যথার্থই তাই। সেরকম অল্প কথার চুটকি লেখায় সামান্য খাটুনির সুযোগ পাওয়া আমার পক্ষে সৌভাগ্যই বটে।
এর আগে একাধিকবার কানাইবাবুর কাছ থেকেও আমি আনন্দবাজারে লঘু গুরু নিবন্ধ রচনার আমন্ত্রণ পেয়েছিলাম, কিন্তু ততটা প্রণোদিত হইনি। যে কাজে বেশ পড়াশোনা আর অধ্যবসায় লাগে তাতে স্বতঃই আমার তেমন উৎসাহ জাগে না। সে কাজটা আমার মনের মত মনে হয়নি, কিন্তু এটা আমার মনের মতন কাজ।
অবশ্যি প্রেমেন একবার বলেছিল বটে আমায় যে, কাজ মনের মত না হোলো তো কী! কাজের মতন মন হলেই হয় কাজে লেগেই মনকে কাজের মত করে নেয়া যায়। যে কোনো কাজে লাগলেই হয়। কাজে লেগেই, লেগে থাকতে থাকতেই মন এসে যায়। প্ৰেমেন বুঝিয়েছিল আমায়। এমন কি এ তত্ত্বও সে শুনিয়েছে, বিশেষ করে আমাদের এই বয়সের তরুণ মন, জলের মতই তরল, যে-আধারে থাকে সেই আকারই পেয়ে যায়। পেয়ে যায়, সব কিছু খাপ খেয়ে যায়, কিছুই বেখাপ্পা লাগে না। দিনকতক থাকলে এমন কি জেলখানাতেও মন বসে যায় তার।
যা বলেছো ভাই! নিজের মন খতিয়ে সায় দিই আমি তার কথায় : আমি আগে কী বোগাই না ছিলাম যে আমার সে চেহারা তুমি দ্যাখোনি। সেই দিব্যকান্তি দেখলে মানুষ মূৰ্ছা যেতো! মেয়েরা বিশেষত। এমন হৃষ্টপুষ্ট হয়ে এলাম কোথা থেকে? সেই জেলখানা থেকে-জেলের খানা থেকেই। এমন মন বসে গেছল যে, চলে আসতে চাইছিল না, কিন্তু এমনি তাদের কানুন ভাই, টার্ম ফুরিয়ে গেলে তার একদিনও বেশি তারা রাখে না, রাখতেই চায় না কিছুতে, হাজার সাধলেও নয়।
অমনিই হয় ভাই! সে বলে : বেংগল ইমিউনিটির কাজটা তোমাকেই নিতে বলছিলাম তাই। দেখো মন বসে যাবে ঠিক। এই বয়সে এমন অযাচিত সুযোগ ছাড়তে নেই। টাকার কতো দরকার তা জানো?
জানি। তবে মন লাগছে না যে, কী করব? দশটা পাঁচটা এক জায়গায় আটকা থাকা, স্বাধীনতা আর সময় বাঁধা রেখে…সে টাকার-কী দাম!
মনে তোমার কাজ লাগেনি, তাই কাজে মন লাগাতে পারছে না! দুনিয়া জুড়ে এত এত লোক কাজ করছে তাহলে কী করে? ছোট বড়ো কতো রকমের কাজ করছে! করছে কী করে তারা? এ যদি না পারো তো কোনোদিনই তুমি কোনো কাজে লাগবে না, না নিজের না পরের। কোনো কাজই হবে না তোমার দ্বারা। কোনোদিন কিছুই তুমি করতে পারবে না।
পারলাম না। সত্যিই নাহক নট কিছু থেকে গেলাম ছেলেদের সেই মার্বেল গুলির মই অনড়–নট নটচড় নট্ কিচ্ছুই। ছেলেবেলা আর কাটল না আমার জীবনে।
জানি যে, কেজো লোক হলেই কাজের কাজী হওয়া যায় একদিন। কিন্তু তা আমি হতে পারলাম কই? প্রেমেনদের মতো কাজের কাজীও হলাম না, নজরুলের মতন কাজীর কাজও হল না আমার দ্বারা।
কিছুই হল না, তবে কোনো খেদও নেই। মনের গর্ভে বা জীবনের পর্বে অশান্তিও নেই কোনো। দুর্দশা হয়ত কদাচ একটু থাকলেও দুরাকাঙ্ক্ষীর দুরত্ত দশাও পায়নি কখনো আমাকে।
কাজ করতে করতেই কর্মবীর হয় কে না জানে! নিতান্ত আলামোহ্ন দাশ হতে না পারলেও একাতই তাকে আলালের ঘরের দুলাল হয়ে কিংবা আলাভোলা বাউন্ডুলে হয়ে জীবন কাটাতে হয় না। না হলেও, তার বাড়ি গাড়ি ফ্রিজ সোফাসেট রেডিয়ো রেকর্ড-প্লেয়ার বৌ-টো-সেই সঙ্গে ছেলেপুলেও তো হয় অন্তত। এয়ারকন্ডিশন্ডু সব, ইয়ার্কি নয়!
সবই তার হয়, আর যেটা যায় সেটা তার সময়। আকাশের মতন ফাঁকা অখন্ড অবকাশ। মুক্ত পাখায় মনের সঞ্চরণের অনন্ত বিস্তার।
কবি বলেছিলেন, অবকাশটাই জীবনের আসল। পেয়ালার ফাঁকটাই রসে ভরে ওঠে। বিজ্ঞানী আর যন্ত্রবিাও বলছেন, শেষ পর্যন্ত সব মানুষকে চূড়ান্ত অবকাশ দেওয়াটাই তাঁদের কাম্য, তার জন্যই নাকি তাদের সাধনা।
সেই এনতার অবকাশ আমি হারাতে যাব?
কবি গেয়েছিলেন, দুয়ার মোর পথ পাশে/ সদাই তারে খুলে রাখি/ কখন কার রথ আসে/ ব্যাকুল হয়ে জাগে আঁখি!
জীবনের আনন্দমেলায় রথ দেখার সঙ্গে কলা বেচার সৌভাগ্য হয় না তার। রাজার দুলাল ঘরের সুমুখ দিয়ে চলে গেলেও, নিজের মন দেওয়া দূরে থাক, চোখের পলক দেখারও ফাঁক পায় না বেচারা। মুখমিষ্টির বিনিময়ে মিষ্টি মুখ, চোখে এবং চেখে, দেখে দেখে যাবার সুযোগ সে হারায়। দিন রাত কাজের গাদায় আর প্রয়োজনের তাগাদায় জড়িয়ে প্রিয়জন মিলনের ফুরসত তার হয় না। জীবনম হলাহল পান করে যায়, তার অমৃত আস্বাদের সময় সে পায় না। জগতের আনন্দযজ্ঞে আমন্ত্রিত হয়েও নিজের যজ্ঞভাগে বঞ্চিত থাকে। হয়ে ওঠা, হয়ে যাওয়া, হতে হতে যাওয়া তার হয় না।
তবে পরমান্নের ভাগীদার হয়েই বা কী, তাও বলা যায় বটে। শেষ পর্যন্ত সবই তো হারাতে হয় সবাইকে। সব কিছুই অরিয়ে যায়। সমস্তই খোয়া যায়, খোয়ার থাকেই আখেরে। বিলকুল হারায়, মহাভিক্ষু আর পথের ভিখারী সবারই একই দশা দাঁড়ায়। খতম হয় সব, সবাই। কবিকেও দুঃখ করে বলতে হয়, হায়রে হৃদয়/তোমার সঞ্চয়/দিনাতে নিশান্তে শুধু পথপ্রান্তে ফেলে যেতে হয়।
তাহলেও সেই পথভ্রষ্ট জীবনেও মুহুর্মুহু হৃদয় হারানোর প্রতিমুহূর্তের প্রাপ্তিযোগ রয়েছেই, যা নাকি হারাবার নয়। তার শেষ অঙ্কে, অঙ্কের শেষ ফল শূন্য হলেও, চরম ক্ষতির সঙ্গে পরম প্রাপ্তি বুঝি ওতপোত থাকে, সেই শূন্যস্থলই বারে বারে অমৃত রসে পূর্ণ হয়ে ওঠে, ক্ষণে ক্ষণে জনে জনে ভরে দিয়ে যায়। সেদিনের বৈঠকখানায় নোকি, খানার বৈঠকে) সেই পরম ক্ষণই এল বুঝি আমার আবার আনন্দবাজারের সেই আমন্ত্রণ।