চোখের জল তখনও গড়িয়ে পড়ছিল—।
প্রভাবতীকে কিছুক্ষণ সময় দিয়ে তারপর এসিজি বললেন, ‘মিসেস রায়, এখন আপনি কী করবেন ভাবছেন? আপনি দু-দুটো অন্যায় করেছেন—তার মধ্যে একটা এখনও শুধরে নেওয়ার সময় আছে। আমি হলে শুধরে নিতাম…।’
‘আপনার কাছে কোনও প্রমাণ আছে?’ বৃদ্ধা মুখ না ফিরিয়েই প্রশ্ন করলেন।
‘না—’ হেসে মাথা নাড়লেন এসিজি ‘প্রমাণ নেই। প্রমাণই কি সব! একটা কথা আপনাকে বলি। ঈশ্বর কমা, সেমিকোলন, কোলন, ড্যাশ—এইসব পাংচুয়েশান মার্ক আমাদের হাতে দেন—তবে দাঁড়িটা নিজের হাতে রাখেন। সময় হলেই আমাদের জীবনে দাঁড়ি টেনে দেন। সেই দাঁড়িটা নিজের হাতে তুলে নেওয়া মানে ঈশ্বরকে অসম্মান করা। আপনি সেটাই করেছেন। প্রমাণ না থাকুক, যে-অন্যায়টা এখনও শোধরানো যায় আপনি সেটা অন্তত শুধরে নিন…।’
‘দিদিকে আমি ভালোবাসতাম। কিন্তু কী করব…সুনন্দাদের জন্যে পাগল-পাগল টান। কেন এমন টান কে জানে! আমার জন্যে দিদি…ছিল শুকতারা, সন্ধ্যাতারা হয়ে গেল। আমার জন্যে…।’
বৃদ্ধার মুখ ভেঙেচুরে গেল। জলভরা কাতর চোখে এসিজির দিকে তাকালেন তিনি। কিছু একটা বলতে চাইলেন।
এসিজি উঠে দাঁড়ালেন। বিড়বিড় করে বললেন, ‘এসব কথা আমি কাউকে বলব না।’
একজন সর্বস্বান্ত রানিকে তাঁর মেকি সিংহাসনে বসিয়ে রেখে এসিজি আর রঙ্গলাল ঘর থেকে বেরিয়ে এলেন।
টিভিতে তখনও মূকাভিনয় চলছিল।
আকাশঘুম (উপন্যাস)
খুন অতি জঘন্য কাজ—খুনি ধরার কাজ আরও জঘন্য।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে এই দামি মন্তব্যটা করেছেন ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত—সংক্ষেপে যাঁর নাম এসিজি। রাজাবাজার বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনা করার সময় এই সংক্ষিপ্ত নামটাই বেশি চালু ছিল। কিন্তু রিটায়ার করার পর কেউ এ-নামে ডাকলে এবং তার সঙ্গে ‘স্যার’ যোগ করলে কানে যেন কেমন লাগে—বিশেষ করে সে যদি পুরোনো ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ না হয়।
রঙ্গলাল গোস্বামী সেই দলেরই একজন। তিনি হঠাৎ এসিজিকে প্রশ্ন করে বসেছেন, ‘এসিজি স্যার, খুন অতি জঘন্য, খুনি ধরা আরও/ সেই কাজে আপনার কেন পোয়াবারো?’
স্বভাবকবি রঙ্গলাল ছন্দ তৈরি করেন কথায়-কথায়। এ-বিষয়ে প্রশ্ন করলে সঙ্কুচিতভাবে মাথা নিচু করে জবাব দেন, ‘আমি একজন স্বভাবকবি/ কবিতায় কথা বলা আমার হবি।’
এসিজির গুণমুগ্ধ এই ব্যাচিলার কবিমানুষটি সবসময় এসিজির সঙ্গী হতে ভালোবাসেন। আর সুযোগ পেলেই ছাত্রের মতো প্রশ্ন করেন এসিজিকে।
মাথার সাদা চুলের গোছায় কয়েকবার টান মেরে এসিজি জিগ্যেস করলেন, ‘পোয়াবারো কথাটার আসল মানে জানেন?’
রঙ্গলাল অবাক হয়ে তাকালেন বৃদ্ধ হুনুরের দিকে। এপাশ-ওপাশ মাথা নাড়লেন ‘না, জানি না।’
‘পোয়াবারো মানে হল পাশাখেলার একটা দান। তো ধরে নিন, খুনির সঙ্গে বুদ্ধির পাশা খেলতে আমার ভালো লাগে। তাই খুনি ধরার কাজটা খুনের চেয়েও জঘন্য জেনেও আমার খুনি ধরতে ভালো লাগে। আপনার স্বভাব-কবিতার নেশার মতো এটাও একটা নেশা।’
‘স্বভাব-কবিতা’ শব্দটা মোটেই এসিজির আবিষ্কার নয়, ওটা রঙ্গলাল গোস্বামীর সম্পত্তি। ওঁর প্রথম কবিতার বইয়ের নাম ‘স্বভাব-কবিতা সমগ্র’।
ব্যাঙ্গালোর এয়ার টার্মিনালে বসে অশোকচন্দ্র আর রঙ্গলাল কথা বলছিলেন। ইন্দিরানগর ছাড়িয়ে এইচ.এ.এল. এরিয়ার এই এয়ার টার্মিনালে ওঁরা এসেছেন পাক্কা দু-ঘণ্টা। কিন্তু কলকাতার উড়ান ফ্লাইট নম্বর-এইট ডব্লিট ফাইভ ওয়ান এইট ছাড়তে এখনও অনেক দেরি। আবহাওয়ার কী একটা যেন গোলমাল হয়েছে—বোধহয় কুয়াশা কিংবা ধোঁয়াশা।
রঙ্গলাল বারবার বিড়বিড় করে বলছিলেন, ‘এসিজি স্যার, আজ বোধহয় কপালে কলকাতা পৌঁছোনো নেই।’
স্পিকারের নানারকম ঘোষণা চলছিল। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে রঙিন মনিটরগুলো রাজ্যের উড়ান-সংবাদ অক্লান্তভাবে পেশ করছিল। মোল্ডেড প্লাস্টিকের আর্গোনমিক চেয়ারে বসে বহু যাত্রী অপেক্ষা করছিলেন। টার্মিনাল বিল্ডিং-এর আধুনিক আলোকসজ্জা সবজায়গায় হিসেবমতো আলো পৌঁছে দিয়েছে। মার্বেল পাথরের গ্রানাইট পালিশ করা মেঝেতে আয়নার মতো প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। অনেক যাত্রীই ব্যস্তভাবে এদিক-ওদিক যাতায়াত করছিলেন। কেউ-বা ট্রলিবোঝাই মালপত্র ঠেলে নিয়ে চলেছেন টার্মিনাল বিল্ডিং-এর বাইরে।
এসিজি ও রঙ্গলালের বোর্ডিং পাস নেওয়া হয়ে গিয়েছিল। এখন ওঁরা সিকিওরিটি চেক শুরু হওয়ার ঘোষণার জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
কলকাতার একটা স্মাগলিং-এর কেসের ব্যাপারে অশোকচন্দ্র গুপ্ত ব্যাঙ্গালোরে এসেছিলেন। কতকগুলো জেমস্টোনের স্পেক্ট্রাল ক্যারেকটারিস্টিকস খতিয়ে দেখার জন্য রমন রিসার্চ ইন্সটিটিউট আর ইন্ডিয়ান ইন্সটিটিউট অফ সায়েন্স-এ ওঁর জরুরি কাজ ছিল। তিনদিনেই সবকাজ ঠিকমতো মিটে যাওয়ায় আজ হালকা মনে বাড়ির পথে রওনা হয়ে পড়েছেন।
রঙ্গলাল গোস্বামী বাগবাজারের ‘লালমহল’-এর বাসিন্দা। বছরতিনেক আগে ডক্টর অশোকচন্দ্র গুপ্ত ওঁর দাদার একটা হারানো চুনি খুঁজে দিয়েছিলেন। সেই থেকে এই অদ্ভুত মানুষটির সঙ্গে এসিজির আলাপ।
এসিজি লক্ষ করেছেন, লাউঞ্জে অনেকেই রঙ্গলাল গোস্বামীকে লক্ষ করছেন। আর খানিকটা নজর কাড়ছেন এসিজিও। কারণ, বোধহয় ওঁদের দু’জনের পোশাক।
এসিজির পরনে পাজামা আর খদ্দরের পাঞ্জাবি, তার ওপরে জড়ানো সাদা শাল। ভেতরে অবশ্য লুকোনো একটা উলের স্যান্ডো গেঞ্জিও রয়েছে। আর রঙ্গলালবাবুর পরনে সাদা ধবধবে ধুতি-পাঞ্জাবি, তার ওপরে মেরুন রঙের এক বিচিত্র জহরকোট। আর গলায় সবুজ রঙের একটা মাফলার।