শিশুসাহিত্য-সারথি তুমি হে!
হে সুধীর সরকার!
হে-সুরধুনীর ভগীরথ তুমি, তোমারে নমস্কার।
কবিতাটা লিখেই কিন্তু আমার মন খারাপ হয়ে গেল–সুধীরবাবুর জন্য ততটা নয়। যতট ঐ কবিতাটার জন্য। সুধীরবাবু তো গেছেনই, তাঁর কাছে আর আমার কোনো প্রাপ্তিযোগ নেই, কিন্তু সেই সঙ্গে আমার কবিতাটাও গেল।
ওটার থেকে কোনো দক্ষিণা পাওয়ার আশা নেই, চাওয়া যায় না। যদিও তাঁর ছেলে সুপ্রিয় সরকার তাঁরই ঐতিহ্যধারায়, তাহলেও এহেতু কিছু দাবী করতে সঙ্কোচ কেমন বাধে না? যেখানে অন্নদাশঙ্কর, প্রেমেন্দ্র প্রমুখ তা-বড়ো তা-বড়ো লেখক অমনি তাঁদের লেখ দিয়েছেন ঐ স্মারকে, সেখানে এই লেখকেরও চক্ষুলজ্জা বলে একটা কিছু থাকতে পারে থাকা উচিত।
তাহলে আমার কয়েক ঘন্টার এই পরিশ্রম পুস্তিকার মাঠে মারা গেল অমনি? ভাবতে মনটা খচ খচ করে কেমন।
যাঁর কাছ থেকে অত পেয়েছি তাঁকে সামান্য একটু শ্ৰদ্ধা, নো হয় পদ্যাকারেই হোলো দিতে আমার কী কার্পণ্য! এতেই আমি কীরূপ স্বার্থপর মন্দমতি নীচাশয় তা টের পাবেন। আমিও তা টের পাইনি যে তা নয়, কিন্তু স্বভাব কি পালটায়? এই আমিই আবার শিশিরকুমার, শরৎচন্দ্রকে অর্থপর বলে দুষেছি, অথচ আমি নিজে কিরকম অর্থগৃধু ত দেখুন!
তবে ভেবে দেখলে অর্থলোলুপ কে নয়? শরৎ, শিশির তো মাথার ঠাকুর, এমনবি বিগ্রহরূপী নারায়ণ থেকে বিড়লা পর্যন্ত সকলেই পরার্থপর। কেউ কিছু কম যান না। সামনে পড়ে পাওয়া চোদ্দ আনা দেখলে প্রায় সবারই হাত বাড়াবার সম্ভাবনা।
কিন্তু ব্যতিক্রম কিছু থাকেই-সুধীরবাবু সেই ব্যতিক্রম। সুধীরবাবু আমার মনের কথ (কিংবা ব্যথাই বলা যায়) কি করে যেন টের পেয়েছিলেন, দেহরক্ষার পর ঈশ্বর লাভের হে; ঈশ্বরের ন্যায় অন্তর্যামী হওয়া যায় বোধ হয়, ( যায় কি যায় না তা দেবযানের মহানস্রষ্টা আমার বন্ধু বিভূতিভুষণই বলতে পারতেন!) এক্ষেত্রেও দেখা গেল প্রায় সেই রকমটাই।
পরের সপ্তাহে দেখলাম, আমার সেই কবিতাটা আনন্দবাজার পত্রিকার আনন্দমেলায় পুনর্মুদ্রিত হয়েছে। দক্ষিণাবাবদে আমি পনের টাকা পেয়ে গেলুম। মরার পরেও খাঁড়া ঘা বসিয়ে গেলেন তিনি আমায়-যদিও তো রূপোর খাঁড়াই। দেহ রেখেও তিনি দিয়ে গেলেন, তারপরেও সামান্য কিছু স্নেহ রেখে গেলেন এই অধমের জন্যে।
পরে শুনেছিলাম, ওটা কানাই সরকার মশায়ের সৌজন্যেই আনন্দমেলায় ছাপা হয়েছিল। তাহলেও দেখুন-সেই সরকার। এখানেও! আমার টাকা-নাই দশা জানতেন বলেই কানাইবাবু আমার এই প্রাপ্তিযোগটা ঘটিয়েছিলেন মনে হয়।
অসামান্য প্রাপ্তিযোগও ঘটেছে আমার তাঁর দৌলতেই। আনন্দবাজারের সূত্রে এখন আমার যে অল্পবিস্তর আমদানি, তার গোড়াতেও তিনিই। তিনি এবং অশোক সরকার মশাই। আর সেটাও ঘটেছিল সুধীরবাবুঘটিত এক মৌচাকখানার আসরেই। সেখানেও উপলক্ষ সুধীরচন্দ্র সরকার, পরোক্ষভাবেই যদিও।
কানাইবাবু সেকালে মৌচাকের বৈঠকে কখনো কখনো আসতেন। এবং প্রায়ই বলতেন আমায় আনন্দবাজারের সম্পাদকীয় পৃষ্ঠায় লেখা দিতে। কী ধরনের লেখা? আউট অব নাথিং–যা কিছু। আমার লেখাটাই তো নাথিং তার মধ্যে। কিছুই থাকে না বলতে গেলে, তাই বোধ হয় ঐ সহজ বায়নাটাই দিয়েছিলেন তিনি আমাকে।
কিন্তু আউট অব নাথিং কিছু লিখতে যাওয়াটাই তো সামথিং। সম্পাদকীয় পৃষ্ঠার তৃতীয় লীডারে যে লঘু রচনাটি থাকে তা মোটেই সামান্য নয়, অসাধারণ এক লেখকের অসামান্যতার পরিচয় তার মধ্যেও-তেমনটা লেখা কি আমার পক্ষে সম্ভব? তাছাড়া, আমার ভাষার ত্রুটি। কথ্য ভাষার আমার গদ্যভঙ্গী ঐ পৃষ্ঠার অকথ্য ভাষার রচনাবলীর সঙ্গে খাপ খাবে কি? যদিও কথ্য ভাষার ক্রিয়াপদগুলি অকথ্যতায় (বস্তুত বেশির ভাগ ক্রিয়াই তো অকথ্য!) বদলে দিলেই নিছক সাধুতায় দাঁড়িয়ে যায়, তাহলেও স্বভাবতই আমি ইতস্তত করেছি। লেখা নিয়ে দেখা দিইনি তাঁর কাছে।
কিন্তু একদিন অভাবিত মাহেন্দ্রযোগ ঘটে গেল অকস্মাৎ। বছরে একবার করে সুধীরবাবুর হেফাজতে আনন্দবাজার, অমৃতবাজার, উল্টোরথ, মৌচাকের সাহিত্য পুরস্কার বিতরণী সাহিত্যিক বৈঠকে বসে–তেমনি এক সাহিত্যবাসরে যোগাযোগটা ঘটল।
উক্ত বাসরে কোনো বক্তৃতাবাজি থাকে না, কিন্তু গলাবাজি বেশ। বাজি ধরে গলাধঃকরণের মতন খাদ্যরাজি উত্তম। চপ কাটলেট থেকে শুরু করে আইসক্রিম অব্দি-যথেষ্ট খাও!
সেবার ল্যান্সডাউন রোডের একটা হিন্দী স্কুলে বৈঠকটা বসেছিল। তিনজনের করে ছোট ছোট টেবিল সাজানো, সব টেবিলই ভর্তি-ঠাই নাই ঠাঁই নাই ছোট সে ঘরে। আমি তো দিশেহারা, টেবিলে টেবিলে খানা, দেখছি, কিন্তু নিজেকে কোনোখানেই দেখছি না।
একটা টেবিলে একটা আসন খালি কেবল। সেখানে অশোকবাবু আর কানাইবাবু বসে সেখানে গিয়ে সাহস করে তৃতীয় জন কেউ বসেনি তখনো। আমি দুঃসাহস ভরে এগিয়ে যেতেই কানাইবাবু আমায় ডাকলেন, পরিচয় করিয়ে দিলেন অশোকবাবুর সঙ্গে।
সাহস পেয়ে এগিয়ে টেবিলের শূন্যস্থল তৃতীয় স্থান অধিকার করলাম গিয়ে। অশোকবাবু কথায় কথায় বললেন, বসুমতীতে আপনার বাঁকা চোখে কলমে যেমনটা আপনি লিখে থাকেন, সেই ধরনের একটা হিউমারস কলম আনন্দবাজারে লিখতে আপনার আপত্তি আছে?
আপত্তি কিসের! আমি বললাম, তেমন সুযোগ পেলে তো আমি বর্তে যাব, সেটা ভাগ্য বলেই মনে করব আমার।