এসিজি অপ্রস্তুত হয়ে পড়লেন। দীপ্তিমানকে সান্ত্বনা দিতে বললেন, ‘আপসেট হবেন না, দীপ্তিমানবাবু…প্লিজ। যিনি চলে গেছেন তিনি তো আর ফিরবেন না!’
রঘুপতি যাদব চুপচাপ নোট নিচ্ছিল। দীপ্তিমানের দিকে কয়েক পলক তাকিয়ে থেকে আবার কাজে মন দিল।
হাতের সিগারেট কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়ে গিয়েছিল। এসিজি সেটা অ্যাশটেতে ফেলে দিয়ে বারকয়েক কাশলেন। মেয়ে ঊর্মিলা সামনে থাকলে নির্ঘাত সিগারেট হাত থেকে কেড়ে নিয়ে ফেলে দিত। ওর বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর থেকে শাসন করার মতো কেউ আর কাছে নেই। যে সবচেয়ে কাছাকাছি থাকত, সবসময় থাকত, সে চলে গেছে বছরদশেক আগে। আকাশে। সেখানে গিয়ে আকাশের তারা হয়ে গেছে।
নিজেকে সামলে নিয়ে মুখ খুললেন দীপ্তিমান। ভাঙা গলায় বললেন, ‘ফোনে আপনাকে এসব কথা বলতে পারিনি। বুঝতেই তো পারছেন, বলা সম্ভব ছিল না। আপনি যদি কাইন্ডলি চারুমার মৃত্যুর ব্যাপারটা একটু ইনভেস্টিগেট করে দেখেন তা হলে আমি শান্তি পাব। চারুমার জন্যে আমি কর্তব্য করতে পারিনি। এমনকী মুখাগ্নিও ওরা করতে দেয়নি আমাকে। হয়তো শ্রাদ্ধের সময়েও ডাকবে না। তাই আমার খুব ইচ্ছে, ওঁর মৃত্যুতে যে শুধুমাত্র নিয়তির হাত ছিল না, সেটা প্রমাণ হোক। তা হলেই আমার শান্তি। আপনি আমাকে ফেরাবেন না…প্লিজ। আপনার ফিজ আমি দেব…হয়তো খুব বেশি পারব না…।’ জল-ভরা চোখে এসিজির হাত চেপে ধরলেন দীপ্তিমান।
‘এ কী করছেন! শান্ত হয়ে বসুন।’ এসিজি বললেন, ‘ফিজের কথা আপনাকে এখন ভাবতে হবে না। বরং ও-বাড়ির লোকজন সম্পর্কে আর যা-যা জানেন সেগুলো আমাকে বলুন। কাজে নামার আগে ব্যাকগ্রাউন্ডটা যতটা ডিটেলে জানা যায় ততই কাজের সুবিধে। আর আপনার খোলাখুলি মতামতও বলবেন কিন্তু…।’
এরপর দীপ্তিমান বলে চললেন, আর অশোকচন্দ্র গুপ্ত চেয়ারে হেলান দিয়ে আধবোজা চোখে সব শুনতে লাগলেন। রঘুপতি যথারীতি কাগজ-কলম নিয়ে দ্বিতীয় দফায় ব্যস্ত হল।
বিশু ফরমাশ পেয়ে আর-একদফা কফি দিয়ে গেল।
এসিজির আঙুলের ফাঁকে সিগারেট পুড়তে লাগল। আর ঘড়ির কাঁটাও ঘুরতে লাগল।
প্রায় ঘণ্টাখানেক পর দীপ্তিমানের কথা শেষ হল।
এসিজি ওঁকে মামুলি কয়েকটা প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, ‘সম্ভবত আমি রোববার প্রভাবতীদের বাড়িতে যাব। তার আগে আমহার্স্ট স্ট্রিট থানার ও. সি.-র সঙ্গে কথা বলে রঘুপতি ফরমালিটিগুলো সেরে রাখবে। তা না হলে ইনভেস্টিগেশানে প্রবলেম হতে পারে। আপনাকে খবর পাঠিয়ে দেব। সেদিন আপনি আমাদের সঙ্গে থাকবেন।’
‘তাতে মাসিমা হয়তো মাইন্ড করতে পারেন।’ দীপ্তিমান বললেন।
‘মাইন্ড করলেই হল!’ বলল রঘুপতি যাদব, ‘আপ বেফিকর রহিয়ে, মিস্টার বসাক। দ্যাট ইজ মাই প্রবলেম। কী বলেন, গুপ্তাসাব?’
রঘুপতির শেষ প্রশ্নটা প্রাক্তন স্যার এসিজিকে লক্ষ করে।
এসিজি হাসলেন। রঘুপতির মেজাজ যখন-তখন হারিয়ে যায়। তাই এসিজি প্রায়ই ওকে সাবধান করে বলেন, ‘রঘুপতি, ডোন্ট লুজ ইয়োর টেম্পার। ওটা খুব দামি জিনিস।’
দীপ্তিমান চলে গেলেন। যাওয়ার আগে আরও একদফা অনুরোধ করে গেলেন অশোকচন্দ্রকে।
রঘুপতি জিগ্যেস করল, ‘স্যার, রঙ্গলালবাবুকে কি ইনফর্ম করতে হবে?’
প্রশ্নটা শুনে এসিজির হাসি পেয়ে গেল। আজকাল এমন একটা বাজে অভ্যেস হয়ে গেছে যে, তদন্তের সময় স্বভাবকবি রঙ্গলাল গোস্বামী পাশে-পাশে না থাকলে তিনি যেন ঠিক মেজাজ পান না। ‘লালমহল’-এর চুনিলালবাবুর দামি পাথর খুঁজে বের করতে গিয়ে তাঁর ভাই রঙ্গলাল গোস্বামীর সঙ্গে এসিজির প্রথম পরিচয়। তারপর থেকে স্বভাবকবি রঙ্গলাল এসিজির গুণমুগ্ধ হয়ে পড়েন। রঙ্গলালের প্রশংসার দুটি অভিনব নমুনা মনে পড়ল এসিজির ‘আমি আপনার গুণমুগ্ধ/আপনি যেন খাঁটি দুগ্ধ’, আর ‘গোয়েন্দা, পক্ষিবিদ, পদার্থবিজ্ঞানী/অমর, আকবর এবং অ্যান্টনি’। এই স্বভাব-কবি কখনও এসিজির ‘তদন্তরসে’ বঞ্চিত হতে চান না।
সুতরাং, হাসতে-হাসতেই অশোকচন্দ্র গুপ্ত রঘুপতিকে বললেন, ‘ওঁকে ইনফর্ম অবশ্যই করবে, রঘুপতি। তা না হলে, ওঁর মতো স্বভাব-কবিতায় বলি—তোমার আমার মুন্ডুপাত/হয়ে যাবে অকস্মাৎ।’
রঘুপতি ঠোঁটের কোণে হাসল। তারপর এগিয়ে গেল প্রাক্তন স্যারের টেলিফোনের দিকে।
এসিজি পায়ে-পায়ে চলে এলেন জানলার গা ঘেঁষে রাখা একটা টেবিলের কাছে। এটা তাঁর পাঁচমিশেলি কাজের টেবিল। টেবিলে বই, পেন, কাগজপত্র সব এলোমেলোভাবে ছড়ানো। তারই মাঝে দাঁড়িয়ে আছে একটা রুবিক কিউব।
রঙিন কিউবটা হাতে নিয়ে তার একটা থাক মোচড় দিতে শুরু করলেন অশোকচন্দ্র। সাজানো রংগুলো ওলটপালট হয়ে যেতে লাগল।
আপনমনে বিড়বিড় করে এসিজি বললেন, ‘অ্যাক্সিডেন্ট, সুইসাইড, না মার্ডার?’
‘…কে দেবে তার কারেক্ট আনসার।’
প্রভাবতীদের পুরোনো পলেস্তারা-খসা বাড়িতে ঢুকতে-ঢুকতে আগের দিনের বিড়বিড় করে বলা কথাটাই জোরে-জোরে উচ্চারণ করেছিলেন অশোকচন্দ্র। প্রশ্নটা তিনি ছুড়ে দিয়েছিলেন সঙ্গী রঙ্গলালবাবুর দিকে। ব্যস!
রঙ্গলাল তৎক্ষণাৎ ওঁর স্বভাব-কবিতা রচনার তীব্র প্রতিভা কাজে লাগিয়ে ছন্দ মিলিয়ে প্রশ্নের উত্তর দিয়ে দিয়েছেন।
এসিজি হেসে বললেন, ‘উত্তর দিতে হবে আমাকেই। কোনও উপায় নেই। আমাকে নিয়ে রঘুপতির অনেক গর্ব। ওর মানটা তো বাঁচাতে হবে!’