রঘুপতি যাদব ঠোঁট উলটে হাত নেড়ে এমন একটা ভঙ্গি করল যার মানে অনেকটা ‘রামজীর লীলা রামজীই জানে’ গোছের। তারপর আবার বলতে শুরু করল।
‘বলরাম চৌধুরি মার্ডার হয়েছেন দুপুর দুটো থেকে চারটের মধ্যে, ওঁর সল্টলেকের বাড়িতে, একতলায় নিজের বেডরুমে। ওঁর মুখের ওপরে বালিশ চেপে ধরেছিল মার্ডারার। বালিশে থোড়াসা ব্লাডও লেগেছে। কিন্তু খুনির সঙ্গে সেরকম লড়াই হয়নি। মানে, বাড়ির কেউ কোনও শব্দ শুনতে পায়নি। তবে বাড়িটা বেশ বড় সঙ্গে বাগানও আছে। তা ছাড়া বাড়ির সবাই তখন খাওয়া-দাওয়া সেরে দুপুরের ঘুম লাগিয়েছে।’
‘বাড়িতে তখন কে-কে ছিল?’ প্রশ্নটা করে শেষ-হয়ে-যাওয়া সিগারেটের টুকরোটা অ্যাশট্রেতে গুঁজে দিলেন এসিজি।
‘প্রায় সবাই। কারণ, বলরামবাবুর দু-ছেলের কেউই নোকরি করেন না। বড়জনের কথা তো একটু আগেই বলেছি। আর ছোটজন, মণিনাথ চৌধুরি, গানবাজনা-পাগল মানুষ। বাবার ব্যবসায় দুজনের কেউই বসেন না। তবে দুজনেই ফ্যামিলি ম্যান। বড়ছেলের একটি ছেলে আছে, কুন্তল, ক্লাস ফাইভে পড়ে। ওর পুজোর হলিডে চলছে। তা সেদিন বাড়িতে সবাই ছিল। মণিনাথ গানবাজনা করছিলেন। ওঁর এক গানের ওস্তাদ সেদিন ছিল ওঁর সঙ্গে। ওস্তাদের নাম অশোক জানা। রোগা, কালো, পান-চিবোনো চেহারা। ড্রেস দেখে গানের ওস্তাদ বলে মনে হলেও চেহারা দেখে সন্দেহ হয়। মনে হয়, চ্যাংড়া, লাফাঙ্গা, মাওয়ালি। মাঝে-মাঝেই থেকে যায় চৌধুরিদের বাড়িতে।’
‘বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ ওদের বাড়ির ঠিকে কাজের বউ সুখীর মা বাগিচায় রোদে ছড়ানো জামাকাপড় তুলছিল। তখনই সে জানলা দিয়ে দেখতে পায় বড়বাবু কেমন পিকিউলিয়ার স্টাইলে বিস্তারায় শুয়ে আছেন। সুখীর মা গিয়ে চেঁচামেচি করতে সবাই এসে দরওয়াজা ভেঙে ঘরে ঢোকে। এই হচ্ছে ব্যাপার।’
কথা থামিয়ে কিছু একটা শোনার প্রত্যাশায় রঘুপতি ওর স্যারের দিকে তাকিয়ে রইল।
অশোকচন্দ্র গুপ্ত নতুন একটা সিগারেট ধরালেন। কয়েকবার ধোঁয়া ছেড়ে বললেন, ‘বলরামবাবুর ঘরের জানজায় গ্রিল বসানো আছে নিশ্চয়ই?’
রঘুপতি মাথা নেড়ে ‘হ্যাঁ’ বলতে চাইল। তারপর বলল : ‘সেইজন্যেই তো ক্লোজড রুম প্রবলেম। আর সতীনাথ চৌধুরি এই কেসটা নিয়ে ভীষণ পলিটিক্যাল প্রেসার তৈরি করেছেন। তাই তো লালবাজারকে নাক গলাতে হয়েছে। এখন আপনি যা করার করুন। আই ওয়ান্ট দ্য ব্লাডি মার্ডারার।’
রঘুপতি কখনওই খুব ব্রিলিয়ান্ট ছাত্র ছিল না। কিন্তু ভীষণ সৎ আর পরিশ্রমী। তাই এসিজি বরাবরই ওকে পছন্দ করতেন, এখনও করেন। ওর মুখের দিকে তাকিয়ে এসিজি একটা অসহায় ভাব খুঁজে পেলেন। ওর মুখের বসন্তের দাগ কিংবা ছোটো করে ছাঁটা চুল সেই ভাব লুকোতে পারেনি।
‘আর রেয়ার কয়েনের ব্যাপারটা?’ এতক্ষণ চুপ করে শোনার পর জয়দেব সরকার আমতা-আমতা করে প্রশ্ন করলেন। জানলা দিয়ে আসা আলো ওঁর কপালের ডান দিকে হাইলাইট তৈরি করেছে।
রঘুপতি অস্পষ্ট একটা শব্দ করে তারপর বলল, ‘ওটা স্পটে গেলেই বুঝতে পারবেন। বডি রিমুভ করে ঘরটা লক করে রাখা হয়েছিল। ঘরের সব জিনিসপত্র যেমন ছিল তেমনই আছে। আমি চাবি নিয়ে এসেছি। আর লোকাল থানাকেও ইনফর্ম করা আছে যে, আমরা স্পটে আজ সকলে যাব। কিঁউ, গুপ্তাসাব, অব চঁলে?’ শেষ প্রশ্নটা চোখ বুজে সিগারেটে টান দেওয়া পাজামা-পাঞ্জাবি-পরা মানুষটিকে লক্ষ্য করে।
চোখ খুললেন এসিজি। বললেন, ‘চলো, যাওয়া যাক। ব্যাপারটা একটু-একটু বোঝা গেল।’
বাড়ি থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠতে-উঠতে অশোকচন্দ্র বললেন, ‘রঘুপতি, একটা ব্যাপার কেমন মজার দ্যাখো। যে-ঘরে ওরা সবাই গায়ের জোরে দরজা ভেঙে ঢুকেছে, সেই ঘর থেকে খুনি পালিয়েছে বুদ্ধির জোরে।’ হাসলেন বৃদ্ধ থিঙ্কিং মেশিন।
রঘুপতি পালটা হেসে ডান হাতের মাসল ফুলিয়ে বলল, ‘এখন তো আমার গায়ের জোর আর আপনার বুদ্ধির জোর, দুটো নিয়েই আমরা যাচ্ছি। অব দেখনা হ্যায় জোর কিতনা বাজু-এ কাতিল মে হ্যায়।’
প্রাক্তন ছাত্রের কথা শুনে প্রাক্তন স্যার হো-হো করে হেসে উঠলেন। আর সেই আচমকা হাসিতে তাঁর ঠোঁট থেকে জ্বলন্ত সিগারেটটা খসে পড়ে গেল তিনি চেষ্টা করেও সেটা সামলাতে পারলেন না।
সল্টলেক জায়গাটা কলকাতার কত কাছে, অথচ কত দূরের বলে মনে হয়। কলকাতা শহরের যানজট, গাড়ির হর্নের তীব্র শব্দ, কালো ধোঁয়া, ভিড়, চিৎকার, কিছুই এখানে নেই। তা ছাড়া বাড়িগুলোর দিকে তাকালেই কেমন চোখ জুড়িয়ে যায়।
বলরাম চৌধুরির বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ঠিক এই কথাটাই মনে হচ্ছিল এসিজি-র।
প্রকাণ্ড মাপের বাড়ি। নাম ‘চৌধুরি ভিলা’। সাদা আর বাদামি রং। বড় লোহার গেটের ওপাশে বড় উঠোন। তার একপাশে সারি-সারি টবে ফুলগাছ। আর বাঁদিকে বেশ বড় মাপের বাগান।
বাড়িতে ঢুকতে-না-ঢুকতেই ফরসা মতন একটা বাচ্চা ছেলে ছুটে এল বাগানের পাশ দিয়ে। তার নাদুসনুদুস চেহারা। মাথায় গামছা দিয়ে তৈরি পাগড়ি। গায়ে মেরুন রঙের পাঞ্জাবি, পায়ে সরু পাজামা আর কোমরে বেল্ট।
বাচ্চাটা ‘সাবু! সাবু!’ বলে চিৎকার করছিল। এসিজিদের দেখামাত্রই চিৎকার করে উঠল, ‘সাবু! জলদি এসো। দেখে যাও কারা এসেছে।’
রঘুপতি যাদব অশোকচন্দ্রের কানের কাছে মুখ নিয়ে গিয়ে বলল, ‘কুন্তল।’