এসিজির সঙ্গে রঙ্গলালের এই একটি জায়গাতেই বেশ মিল : দু’জনেই শীতকাতুরে। নইলে ব্যাঙ্গালোরে সেরকম শীত কোথায়!
রঙ্গলাল গোস্বামীর রং শ্যামলা। ডানহাতের তিন আঙুলে রুপোয় বাঁধানো তিনটে পাথরের আংটি। মাথার তেল-চকচকে কোঁকড়ানো চুলের ঠিক মাঝখান দিয়ে সিঁথি। কপালের বাঁ-দিকে একটা ছোট্ট আঁচিল। নাকটা বেশ জম্পেশ। দাড়ি-গোঁফ সুন্দর করে কামানো। গা থেকে পারফিউমের গন্ধ বেরোচ্ছে। বোঝাই যায়, বেশ শৌখিন মানুষ।
রঙ্গলালকে অনেকেই দক্ষিণ ভারতীয় ভেবে ভুল করছিল। তাদের দক্ষিণী কথার জবাবে রঙ্গলাল আকর্ণ হাসছিলেন এবং ‘থ্যাঙ্ক য়ু’ বলছিলেন।
এসিজি একটি সিগারেট ধরিয়েছিলেন। এরপর প্রায় আড়াই ঘণ্টা সিগারেট ছেড়ে থাকবে হবে। প্লেন ওড়ার সময় ‘স্মোকিং প্রহিবিটেড’-এর আইন জারি হয়ে গেছে।
‘পোয়াবারো’ মানে যে পাশা খেলার একটা দান এ-কথা শোনার পর রঙ্গলাল সমঝদারের মতো মাথা নাড়ছিলেন। তখন সময় কাটানোর জন্য গোয়েন্দাপ্রবর পাঞ্জাবির পকেট থেকে বের করে নিয়েছেন একটা রুবিক কিউব—এবং শুরু করে দিয়েছেন রং-মেলান্তির খেলা।
এই বিচিত্র রঙিন কিউবটা রঙ্গলাল আগেও এসিজির কাছে দেখেছেন। দু-একবার ওঁর কাছ থেকে কিউবটা চেয়ে নিয়ে রং মেলানোর চেষ্টাও করেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা দেখে সহজ মনে হলেও আসলে যাচ্ছেতাইরকম কঠিন।
এই সদা-চুল মানুষটি রঙ্গলালকে সবসময় অবাক করে দেন। কোনওরকম সমস্যা পেলেই হল—এসিজি তার সমাধান করতে মনে-মনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। নিজেকে যখন তিনি ‘থিঙ্কিং মেশিন’ বলেন, তখন মোটেই নিজেকে জাহির করেন না—যা সত্যি তাই বলেন। তাঁর কথায় সি. অগাস্ত দুপাঁ, শার্লক হোমস, এরকুল পোয়ারো থেকে শুরু করে পরাশর বর্মা, ব্যোমকেশ বক্সী, ফেলু মিত্তির সকলেই থিঙ্কিং মেশিন। আসল কথা হল, গোয়েন্দাদের থিঙ্কিং মেশিন না হলে চলে না।
এখন বসে-বসে তিনি কী ভাবছিলেন কে জানে। হঠাৎই একজন ফরসা, বেঁটে এবং মোটাসোটা ভদ্রলোক অনেকটা হাঁপাতে-হাঁপাতে এসে এসিজির বাঁ-পাশের খালি চেয়ারটায় ধপাস করে বসে পড়লেন। তারপর নিভাঁজ বাংলায় প্রশ্ন করলেন, ‘কলকাতার ফ্লাইট ক’টায় ছাড়বে কিছু বলল?’
এসিজি সিগারেটে লম্বা টান দিয়ে বললেন, ‘এটুকু বলেছে, যে-কোনও সময় সিকিওরিটি চেক-এর জন্যে ডাক পড়তে পারে।’
এরপর ভদ্রলোক অশোকচন্দ্রের সঙ্গে আলাপ জুড়ে দিলেন। বললেন, তিনি পেশায় ডাক্তার। নাম ভবানীপ্রসাদ দে। লেক প্লেসে থাকেন। ওঁর একমাত্র মেয়ে ব্যাঙ্গালোরের একটা মেডিকেল কলেজে এ-বছরের মাঝামাঝি অ্যাডমিশন নিয়েছে। ওর সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন।
পরিচয় বিনিময় করার সময় এসিজি নিজের খুব সংক্ষিপ্ত পরিচয় দিয়েছিলেন। কিন্তু রঙ্গলাল গোস্বামী—যিনি এসিজির এমন গুণমুগ্ধ যে, ওঁকে নিয়ে স্বভাব-কবিতা লিখেছেন : ‘আমি আপনার গুণমুগ্ধ/ আপনি যেন খাঁটি দুগ্ধ’—তিনি সংক্ষিপ্ত পরিচয়ে মোটেই সন্তুষ্ট হলেন না। এসিজির পদার্থবিজ্ঞানে দক্ষতা, পাখির নেশা, অপরাধবিজ্ঞান চর্চা, খুনি ধরার নেশা, রুবিক কিউব সমাধানের ‘অলৌকিক ক্ষমতা’—সবই সবিস্তারে পেশ করলেন ডক্টর দে-র কাছে।
এই বিস্তারিত পরিচয়ে এসিজি লজ্জা এবং সঙ্কোচ ছাড়াও ভয় পাচ্ছিলেন। ভবানীপ্রসাদবাবু ভেবে না বসেন যে, রঙ্গলাল গোস্বামী এসিজির প্রচারসচিব। আজকাল নানা মহলে এই পদটির বেশ চল হয়েছে।
অশোকচন্দ্রের ‘জীবনী’ জানার পর ভবনীপ্রসাদ একেবারে বিগলিত হয়ে পড়লেন। জানা গেল, ভদ্রলোক গোয়েন্দাকাহিনির অন্ধ ভক্ত। এসিজির দু-একটি কীর্তিকলাপ যে পড়েছেন সেটা ওঁর বেশ মনে পড়ছে।
‘সত্যি, আমি খুব লাকি। আপনার মতো জিনিয়াসের সঙ্গে এরকম আচমকা পরিচয় হয়ে যাবে ভাবতে পারিনি।’
আজকাল ‘জিনিয়াস’ আর ‘জিনিস’—দুটো শব্দ প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে। বেপরোয়া অতিব্যবহারে বিশেষণের ক্ষয় হয়। যেরকম হয়েছে ‘শহিদ’ শব্দটার। মনে মনে ভাবছিলেন এসিজি।
ভবানীপ্রসাদ এসিজির হাত চেপে ধরলেন। একগাল হেসে বললেন, ‘এয়ারবাসে তো অনেক সিট খালি থাকবে…এয়ারহোস্টেসকে ম্যানেজ করে আপনার পাশে বসব। তারপর দু-আড়াই ঘণ্টা ধরে আপনার সব থ্রিলিং এক্সপিরিয়েন্স শুনতে-শুনতে যাব। আপনার কোনও আপত্তি নেই তো?’
এসিজি হেসে বললেন, ‘আপত্তি কেন, বরং ভালোই লাগবে। কী বলেন, রঙ্গলালবাবু?’
রঙ্গলাল গোস্বামী মাথা হেলিয়ে বললেন, ‘ডাক্তার, ডক্টর, কী বা মিশ্রণ/ অনাবিল স্বাদে মোর ভরিবে ভ্রমণ।’
স্বভাবকবির উত্তর শুনে ভবানীপ্রসাদ হো-হো করে হেসে উঠলেন। হাসির দমক থামলে চোখ বড়-বড় করে বললেন, ‘মশাই আপনিও তো দেখছি আর-এক ধরনের জিনিয়াস!’
রঙ্গলাল গোস্বামী সলজ্জভাবে নিজের পরিচয় দিলেন।
আর ঠিক তখনই অডিয়ো সিস্টেমে ঘোষণা করা হল, কলকাতাগামী উড়ান এইট ডব্লিউ ফাইভ ওয়ান এইট-এর যাত্রীদের সিকিওরিটি চেক-এর জন্য এগোতে অনুরোধ করা হচ্ছে।
এসিজি চটপট উঠে দাঁড়ালেন। হাতের সিগারেটটা একটু দূরে রাখা লিটারবিন-এ ফেলে দিলেন। তারপর রুবিক কিউবটা পাঞ্জাবির পকেটে চালান করে দিয়ে রঙ্গলালকে তাগাদা দিলেন : ‘চলুন, রঙ্গলালবাবু, শেষ পর্যন্ত তা হলে আমরা কলকাতা পৌঁছোতে পারব।’
রঙ্গলাল নির্মল হাসি হেসে ওঁর ট্র্যাভেল ব্যাগটা তুলে নিলেন। এসিজিও ঝুঁকে পড়ে হাত বাড়ালেন ওঁর ব্রিফকেসের হাতলের দিকে।