অশোকচন্দ্র গুপ্ত রত্নাবলীর দিকে তাকালেন। নীচু গলায় বিড়বিড় করে বললেন, ‘জানি না। একমাত্র মিসেস মুখার্জিই বলতে পারেন।’
রত্নাবলী মুখে আঁচল গুঁজে মাথা নীচু করে বসেছিলেন। ওঁর শরীরটা সামান্য কেঁপে-কেঁপে উঠছিল। আঁচল দিয়ে বারবার চোখ মুছে কয়েকবার নাক টেনে মুখ তুললেন তিনি। চোখ লাল, চোখের কোল ফোলা। সব মিলিয়ে বিধ্বস্ত অবস্থা।
চশমাটা নাকের ওপরে ঠিক করে বসিয়ে মাথা সামান্য হেলিয়ে ভাঙা গলায় কথা বললেন তিনি, ‘এগারো বছর ধরে আমার সব লেখা রঞ্জন লিখে দিয়েছে। যেসব বইয়ের জন্যে আমার এত নামডাক সেগুলো সব রঞ্জনের লেখা…শুধু বইগুলোর টাইটেল পেজে আমার নাম ছাপা আছে।’
সবাই অবাক হয়ে তাকালেন রঞ্জন দেবনাথের দিকে। যা শুনছেন ঠিক শুনছেন তো! কিন্তু রঞ্জন দেবনাথ নির্বাক নির্বিকার।
দু-একবার ঢোঁক গিলে রত্নাবলী আবার বলতে শুরু করলেন, ‘ওর সঙ্গে আমার খুব বন্ধুত্ব ছিল। আমার লেখা ও প্রথম দিকে কারেকশান করে দিত। তারপর এক-একসময় গোটা লেখাটাই রিরাইট করে দিত। সেগুলো আমি আবার নিজের হাতে কপি করে ছাপতে দিতাম। প্রথম-প্রথম ব্যাপারটা অনেকটা খেলা বা মজার মতো ছিল। কিন্তু যেই আমার বইয়ের বিক্রি বাড়তে লাগল তখন সেটা আর নিছক খেলা রইল না। রঞ্জনের দু-একটা বই ছাপা হয়েছিল, কিন্তু সেগুলো একদম বিক্রি হত না। ওর তখন ফ্যামিলি বারডেন অনেক—খুব টাকার দরকার। তাই আমিই একদিন ওকে বললাম, ”তুমি লেখো—আর সেগুলো আমার নামে ছেপে বেরোক, তা হলে টাকা আসবে। যা পাব, তুমি অর্ধেক নেবে, আর বাকিটা আমি। অবশ্য যদি চাও সবটাই নিতে পারো। তোমাকে দিতে মন চায় না এমন কিছু তো আমার নেই…।”
শব্দ করে কেঁদে উঠলেন রত্নাবলী। কাঁদতে-কাঁদতেই বললেন, ‘আর তো লুকিয়ে রাখার কোনও মানে হয় না। রঞ্জনকে…রঞ্জনকে আমি ভীষণ ভালোবাসতাম। এখনও ভালোবাসি। ওর মতো বন্ধু হয় না। আমার জন্যে ও কম স্যাক্রিফাইস করেনি। আমার যে-উপন্যাসটা রবীন্দ্র পুরস্কারের ফাইনাল রাউন্ডে গিয়েছিল সেটাও ওর লেখা। আমার যে-বই ইংরিজিতে বেরিয়েছে সেটারও আসল মালিক রঞ্জন। সত্যি, কত যশ আর খ্যাতি থেকে বেচারা বঞ্চিত হয়েছে! আর আমি? এগারো বছর ধরে অন্যের খ্যাতি নিজের নামে যোগ করে-করে সেটা আমার হকের দাবি বলে ভাবতে শুরু করেছি। সিংহাসনে একবার বসতে পারলে কে আর সহজে নেমে আসতে চায় বলুন! আমারও ঠিক সেই দশা হয়েছিল।
‘তারপর…তারপর…বছর দুয়েক ধরে রঞ্জন নানান অজুহাতে আমাকে এড়িয়ে চলতে লাগল। নিজের নামে লিখতে শুরু করল আবার। আমার তখন কী দুরবস্থা একবার ভাবুন! সবাই লেখা চায়, কিন্তু আমার মাথায় যুতসই কোনও আইডিয়া আসে না। নিজের সঙ্গে সে যে কী কঠিন লড়াই! স্পষ্ট বুঝতে পারছিলাম, রূপ-যৌবন-খ্যাতি সবই একে-একে ছেড়ে চলে যাচ্ছে। এখন শুধু অপেক্ষা। এরকমই একটা মানসিক অবস্থার মধ্যে এল এই কনফারেন্স। তারপর…’ দু-হাতে মুখ ঢেকে কাঁদতে শুরু করলেন রত্নাবলী।
‘কিন্তু গোস্ট রাইটারের ব্যাপারটা তো প্রমাণ করা খুব শক্ত। পাঁচকড়ি দে কিংবা এডগার ওয়ালেসের ব্যাপারটা কেউ প্রমাণ করতে পারেননি।’ অশোকচন্দ্র মন্তব্য করেছেন রত্নাবলীকে লক্ষ করে।
কোনওরকমে কান্না চাপা দিয়ে রত্নাবলী ভাঙা স্বরে বললেন, ‘আমিও সেরকমই ভেবেছিলাম। কিন্তু রঞ্জন একদিন আমাকে কতকগুলো অডিয়ো ক্যাসেট শুনতে দিয়েছিল…আর, কারেকশন করা রিরাইট করা আট-দশটা ম্যানুস্ক্রিপট দেখিয়েছিল। অডিয়ো ক্যাসেটে আমাদের অনেক অন্তরঙ্গ কথা ধরা ছিল। ওগুলো দেখার পর, শোনার পর আর কোনও যুক্তি টেকে না—একেবারে অকাট্য প্রমাণ।’
আবার চোখ মুছলেন রত্নাবলী : ‘আশ্চর্য! কীভাবে ”রত্না” থেকে আমি হঠাৎ ”মিসেস মুখার্জি” হয়ে গেলাম রঞ্জনের কাছে! শেষটা এত কষ্টের হবে ভাবিনি। আপনারা…আপনারা আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি যাই, মিস্টার গুপ্ত…মাথাটা ভীষণ ব্যথা করছে…ঘুমের ওষুধ খেয়ে শুতে হবে। বড় ক্লান্ত লাগছে।’
খুব ধীরে পা ফেলে রত্নাবলী মুখোপাধ্যায় চলে গেলেন ঘর থেকে। রঘুপতি যাদব নড়েচড়ে উঠেছিল, কিন্তু এসিজি তাকে হাতের ইশারায় থামালেন। রত্নাবলীর ইঙ্গিত তিনি ধরতে পেরেছেন। বিদায় যদি সত্যিই ওঁকে নিতে হয় তা হলে সম্রাজ্ঞীর মতো বিদায় নেওয়াই ভালো।
উঠে দাঁড়ালেন এসিজি। ভাস্কর রাহাকে লক্ষ করে বললেন, ‘চলি ভাস্করবাবু, পরে কখনও আবার দেখা হবে। আর একটা কথা : রঘুপতি যাদবের ফাইলে কিন্তু দেবারতি মানির ব্যাপারটা সুইসাইড বলেই লেখা হবে। আশা করি তাতে আপনাদের কোনও আপত্তি হবে না।’
কিছুক্ষণ সবাই চুপচাপ।
তারপর প্রশান্ত রায় এসে দাঁড়ালেন এসিজির কাছে। ইতস্তত করে বললেন, ‘কিন্তু মিস্টার গুপ্ত, দেবারতি মানি ওই সিক্রেট ব্যাপারটা জানতে পেরেছিল কেমন করে?’
তেতো হাসলেন এসিজি। বললেন, ‘সেটা তো বোঝাই যাচ্ছে। রঞ্জন দেবনাথই খবরটা দিয়েছিলেন দেবারতিকে। কারণ তিনি জানতেন, দেবারতি ব্যাপারটা জানার পর পরিণতি কী হবে।’
অশোকচন্দ্র এগিয়ে গেলেন একটু দূরে দাঁড়িয়ে থাকা রঞ্জনের কাছে। ওর পিঠ চাপড়ে বললেন, ‘আর আপনার কোনও চিন্তা নেই। পথ পরিষ্কার। নাম-ডাক কিংবা টাকা পেতে কাল থেকে আপনার আর কোনও অসুবিধে হবে না।’