দীপ্তিমান পরিচয় করিয়ে দিলেন। এবং দেওয়ামাত্রই প্রভাবতী ওঁকে অনেকটা হুকুমের সুরে বললেন, ‘তুমি এবার যেতে পারো। আমাদের কথাবার্তার সময় তোমার থাকার দরকার নেই।’ তারপর আরতির দিকে ফিরে : ‘ওদিকের জানলাটা খুলে দে। আর টেবিলের ওই ঘটি থেকে আমাকে আধগ্লাস জল দে।’
প্রভাবতীর কাছাকাছি চারুবালার খাটের কিনারায় এসিজিরা বসেছিলেন। এসিজি সূক্ষ্ম নজরে রুগ্ন ভগ্নস্বাস্থ্য বৃদ্ধাকে দেখছিলেন। সারা মুখে অহঙ্কারের ছাপ। এমনকী বলিরেখাগুলোও সেই অহঙ্কারী ঢঙে সামিল হয়েছে।
এসিজির গলা শুকিয়ে যাচ্ছিল। সিগারেটের জন্য। কিন্তু এখানে সিগারেট মানায় না। একটু কেশে নিয়ে তিনি বললেন, ‘মিসেস রায়, দীপ্তিমানবাবু আমাদের সঙ্গে থাকাটা খুব জরুরি।’
‘তার মানে! কী বলতে চান আপনি! আমাদের ফ্যামিলির কথা বাইরের কোন এক দু-পয়সার জ্যোতিষীর সামনে বলতে হবে!’ ঘাড় কাত করে ওপরওয়ালার ভঙ্গিতে এসিজির দিকে দেখলেন প্রভাবতী : ‘আপনার কাছে ও জরুরি হতে পারে, আমার কাছে নয়।’
এরপর আর কোনও কথা চলে না।
দীপ্তিমান মুখ নিচু করে বসেছিলেন। এসিজির দিকে ‘আপনাকে বলেছিলাম না!’ এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে ঘর ছেড়ে চলে গেলেন।
‘চারুবালা কীভাবে মারা গেছেন বলে আপনার মনে হয়?’ এসিজি সরাসরি প্রশ্ন করলেন।
‘সবাই যা জানে তাই—’ আরতির দেওয়া জলের গ্লাসে চুমুক দিলেন ‘অ্যাক্সিডেন্ট।’ তারপর আরতিকে : ‘তোকে আধগ্লাস বললাম, এতটা দিলি! যা বাকি জলটা ঘটিতে ঢেলে রাখ। ঘটিটা ঠিকমতো ঢাকা দিবি। কোনও কাজের একটা ছিরি নেই।’
আরতি কোনও জবাব না দিয়ে হুকুম তামিল করল।
‘যদি অ্যাক্সিডেন্ট না হয় তবে আর কীভাবে চারুবালা মারা যেতে পারেন?’
বিরক্তির একটা শব্দ করে বৃদ্ধা বললেন, ‘সুইসাইড হতে পারে। পাগলের খেয়াল—কী করে বলব বলুন!’
‘খুনও হতে পারে।’
‘তার মানে! খুনের প্রশ্ন উঠছে কোত্থেকে! তখন তো ছাদে আর কেউ যায়নি!’
‘আপনি কী করে জানলেন?’ এসিজি হেসে প্রশ্ন করলেন। তারপর ‘আপনি শুধু আপনারটা বলতে পারেন।’
‘না, আমি জানি। দিদি যখন ছাদে যায়—ছাদ থেকে পড়ে যায়—তখন এ-ঘরে ছেলেমেয়েদের সঙ্গে আমি কতকগুলো জরুরি কথা বলছিলাম। অমলেশ বাড়ি ছিল না। আপনারা যেখানে বসে আছেন, অজু-বিজু, ওদের দু-বউ, ওখানে বসেছিল। আর সুনন্দা আমার বিছানায়। আরতি নীচে কলতলায় গিয়েছিল। এরপর বাকি রইল বাচ্চারা। ওরা নিশ্চয়ই তাদের ”দিদু”কে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয়নি!’
অশোকচন্দ্রের মনে হল তিনি কোনও জজসাহেবের এজলাসে বসে আছেন। প্রভাবতীর কথা শুনে মনে হল, সব প্রশ্নের উত্তর তিনি যেন আগেভাগেই জেনে তৈরি করে নিয়েছেন।
রঙ্গলাল এসিজিকে দেখছিলেন। থিঙ্কিং মেশিনকে খানিকটা যেন নাজেহাল দিশেহারা লাগছে।
‘আপনার দিদির হাতে কাপড় ছড়ানোর একটা ক্লিপ ছিল। উনি কি তখন কাপড় ছড়াতে গিয়েছিলেন, না তুলতে গিয়েছিলেন?’
‘পাগলের কখন কী খেয়াল হয়, আমি কী করে জানব!’
এসিজি দু-হাতের দশ আঙুল মাথায় ঠেকালেন। একটু সময় নিয়ে তারপর বললেন, ‘পুলিশ এসে ছাদে কিন্তু কোনও কাপড় পায়নি।’
‘বললাম তো, পাগলের খেয়াল! হয়তো ক্লিপ হাতে এমনই ছাদে ঘুরতে গিয়েছিল।’
‘ওঁর সোনার হারের ব্যাপারটা জানেন তো!’
‘জানাজানির আবার কী আছে! ওটা হয়তো দিদির কোমরেই বরাবর গোঁজা ছিল—ছাদে কোনওভাবে খসে পড়েছে।’
‘মারা যাওয়ার কিছুদিন আগে চারুবালা কারও একটা গোপন অন্যায় দেখে ফেলেছিলেন। সেটার কথা উনি মাঝে-মাঝেই বলতেন। আপনি কখনও শুনেছেন?’
‘না তো!’ তারপর আরতিকে : ‘বেলা হয়ে গেছে। তুই গিয়ে আমার স্নানের গরম জল বসিয়ে দে। কালকের মতো বেশি গরম করিস না।’
আরতি ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল।
‘ভালো করে মনে করে দেখুন, মিসেস রায়। কোনও কিছু একটা জেনে ফেলার ব্যাপারে…।’
‘আপনি কার থেকে এসব আজেবাজে কথা শুনেছেন বলুন তো!’
এসিজি ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন। এও বুঝলেন, আর কথা বাড়িয়ে লাভ নেই। তাই প্রভাবতীর কাছে বিদায় নিয়ে উঠে পড়লেন।
প্রভাবতী সঙ্গে-সঙ্গে রেডিয়োর এফ. এম. চ্যানেল চালিয়ে শুনতে শুরু করলেন। গলা তুলে বললেন, ‘যাওয়ার আগে একটু চা-টা খেয়ে যাবেন—।’
একতলার দিকে নেমে-যাওয়া সিঁড়ির পাশে দীপ্তিমান অপাংক্তেয়র মতো দাঁড়িয়ে ছিলেন। এসিজি ওঁর কাছে এসে বললেন, ‘সরি, কিছু মনে করবেন না। এবারে ছোটভাই আর দু-ভাইয়ের স্ত্রীদের সঙ্গে কথা বলব।’
‘হ্যাঁ, ও-ঘরে চলুন। বিজুদার ঘরে আপনাদের চায়ের ব্যবস্থা হয়েছে।’
বিজয়েন্দ্রর ঘরে বসে চা খেতে-খেতে কথাবার্তা সেরে নিলেন এসিজি।
আলোচনাটা টাকাপয়সা আর বিষয়-সম্পত্তির দিকে চলে গেল।
এই বাড়িটা মনোহর রায়ের পৈতৃক সম্পত্তি ছিল। কিন্তু তিনি স্ত্রীকে সেটা আইনমাফিক গিফট করে যান। টাকাপয়সার সবরকম দায়িত্বও প্রভাবতীর ওপরে। ফলে বিরাট বিষয়আশয়ের মালিক হয়েও ছেলেমেয়েরা মালিক নন। সবটাই মা-নির্ভর। প্রভাবতী যাঁকে পছন্দ করেন তাঁরই বাড়বাড়ন্ত। যেমন, এখন সুনন্দা আর অমলেশ প্রভাবতীর দু-নয়নের মণি। কিছুদিন পরই হয়তো অজয়েন্দ্র কিংবা বিজয়েন্দ্রর পালা আসবে। কলকাতার আশেপাশে জমিজিরেত অনেক ছিল। কিন্তু তার প্রায় সবটাই বিক্রি হয়ে গেছে। বিক্রির টাকা প্রভাবতী অমলেশকে দিয়েছেন—কন্সট্রাকশানের ব্যবসা দাঁড় করাতে।