এসিজি ইশারায় ছেলেটাকে কাছে ডাকলেন, জিজ্ঞাসা করলেন, ‘তোমার নাম কী?’
কুন্তল বেশ স্মার্টভাবে উত্তর দিল, ‘এখন আমি চাচা চৌধুরি।’
এসিজি অবাক হয়ে বললেন, ‘চাচা চৌধুরি মানে?’
খিলখিল করে হেসে উঠে কুন্তল বলল : ‘এ মা, চাচা চৌধুরির নাম জানে না! চাচা চৌধুরির কমিক্স বই পড়োনি?’
এসিজির অতিকষ্টে মনে পড়ল যে, ম্যাগাজিনের স্টলে এই নামে কমিকস দেখেছেন, এবং সেই ‘চৌধুরি’ বানানে কোনও উ-কার ছিল না।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, দেখেছি। সাত-তাড়াতাড়ি জবাব দিলেন তিনি।’
‘জানো, চাচা চৌধুরির বুদ্ধি কম্পিউটারের চেয়েও প্রখর!’
এসিজি সায় দিয়ে ঘাড় নাড়লেন।
প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বাগানের দিক থেকে ছুটে এল আর-একটি ছেলে। বয়েস ষোলো-সতেরো। ময়লা রং। পরনে শুধু একটা হাফ প্যান্ট। পাঁজরা গোনা যাচ্ছে।
‘হুকুম করুন, চাচা চৌধুরি’ বলতে-বলতে ছুটে আসছিল ছেলেটা। কিন্তু তিনজন মানুষকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ওর কথা আটকে গেল মাঝপথেই।
‘ও হচ্ছে সাবু’, নতুন বালকটির দিকে আঙুল দেখিয়ে গম্ভীরভাবে মন্তব্য করল কুন্তল।
রঘুপতি বিড়বিড় করে বলল, ‘এর নাম বিলু। এ-বাড়িতে ফাইফরমাশের কাজ করে।’
অশোকচন্দ্র কুন্তলকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘সবসময় তোমরা এমনই খেলা করো?’
‘না, না। যখন বিলুদার কোনও কাজ থাকে না তখন খেলি।’
‘চাচা চৌধুরি আর সাবু সেজে কী করো?’
‘সারা বাড়ি আর বাগানে ঘুরে-ঘুরে বেড়াই। দেখি কোথাও কোনও বিপদ হচ্ছে কিনা। জানো তো, চাচা চৌধুরি সবার খুব উপকার করে। কাউকে ভয় পায় না। আর সাবুর গায়ে এমন জোর যে, উড়ন্ত এরোপ্লেনকে ধরে আছাড় দিতে পারে…।’
শেষ কথাটা শুনে বিলু সাদা-সাদা দাঁত বের করে সরল হাসি হাসল।
জয়দেব সরকার একটু বিরক্ত হচ্ছিলেন। গুরুত্বপূর্ণ কাজ সামনে ফেলে রেখে বাচ্চাদের সঙ্গে এই গালগল্প! এ-গল্প তো পরেও করা যেত!
অধৈর্য হয়ে পড়েছিল রঘুপতিও। ও চাপা গলায় বলল, ‘স্যার, গপসপ পরে হবে। আগে চলুন, বলরাম চৌধুরির কামরাটা দেখবেন চলুন।’
অশোকচন্দ্র শরীরটাকে ঝুঁকিয়ে কুন্তলের সঙ্গে কথা বলছিলেন। রঘুপতির কথায় সোজা হয়ে দাঁড়ালেন। ওর দিকে তাকালেন মায়ার চোখে। তারপর হেসে বললেন, ‘মাই ডিয়ার রঘুপতি, কতবার তোমাকে বলেছি যে, গায়ের জোরের লড়াইয়ে স্পিডটা একটা ফ্যাক্টর, কিন্তু বুদ্ধির লড়াইয়ে নয়। চেহারা আমার শার্লক হোমসের মতো নয়, সেরকম করে পাইপ টানতেও পারি না। এরকুল পোয়ারোর মতো মোমের পালিশ দেওয়া গোঁফও আমার নেই। এছাড়া দেবেন্দ্রবিজয়, হুকাকাশি, রবার্ট ব্লেক বা ব্যোমকেশের মতো ক্ষুরধার বুদ্ধিও নেই আমার। তবে আমি অতি সাধারণ এক হুনুর মানে, গোয়েন্দা যে মোটামুটিভাবে জোড়াতালি দিয়ে কোনওরকমে কাজ চালিয়ে নেয়।’ একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে অশোকচন্দ্র কুন্তলের দিকে ফিরে বললেন, ‘এখন চলি, চাচা চৌধুরি। পরে তোমার সঙ্গে আবার গল্প করব।’ তারপর রঘুপতিকে বললেন : ‘চলো, কোথায় নিয়ে যাবে চলো—।’
ওঁরা তিনজনে উঠোন পেরিয়ে কয়েক ধাপ সিঁড়ি উঠে পৌঁছে গেলেন একটা সুদৃশ্য কাঠের দরজার সামনে। রঘুপতি যাদব কলিংবেলের বোতাম টিপল। কুন্তল আর বিলু দৌড়ে চলে গেল বাগানের দিকে।
এ-বাড়িতে আসার পথে রঘুপতি আরও অনেক খবর দিয়েছে এসিজিকে। প্রত্যেকের জবানবন্দির সারমর্ম জানিয়েছে। এসিজির কিছু এলোমেলো প্রশ্নের উত্তরও দিয়েছে।
অশোকচন্দ্র বেশ বুঝতে পারছিলেন রঘুপতি টেনশনে ভুগছে। ধৈর্য ব্যাপারটা ওর বরাবরই একটু কম। এখন সেটা বোধহয় আরও কয়েক দাগ কমে গেছে।
বলরাম চৌধুরির শোবার ঘরে এসে রঘুপতির টেনশনটা আরও স্পষ্ট হল। ও হাত-পা নেড়ে খুব তাড়াতাড়ি সব কিছু বলতে শুরু করল। ওর মুখে লালচে ভাব ফুটে উঠল একইসঙ্গে।
‘গুপ্তাসাব’ কখনও-কখনও অশোকচন্দ্রকে এই নামেও ডেকে থাকে রঘুপতি, বলল : ‘ঘরের সবকিছু সেদিনের মতোই আছে। শুধু ডেডবডি আর রক্তমাখা বালিশটা সরিয়ে নেওয়া ছাড়া আর কোনও চিজ ইধার-উধার করা হয়নি।’
ঘরে ঢোকার সময় রঘুপতি বলরাম চৌধুরির দু-ছেলেকেই ডেকে নিয়েছে। সতীনাথ চৌধুরি গম্ভীর মুখে এসে দাঁড়ালেও মণিনাথ বেশ বিরক্তি নিয়ে হাজির হয়েছেন। মণিনাথের সঙ্গে তাঁর গানের গুরু অশোক জানাও এসে উপস্থিত।
রঘুপতি চাপা গলায় সকলের পরিচয় জানিয়ে দিয়েছে এসিজিকে।
মণিনাথ ভুরু কুঁচকে হাই-পাওয়ার চশমার কাচ দিয়ে দাদার দিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন, ‘বড়দা, আমার এখানে হাজির থাকাটা কি খুব জরুরি? নতুন একটা সুর তৈরি করছিলাম…মানে, যা বলার পুলিশকে তো আগেই জানিয়েছি…বাবা তো আর ফিরে আসবেন না…।’
সতীনাথ চৌধুরি শুধু স্থির ঠান্ডা চোখে তাকালেন ছোটো ভাইয়ের দিকে। সে-দৃষ্টিতে নীরব শাসন ছিল। মণিনাথ তৎক্ষণাৎ কথা থামিয়ে চোখ নামিয়ে নিলেন। সেই অবস্থাতেই বন্ধু এবং গুরু অশোক জানার দিকে আড়চোখে তাকালেন।
গানের মাস্টারমশাইয়ের গলার শিরা, কণ্ঠা ইত্যাদি বেশ স্পষ্ট। কে জানে প্রতিদিন গানের চর্চা করে এই অবস্থা হয়েছে কিনা। আর গলার দৈর্ঘ্যও নেহাত ফেলনা নয়।
তিনি গুনগুন করে কী একটা সুর ভাঁজছিলেন। কালো ঠোঁট পানের রসে লালচে। বন্ধুর দৃষ্টি লক্ষ করে তাঁর পিঠে হাত রেখে জড়ানো গলায় বললেন, ‘বড়দার কথা অমান্য করতে নেই, মণিভাই। ও-সুর আমি পরে তুলিয়ে দেব’খন—।’