সতীনাথ চৌধুরি রঘুপতি যাদবকে লক্ষ করে সামান্য রুক্ষ স্বরে জানতে চাইলেন, ‘কবের মধ্যে আপনি কেসটা সলভ করছেন, ইন্সপেক্টর যাদব?’
রঘুপতি অশোকচন্দ্রকে দেখিয়ে বললেন, ‘কোশিশ তো করছি। সেইজন্যেই আজ আমার স্যারকে নিয়ে এসেছি।’
তাচ্ছিল্যের চোখে এসিজির দিকে দেখলেন সতীনাথ। তারপর বললেন, ‘বাবা আমাদের পার্টিকে বিরাট ডোনেশান দিতেন। আমার ওপর খুব চাপ আসছে—।’
মণিনাথ যেন দাদাকে সায় দিতেই বলে উঠলেন, ‘সলভ করতে না পারেন, অন্তত কাউকে অ্যারেস্ট তো করুন—।’
রঘুপতির বসন্তের দাগ-ধরা মুখে বিরক্তির ভাঁজ পড়ল। ও অভদ্র স্বরে জবাব দিল, ‘অ্যারেস্ট ম্যায় আভি ইসি বক্ত কর সকতা হুঁ। লেকিন সে আপনার হেলথের পক্ষে ভালো হবে না।’
মণিনাথ স্পষ্ট শিউরে উঠে নিজের অজান্তেই এক পা পিছিয়ে গেলেন।
‘এই কাগজটা দেখুন’ জয়দেব সরকার একটা কাগজ দেখিয়ে সকলের মনোযোগ চাইলেন, ‘এটা একটা কয়েনের টেস্ট রিপোর্টের জেরক্স কপি।’
রঘুপতি আর এসিজি কাগজটা দেখার জন্য জয়দেববাবুর খুব কাছে এসে ঝুঁকে পড়লেন।
‘ম্যাড্রাসের ”জুপিটার” নামের কোনও এক কম্পিউটারাইজড এয়ার কন্ডিশনড ল্যাবরেটরিতে এই টেস্টটা করা হয়েছে। ১৬১৬ সালের কপার-ইরিডিয়াম হাফ আনা কয়েন। হাতে পাঞ্চ করে তৈরি। ভর ৮২ গ্রাম ৭০০ মিলিগ্রাম। আর কয়েনটা এক সেন্টিমিটার পুরু।’ রিপোর্টটা আর-একবার দেখে নিয়ে জয়দেব সরকার বললেন, ‘এ ছাড়া রেডিওঅ্যাকটিভিটিও বেশ আছে দেখছি—।’
সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে এসিজি প্রশ্ন করলেন, ‘এই জেনুইন কয়েনটা হাতে পেলে তার দাম মোটামুটিভাবে কত হতে পারে, মিস্টার সরকার? লাখ টাকা?’
রিপোর্টটা টেবিলে রেখে দিয়ে একটু হেসে জয়দেববাবু, বললেন, ‘যে সত্যি-সত্যি অ্যান্টিক কয়েনের কদর বোঝে, তার কাছে এর দাম অনায়াসে কয়েক কোটি টাকা হতে পারে।’
ঘরে যেন বাজ পড়ল। অনেকক্ষণ সবাই চুপ। শুধু কোয়ার্টজ ঘড়ির সেকেন্ডের কাঁটা নড়ার টিকটিক শব্দ।
ওই নোংরা চেহারার কয়েনগুলোর এত দাম! ভাবল রঘুপতি। অশোকচন্দ্র স্পষ্ট স্বরে বললেন, ‘রঘুপতি, এবার তুমি বোধহয় বলরামবাবুর মার্ডারের জেনুইন মোটিভের হদিস পেয়ে গেছ।’
হঠাৎই সতীনাথ ও মণিনাথের দিকে ফিরে এসিজি বিনীতভাবে বললেন, ‘আপনারা যদি একটু বাইরে অপেক্ষা করেন তা হলে ভালো হয়। আমরা একটু আলাদা কথা বলতে চাই—।’
‘ওঃ, শিওর’ বলে সতীনাথ দরজার দিকে এগোলেন।
মণিনাথ দাদাকে অনুসরণ করে বেরিয়ে যাওয়ার আগে টেবিলের কয়েনগুলোর দিকে কয়েকবার দেখলেন।
ওঁরা চলে যেতেই রঘুপতি দরজাটা বন্ধ করে দিল ভেতর থেকে। তারপর বলল, ‘গুপ্তাসাব, এবার বলুন, কী বুঝলেন?’
‘একটা ব্যাপার আমি বোধহয় সলভ করতে পেরেছি, রঘুপতি—।’
‘কোন ব্যাপার?’
‘তোমার ক্লোজড রুম প্রবলেম। বন্ধ ঘর থেকে খুনি কীভাবে পালাল সেটা আমি বোধহয় ধরতে পেরেছি।’
রঘুপতি প্রত্যাশা-ভরা চোখ নিয়ে তাকিয়ে রইল প্রাক্তন স্যারের দিকে।
জানলার কাছে গিয়ে সিগারেটের শেষ হয়ে আসা টুকরোটা বাইরে ফেলে দিলেন এসিজি। তারপর ঘাড়ের-কাছে-নেমে-আসা সাদা চুলের গোছায় বারকয়েক টান মেরে বললেন, ‘চলো, রঘুপতি। এবারে যাওয়া যাক। তবে যাওয়ার আগে চাচা চৌধুরির সঙ্গে একবার কথা বলে যাব—খুব জরুরি কথা।’
রঘুপতি বেশ অবাক হলেও কিছু বলল না।
ঘরটা শেষবারের মতো দেখে নিয়ে অশোকচন্দ্র গুপ্ত বেরিয়ে এলেন বাইরে। ওঁকে অনুসরণ করে জয়দেব সরকার ও রঘুপতি যাদব।
‘রঘুপতি, এই রেয়ার কয়েনের ব্যাপারটা মাথায় রেখে তুমি একটু নতুন অ্যাঙ্গেল থেকে তদন্ত শুরু করো। আর আমি তোমাকে বাড়তি কিছু ইনফরমেশন দেব। মনে হয়, এ-থেকে তুমি দিন-সাতেকের মধ্যেই মার্ডারারকে খাঁচায় পুরতে পারবে।’ প্রাক্তন ছাত্রের গম্ভীর মুখের দিকে তাকিয়ে এসিজি জিগ্যেস করলেন, ‘কী, খুশি তো?’
কথা বলতে-বলতে ওঁরা বাড়ির মোজেইক করা চাতালে বেরিয়ে এসেছিলেন। সতীনাথ আর মণিনাথ কোথা থেকে যেন ওঁদের দেখতে পেয়ে ব্যস্ত পায়ে কাছে চলে এলেন।
রঘুপতি সতীনাথের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আপনাদের কো-অপারেশনের জন্যে ধন্যবাদ।’
সতীনাথ সৌজন্য দেখিয়ে কী একটা বলতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এসিজির কথায় সেটা আর বলে উঠতে পারলেন না।
‘আপনার ছেলেকে একবার পাঠিয়ে দেবেন, কয়েকটা কথা বলব—।’
‘তার মানে! বাবার মার্ডারের ব্যাপারে ওইটুকু বাচ্চার কী বলার আছে!’ বেশ বিরক্ত হয়ে ভুরু কুঁচকে জানতে চাইলেন সতীনাথ।
‘চাচা চৌধুরি আর সাবুর গল্প করব। সে আপনি বুঝবেন না।’ হেসে বললেন এসিজি। তারপর রঘুপতিকে চোখের ইশারা করলেন। যার মানে, ‘কুন্তলকে ডেকে নিয়ে এসো।’
রঘুপতি বাড়ির ভেতর দিকে রওনা হতেই সতীনাথ আহত গলায় বললেন, ‘থাক, আমিই পাঠিয়ে দিচ্ছি—।’
সতীনাথ চলে যাওয়ার কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই কুন্তল চলে এল লাফাতে-লাফাতে। এখন ওর মাথায় পাগড়ি নেই, কোমরের বেল্টও উধাও।
‘আমাকে ডেকেছ?’
‘হ্যাঁ, তোমার দাদুর ব্যাপারে একটু চাচা চৌধুরির সাহায্য চাই। চলো, বাগানে চলো।’
ভ্যাবাচ্যাকা মণিনাথকে চাতালে দাঁড় করিয়ে রেখে এসিজি কুন্তলকে নিয়ে বাগানের গাছপালার মধ্যে চলে এলেন। ওঁকে অনুসরণ করে সঙ্গী হলেন জয়দেব সরকার আর রঘুপতি যাদব।
নানান গাছের ফাঁক দিয়ে বলরাম চৌধুরির ঘরের জানলা দুটো দেখা যাচ্ছিল। সেদিকে আঙুল তুলে এসিজি কুন্তলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বলো তো, চাচা চৌধুরি, লাস্ট সোমবার দুপুরে তুমি কি কাউকে ওই জানলার কাছে ঘোরাঘুরি করতে দেখেছ?’