এসিজি বুঝলেন, মা-কে নিয়ে দু-ছেলে আর তাঁদের স্ত্রীদের ক্ষোভের শেষ নেই। অথচ কিছু করারও নেই—কারণ, প্রভাবতীই এ-বাড়িতে শেষ কথা।
এরপর সুনন্দার সঙ্গে কথা বলে উলটো ছবি পাওয়া গেল। বড় মেয়ে মায়ের প্রশংসায় একেবারে পঞ্চমুখ। সারা জীবন ধরে প্রভাবতী যে কত ত্যাগ স্বীকার করেছেন, কত কষ্ট সয়েছেন সেগুলো বিস্তারিত বললেন সুনন্দা। মায়ের স্নেহ-মমতা-দয়া সম্পর্কেও এত বলতে লাগলেন যে, এসিজির মনে হচ্ছিল তিনি ভগিনী নিবেদিতা অথবা ফ্লোরেন্স নাইটিংগেলের জীবনী শুনছেন।
অমলেশ বাড়িতে নেই। তিনি দু-দিন আগে ব্যবসার কাজে ভাইজাগ গেছেন—পরশু ফিরে আসবেন। তবে অমলেশ থাকলেও বোধহয় কোনও লাভ হত না। কারণ, সুনন্দার কথারই প্রতিধ্বনি বোধহয় শুনতে পাওয়া যেত।
এসিজির মনটা কেমন যেন খচখচ করছিল। চারুবালা ছাদে গেলেন কাপড় ছড়াতে অথবা কাপড় তুলতে। অথচ ছাদে কোনও কাপড় পাওয়া গেল না। দীপ্তিমান, অজয়েন্দ্র—দুজনেই বলেছেন চারুবালা সাধারণত ছাদে যেতেন না। তা হলে সেদিন হঠাৎ গেলেন কেন! অন্যান্য দিন ওঁর কাপড়খানা কে ছড়াত, কে তুলত? নিশ্চয়ই আরতি! আরতির সঙ্গে একবার আলাদা কথা বলা দরকার।
বিজয়েন্দ্রকে ডেকে এসিজি বললেন, ‘বিজয়বাবু, আরতিকে একবার ডেকে দেবেন? নীচে বসবার ঘরে ওর সঙ্গে একটু আলাদা কথা বলব। তবে কেয়ারফুলি ডাকবেন—আপনার মা যেন টের না পান। টের পেলেই হয়তো রাগারাগি করবেন…।’
বিজয়েন্দ্র ওঁর স্ত্রী তুলিকাকে ডেকে চাপা গলায় কী যেন বললেন। তুলিকা চলে গেলেন রান্নাঘরের দিকে।
‘আপনারা নীচে যান—ও আসছে। তবে বেশিক্ষণ ওকে আটকে রাখবেন না। একটু পরেই মা চান করতে যাবে। তখন আরতিকে ডেকে না পেলে পরে তুলোধোনা করে ছাড়বেন।’ কথা শেষ করে অদ্ভুত হাসলেন বিজয়েন্দ্র।
নীচের বসবার ঘরে ওঁরা তিনজন সবে গুছিয়ে বসেছেন, আরতি দরজায় এসে দাঁড়াল। পরনে ছাপা শাড়ি, আঁচল কোমরে গোঁজা।
‘আমায় ডেকেছেন, দাদাবাবু?’
‘তুমি তো জানো আমরা পুলিশের লোক—’ গম্ভীর চালে কথা শুরু করে এখন একটা সিগারেট ধরালেন এসিজি। গায়ের শালটা বাঁ-হাতের ওপরে ঝুলে পড়েছিল, সেটা কাঁধের দিকে টেনে নিলেন।
আরতির শ্যামলা মুখ পলকে ফ্যাকাসে হয়ে গেল। শুকনো গলায় বলল, ‘হ্যাঁ, দাদাবাবু, জানি—।’
‘তোমাকে কয়েকটা কথা জিগ্যেস করব। একদম ঠিক-ঠিক জবাব দেবে। উলটোপালটা চালাকি করলে…।’
‘মা কালীর দিব্যি—সত্যি বই মিথ্যে কইব না।’
‘চারুবালা—মানে, তোমার পিসিমার শাড়ি-জামাকাপড় রোজ কে ছাদে শুকোতে দিয়ে আসত, আর কে তুলে নিয়ে আসত?’
‘আ-আমি?’
‘অন্য কেউ কখনও যেত না?’
‘না। তবে কিছুদিন হল মা মাঝে-মাঝে বড়দিকে পাঠাতেন। কখনও বা পিসিমাকে পাঠাতেন।’
‘পিসিমা যেদিন মারা যান সেদিন পিসিমার কাপড় কে ছড়িয়ে দিয়ে এসেছিল?’
একটু চিন্তা করে আরতি বলল, ‘বড়দি।’
‘শনিবার, পিসিমা যখন ছাদ ভেঙে পড়ে যান, তখন সত্যি-সত্যি বড়দি, দাদাবাবুরা, বউদিরা—সবাই মায়ের ঘরে ছিল?’
আবার সময় নিল আরতি। তারপর ‘হ্যাঁ। তবে তারপরই বড়দি আবার ছাদের দিকে গেছল। আমরা তখন বারান্দা দিয়ে গলিতে দেখচি কী পড়ল, কীসের ওরকম আওয়াজ হল।’
‘পিসিমার গলার চেনটা চুরি হয়েছিল তুমি জানো?’
‘মা কালীর দিব্যি, ও-হার আমি নিইনি, দাদাবাবু।’ আরতি আর একটু হলেই এসিজির পায়ে পড়ে আর কী!
‘না, না—তুমি নাওনি আমরা জানি। তবে হারটা ক’দিন ধরে পাওয়া যাচ্ছিল না। হয়তো কোথাও হারিয়ে গিয়ে থাকবে…। তারপর—পিসিমা মারা যাওয়ার দিন—ছাদে পাওয়া গেছে।’
আরতি ঠোঁট কামড়ে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল।
‘হারটা কোথায় হারিয়ে গিয়েছিল তুমি জানো?’ আবার প্রশ্ন করলেন এসিজি।
‘মনে হয় হারায়নি কোথাও। হয়তো মায়ের কাছটিতেই রেখে দিয়ে পিসিমা পাগলামির খেয়ালে ভুলে গেছে।’
এসিজির ভুরু কুঁচকে গেল। তিনি একবার দীপ্তিমানের দিকে দেখলেন। দুজনে চোখাচোখি হল।
‘হারটা সত্যি-সত্যি হারালে মা চেঁচিয়ে বাড়ি মাথায় তুলত। দোকান-ফেরত সামান্য চার আনা আট আনার গণ্ডগোল হলেই আমায় যেরকম মুখ করে!’
এসিজির কোঁচকানো ভুরু সোজা হচ্ছিল না। মনে-মনে নতুন একটা ছবি আঁকার চেষ্টা করছিলেন তিনি। মনে হচ্ছিল, চারুবালাকে শুধু নিয়তির অদৃশ্য হাত পিছন থেকে ধাক্কা দেয়নি, তারও পিছনে হয়তো মানুষেরও হাত ছিল।
এসিজি আনমনা হয়ে গেলেন। মাথার পিছনে হাত নিয়ে সাদা চুলের গোছায় টান মারতে শুরু করলেন।
তারপর হঠাৎই আরতিকে বললেন, ‘ঠিক আছে, তুমি যাও। আমার সঙ্গে যেসব কথা হল কাউকে বলবে না। বললে তোমারই বিপদ হবে।’
আরতি ফ্যাকাসে মুখে মাথা নেড়ে চলে গেল।
কাজের লোকরা সত্যি-সত্যিই কাজের লোক। এটাকে কি যমক অলঙ্কার বলা চলে? আপনমনেই হাসলেন বৃদ্ধ হুনুর। তারপর বললেন, ‘গোস্বামী রঙ্গলাল / বাদ বাকিটা হবে কাল।’
‘কী বুঝলেন, ডক্টর গুপ্ত?’ দীপ্তিমান ইতস্তত করে জিগ্যেস করলেন।
‘মোটামুটি বোধহয় বুঝতে পারছি। আপনার সন্দেহ সত্যি হলেও হতে পারে। কাল আমি আর রঙ্গলালবাবু এ-বাড়িতে আর-একবার আসব। কী, রঙ্গলালবাবু, সময় হবে তো আপনার?’
আকর্ণ হাসলেন রঙ্গলাল ‘প্রশ্নটি অতি অবান্তরম/সময় হইবে সুনিশ্চিতম।’
দিনের আলোয় যে-বাড়িটাকে জীর্ণ অসুস্থ বলে মনে হচ্ছিল, রাতের আঁধারে সেটাকে ভুতুড়ে বলে মনে হল।