তিনি ভদ্রলোক ছিলেন বাস্তবিক।
.
৭৬.
হেমেন্দ্রপ্রসাদের কৃপায় মাস বরাদ্দ মজুরিটা মজে গিয়ে আমি প্রায় মোক্ষাভের পথেই এগিয়েছিলাম বলা যায়।
হ্যাঁ, মজুরিই বলব। লেখার মোট ফেলে সেই মোটের ওপর কিছু পাওয়া–আমাকে লেখক হিসেবে এক মেহনতি মজদুর ছাড়া আর কিছুই মনে করিনে। বাহুবল অভাবে রিক্শা টানতে পারিনে বলেই অঙ্গুলিসম্বল এই কলম টানি–চিরকালই নিজেকে মজুর বলে জানি। মাথার মোট গেলে আর মজুরি না পেলে বেকার দশায় নিজেকে কেমন মুমুক্ষু বা মুমূর্ষ বলেই মনে হতে থাকে।
বরাদ্দের শতকরা বিশভাগ মোচন হতেই নির্বিষ ঢোঁড়াসাপের পর্যায়ে পৌঁছেছিলাম। পাঁচ দশ টাকার লেখায় উঞ্ছবৃত্তির ফসল কোথায় মেলে তার জন্য ঢোঁড়াছুঁড়ি লাগিয়েছিলাম, তার ওপর বাকী আশীভাগটাও বাদ গিয়ে…কী বলব? শেষপর্যন্ত বুঝি আশীর্বাদই দাঁড়াল। মায়ার গ্রন্থিমুক্ত হয়ে হাতে হাতেই মোক্ষলাভ হল আমার।
সেদিনকার সাহিত্যের বৈঠকখানায় খানা আর বৈঠক দুই-ই উপাদেয় ছিল সন্দেহ নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে আরও উপাদেয় আর একখানা জুটল আমার–অশোকবাবুদের ঐ প্রস্তাব।
শাপে বর হয়ে গেল আমার। বারে বারে আমার বরাতে এইটেই ঘটেছে, দেখেছি আমি।
অল্প লইয়া থাকি/তাই মোর/যাহা যায় তাহা যায়! তা সত্যি; কিন্তু ওই তাহা-টুকুও গেলে যাহা-র পরেও যাহা আছে আরও যে তাহা-তাহা থাকে, তার খবর পাই না। ভাগ্যের বরখাস্ত না হলে বুঝি বিধাতার বরহও আমার নাগালে আসে না। মহাপ্রসাদের পরমায় নিজের গালে পাইনে। চাঁচলরাজবাড়ির পিলখানায় রাজহস্তী মোহনপ্রসাদের সম্মুখে যেমনটা দেখেছিলাম একদা, তেমনি করে উসিতরসের মতই আপনার থেকে মুখে উঠে আসে না খাবার।
ষোলো আনা গেলেই–সেই পর্বের পরেই আমার পড়ে পাওয়া সেই আঠারো আনা গেলার পার্বণ!
হেমেন্দ্রবাবুর অভিসম্পাতের মত এককালের সেই শিশির-সম্পাতও আমার জীবনে মাহেন্দ্রযোগ হয়ে দেখা দিয়েছিল।
খতিয়ে দেখলে দেখা যায়, কেউ কারো কোনো ক্ষতি করতে পারে না কখনোই। ওপরওয়ালার যেন তাতে সায় দেওয়া দস্তখতি নেই। তাই সব ক্ষতি বিক্ষতি পুষিয়ে গিয়ে নেপথ্যের থেকে পরম উচ্চাতি হতে দেখা যায়। যেমন নাকি কবে চক্ৰবাহননে মুহ্যমান মহর্ষি বাল্মীকির কণ্ঠ থেকে অন্তরের শোক প্রথম শ্লোক বাক্যের স্বচ্ছন্দ উচ্চারণে উদগীত হয়েছিল একদা…সেই-মা নিষাদ প্রতিষ্ঠাং তমগমঃ শাশ্বতীসমা…সেই রকম শিশির-সম্পর্কিত সভাপজনিত সেইকালের একটি কথাই শেষকালে কিনা প্রতিষ্ঠা দিল আমাকে।
মনের দুঃখে আমি বলেছিলাম, কার কাছে মনে পড়ে না ঠিক, হয়ত বা কল্লোলের আড্ডাতেই, শিশির ভাদুড়ি নহ, বোতলের তুমি! নিঃসন্দেহ বিদ্বেষবশেই। কিন্তু আমার সেই কথাটিই লাখ কথার এক কথা হয়ে দাবানলের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ল দিগ্বিদিকে। আমার বড়ো বড়ো কবিতা, ছোট ছোট গল্প, ইয়া ইয়া প্রবন্ধ, তাবৎ রচনা ছাপিয়ে…কী করে কে জানে দেশময় ছড়িয়ে পড়ল শেষটায়!
লিখে বার করিনি, ছাপা হয়নি কোথাও, তবু চাপা রইলো না। পা-মোড়া আমার সেই প্রথম বি-রসের ভিয়েন পান্তুয়ার মতই যেন লোকের মুখে মুখে ফিরতে লাগল। নিষাদযোগে পাওয়া বাল্মীকির পরম উপলব্ধির মতন বিষাদযোগে পাওয়া আমার সেই প্রথম দুর্বাক্যই আমার মোক্ষম প্রাপ্তিযোগের কারণ।
কারণ প্রাণতোষ ঘটক যখন (তার অনেক পরে ) বসুমতীর মালিকানা উত্তরাধিকার করে তাদের কাগজে লিখতে ডাকলেন আমায়, তখন সেই কথাটিরই পুনরুল্লেখ করলেন আমার কাছে…
আপনি ওই শিশির ভাদুড়ি নহ-র মতই টপিক্যাল খবরের ওপর দুচার লাইনের ওই ধারার টিপ্পনি দিয়ে এক-কলম করে লিখুন না রবিবারের বসুমতীতে…লিখবেন?
আমি যেন হাতে স্বর্গ পেলাম, বলতে কী!
তার আগে আমি দু-পাঁচ টাকার উঞ্ছবৃত্তি করেছি, চয়নিকা ইত্যাদি অধুনালুপ্ত নানান পত্রিকায় লেখা দিয়ে, তার মধ্যে মৌচাক থেকেই পেয়েছি আমি ম্যাসিমা। রামধনুর থেকেও প্রায় তাই। আর মিনিমাম্ এসেছে যতো খুদে খুদে ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে। সারা কলকাতা ঝেটিয়ে তারা এসেছিল, তাদের পাড়ার কিংবা ইস্কুলের হাতে-লেখা পত্রিকায় আমার লেখা নিতে, কিন্তু আমি একেবারে অমনি লিখব না, লিখতে পারব না জেনে সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের পকেট হাতড়ে যা পেয়েছে বার করে দিয়েছে…পাঁচ আনা, সাত আনা, এমনকি চোদ্দ আনা পর্যন্ত খসিয়ে আমার একটা অত্যন্ত ছোট গল্প কিংবা অতিশয় খাটো কবিতা নিয়ে গেছে তাদের পরিচালিত পত্রিকায় প্রকাশের জন্য। এবং তার পরে, তারাই ইস্কুলের টিফিনের পয়সা জমিয়ে আমার গল্পের বই কিনে-সেকালে তার দাম ছিল চার আনা, ছআনা মাত্র–আমার বাজার গরম করেছিল–দেশে প্রদেশে চারিয়ে দিয়েছিল তারাই, আমি স্থির নিশ্চিত। লাইব্রেরি থেকে পাঠছলে বাড়ি নিয়ে ছিঁড়েখুঁড়ে মলাট উড়িয়ে শেষপর্যন্ত লোপাট করে লাইব্রেরিয়ানকে আবার কিনতে বাধ্য করেছিল–তারা ছাড়া আর কেউ না, আমার দৃঢ় বিশ্বাস।
সেকালে এমনি করেই আমায় বেঁচেবর্তে রেখে একালে এনে পৌঁছে দিয়েছে সেই বালখিল্যের দল। আমার জীবনে আমি কোন ছেলেমেয়েকে মানুষ করতে পারিনি, পাছে সেই দায় পোহাতে হয়, সেই ভয়ে বিয়েই করলাম না একদম, কিন্তু অবশ্যই আমি বল যে, বাংলার ছেলেমেয়েরা আমাকে মানুষ করার জন্য হদ্দমু চেষ্টা করেছিল।