বলরাম চৌধুরির ঘরের দরজা যে আবার মেরামত করা হয়েছে সেটা লক্ষ করলেন এসিজি। আর একইসঙ্গে নতুন হাজির হওয়া তিনটি মানুষকে খুঁটিয়ে জরিপ করলেন।
তালা খুলে রঘুপতি যাদব বলরাম চৌধুরির ঘরে আমন্ত্রণ জানাল এসিজিকে। জয়দেব সরকারকেও ডেকে বলল : ‘আসুন, জয়দেববাবু—।’
কিন্তু সতীনাথ ও মণিনাথকে অনুসরণ করে যখন অশোক জানা ঘরে ঢুকতে যাচ্ছেন তখন মুখিয়ে দাঁড়িয়ে রঘুপতি বলল : ‘আপ কিঁউ আ রহে হ্যায়, মাস্টারজি?’
অশোক জানা কয়েকবার ঢোঁক গিলে ইতস্তত করে বললেন, ‘না,মানে, মণিভাই খুব সেন্টিমেন্টাল তো…হঠাৎ যদি ওর কিছু একটা হয়ে যায়…পিতৃশোক বলে কথা…।’
‘তার জন্যে আমরা আছি। আপ দফা হো যাইয়ে—।’
‘মানে!’
‘মানে আপনি আসতে পারেন—।’ বলেই দরজাটা ‘মাস্টারজি’র মুখের ওপর বন্ধ করে দিয়েছে রঘুপতি।
তারপর উত্তেজিতভাবে শুরু করেছে ওর ধারাবিবরণীর রাজধানী এক্সপ্রেস।
এসিজি একহাতে সিগারেটে টান মারছিলেন, আর অন্য হাতে টানছিলেন সাদা চুলের গোছা। চশমার ফাঁক দিয়ে তাঁর অভিজ্ঞ চোখ ঘরের প্রতিটি জিনিস প্রায় গোগ্রাসে গিলছিল।
ঘরে বড়-বড় দুটো জানলা। দুটোই বাগানের দিকে। জানলায় ঘিয়ে রঙের সুদৃশ্য গ্রিল বসানো। গ্রিলের ওপাশে ঘষা কাচের শার্সি বসানো পাল্লা। গ্রিলের লোহাগুলো প্রায় আট মিলিমিটার পুরু। এ-গ্রিল কাটার বা ভাঙার কোনও প্রশ্নই ওঠে না।
জানলা দিয়ে বাগানের গাছপালা দেখা যাচ্ছে। পাতার ফাঁক-ফোকর দিয়ে রোদ আর আলো এসে পড়েছে ঘরে।
একটা জানলার সোজাসুজি বলরাম চৌধুরির খাট। আর-একটা জানলার সামনে বসানো রয়েছে একটা বড় টেবিল। টেবিলে প্রচুর ফাইল আর কাগজপত্র। আর তার সামনে একটা গদি-আঁটা স্টিলের চেয়ার—টেবিলের কাছ থেকে খানিকটা দূরে সরানো।
এ ছাড়া ঘরে টিভি, আলনা, আলমারি, টেলিফোন, কোয়ার্টজ দেওয়াল-ঘড়ি আর একটা বুক কেস রয়েছে।
স্টিলের চেয়ারটা ছাড়া অতিথিদের বসার জন্য ঘরে দুটো লাল রঙের প্লাস্টিকের কিউব রয়েছে। আর তার সঙ্গে মানানসই প্লাস্টিক আর কাচে তৈরি একটা শৌখিন টি-টেবিল।
টেবিলের কাছে গিয়ে ডানদিকের ওপরের ড্রয়ারটা টেনে খুলল রঘুপতি যাদব। জয়দেব সরকারকে ইশারায় ডেকে বলল, ‘মিস্টার সরকার, সেই সকাল থেকে আপনি বোধহয় বোর হয়ে গেছেন। এইবার আপনার সাবজেক্টে এসে গেছি। ইধর আইয়ে। দেখিয়ে’ বলে খোলা ড্রয়ারের ভেতরে আঙুল দেখিয়ে রঘুপতি বলল : ‘রেয়ার কয়েন্স। তবে জেনুইন রেয়ার কিনা আপনি বলতে পারবেন।’
ড্রয়ারটার কাছে এসে জয়দেব সরকার মানুষটা যেন মুহূর্তে বদলে গেল। এতক্ষণ যার কথাবার্তায় চেহারায় তেমন কোনও বৈশিষ্ট্য খুজে পাওয়া যাচ্ছিল না এখন সে যেন শিকারি চিতা হয়ে গেল পলকে।
ড্রয়ারে একটা সাদা কাগজের ওপরে অন্তত পনেরো-বিশটা বড় মাপের তামার পয়সা পড়ে আছে। তার বেশিরভাগই বদখত চেহারার, গায়ে সবুজ কপার সালফেটের দাগ-ধরা।
জয়দেব সরকার গোটা ড্রয়ারটাকে বাইরে বের করে নিয়ে টেবিলের ওপরে রাখলেন। তারপর থিঙ্কিং মেশিনকে তাজ্জব করে দিয়ে পকেট থেকে একটা ম্যাগনিফাইং গ্লাস বের করে তামার পয়সাগুলোকে খুঁটিয়ে দেখতে লাগলেন।
রঘুপতি আর এসিজি ভদ্রলোকের দুপাশে দাঁড়িয়ে ওঁর কাজকর্ম লক্ষ করছিলেন।
একটা-একটা করে প্রত্যেকটা কয়েন দেখলেন জয়দেব সরকার। একটা সাদা কাগজ টেনে নিয়ে পকেট থেকে পেন বের করে কীসব লিখে নিতে লাগলেন মাঝে-মাঝে।
রঘুপতি যাদব আবেগহীন গলায় মন্তব্য করল, ‘আপনি নিশ্চিন্তে কাজ করুন, মিস্টার সরকার। ফিঙ্গারপ্রিন্ট এক্সপার্টের টিম তাদের কাজ কমপ্লিট করে গেছে।’
‘অ্যাঁ’ জয়দেব সরকার আচমকা মনোযোগ ভেঙে মুখ তুলে তাকালেন। তারপর বোধহয় রঘুপতির কথার সারমর্ম তাঁর মাথায় ঢুকল। তাই ‘ও, ঠিক আছে’ বলে আবার মাথা নামিয়ে কাজ করতে লাগলেন।
বেশ কিছুক্ষণ পর জয়দেব সরকার আতসকাচ টেবিলে রেখে মাথা তুলে এসিজি আর রঘুপতিকে দেখলেন। একটু দূরে সতীনাথ আর মণিনাথ চাপা গলায় নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন। সেদিকে একবার দেখে নিয়ে ভদ্রলোক ইতস্তত করে জিজ্ঞাসা করলেন এসিজিকে, ‘ওঁদের সামনেই বলব?’
‘বলুন।’
এসিজি হাতের সিগারেটে শেষ টান দিয়ে টুকরোটা হাতে নিয়ে জানলার গ্রিলের দিকে এগোলেন। টুকরোটা গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাইরে ছুড়ে ফেলার সময় কয়েকটা গাছগাছালির পাশে কুন্তলকে দেখতে পেলেন।
হাতের ইশারায় ওকে কাছে ডাকলেন এসিজি।
কুন্তল ছুটে গ্রিলের কাছে এসে দাঁড়াল। মাথার পাগড়ি তখনও একই ঢঙে বসানো। ওর কয়েক হাত পিছনে সাবু, ওরফে বিলু।
‘কী করছ, চাচা চৌধুরি?’
কুন্তল চোখ বড়-বড় করে বলল, ‘বাড়ির ওপরে ওয়াচ রাখছি…কখন কী বিপদ হয়।’
গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বাচ্চাটার সরল চোখ দেখলেন অশোকচন্দ্র। তারপর বললেন, ‘ঠিক আছে, খেলা করো গিয়ে।’
এসিজি গ্রিলের নকশাটা বেশ ভালো করে দেখলেন। সত্যি, এ-গ্রিল কারও পক্ষে কাটা বা বেঁকানো বেশ কঠিন ব্যাপার। তা ছাড়া সেরকম কোনও চেষ্টার ছাপ কোনও গ্রিলেই দেখেনি রঘুপতি।
এসিজি টেবিলের কাছে ফিরে এসে নতুন একটা সিগারেট ধরাতেই জয়দেব সরকার গলাখাঁকারি দিলেন, বললেন, ‘স্যার, মিস্টার চৌধুরি ইদানীং বোধহয় রেয়ার কয়েন নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছিলেন—।’