
না, না। সঞ্জীব বলে ওঠে।
পরেশ প্রতিবাদ জানায়, মিথ্যা বলিস না সঞ্জীব, আমরা পাঁচজনেই মনে মনে দীপাকে চেয়েছি, কিন্তু শেষ পর্যন্ত দীপা নির্বাণীর গলাতেই মালা দিয়েছিল, কারণ দীপা ভালবাসত একমাত্র নির্বাণীকেই।
কিরীটী বলল, ঠিক। এবং সহজভাবেই ব্যাপারটা নেওয়া উচিত ছিল আপনাদের, কিন্তু তা নিতে পারলেন না—
সঞ্জীব বলে ওঠে, বিশ্বাস করুন কিরীটীবাবু, সহজভাবেই নিয়েছিলাম অন্তত আমি ব্যাপারটা–
তাই যদি হবে সঞ্জীববাবু, আপনি আমার কাছে মিথ্যে স্টেটমেন্ট দিলেন কেন?
মিথ্যে স্টেটমেন্ট দিয়েছি!
হ্যাঁ, দিয়েছেন।
না। সত্যিই বলেছি।
কিন্তু সঞ্জীবের কথা শেষ হল না, এক নীলবসনা নারী খোলা দরজাপথে ঘরে এসে ঢুকল।
সঞ্জীব ঘেমে গিয়েছে ততক্ষণে। বাকি তিনজনের মুখেও কোন কথা নেই। কেবল দীপিকা মাথা নীচু করে বসে আছে।
নীলবসনা নারী সোজা বাথরুমের মধ্যে গিয়ে ঢুকল, তারপরই হঠাৎ দপ দপ করে ঘরের সব কটা আলো জ্বলে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে দীপিকা মুখ তুলল।
কিরীটী বললে, আসুন, বের হয়ে আসুন!
সেই নীলবসনা নারী একপ্রকার ছুটেই বাথরুম থেকে বের হয়ে দীপিকার সামনে দিয়ে দুই ঘরের মধ্যবর্তী দরজাপথে পাশের ঘরে গিয়ে ঢুকল—আর সঙ্গে সঙ্গে অস্বাভাবিক তীক্ষ্ণ গলায় চেচিয়ে উঠল দীপিকা, ধর ওকে, ধর বলতে বলতে উঠে দাঁড়াতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেল মেঝেতে।
কিরীটী দীপিকাকে পরীক্ষা করে বললে, নার্স, অজ্ঞান হয়ে গিয়েছেন, আসুন ধরুন ওঁকে, তুলে বিছানায় শুইয়ে দিই।
কিরীটী মাথার দিকটা ধরল, নার্স ও স্বাতী পায়ের দিক ধরে দীপিকাকে তুলে শয্যায় শুইয়ে দিল।
যান, পাশের ঘরে ডাঃ বর্মণ আছেন তাঁকে ডেকে আনুন।
সবাই চুপ, সবাই যেন বোবা। ডাঃ বর্মণকে ডাকতে হল না, তিনি নিজেই এসে ঘরে ঢুকলেন।
আপনার পেসেন্টকে পরীক্ষা করে দেখুন ডাক্তার!
ডাঃ বর্মণ দীপিকার পাল্টা একবার পরীক্ষা করলেন, তারপর শান্ত গলায় বললেন, She is alrightমনে হচ্ছে মিঃ রায়, আপনার experiment successful! জ্ঞান ফিরে আসার সঙ্গে সঙ্গে ওঁর পূর্বস্মৃতি আবার ফিরে পাবেন। নার্স সোডিয়াম গার্ডিনল ইনজেকশনটা এঁকে দিয়ে দাও। রেডি করাই আছে পাশের ঘরে ট্রের ওপরে। নার্স চলে গেল পাশের ঘরে এবং সিরিঞ্জটা হাতে নিয়ে এসে ইনজেকশনটা দিয়ে দিল। ঠিক আছে, ডাঃ বর্মণ বললেন, now let her sleep for 2/3 hours! ঘুম ভাঙবার পর নিশ্চয়ই আমরা দেখতে পাব উনি পূর্বস্মৃতি ফিরে পেয়েছেন। আমি কি চলে যাব এবারে, মিঃ রায়? আমার কিন্তু নাটকের শেষ দৃশ্যটা দেখতে ইচ্ছে করছে if you allow me please!
থাকুন আপনি। তপনবাবু? বলে উচ্চকণ্ঠে ডাকল কিরীটী।
নীলবসনা নারী ঘরে এসে ঢুকল।
আপনি ঐ মেয়ের পোশাক ছেড়ে নিজের জামাকাপড় পরতে পারেন এবারে।
তপন চলে গেল আবার পাশের ঘরে।
সবাই নিবক, সবাই বোবা। যেন পাথর চার বন্ধু শিখেন্দু, পরেশ, নির্মল, সঞ্জীব।
এবারে সঞ্জীববাবু বলুন,সে রাত্রে কেন নারীর বেশ ধরে এখানে এসেছিলেন?
একটু কৌতুক করবার জন্য—ক্ষীণ গলায় বললে সঞ্জীব।
কৌতুক!
হ্যাঁ, কথা ছিল আমি বাথরুমের মধ্যে লুকিয়ে থাকব-নির্বাণী ও দীপা ঘরে এসে খিল দিলে আমি বাথরুম থেকে বের হয়ে আসব। এসে—
বলুন, থামলেন কেন?
নির্বাণীর সঙ্গে অভিনয় করে চলব, এই তোমার যদি মনে ছিল নির্বাণী, আমাকে ভালবেসে মজাতে গিয়েছিলে কেন? Just a fun—কিরীটীবাবু, just a fun!
আপনার ঐfun বা কৌতুকের পরিকল্পনাটা আপনার অন্যান্য বন্ধুরা জানতেন? বলেছিলেন তাঁদের?
জানত–সবাই জানত, পরামর্শ করেই আমরা পরিকল্পনাটা করেছিলাম।
সে-রাত্রে কখন এসেছিলেন আপনি?
রাত তখন সাড়ে এগারোটার পরই হবে, সঞ্জীব বললে, বোধ হয় পৌনে বারোটা।
কোন্ পথ দিয়ে আপনি ওপরে গিয়েছিলেন?
বাগানের দিকে বাড়ির পিছনে মেথরদের যাঅয়াতের ঘোরানো লোহার সিঁড়ি দিয়ে।
কি–কি বললেন? ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে পিছন দিককার?
হ্যাঁ।
কিন্তু সিঁড়ি দিয়ে উঠে যদি দেখতেন বাথরুমের দরজা বন্ধ, তবে বাথরুমে ঢুকতেন কি করে?
শিখেন্দু বলেছিল, দরজাটা সে খুলে রেখে দেবে
কিন্তু আমি—আমি দরজাটা খুলে রাখবার কথা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। মনেই ছিল না কিরীটীবাবু কথাটা। বিশ্বাস করুন, আমি দরজা খুলে রাখিনি।
জানি আপনি রাখেননি, নির্বাণীতোষ নিজেই খুলে রেখেছিলেন সন্ধ্যা থেকে—কিরীটী বললে।
পরেশ বলল, নিবণী খুলে রেখেছিল!
হ্যাঁ।
কিন্তু কেন? সে তো জানত না আমাদের প্ল্যানটা?
বলতে পারেন তাঁর নির্মম ভাগ্যই তাঁকে দিয়ে দরজাটা খুলিয়ে রেখেছিল সে-রাত্রে। কিন্তু সঞ্জীববাবু, আপনি বাথরুমে ঢুকে কি দেখেছিলেন? বলুন, গোপন করবেন না কারণ আমি জানি আপনি কি দেখেছিলেন। কিরীটীর স্বর স্পষ্ট ও কঠিন।
সঞ্জীবের সমস্ত মুখ যেন রক্তহীন ফ্যাকাশে বিবর্ণ হয়ে গিয়েছে। সে কেমন অসহায় বোবা দৃষ্টিতে কিরীটীর মুখের দিকে চেয়ে আছে। সে কথা বলতে পারছে না। ঠোঁট দুটো তার কাঁপছে, আমি–আমি—
আমি বলছি, আপনি কি দেখেছিলেন, সঞ্জীববাবু, আপনার বন্ধু রক্তাক্ত অবস্থায় বাথরুমের মেঝেতে পড়ে আছেন বলুন, তাই দেখেননি?
হ্যাঁ। সেই দৃশ্য দেখে আমি এমন ঘাবড়ে যাই যে—
যে পথে এসেছিলেন সেই পথেই পালিয়ে যান আবার পরমুহূর্তেই!
হ্যাঁ।
কোথায়, কোথায় যান সোজা বেলতলার বাড়ি থেকে?
ক্লাবে। সেখান থেকে বেশ বদলে মেসে যাই।
তাই ফিরতে আপনার মেসে সে-রাত্রে এত দেরি হয়েছিল, তাই না?
হ্যাঁ।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, পৌনে এগারোটায় যদি নির্বাণীতোেষ ওপরে গিয়ে থাকেন, তিনি খুন হয়েছেন সঙ্গে সঙ্গে। বাথরুমে ঢুকে মাথা ধরার জন্য যখন কোডোপাইরিন ট্যাবলেট হাতে জলের গ্লাস নিয়ে বেসিনের সামনে গিয়ে বেসিনের ট্যাপ থেকে জল ভরছিলেন, ঠিক সেই সময়েই অতর্কিতে পিছন থেকে ছোরার আঘাতে—
পরেশ বললে, তবে কি
হ্যাঁ পরেশবাবু, বাথরুমের স্ক্রিনের আড়ালে হত্যাকারী যেন ওৎ পেতে দাঁড়িয়ে প্রস্তুত হয়ে ছিল, কারণ সে জানত নির্বাণীতোষ ওপরে আসবে এবং বাথরুমেও আসাটা তার স্বাভাবিক শোবার আগে
কে–কে সেই হত্যাকারী। শিখেন্দু ভাঙা গলায় যেন চঁচিয়ে উঠল।
এখনও—এখনও বুঝতে পারলেন না শিখেন্দুবাবু, নির্বাণীতোষের হত্যাকারী কে?
কে?
সে জানত নির্বাণীতোষের শয়নঘরের দরজা বন্ধ, তাই পিছনের বারান্দা দিয়ে বাথরুমের খোলা দরজাপথে ঘরে ঢুকে শয়নঘরের দরজাটা খুলে দিয়েছিল এবং বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিয়েছিল! আপনি—শিখেন্দুবাবু, ইট ওয়াজ ইউ! অ্যাণ্ড ইট ওয়াজ দি মোস্ট আনকাইণ্ডেস্ট অফ ইউ!
অকস্মাৎ ঘরের মধ্যে যেন একটা মৃত্যুর স্তব্ধতা নেমে এসেছে।
পালাবার চেষ্টা করবেন না শিখেন্দুবাবু, কারণ বাড়ি ঘিরে রেখেছে পুলিসে। সন্দেহটা প্রথম থেকেই আপনাকে ঘিরেই আমার মনের মধ্যে দানা বেঁধে উঠেছিল। সে-রাত্রে ফোনে সংবাদ পেয়ে এখানে এসে সব দেখেশুনে কিন্তু একটা—একটা ব্যাপার সব কিছুকে যেন জট পাকিয়ে দিচ্ছিল, ঐ জটটা আমি কিছুতেই খুলতে পারছিলাম না।
কিন্তু জটটা খুলে গেল গতসন্ধ্যায় স্বাতীদেবীর স্বীকারোক্তির পরে এবং জটটা হচ্ছে—আমি কিছুতেই বুঝতে পারছিলাম না বাথরুমের দরজাটা বন্ধ ছিল কেন, ওটা তো–
কিরীটীর কথা শেষ হল না, শিখেন্দুর দেহটা চেয়ার থেকে মাটিতে গড়িয়ে পড়ে গেল। সশব্দে হঠাৎ।
কি হল, কি হল! সকলেই বলে ওঠে।
ছুটে গেল সবাই শিখেন্দুর ভূলুষ্ঠিত দেহটার কাছে। শিখেন্দুর দেহটা শেষবারের মত আক্ষেপ করে তখন একেবারে স্থির হয়ে গিয়েছে।
বীরেন মুখার্জী পাশের ঘর থেকে ছুটে এসেছেন ততক্ষণে। ডাঃ বর্মণই পরীক্ষা করে বললেন, হি ইজ ডেড
বীরেন মুখার্জী বললেন, ডেড!
হ্যাঁ, খুব সম্ভবত পটাশিয়াম সায়ানাইড-ডাঃ বর্মণ বললেন।
কিরীটী ক্লান্ত গলায় বললে, এ একপক্ষে ভালই হল। নিদারুণ অপমান আর লজ্জার হাত থেকে উনি নিজেকে সরিয়ে দিলেন।
বীরেন মুখার্জী বললেন, কিন্তু আসামী ফাঁকি দিল–
ধরলেও আপনারা প্রমাণ করতে পারতেন না মিঃ মুখার্জী যে শিখেই নির্বাণীতোষকে সে-রাত্রে হত্যা করেছিল!
কেন?
প্রমাণ—প্রমাণ পেতেন কোথায়? কারণ হত্যার আগে বা পরে কেউ ওকে বাথরুমের মধ্যে দেখেছে, এমন কথা তো বলতে পারত না হলফ করে। ইট ওয়াজ এ মাস্টার প্ল্যান। নিজের দীর্ঘদিনের বন্ধু নির্বাণীতোষকে নিজের পথ থেকে সরাবার জন্য শিখেন্দুবাবু যে প্লান করেছিলেন সেটা ছিল একেবারে নিখুঁত। কিন্তু হত্যা করবার পর স্মৃতিভ্রংশ দীপিকার দিকে তাকিয়েই বুঝতে পেরেছিল তার সব প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে। দীপিকাকে লাভ করা তার কোন দিনই সম্ভব হবে না। যোগ-বিয়োগে প্রকাণ্ড ভুল হয়ে গিয়েছে—আর সেই হতাশার বেদনা, আশাভঙ্গের দুঃখটাই যেন আমি সে-রাত্রে এখানে এসে ওর চোখেমুখে দেখেছিলাম। যেটা মনে হয়েছিল তখুনি আমার, বন্ধুবিচ্ছেদ বা বন্ধুর মৃত্যুজনিত দুঃখ নয় সেটা। অন্য কিছু সামথিং এলস! আমার মনে সন্দেহও তখুনি উঁকি দেয় ওকে ঘিরে—কিন্তু এ ঘরে আর নয়, চলুন পাশের ঘরে যাওয়া যাক। বীরেনবাবু, ডেড় বডিটা এ ঘর থেকে সরাবার ব্যবস্থা করুন।
পাশের ঘরে বসেই কিরীটী তার কাহিনী বলে যেতে লাগল। কাহিনীর শেষাংশ—
বলছিলাম না, ইট ওয়াজ এ মাস্টার প্ল্যান দীপিকাকে না পাওয়ার দুঃখে শিখেন্দু ভেতরে ভেতরে উন্মাদ হয়ে উঠেছিল, তার ভালবাসা, চাওয়া ব্যর্থ হল—নির্বাণীতোেষ তার ঈপ্সিতাকে তার চোখের সামনে থেকে ছিনিয়ে নিয়ে গেল! কোন কোন ক্ষেত্রে নারী বা পুরুষের বিশেষ কোন পুরুষ বা নারীকে ঘিরে ভালবাসা বা কামনা কতখানি স্বার্থপর কতখানি তীব্র হতে পারে এবং তার ফলে তারা যে কতখানি হৃদয়হীন ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠতে পারে তারই জাজ্বল্যমান প্রমাণ দিয়ে গেল আমাদের শিখেন্দু।
দীপিকা তার হাতের বাইরে চলে যাওয়ায় শিখেন্দুর মনের অবস্থাটাও ঠিক তাই হয়েছিল। সে মনে মনে নির্বাণীকে পথ থেকে সরাবার প্ল্যান করে। প্ল্যানটা একেবারে নিখুঁত। নির্বাণীতোষকে প্যাণ্ডেল থেকে উপরে চলে যেতে বলে, তাঁর মাথার যন্ত্রণা বলায়। নির্বাণীতোষ ভিতরে চলে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেও পিছনের সিঁড়ি দিয়ে সম্ভবত ওপরে চলে যায় এবং বাথরুমে নির্বাণীর আগেই গিয়ে পৌঁছয়।
নির্বাণী কোডোপাইরিন খাবার জন্য বাথরুমে গ্লাস হাতে এসে ঢুকল এবং যখন সে ট্যাপ থেকে গ্লাসে জল ভরছে, শিখেন্দু পেছন থেকে তাকে ছোরা মারল। নির্বাণী পড়ে গেল। হাতের গ্লাসটা বেসিনের মধ্যে পড়ে চিড় খেয়ে গেল, ট্যাপটা ভোলাই রইল। শিখেন্দু পালাল আবার ঐ লোহার সিঁড়ি দিয়েই। নির্বাণীর রক্তাক্ত ছোরাবিদ্ধ মৃতদেহটা পড়ে রইল। তারপর কিছুক্ষণ বাদে ওপরে এলো দীপিকা। সে সম্ভবত ঘরে ঢুকে ঘরে আলো জ্বলছে দেখে—অথচ তার স্বামীকে ঘরের কোথাও না দেখে তাকে অনুসন্ধান করতে গিয়ে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। আমার মনে হয়েছে শিখেন্দু হত্যা করে চলে যাবার আগে পিছনের সিঁড়ি দিয়ে বাথরুমের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যায়, অবিশ্যি এটাও অনুমান। যাই হোক, স্বামীকে খুঁজতে খুঁজতে বাথরুমের দরজা খোলা দেখে দীপিকা বাথরুমেই ঢোকে এবং আলো জ্বালায়। আর ঠিক সেই মুহূর্তে বাথরুমে পূর্ব প্ল্যান মত নীল শাড়ি পরে সঞ্জীববাবু ঢোকেন। তার পরেও আমার অনুমান, হয়তো দীপিকাদেবীর দুটো ব্যাপারই একই সঙ্গে চোখে পড়ে, শাড়ি পরা সঞ্জীববাবু ও তাঁর স্বামীর রক্তাক্ত ছোরাবিদ্ধ ভূলুণ্ঠিত মৃতদেহটা। স্বামীর মৃতদেহ ও শাড়ি পরা সঞ্জীববাবুকে চিনতে পেরে এবং দুটোকে একই ঘটনার সঙ্গে জড়িত বলে তাঁর মনে হয়—অ্যাণ্ড শী ফেনটেড, ড্রপড অন দি ফ্লোর! সঞ্জীববাবু নিশ্চয়ই বলতে পারবেন, তাই ঘটেছিল কিনা।
সঞ্জীব মৃদু কণ্ঠে বললে, হ্যাঁ। প্রথমেই বাথরুমে ঢুকে দীপার সঙ্গে আমার চোখাচোখি ও তার পরই দুজনেরই আমাদের একসঙ্গে নজরে পড়ে মৃতদেহটা। দীপিকা চিৎকার করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে যায় আর আমি সঙ্গে সঙ্গে যে পথে বাথরুমে এসেছিলাম সেই পথেই পালাই তাড়াতাড়ি।
আপনার পালাবার সময় কেউ আপনাকে দেখেছিল?
বোধ হয় শিখেন্দু দেখতে পেয়েছিল, সে তখন নীচে প্যাণ্ডেলেই ছিল। সে ও দীপিকা দুজনেই যদি ভাবে যে আমিই নির্বাণীকে হত্যা করেছি—তাই আমি সেদিন রাত্রে আদৌ আসিনি এখানে আপনাকে বলেছিলাম।
কিরীটী বললে, এখন বুঝতে পারছি আমার আর একটি অনুমানও ঠিক, নীলবসনা কোন নারীই সে রাত্রে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে ওঠেনি।
তবে গোকুল যে তার জবানবন্দিতে বলেছিল–বীরেন মুখার্জী বললেন।
গোকুলকে ডাকুন তো!
গোকুলকে ডাকা হল। কিরীটী বললে, গোকুল তুমি মিথ্যা বলেছ।
কি মিথ্যা বলেছি বাবু? গোকুল যেন রীতিমত ভয় পেয়ে গেল।
সে-রাত্রে ভেতরের সিঁড়ি দিয়ে তিনতলায় নীল শাড়ি পরা বৌ ওঠেনি, তাই নয় কি? তবে তুমি ঐ কথা বলেছিলে কেন?
আজ্ঞে–আমি দেখিনি। শিখেদাদাবাবু আমায় বলতে বলেছিলেন তাই পরে ভেবেছিলাম, সত্যি কথাটা বলব কিন্তু ভয়ে বলতে পারিনি। শিখেন্দুদাদাবাবুও বলেছিলেন, সত্যি কথা বলতে গেলে আবার পুলিস আমাকে সন্দেহ করবে—
এখন বলুন তো সঞ্জীববাবু, নারীর বেশে সে-রাত্রে নির্বাণীতোষের ঘরে হানা দেবার প্ল্যানটা কার?
জবাব দিল পরেশ, শিখেন্দুর। সে-ই প্ল্যানটা করেছিল।
এখন তোবুঝতে পারছেন আপনারা, আসলে কোন কৌতুক সৃষ্টির জন্যই নয়—সঞ্জীববাবুর ঘাড়ে হত্যার অপরাধটা চাপানোর জন্যই শিখেন্দু ঐ প্ল্যানটা করেছিল, সত্যিই মাস্টার প্ল্যান! কিন্তু সেদিন যদি ব্যাপারটা একবারও আপনারা কেউ আমাকে খুলে বলতেন, তবে হয়ত সেইদিনই মীমাংসায় আমি পৌঁছতে পারতাম। শিখেন্দুর মনেও সন্দেহ জাগত না,সে পটাশিয়াম সায়ানাইড খাবারও সুযোগ পেত না।
সঞ্জীবকে বাঁচানোর জন্য আমরা মুখ খুলিনি—শিখেন্দুই.পরামর্শ দিয়েছিল। নির্মল ও পরেশ বললে।
কিন্তু তবু দেখলেন তো, পাপ কখনো চাপা থাকে না। শিখেন্দুর দুটি মাত্র মারাত্মক ভুলের জন্যই তার অমন নিখুঁত চতুর প্ল্যানটাও ভেস্তে গেল, পাপ প্রকাশ হয়ে পড়ল।
বীরেন মুখার্জী বললেন, দুটি মারাত্মক ভুল!
হ্যাঁ, কিরীটী বললে, প্রথম ভুল চিৎকার শোনার পর ওপরে এসে শিখেন্দুর বাথরুম দিয়ে ঘরে ঢুকে বাথরুমের দরজাটা বন্ধ করে শোবার ঘরের দরজাটা খুলে দেওয়া এবং দ্বিতীয়, দীপিকার অচৈতন্য দেহটা বাথরুম থেকে তুলে নিয়ে যাওয়া। বাথরুমের দরজাটা যদি সে না বন্ধ করে দিত, আমাদের অন্ধকারেই হাতড়াতে হত কোন্ পথ দিয়ে হত্যাকারী পালালো সে ব্যাপারে এবং সেই সঙ্গে নীলবসনা নারীর ব্যাপারটাও একটা সত্যের আবরণ নিয়ে থেকে যেত। কিন্তু হত্যাকারী নিজের ভুলের জালে নিজেই জড়িয়ে আমার মনে সন্দেহের উদ্রেক করে দিল। অথাৎ ঐ বাথরুমের বন্ধ দরজা ও দীপিকার শোবার ঘরের মেঝেতে পড়ে থাকা দীপিকার অচৈতন্য দেহটা দেখে শিখেন্দুর মনের দীর্ঘদিনের লালসা তাকে ঘিরে হঠাৎ প্রবল হয়ে ওঠে, সে নিজেকে আর দীপিকাকে স্পর্শ করার লোভটা থেকে সামলাতে পারে না। তাকে বাথরুমের মেঝে থেকে তুলে বুকে করে পাশের ঘরে নিয়ে যায় এবং প্রমাণ করে দিয়েছিল সেটাই আমার কাছে দীপিকার প্রতি শিখেন্দুর গোপন তীব্র আকর্ষণটা। তাছাড়া ভেবে দেখুন মিঃ মুখার্জী, নির্বাণীতোষকে ঐ ভাবে হত্যা করার সুযোগ ঐ রাত্রে সকলের সন্দেহ বাঁচিয়ে একমাত্র নির্বাণীর বন্ধুদের মধ্যে শিখেন্দুরই বেশী ছিল, কারণ সে ছিল এ-বাড়ির সকলের পরিচিত, স্নেহের জন—বিশ্বাসের জন, একপ্রকার ছেলের মত এবং এ-বাড়ির গলিখুঁজি সব তার নখদর্পণে। প্যাণ্ডেলের ভেতরই ছিল লোহার ঘোরানো সিঁড়িটা মেথরদের দোতলা-তিনতলায় যাতায়াতের এবং প্যাণ্ডেলে উপস্থিত থেকে শিখেন্দু সব কিছুর ওপরেই নজর রাখতে পেরেছিল সর্বক্ষণ।
নির্বাণীতোষের নিজের শিখেন্দুর প্রতি ভালবাসা, স্নেহ ও বিশ্বাস এবং সর্বোপরি এ-বাড়ির প্রত্যেকের তার প্রতি ভালবাসা ও বিশ্বাসের সুদৃঢ় বর্মটা গায়ে দিয়ে অনায়াসেই সে সকলের সন্দেহ থেকে দূরে যেতে পারত, ঘটনাচক্রে সে-রাত্রে আমি এখানে শিবতোষবাবুর আহ্বানে না এসে পড়লে হয়ত নির্বাণীতোষের হত্যাকারী চিরদিন অন্ধকারেই থেকে যেত।
বীরেন মুখার্জী বললেন, কিন্তু দীপিকাদেবী জ্ঞান ফিরে পাবার পর?
তখনো তিনি বলতেন কিনা সন্দেহ। এবং আজ যে ব্যবস্থা করা হয়েছিল, তাঁর ঘুমোননা মনের ওপরে একটা শক-এর আলোর ঝাপটা ফেলার, সেরকম কিছু না ঘটলে কবে যে তাঁর অহল্যার ঘুম ভাঙত তাই বা কে জানে! অবিশ্যি জেগে উঠে সব যখন তিনি জানতে পারবেন, নতুন করে আঘাত পাবেন এবং প্রচণ্ড আঘাতই পাবেন। সে কথা জেনেও আমি এই ব্যবস্থা করেছি, কারণ যতই আঘাত লাগুক তিনি তাঁর স্বামীর হত্যাকারীকে তো অন্তত চিনতে পারবেন।
ঐ ঘরে এসে কাহিনীর শেষাংশ শুরু করবার আগে কিরীটী নীচের তলা থেকে শিবতোষবাবুকে ডাকিয়ে আনিয়েছিল। তিনি সব শুনে যেন স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিলেন। কিরীটীর বলা শেষ হবার পর মৃদু কণ্ঠে কেবল বললেন, আশ্চর্য, শিখেন্দু–!
শিবতোষবাবুর চোখে জল।
কারো মুখেই কোন কথা নেই। ভোরের আলো জানলাপথে তখন ঘরে এসে পড়েছে। কিন্তু পাশের ঘরে শয্যায় তখনো ওষুধের প্রভাবে দীপিকা আঘোরে ঘুমোচ্ছ। পরম নিশ্চিন্তেই যেন ঘুমোচ্ছে।