প্রায় একই সময়ে বাংলা একাডেমী আবদুল কাদির-সম্পাদিত পাঁচ খণ্ড নজরুল-রচনাবলীর (১৯৬৬-৮৪) একটি নতুন সংস্করণ-প্রকাশের উদ্যোগ নেয়। তার জন্যে সরকারের বিশেষ অর্থ-মনজুরি পাওয়া গিয়েছিল। একাডেমীর মহাপরিচালক মোহাম্মদ হারুন-উর-রশিদ নতুন সংস্করণের জন্যে যে সম্পাদনা-পরিষদ গঠন করেছিলেন, তা এ রকম: সভাপতি–আনিসুজ্জামান; সদস্য–মোহাম্মদ আবদুল কাইউম, রফিকুল ইসলাম, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান, মনিরুজ্জামান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, করুণাময়। গোস্বামী; সদস্য-সচিব–সেলিনা হোসেন। বৎসরাধিক পরিশ্রম করে আমরা চার খণ্ডে এই নতুন সংস্করণ প্রকাশ (১৯৯৩) করতে সমর্থ হই। এই সংস্করণে কবির প্রকাশিত বইগুলি কালানুক্রমিকভাবে বিন্যস্ত হয়। কবির সুস্থাবস্থায়। প্রকাশিত বইপত্রের সর্বশেষ সংস্করণের পাঠ অনুসৃত হয় এবং কবির অসুস্থাবস্থায় প্রকাশিত বইগুলির প্রথম সংস্করণের পাঠ গৃহীত হয়। গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত নজরুলের কিছু রচনা নানা গুচ্ছ করে আবদুল কাদিরের দেওয়া ভিন্ন। ভিন্ন নামে রচনাবলীতে সংকলিত হয়েছিল। সেসব নামে এবং সেসব লেখা নিয়ে কখনো কোনো বই প্রকাশিত হয়নি বলে আমরা গ্রন্থনাম বাদ দিয়ে সেসব লেখা। ‘গ্রন্থাকারে অপ্রকাশিত রচনার অন্তর্ভুক্ত করি। নজরুলের গানের ক্ষেত্রে আমরা
অনুসরণ করি মুদ্রিত পাঠ, রেকর্ডে ধারণকৃত বা স্বরলিপিতে বিধৃত গানের পাঠে ভেদ থাকলে আমরা তা নির্দেশ করিনি, কেননা তা করতে গেলে বহু সময়। লাগতো। নজরুলের অসুস্থাবস্থায় প্রকাশিত যেসব গ্রন্থে তার অন্যান্য প্রকাশিত গ্রন্থের কবিতা অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল, আমরা সেসবের পুনরাবৃত্তি বর্জন করি, তবে এ-সংক্রান্ত তথ্য গ্রন্থপরিচয়ে উল্লেখ করি। আবদুল কাদির-প্রদত্ত গ্রন্থপরিচয় অক্ষুণ্ণ রেখে আমরা ‘পুনশ্চ’ শিরোনামে অতিরিক্ত তথ্য সন্নিবেশ করি। আমরা সাধারণভাবে আধুনিক বানানপদ্ধতি অনুসরণ করি, তবে নজরুলের গ্রন্থনামের বানান এবং যেসব ক্ষেত্রে বানানের কোনো বিশেষত্ব রক্ষা করা অপরিহার্য বিবেচিত হয়, সেসব ক্ষেত্রে মূলের বানান অপরিবর্তিত রাখি। আবদুল কাদিরের নিষ্ঠা ও শ্রমের প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ সম্পাদনা-পরিষদের নামের ওপরে। আমরা ‘আবদুল কাদির-সম্পাদিত নজরুল-রচনাবলী’ কথাগুলো লিপিবদ্ধ করি।
বইটি প্রকাশের পরে প্রায় সকলেই এটাকে প্রামাণ্য এবং অপেক্ষাকৃত উন্নত সংস্করণ বলে গ্রহণ করেছিলেন। বাংলা একাডেমী থেকে এটির পুনর্মুদ্রণও হয়, কিন্তু তারপর বইটি নিয়ে আমি এমন অশিষ্টাচারের সম্মুখীন হই, যার কথা এখানে বলে ফেলাই ভালো।
আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ তখন বাংলা একাডেমীর মহাপরিচালক। তাঁর কাছ থেকে পাওয়া একটি চিঠিতে জানা গেল যে, একাডেমী নজরুল্ল রচনাবলীর একটি পরিমার্জিত সংস্করণ প্রকাশ করতে ইচ্ছুক এবং সেই উদ্দেশে তাঁর দপ্তরে আহূত একটি সভায় আমি আমন্ত্রিত। বস্তুত ওই রচনাবলীর একটি নতুনতর সংস্করণ প্রকাশের আবশ্যকতা ছিল। ১৯৯৩ সালের পরে নজরুলের আরো কিছু লেখা উদ্ধার করা গিয়েছিল, আমাদের সংস্করণের এক-আধটি পুনরাবৃত্তি বর্জনের অপেক্ষায় ছিল। সুতরাং চিঠি পেয়ে খুশি হওয়ারই কথা। কিন্তু সভা-অনুষ্ঠানের একদিন আগে একাডেমীর একজন কর্মকর্তা ফোন করে বললেন যে, মহাপরিচালক ওই সভা স্থগিত করেছেন, পুনর্নির্ধারিত সভার স্থানকাল পরে জানানো হবে। এ-বিষয়ে একাডেমী থেকে কেউ আর কিছু জানাননি। অনেক পরে অন্য সূত্রে জানতে পারি, নজরুল-রচনাবলীর সম্পাদনা পরিষদ পুনর্গঠিত হয়েছে এবং তাতে আগের সম্পাদনা-পরিষদের যে পাঁচজনকে বাদ দেওয়া হয়েছে, তার মধ্যে আমি একজন, আর নতুন যে-দুজন যুক্ত হয়েছেন, তার মধ্যে আবুল কালাম মনজুর মোরশেদ একজন। সম্পাদনা পরিষদ পুনর্গঠনের অধিকার তো একাডেমীর আছেই, তবে তা নিয়ে লুকোচুরি খেলতে হবে কেন?
নজরুল ইন্সটিটিউটের কথায় ফিরে যাই। দু-বছর কার্যকাল শেষ করে মনিরুজ্জামান চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে ফিরে গেলে ১৯৯৩ সালে নজরুল ইন্সটিটিউটের নির্বাহী পরিচালকরূপে আবার যোগ দেন মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ। ১৯৮৫ সালে ইন্সটিটিউটের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে ১৯৯১ সাল পর্যন্ত তিনি ওই পদেই নিযুক্ত ছিলেন। তিনি চাইলেন কবির ছবির একটা অ্যালবাম প্রকাশ করতে এবং এর জন্যে সরকারের বিশেষ অনুদানও পেয়ে গেলেন। নজরুল-অ্যালবাম প্রকাশের জন্যে তিনি একটি কমিটি গঠন করলেন আমাকে আহ্বায়ক করে। ট্রাস্টি বোর্ডের তিনজন সদস্য-ওয়াকিল আহমদ, রফিকুল ইসলাম এবং সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপ-সচিব তাজুল ইসলাম–থাকলেন এই কমিটির সদস্য, আর মাহফুজুউল্লাহ্ হলেন তার সদস্য-সচিব। ছবি সংগ্রহ করতে এবং বাছাই করতে কিছু সময় লেগেছিল। চারটি ছবি আমি জোগাড় করে দিই–বন্ধু আবদুল আলীর বড়ো ভাবি বেগম এ জেড এম আব্দুল আলিমের কাছ থেকে তিনটি আর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষক ইরশাদ কামালের কাছ থেকে একটি। নজরুল-অ্যালবাম প্রকাশিত হয় ১৯৯৪ সালে। অ্যালবামের শিল্প-নির্দেশনা দিয়েছিলেন কাইয়ুম চৌধুরী। আমি এর মুখবন্ধ লিখেছিলাম, তা পড়ে মাহফুজউল্লাহ্ বলেছিলেন, আপনি কবিতা লিখলে পারতেন!’ তবে তা বোধহয় কেবল বন্ধুত্বের অনুরোধে।