‘দাঁড়াও, ভেবে বলছি।’ বাচ্চা ছেলেটা আঙুলে কর গুনতে লাগল আর ধীরে-ধীরে বিড়বিড় করে বলতে লাগল, ‘শুক্র, বৃহষ্পতি, বুধ…।’
‘কুন্তলবাবু, চাচা চৌধুরির বুদ্ধি কম্পিউটারের মতো প্রখর। চাচা চৌধুরি একবার যা দ্যাখে তা কখনও ভোলে না—’ অশোকচন্দ্র কুন্তলকে উৎসাহ দিতে চাইলেন।
‘মনে পড়েছে! মনে পড়েছে!’ কুন্তল আচমকা লাফিয়ে উঠে বলল, ‘গানকাকু ওই ডানদিকের জানলার গ্রিলের কাছে দাঁড়িয়ে কী যেন করছিল।’
‘গানকাকু!’
‘হ্যাঁ। কাকুমণিকে যে গান শেখায়।’
এসিজি ‘চকাৎ’ শব্দে একটা চুমু খেলেন কুন্তলের গালে। তারপর বললেন, ‘থ্যাংক য়ু, চাচা চৌধুরি। তুমি আমার চেয়েও বড় হুনুর।’
‘হুনুর মানে!’ অবাক চোখে বৃদ্ধের দিকে তাকাল কুন্তল।
‘এটা ফারসি শব্দ—বাংলায় ঢুকে পড়েছে। এর মানে হল, খুব বুদ্ধিমান, এককথায় গোয়েন্দা বলতে পারো। আজ আমরা চলি। পরে একদিন এসে তোমার সঙ্গে খুব গল্প করব।’
চৌধুরি ভিলার বাইরে এসে রঘুপতি এসিজিকে জিগ্যেস করল, ‘ব্যাপারটা কী হল, গুপ্তাসাব?’
এসিজি নতুন একটা সিগারেট ধরিয়ে বললেন, ‘ড্যাম সিম্পল, রঘুপতি। গানের মাস্টারমশাই অশোক জানা-ই হচ্ছে কালপ্রিট—তোমার রেয়ার বার্ড। তবে সেরকম কোনও প্রমাণ তো নেই। তুমি ওকে খাঁচায় পুরে ছত্রিশ রকম পুলিশি দাওয়াইয়ের সাইতিরিশটি ডোজ অ্যাপ্লাই করলেই বোধহয় কনফেশান পেয়ে যাবে।’
‘কিন্তু জানলার কাছে উনি কী করছিলেন?’ জয়দেব সরকার জানতে চাইলেন।
ওঁরা কথা বলতে-বলতে গাড়িতে উঠে পড়লেন।
চলন্ত গাড়ির জানলা দিয়ে সিগারেটের ছাই ঝেড়ে এসিজি বললেন, ‘রঘুপতি, রামভক্ত হনুমানের গন্ধমাদন পর্বত বয়ে নিয়ে আসার গল্পটা তোমার মনে আছে তো! বিশল্যকরণী চিনতে না পেরে গোটা পর্বতটাই বয়ে নিয়ে এসেছিল পবন-নন্দন।’ সিগারেটে পরপর দুটো লম্বা টান দিয়ে তারপর বললেন : ‘এও অনেকটা সেইরকম। জানলার গ্রিলটা কাটতে বা ভাঙতে না পেরে অশোক জানা হনুমানের মতো গোটা গ্রিলটাই খুলে নিয়েছিল জানলার ফ্রেম থেকে। এই কাজের জন্যে খানিকটা নারকোল তেল আর একটা ভারী স্ক্রু-ড্রাইভারই যথেষ্ট। আমার ধারণা, ও আগে থেকেই গ্রিলের বেশ কয়েকটা স্ক্রু খুলে রেখেছিল। ঘটনার দিন শেষ একটা কি দুটো স্ক্রু খুলে গ্রিল সরিয়ে ও বলরামবাবুর ঘরে ঢোকে। তারপর নিজের কুকর্ম আড়াল করতে জানলার ঘষা কাচের পাল্লা ভেজিয়ে দেয়। কাজ সেরে বেরিয়ে এসে যখন ও গ্রিলটা আবার জায়গামতো বসিয়ে স্ক্রু এঁটে দিচ্ছিল, তখনই বোধহয় কুন্তল ওকে দেখতে পায়। ব্যস, এই হল তোমার ক্লোজড রুম প্রবলেম।’
একটু থেমে এসিজি রঘুপতিকে জিজ্ঞাসা করলেন ‘কী, এবার খুশি তো? এবার পারবে তো জাল গোটাতে?’
রঘুপতি চওড়া হেসে বলল, ‘স্যার, ভাগ্যিস আপনি শার্লক হোমসের মতো পাইপ টানতে পারেন না, আর এরকুল পোয়ারোর মতো মোমের পালিশ দেওয়া গোঁফ আপনার নেই!’
‘কেন, তা হলে কী হত?’ কপালে ভাঁজ ফেলে জানতে চাইলেন ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত।
‘তা হলে আপনি গল্পের বইয়ের পাতায় ঢুকে যেতেন। বলরাম চৌধুরির মার্ডার কেস আর সলভ হত না।’
ওঁরা তিনজনেই একসঙ্গে হেসে উঠলেন জোর গলায়।