তা নিয়ো না হয়। কিন্তু রামের প্রায় সমবয়সী হবে না? অবশ্যি আজকাল কেউ বয়স নিয়ে মাথা ঘামায় না আর। জাত কুল নিয়েই বাছ-বিচার করে না শুনছি।
তা তোমরা কি আসছে মাসেই যাচ্ছ তাহলে? সব ঠিক? প্রায় ঠিক। কর্তা এক মাসের নোটিশ দিয়েছেন–এখান থেকে এখন ছাড়ান পেলেই হয়। কর্তা এর পরে বাড়ি বসে প্র্যাকটিস করবেন ঠিক করেছেন। তোমরা কলকাতায় কখনো এলে আমাদের বাড়ি এসো কিন্তু দিদি?
হ্যাঁ, একবার তো যেতেই হবে কলকাতায়–এই হাতের মানতটা ছাড়াতে হবে আমাকে।
আচ্ছা আসি দিদি, হ্যাঁ, যেজন্যে এসেছিলাম-কাল সকালে দশটার মধ্যে রাম ও সত্যকে আমাদের বাড়ি পাঠিয়ে দিয়ে মনে করে, কেমন?
কেন দিদি?
কাল ভাইফোঁটার দিন না? আহা, ওদের কোনো বোন নেই কী দুঃখু! নিজের দাদার সঙ্গে ওদেরকেও ফোঁটা দেবে মেয়েরা। ভাই-ই তো ওরা।
আচ্ছা, দেবো পাঠিয়ে। হাসিমুখে মা বললেন।
আমাদের রান্নাঘর আর ভাড়ার ঘরটাই ছিল দুতরফের সীমান্ত প্রদেশ।
মাঝখানের একটা দরজার খিল খুলে যাতায়াত করা যেত। দু বাড়ির গিন্নিরাই ঐ পথে যেতেন আসতেন-আমরা ও-পথ কোনোদিন ব্যবহার করতাম না।
রান্নাঘর দিয়ে রিনির মা সেই পথেই চলে গেলেন।
শুয়ে শুয়ে ভাবতে লাগলাম আকাশ-পাতাল।
মেজোটার সঙ্গে বিয়ে কেন? রিনির সঙ্গে হলে কী হয়? কেন, রিনির সঙ্গে কি হতে পারে না আমার বিয়ে? সে তো বয়সে ছোটই আমার চেয়ে…ওর মেজদির চেয়ে কি খুব খারাপ মানাবে তাহলে?
না, মেজোকে কোনোদিন আমার চোখে লাগেনি। মনেও লাগেনি কোনোদিন। ওর সঙ্গে বিয়ে কী! ধ্যুৎ!
করলে আমি রিনিকেই বিয়ে করব। সুবিধে মত মাকে বলতে হবে একদিন… ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়েছি।
ঘুম থেকে তুলে খাওয়াতে হয়েছে আমায়।–কিরে, তোর পড়াশুনা কিছু নেই আজ? ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কাটালি সন্ধ্যে বেলাটা। দেখি গা-টা…গা তো গরম হয়নি, ভালোই আছিস তো, ঘুমুচ্ছিলি কেন তবে?
এমনি। ভালো লাগছিল না।
নে, খেয়েদেয়ে শুয়ে পড় তাহলে। নটা বাজে প্রায়…
খেয়েদেয়ে নটায় শুয়ে উঠলাম পরদিন সকাল নটায়। শুনলাম সত্য কখন গিয়ে ফোঁটা নিয়ে ফিরে এসেছে। ঘুমুচ্ছিলুম বলে আমাকে ভোলা হয়নি। মুখ ধুয়েই চলে গেলাম সটান।
দেখলাম, আসন পাতা। আসনের সামনে পায়েস পিঠে সন্দেশ সব সাজানো। ধান দূর্বা, চন্দন সব তৈরি।
তার আগে জীবনে কোনো বোনের ফোঁটা পাইনি। বেশ লাগছিল কিন্তু, সত্য-টত্য সবার, ফোঁটা হয়ে গেছে আগেভাগেই। আমার বাকী কেবল।
প্রথমে নানু আমায় ফোঁটা দিল কোনরকমে মন্তর আউড়ে। ওর মা বললেন, রামকে একটু আদর কর। রাম তোর ছোেট না? ছোট ভাইয়ের মতই।
আদর আবার কী! বলে সে আলতো হাতের এক চাপড় বসিয়ে দিল আমার ঘাড়ে এই তো আদর।
তারপর মেজোর পালা। না, সে ফোঁটা দেবে না কিছুতেই কাল আমার মা কী বলেছেন না? সেইজন্যেই।
রিনি, তোর রামদাকে ফোঁটা দে এবার। বললেন মাসিমা।
রিনি, ফোঁটা দিল তার পর। বেশ স্পষ্ট করে মরটা পড়ল-যমের দুয়োরে কাঁটা দেওয়া পর্যন্ত বাদ দিল না কিছুই। ফোঁটা দিয়ে আমার পায়ে হাত ঠেকিয়ে প্রণাম করল তার পর।
জীবনে সেই প্রথম আমি প্রণাম পেলাম একজনের। বেশ রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা সত্যিই যেমন রোমাঞ্চিত হয়েছিলাম পরে আরেকবার যেবার আমার উত্তর কৈশোরে একজন প্রায়-যুবকের কাছ থেকে আপনি বলে সোধিত হতে শুনেছিলাম। কিন্তু ওটা যেন আর চেয়েও আরো বেশি মিষ্টি-আপনির চেয়েও আরও যেন আপনার।
ভাবছিলাম, মাসিমা ওকেও হয়ত একটু আদর করতে বলবেন আমাকে।কেন জানি না, তা বললেন না কিন্তু। পাছে সে আমার অন্য ঘাড়ে আরেক থাপ্পড় ঝাড়ে সেই ভয়েই হয়ত
কিন্তু আমি জানি, বললে পরে সেদিনকার সেই সন্দেশ খাওয়ানোর মই সে করে বসত আবার–সবার সামনেই।
যা, আদর না পাই, দাদার প্রাপ্য প্রণাম পেয়েছি তো!
.
০৯.
আমার জীবনে তুই একমাত্র মেয়ে। তুই প্রথম আর তুই-ই শেষ। তোকে ছাড়া আর কোনো মেয়েকে আমি জানি না, জানতে চাই না।
সেদিন ছাদের বুকে বসে কিশোরী রিনিকে বুকের কাছাকাছি পেয়ে কিশোর আমার একথা বলতে এতটুকু বাধেনি। উপন্যাসের নায়কের মতই উপস্থিত কথায় তুখোড় হয়ে উঠেছিলাম আমি সেই ঐচোড় বয়সেই–অল্প বয়েস থেকে উপন্যাস পড়ে পড়েই হয়ত আমার এই উপযুক্ত হওয়া। কিংবা হয়ত ভালোবাসায় পড়লে সহজেই এমন সব উপলব্ধি ঘটে, যাতে মজবুত কথার যুতসই জবাব যতো মুখের ওপর আপনার থেকেই এসে যায়।
খুব ছোটর থেকে নভেল পড়ে পড়ে পেকে উঠেছিলাম। প্রায় কায়মনোবাক্যে পরিপক্ক। কায়ের দিক থেকে ততটা হয়ত না হলেও মনোবাক্যে তো বটেই। পাকা পাকা কথা কইতে পারতাম বেশ।
আর মেয়েদের তো এমনিতেই কথার বাঁধুনি। স্বভাবতই তারা নভেলটি–সর্বদাই।কোনো রোমান্স কাহিনী না পড়েও তারা বোরামান্টিক। আজন্ম নায়িকা। মুহুর্মুহু রোমাঞ্চকর।
তাই সহজেই সে বলতে পেরেছিল, এই তো তোমার জীবনের শুরু গো! আমার পরেও আরও কত মেয়ে পাবে, কতজনাই তোমার জীবনে আসবে–তখন তুমি অনায়াসেই ভুলে যাবে আমায়। দেখে নিয়ে। এই সামান্য বয়সেই নারীসুলভ অসামান্যতার দুঃস্বাভাবিক নৈপুণ্যে জীবনের এত বড় তত্ত্ব দুকথায় ব্যক্ত করতে একটুও তার বাধেনি।
সটান আমার উপন্যাসপাঠের ভূমিকায় আসতে হয় এবার…
সেকালের সব ছেলের মতন আমারও গ্রাম্য পাঠশালায় বাল্যপাঠ শুরু। এখনকার মতন অলিগলিতে কে জি ইস্কুলের পত্তন হয়নি তখন, গগ্রামে তো নয়ই; গেয়ো পণ্ডিতের আটচালায় গিয়ে লেখাপড়া শিখতে হত সবাইকে।