‘কেন?’ রঘুপতি জিজ্ঞাসা করল।
‘কারণ, আমি জানি একজন বিদেশি বায়ার মানে, খদ্দের—এখন বিশেষ কয়েকটা কয়েনের জন্যে হন্যে হয়ে কলকাতা আর তার আশেপাশে চষে বেড়াচ্ছে। একইসঙ্গে প্রচুর দালালও ঘুরছে বাজারে। মিস্টার চৌধুরির পয়সাগুলোর মধ্যে সেরকম কয়েকটা কয়েন দেখতে পাচ্ছি—।’
সতীনাথ আর মণিনাথ খুব তাড়াতাড়ি ওঁদের কাছে চলে এলেন। প্রায় হাঁ করে জয়দেব সরকারের মুখের দিকে তাকিয়ে রইলেন। কিন্তু মাঝে-মাঝেই ওদের নজর ছিটকে যাচ্ছিল কয়েনগুলোর দিকে।
‘আপনাদের বাবার কাছে কয়েনের খোঁজে কোনও লোকজন আসত?’ রঘুপতি দু-ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করল।
মণিনাথ বললেন, ‘কীসের খোঁজে আসত জানি না, তবে বেশ কিছুদিন ধরে দেখতাম উলটোপালটা ধরনের লোক বাবার কাছে আসত।’
‘বেশ কিছুদিন বলতে?’ এসিজি জানতে চাইলেন।
‘এই মাস চার, সাড়ে চার’ উত্তর দিলেন সতীনাথ। অবশ্য উত্তর দেওয়ার আগে মণিনাথের নীরব সমর্থন খুঁজেছেন।
জয়দেব সরকার বলে উঠলেন, ‘প্রায় মাসছয়েক ধরে এই কয়েন খোঁজার ঢেউ উঠেছে। কলকাতা থেকে ব্যাপারটা এখন গ্রাম-গঞ্জেও ছড়িয়ে পড়েছে।’
‘রেয়ার কয়েনের কথা কী বলছিলেন’ সতীনাথ আসল প্রসঙ্গ পালটাতে চাইলেন না।
জয়দেববাবু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে এসিজিকে লক্ষ করে বললেন, ‘যেসব রেয়ার কয়েনের খোঁজ চলছে তার মধ্যে বেশিরভাগই হল ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির হাফ আনা, মানে, আধ আনা। কয়েনগুলো বাজারে ছাড়ার বছরগুলো হল : ১৬১৬, ১৭১৭, ১৮০৬, ১৮১৮, ১৮৩৯, ১৮৪০, ১৮৪২, ১৮৪৪। এতে যেসব ছবির ছাপ আছে সেগুলো হল : জোড়া ডাব, রাজা রামচন্দ্রের দরবার, হনুমান, জোড়া সাপ এইসব। পয়সাগুলো মেইনলি তামার তৈরি, তার সঙ্গে বোধহয় কিছুটা করে ইরিডিয়াম মেশানো আছে—।’
‘ইরিডিয়াম! ওটা তো রেয়ার মেটাল!’ অশোকচন্দ্র গুপ্ত অবাক হয়ে বললেন।
জয়দেব সরকার মাথা নেড়ে হাসলেন : ‘হয়তো সাধারণ ইরিডিয়াম নয়, তার কোনও রেডিওঅ্যাকটিভ আইসোটোপ। মানে ইরিডিয়াম-১৯১ আর ইরিডিয়াম-১৯৩। তেজস্ক্রিয় হলেও ইরিডিয়ামের এই দুটো আইসোটোপ খুব স্টেবল—মানে, হাফ লাইফ অনেক বেশি।’
‘তা হলে তো সেই কয়েনের রেডিওঅ্যাকটিভিটি থাকবে!’ একটু ভয়ের গলায় বললেন এসিজি।
জয়দেব সরকার জোর দিয়ে বললেন, ‘থাকবেই তো! তবে তার এফেক্ট কী হবে সেটা বলতে পারব না। বাজারের খবর হচ্ছে, এ-ধরনের পয়সা নাকি আতপ চাল টানে। মানে, চুম্বক যেমন লোহা টানে আর কী! তারপর কেউ-কেউ বলছে, তাতে নাকি আতপ চালের দানার রঙও পালটে যায়। তবে একটা ধান ভেঙে সঙ্গে-সঙ্গে তার চালের দানাটা দিয়ে টেস্ট করতে হবে—এতে নাকি চালের দানাটায় কোনও ময়েশ্চার জমে না।’
‘বলেন কী, মশাই!’ মণিনাথ তাঁর হাই-পাওয়ার চশমা নাকের ডগায় ঠিক করে বসাতে-বসাতে বললেন।
জয়দেব সরকার মণিনাথের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বললাম তো, এসব খবর আমার কানে এসেছে। গুজব না সত্যি বলতে পারব না। কারণ, এই চালের দানা টেনে নেওয়ার ব্যাপারটা আমি স্বচক্ষে দেখিনি।’
সতীনাথের গম্ভীর মুখে অনেকগুলো ভাঁজ পড়ল। তিনি এসিজির দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘বাবাকে আমি বেশ কয়েকবার ধানের শিষ নিয়ে ঘরে ঢুকতে দেখেছি—।’
‘বাবা কি চালের দানা নিয়ে কয়েন টেস্ট করছিলেন?’ মণিনাথ যেন আপনমনে নিজেকেই প্রশ্ন করলেন।
‘হতে পারে।’ রঘুপতি বলল, ‘তবে ইয়ে সচ হ্যায় গুপ্তাসাব, কী আমরা ঘরের মেঝেতে বেশ কয়েকটা চালের দানা দেখেছিলাম। ওগুলোকে আমরা তেমন কোনও ইম্পর্ট্যান্স দিইনি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি কেসটা কী—।’
‘বাবার কালেকশানে কি ওরকম রেয়ার কয়েন সত্যি-সত্যি আছে?’ সতীনাথ জয়দেব সরকারের কাছে জানতে চাইলেন।
‘আছে। ১৭১৭, ১৮৩৯, আর ১৮৪০ সালের তিনটে আধ আনা এখানে আছে।’ আঙুল দিয়ে টেবিলে রাখা কয়েনগুলোর দিকে দেখালেন জয়দেববাবু।
‘সত্যি?’ বিস্ময় মেশানো প্রশ্নে যেন ফেটে পড়লেন মণিনাথ আর সতীনাথ।
এসিজি বেশ অবাক হয়ে তাকালেন জয়দেব সরকারের দিকে। রঘুপতির চোয়ালের রেখা শক্ত হল, চোখ ছোটো হয়ে এল।
কয়েক সেকেন্ড সবাইকেই উৎকণ্ঠায় রেখে তারপর হেসে জয়দেব সরকার বললেন : ‘সাল তারিখ ঠিক থাকলেও এই তিনটে পয়সাই নকল। তা না হলে এগুলোর এক-একটার দাম কম করেও কয়েক লক্ষ টাকা হত।’
এ-কথায় কয়েকটা বেলুন যেন চুপসে গেল ঘরের মধ্যে।
‘এরকম প্রচুর নকল কয়েন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে। অনেকে কিনে ঠকছেও। আবার কেউ-কেউ কয়েন হাতে পেয়ে প্রচুর টাকা খরচ করে ল্যাবরেটরিতে টেস্ট করাচ্ছে।’ কথা বলতে বলতে টেবিল থেকে আতসকাচটা তুলে নিয়ে পকেটে ঢোকালেন জয়দেব সরকার।
রঘুপতি যাদব সতীনাথ আর মণিনাথের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞাসা করল, ‘আপনারা কয়েনের ব্যাপারে কিছু জানেন না?’
দুজনেই মাথা নাড়লেন।
এসিজি সিগারেট হাতে নিয়ে ঘরটা ঘুরে-ফিরে দেখছিলেন। কখনও দরজার কাছে, কখনও বিছানার পাশে, আর কখনও বা জানলার গ্রিলের কাছে গিয়ে থমকে দাঁড়াচ্ছিলেন।
‘মিস্টার সরকার’, জয়দেববাবুকে লক্ষ করে বলল রঘুপতি, ‘দেখুন তো, টেবিলের এইসব কাগজপত্রে কয়েনের ব্যাপারে আর কিছু পান কিনা—।’
একটুও ব্যস্ত না হয়ে জয়দেব সরকার টেবিলের কাছে এলেন। মাথা ঝুঁকিয়ে একটা-একটা করে কাগজ দেখতে লাগলেন।