অশোকচন্দ্র ও রঙ্গলাল বাড়িতে ঢুকতেই সুনন্দার সঙ্গে দেখা হল। টেলিফোনে আগাম বলা ছিল। সুতরাং অপছন্দ মুখে সুনন্দা ওঁদের দোতলায় মায়ের ঘরে নিয়ে গেলেন।
সিঁড়ি দিয়ে ওঠার সময় এসিজি টিভি চলার শব্দ পাচ্ছিলেন, বাচ্চাদের কথাবার্তা শুনতে পাচ্ছিলেন। প্রভাবতীর ঘরে ঢুকতেই টিভির শব্দ ওঁদের কানে ধাক্কা মারল।
গতকালের গন্ধটা আরও উগ্রভাবে এসিজির নাকে এল।
প্রভাবতী সম্রাজ্ঞীর ঢঙে সেজেগুজে সোফায় বসে ছিলেন। শরীর টান-টান। মুখে প্রসাধনের সামান্য আস্তর।
আরতি ওঁর পাশে মেঝেতে বসে টিভি দেখছিল। এসিজিদের দেখেই উঠে দাঁড়াল।
প্রভাবতী ওকে বললেন, ‘টিভির আওয়াজটা একদম কমিয়ে দে।’
হুকুম তামিল হল। টিভিতে মূকাভিনয় শুরু হল।
‘বলুন, ডক্টর গুপ্ত, কী ব্যাপারে দেখা করতে চেয়েছেন?’ প্রভাবতী মাপা গলায় প্রশ্নটা করলেন। অনুমতির অপেক্ষা না করেই এসিজি রঙ্গলালকে নিয়ে চারুবালার খাটের কিনারায় বসে পড়লেন। তারপর নিচু গলায় বললেন, ‘আপনার সঙ্গে প্রাইভেট কিছু কথা ছিল।’
সঙ্গে-সঙ্গে হুকুম হল : ‘আরতি, তুই এখন যা। আমি ডাকলে তবে আসবি।’
আরতি তাড়াতাড়ি পা ফেলে চলে গেল। যেন পালিয়ে বাঁচল।
সুনন্দাও চলে যাচ্ছিলেন, কিন্তু এসিজি ওঁকে ডেকে প্রশ্ন করলেন, ‘আপনার পিসিমা যেদিন মারা যান সেদিন আপনি ওঁর কাপড় ছড়াতে ছাদে গিয়েছিলেন? পরে, পিসিমা ছাদ থেকে পড়ে যাওয়ার পরেও আপনি আবার ছাদে গিয়েছিলেন। অথচ তখন তো সকলের গলির দিকে ছুটে যাওয়ার কথা। এটা একটু এক্সপ্লেইন করবেন?’
সুনন্দা দিশেহারা চোখে মায়ের দিকে তাকালেন।
প্রভাবতী স্থির গলায় বললেন, ‘তুই যা। আমি কথা বলছি।’
সুনন্দা যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। এসিজির দিকে তাকিয়ে বোকা-বোকা হেসে চটপট চলে গেলেন।
‘যা বলার আমাকে বলুন, ডক্টর গুপ্ত। ওরা সব ছেলেমানুষ—।’
প্রভাবতীর গলায় সামান্য চ্যালেঞ্জের ছোঁওয়া ছিল। ঘরের জোড়া টিউব লাইটের আলোয় ওঁর বলিরেখাগুলো নিষ্ঠুর দেখাল।
এসিজির ঠোঁটের কোণে একচিলতে হাসি ফুটে উঠল। মাথার চুলের গোছায় টান মেরে তিনি বললেন, ‘ম্যাডাম, আপনাকে একটা গল্প শোনাই। গল্পে হয়তো অনেক ফাঁকফোকর থাকবে—সেগুলো আপনাকেই ভরাট করতে হবে…।’
প্রভাবতীর মুখ পাথরের মতো। চোখ টিভির দিকে।
কাল সারাটা রাত ধরে বহু ভেবেছেন বৃদ্ধ হুনুর। মনে-মনে এমন একটা গল্প তৈরি করতে চেয়েছেন যেটা প্রতিটি সূত্রের সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। সোনার হার, কাপড় ছড়ানোর প্লাস্টিকের ক্লিপ, সুনন্দার ছাদে যাতায়াত—আর, সবশেষে চারুবালার নিয়তি। এখন সেই গল্পই শোনাতে এসেছেন প্রভাবতীকে।
সামান্য কেশে নিয়ে এসিজি বলতে শুরু করলেন ‘আপনি একটা চান্স নিয়েছিলেন, মিসেস রায়। চারুবালাকে আপনি নানান ছল-ছুতোয় ছাদের ওই বিপজ্জনক জায়গাটায় পাঠাতে চেয়েছিলেন। তাই ওঁর ভেজা কাপড় ইদানীং ওই বিপজ্জনক জায়গাতেই ছড়ানো হত। কে ছড়াতেন জানি না। তবে আপনি নন। সুনন্দা হতে পারে, আরতি হতে পারে। হয়তো ছড়ানোর জন্যে ওরা লাঠি বা অন্য কিছু ব্যবহার করত—যাতে ওই লক্ষ্মণের গণ্ডির ভেতরে ঢুকে পড়তে না হয়। তা ছাড়া, আমি দেখেছি, দড়িটা লাঠি দিয়ে টেনে এনেও নিরাপদ জায়গায় দাঁড়িয়ে কাপড় ছড়ানো যায়, ক্লিপ আঁটা যায়। আপনি সেই শনিবার চারুবালাকে বকাঝকা করে ওঁর শুকনো কাপড় তুলে আনতে পাঠিয়েছিলেন—আমার সেরকমই মনে হয়।
‘কিন্তু চারুবালা ছিলেন কিছুটা ছিটগ্রস্ত। তাই সবসময় হয়তো ছাদে গিয়েও ওই জায়গাটায় পা দিতেন না। হয়তো সাদা দাগটা ওঁকে পুরোনো কথা মনে করিয়ে দিত—উনি সাবধান হয়ে যেতেন।
‘আপনি তখন খানিকটা সমস্যায় পড়লেন। তখন সোনার হারের টোপটা আপনার মাথায় এল। ওটা আপনি চারুবালার কাছ থেকে কোনও অজুহাতে নিয়ে লুকিয়ে ফেললেন। তারপর ছাদের ওই বিপজ্জনক জায়গায় হারটা রেখে দিয়ে এলেন। না, আপনি নন—আপনার হয়ে অন্য কেউ। আপনি যে সিঁড়ি ভাঙতে পারেন না তা আমি জানি।
‘এইবার কাজ হল। চারুবালা ছাদে গেলেন। সোনার চেনটা দেখতে পেলেন। তারপর ঠিক কী হয়েছে জানি না। উনি শাড়ি থেকে ক্লিপটা আগে খুলেছেন, নাকি চেনটা আগে কুড়িয়ে নিয়েছেন কে জানে! চেনটা আগে নিয়ে থাকলে ওটা হয়তো আবার ওঁর হাত থেকে খসে পড়ে গেছে ছাদেই। কিন্তু ক্লিপটা হাতে থেকে গিয়েছিল…।’
একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন এসিজি। তারপর আবার খেই ধরলেন : ‘নিয়তি তার কাজ করল। চারুবালা পড়ে গেলেন। আর আপনার এ-ঘর থেকে সুনন্দা সঙ্গে-সঙ্গে ছাদে চলে গেল পিসিমণির শাড়িটা তুলে আনতে…।’
এসিজি থামলেন।
অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন প্রভাবতী। টিভির দিকে তখনও তাকিয়ে রয়েছেন। কিন্তু ওঁর দু-চোখ থেকে ভাঙা গাল বেয়ে জল গড়িয়ে পড়ছিল। টিভির আলোয় জলের রেখা চকচক করছিল।
চাপা খসখসে গলায় বললেন, ‘হারটা আমি দিদির কাছ থেকে নিইনি। দিদিই আমাকে ওটা গলা থেকে খুলে রাখতে দিয়েছিল—পরে ভুলে গিয়েছিল। অবশ্য চাইলে আমিও অস্বীকার করতাম।
‘আপনার একটা গোপন অন্যায় চারুবালা দেখে ফেলেছিলেন। সেটা কী আমি আঁচ করতে পারিনি—।’
নিষ্প্রাণ যান্ত্রিক গলায় প্রভাবতী বললেন, ‘এই বাড়িটা আমি সুনন্দার নামে উইল করে গেছি। অমলেশ যেদিন কাগজপত্র সই করিয়ে নেয় দিদি সেদিন দেখেছিল। তারপর থেকেই আমাকে জ্বালিয়ে মারত। বলত, ”এ তুমি ঠিক করলা না। অজু-বিজু ভিটা ছাইরা কই যাইব!” কিন্তু কী করব! সুনন্দা-অমলেশের জন্যে যতটা আমার মন টানে অজু-বিজুর জন্যে ততটা না। ওরা অনেক পেয়েছে—।’