দীর্ঘকায় এসিজির হাতে ব্রিফকেসটা অনেকটা খেলনাগোছের দেখাচ্ছিল। এপাশ-ওপাশ নজর বুলিয়ে তিনি ডক্টর দে-কে বললেন, ডাক্তারবাবু চলুন—।’
তখই তিনি খেয়াল করলেন, ডক্টর দে বেশ মনোযোগ দিয়ে একজন লম্বা ভারী চেহারার ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছেন।
ভদ্রলোকের বয়েস ষাট কি বাষট্টি হবে। পরনে গাঢ় নীল রঙের সাফারি সুট। ডানহাতের মধ্যমায় একটা বড় হিরের আংটি জ্বলজ্বল করছে। মাথা ভারতি কাঁচাপাকা চুল। চোখে সোনালি ফ্রেমের আধুনিক ডিজাইনের চশমা। পুরুষ্ট গোঁফ। দু-গালে এবং চিবুকের নিচে চর্বির থাক।
ডক্টর দে চাপা গলায় বললেন, ‘ওই ভদ্রলোককে চিনতে পারছেন?’
এসিজি আর রঙ্গলাল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকালেন।
মুখটা যেন চেনা-চেনা মনে হল এসিজির। এই মুখের ছবি কোথায় যেন দেখেছেন?
রঙ্গলাল ঠোঁট উলটে মাথা নাড়লেন! ‘দেখে মনে হয় নাকো চিনি উহারে…।’
‘মদনমোহন চ্যাটার্জি—’ ছোট্ট করে বললেন ভবানীপ্রসাদ।
ব্যস! তক্ষুনি সব মনে পড়ে গেছে এসিজির।
মদনমোহন চ্যাটার্জি। বিখ্যাত বিজনেস টাইকুন। খবরের কাগজের পাতায় প্রায়ই নানান কারণে ওঁর ছবি ছাপা হয়ে থাকে। এই তো মাসখানেক আগে কাগজে খবর ছিল, হলদিয়াতে মদনমোহন চ্যাটার্জি দু-হাজার কোটি টাকা দিয়ে একটা স্টিল প্ল্যান্ট শুরু করতে চলেছেন। আমেরিকায় নিউ ইয়র্ক আর লস এঞ্জেলসে ওঁর শিপিং কোম্পানি রয়েছে। আমেরিকাতে একবছর—বোধহয় ১৯৯৮ কি ১৯৯৯ সালে—’ম্যান অফ দ্য ইয়ার’ নির্বাচিত হয়েছেন।
এসিজি লক্ষ করলেন, মদনমোহন চ্যাটার্জি একা নন। ওঁর সঙ্গে রয়েছেন আরও দু’জন পুরুষ ও দু’জন মহিলা।
‘আপনি মিস্টার চ্যাটার্জিকে চেনেন নাকি?’ এসিজি ভবানীপ্রসাদকে জিগ্যেস করলেন।
ভবানীপ্রসাদ হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ, একসময়ে…মানে, বছরদশেক আগে…আমি ওঁর ট্রিটমেন্ট করেছিলাম।’
‘কীসের ট্রিটমেন্ট?’
‘অ্যাজমার। মিস্টার চ্যাটার্জির হাঁপানির প্রবলেম আছে।’
‘এখন আপনার সঙ্গে কোনও যোগাযোগ নেই?’
হাসলেন ডক্টর দে। মুখে কেমন একটা বিষণ্ণ ভাব ফুটিয়ে বললেন, ‘নাঃ। কী করে আর থাকবে! আমি মশাই সস্তার ডাক্তার। আমি যখন ওঁর ট্রিটমেন্ট করতাম তখন উনি এত বড়লোক ছিলেন না। এখন আমাকে দেখে হয়তো চিনতেই পারবেন না।’
এসিজি সায়ে দিয়ে মাথা নাড়লেন : ‘হ্যাঁ—পয়সা অনেকসময় মানুষকে বদলে দেয়…।’
রঙ্গলাল এসিজির সঙ্গে তাল দিয়ে বললেন, ‘ধন বড় বিচিত্র/ বদলে দেয় চরিত্র।’
‘ইকনমিক টাইমস’, ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড, ‘মানি ম্যটারস’, ‘ইয়োর শেয়ার’ ইত্যাদি পত্রিকায় মদনমোহন চ্যাটার্জিকে নিয়ে প্রায় লেখালিখি হয়। ব্যবসায়ীদের দুনিয়ায় ওঁর ডাকনাম হজমমোহন চ্যাটার্জি। কারণ, উনি নাকি প্রতিদ্বন্দ্বী ব্যবসায়ীদের জ্যান্ত গিলে খেয়ে হজম করেন। লোকে বলে, বহু ইন্ডাস্ট্রিকে উনি প্যাঁচ কষে সিক হওয়ার দিকে ঠেলে দিয়েছেন, তারপর সেই সিক ইন্ডাস্ট্রি কিনে নিয়েছেন। অন্তত চারজন ইন্ডাস্ট্রির মালিক ভাগ্যের ফেরে এখন মদনমোহন চ্যাটার্জির নানান কোম্পানিতে ম্যানেজার কি ডেপুটি ম্যানেজারের চাকরি করছেন।
মদনমোহনের চলাফেরার ভঙ্গি আর হাবভাবে পয়সা ফুটে বেরোচ্ছিল। তিনি আঙুল তুলে ইশারা করেছিলেন আর ওঁর সঙ্গী চারজন পড়ি-কি-মরি করে সেই হুকুম তামিল করছিলেন।
সিকিওরিটি চেকের পর বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হল না। স্পিকার ঘোষণা শুনে যাত্রীরা রওনা হলেন প্লেনের দিকে।
প্লেনটা এয়ারবাস-এ থ্রিটোয়েন্টি। এতে প্রায় শ’আড়াই কি তার বেশি সিট থাকলেও এসিজি লক্ষ করলেন, প্যাসেঞ্জারের সংখ্যা বেশ কম। এই শীতের সময়, বিশেষ করে শনিবারে, হয়তো রাশ কম থাকে—কে জানে! আর সেইজন্যই ডক্টর দে এসিজি আর রঙ্গলালের সঙ্গে বসার সুযোগ পেলেন।
রঙ্গলাল উইন্ডো সিট নিয়েছিলেন। এটা ওঁর জীবনের দ্বিতীয় প্লেন জার্নি। প্রথমটা কয়েকদিন আগে এখানে আসার সময়। তখনও বাচ্চাছেলের মতো উইন্ডো সিট নিয়েছিলেন।
প্লেনের সিটের ব্যবস্থা দুই-চার-দুই ঢঙে সাজানো। দুই আর চারের মাঝে দুটো অলিপথ সমান্তরালভাবে প্লেনের লেজের দিক থেকে নাক পর্যন্ত চলে গেছে। সামনের দিকে এক্সিকিউটিভ ক্লাস—পরদার আড়াল দিয়ে সেটাকে ইকনমি ক্লাস থেকে আলাদা করা হয়েছে।
ইকনমি ক্লাসের মাঝামাঝি জায়গায় বাঁ-দিকের দুটো সিটে পরপর বসলেন রঙ্গলাল ও এসিজি। তারপরই অলিপথ। অলিপথের পরের সিটটাতে ভবানীপ্রসাদ বসলেন। ফলে এসিজির সঙ্গে কথা বলতে ওঁর তেমন অসুবিধে হচ্ছিল না।
এসিজি লক্ষ করলেন, মদনমোহন চ্যাটার্জি ওঁর সঙ্গী একজন সুন্দরী মাঝবয়েসি মহিলা ও একজন পুরুষকে নিয়ে এক্সিকিউটিভ ক্লাসে ঢুকে গেলেন। অন্য দু’জন ইকনমি ক্লাসে, এসিজিদের কাছ থেকে একটু দূরে, ডানদিকের সিটে বসে পড়লেন।
মদনমোহনের এক্সিকিউটিভ ক্লাসের সঙ্গী দু’জন কি তা হলে ওঁর আত্মীয়? ভাবলেন এসিজি…আর ইকনমি ক্লাসের এই দু’জন কি কর্মচারী?
ডক্টর দে একমনে মদনমোহন ও তাঁর সঙ্গীসাথীদের লক্ষ করছিলেন। এসিজিও একপলকে ওঁদের দেখে নিয়েছিলেন। তাতে এসিজির ধারণা হয়েছে, ওঁরা কেউই অন্তর থেকে মদনমোহন চ্যাটার্জির হুকুম তামিল করছেন না। কে জানে, এসিজির ধারণা হয়তো ভুলও হতে পারে।
রঙ্গলাল হঠাৎই বললেন, ‘এসিজি স্যার, ফিরে গিয়ে ভাবছি আমার সেই লেখাটায় হাত দেব…।’