সকল শিক্ষক অবশ্য ওই তত্ত্বাবধায়কের মতো নিষ্ঠুর ছিলেন না। অনেকেই, ছাত্রদের ভাষায়, বেশ সহযোগিতা করেছেন পরীক্ষার্থীদের সঙ্গে।
আমরা যখন অন্যের ঘর সামলাতে ব্যস্ত, তখন যে আগুন লেগেছে নিজের ঘরেই, তা বুঝতে একটু দেরি হয়েছিল। টের পেলাম যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রেরা দাবি করে বসলো, এম এ ফাইনালে তারা লিখিত পরীক্ষা দেবে না, মৌখিক পরীক্ষা নিয়ে তাদের ফল নির্ণয় করতে হবে। আমাদের শিরে বজ্রাঘাত। শিক্ষকেরা এ-দাবি মানবেন না, পরীক্ষার্থীরাও ছাড়বে না। আবেদন নিবেদন শেষ হলে শুরু হলো সংগ্রামের পালা। উপাচার্যের দপ্তরে ছাত্রদের সঙ্গে আলোচনা পর্যবসিত হয় ঘেরাওয়ে। আমরা না-খেয়েদেয়ে সেখানে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটাই, ছাত্রেরা পালা করে খেয়েদেয়ে এসে আমাদের ঘেরাও করে রাখে, কটুকাটব্য করে, স্লোগান দেয়। একসময়ে তারা পাহারা উঠিয়ে নেয়। আবার আলোচনা, আবার ঘেরাও। উত্তাপ বাড়তে থাকে। শেষে উপাচার্য ইন্নাছ আলী নিজেই সিদ্ধান্ত নেন : লিখিত পরীক্ষা হবে, তবে সে-পরীক্ষা বাধ্যতামূলক হবে না; যারা লিখিত পরীক্ষা দেবে না, তারা কেবল মৌখিক পরীক্ষা দেবে। অর্থাৎ কেউ লিখিত ও মৌখিক দুটো পরীক্ষা দিয়ে, আর কেউ শুধু মৌখিক পরীক্ষা দিয়ে, এম এ ডিগ্রি অর্জন করবে। ডিপ্লোমায় কোনো পার্থক্য থাকবে না, তবে নম্বরপত্রী দেখলে তফাৎটা বোঝা যাবে।
আমি এই ব্যবস্থা মেনে নিতে পারলাম না। অমন পরীক্ষার সঙ্গে কোনো সংস্রব রাখবো না বলে ছুটি নিয়ে সপরিবারে কলকাতায় চলে গেলাম। বিভাগের দায়িত্ব বর্তালো ড. মোহাম্মদ আবদুল আউয়ালের ওপরে। তিনিই অন্য সহকর্মীদের সাহায্যে পরীক্ষা নিলেন। বেশির ভাগই শুধু মৌখিক পরীক্ষা দিলো। তার একটা কারণ, লিখিত পরীক্ষা না-দেওয়ার জন্যে পরীক্ষার্থীদের ওপর আন্দোলনকারীদের চাপ। একজন ভালো ছাত্র–তার অন্য গুণও ছিল–সেই চাপের কাছে নতিস্বীকার করেছিল। তার প্রতি স্নেহ ও সহানুভূতি থাকা সত্ত্বেও পরবর্তীকালে আমি তার আনুকূল্য করতে পারিনি–করিনি বললেই ঠিক বলা হয়। সেজন্যে আমার মনে আজো দুঃখ আছে, কিন্তু আবারো ওই অবস্থায় পড়লে আমি ঠিক ওই আচরণই করতাম।
আমার কলকাতায় যাওয়ার আগে, ৭ মার্চ, দেশের প্রথম সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হলো। আমাদের ভোটকেন্দ্র ক্যাম্পাসের সন্নিহিত এলাকায়। দুই গাড়ি করে আমরা একসঙ্গে ভোট দিতে গেলাম–উপাচার্য ইন্নাছ আলী, রেজিস্ট্রার মুহম্মদ খলিলুর রহমান, ইংরেজি বিভাগের অধ্যক্ষ মোহাম্মদ আলী আর আমি। স্বাধীন দেশে এই প্রথম ভোট দিতে যাচ্ছি–মনের মধ্যে প্রচণ্ড উৎসাহ। ভোটকেন্দ্রে গিয়ে সে-উৎসাহ দপ করে নিভে গেল। জানলাম, আমাদের ভোট দেওয়া হয়ে গেছে।
আমাদের এলাকায় সরকারদলীয় প্রার্থী জয়লাভ করেছিলেন। নিজের ভোটটা আমি তাকেই দিতাম। তিনি এমনিতেই জিততেন। তবে উৎসাহী রাজনৈতিক কর্মীরা সে-আশার ওপর ভর করে নিশ্চেষ্ট থাকতে চায়নি।
পরীক্ষা না দিয়ে পাশ করতে চাওয়া আর ভোট না দিতে দিয়ে নিজেদের প্রার্থীকে পাশ করাতে চাওয়ার মধ্যে কোনো পার্থক্য আমি দেখতে পাইনি।
এবারের নির্বাচনে ৩০০ আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ পেয়েছিল ২৯৩টি। প্রায় দশটা আসনের ফলাফলের যথার্থতা নিয়ে মানুষের মনে প্রশ্ন ছিল।
১৯.
শেষবার কলকাতায় এসেছিলাম শরণার্থী হিসেবে, এবার এলাম স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে। একটু গর্ববোধ তো ছিলই। আগের মতো এবারেও উঠলাম ছোটোফুপুর বাড়ি। মুক্তিযুদ্ধকালীন বন্ধুরা বাংলাদেশ সম্পর্কে জানতে চান। বলি, সমস্যা পর্বতপ্রমাণ, মন্দ অনেক কিছু ঘটছে, কিন্তু ইতিবাচক ব্যাপারও যা হচ্ছে, তা থেকে আশাবাদী হওয়ার কারণ আছে।
১৯৭১-এ বেবী প্রতিজ্ঞা করেছিল যে, দেশ স্বাধীন না হওয়া পর্যন্ত সে কোনো বিনোদনমূলক অনুষ্ঠানে যাবে না। আমি একবার নাটক দেখতে গিয়েছিলাম, তাকে নিতে পারিনি। এবারে সে জানালো, সে নাটক দেখতে যাবে এবং আমাকে তখন ঘরে বসে বাচ্চাদের সামলাতে হবে। তাই হলো। একাদিক্রমে সে চারটি নাটক দেখে খুশি হয়ে ফিরেছিল : টিনের তলোয়ার, শের আফগান, পাগলা ঘোড়া, তিন পয়সার পালা।
এবার কলকাতা সফর ছিল পুনর্মিলনের আনন্দে পরিপূর্ণ, ব্যক্তিগতভাবে কৃতজ্ঞতাপ্রকাশের সুযোগ তাতে ছিল। আড়াই সপ্তাহ কলকাতায় আনন্দময় সময় কাটিয়ে যথাস্থানে ফিরে এলাম।
২০.
অধ্যাপক ড্যানিয়েল থরনার জাতিতে মার্কিন, কিন্তু সত্তরের দশকে তিনি ছিলেন সোরবোনের ইকোল প্রাতিক দেজৎ ইতুদের দিরেক্তর দেতুদ। এই অর্থনীতিবিদ ছিলেন আমাদের অধ্যাপক নূরুল ইসলাম, অধ্যাপক মুশারফ হোসেন ও ড. স্বদেশরঞ্জন বসুর বন্ধু। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে তিনি নূরুল ইসলামের স্ত্রী ও সন্তানদের বাংলাদেশের বাইরে নিতে সাহায্য করেছিলেন, তাছাড়া নিজে প্যারিস থেকে কলকাতায় এসেছিলেন বন্ধুবান্ধবদের খোঁজখবর করতে। তখনই তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় হয়। ১৯৭৩ সালে স্বদেশ বসু যখন বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের পরিচালক, তখন তাঁর কাছে জানতে পারি, সে-বছরেই প্যারিসে ইন্টারন্যাশনাল কংগ্রেস অফ ওরিয়েন্টালিস্টের দ্বিশতবর্ষপূর্তি উদ্যাপিত হবে এবং ড্যানিয়েলের ইচ্ছা, আমি তাতে যোগ দিই। আমি এই প্রস্তাবে একটু অবাকই হই, তবে সাগ্রহে সম্মতি দিই। যথাসময়ে আমন্ত্রণপত্র এবং টিকিট এসে গেল এবং আমি ফরাসি জাতীয় দিবসে ঢাকা থেকে রওনা হলাম–তবে দিল্লিতে। সেখানে আমাদের হাই কমিশনার ড. এ আর মল্লিকের বাড়িতে একদিন থেকে যাত্রা করলাম বোম্বাইয়ে, সেখান থেকে। সোজা প্যারিস।