মিজানের পরামর্শটা মনে ধরলেও, মুখে একপ্রকার উড়িয়েই দিয়েছিলো হোসেন। বলেছিলো, ‘ধুর, কী সব যে বলিস তোরা! এটা আহামরি কিছুই হয়নি। আসলে ওই অদ্ভুত লোকটা থেকে এই গল্পের মূল উপাদান এসেছে বলেই তোদের কাছে গল্পটাকে ভালো লাগছে। পেছনের গল্পটা না জানলে এটা পড়তে পড়তে তোদের হাই উঠে যেতো। কিন্তু তাই বলে ঢাকাইয়া কাগজে লেখা পাঠিয়ে মান-ইজ্জত খোয়াবো, এমন আহাম্মক আমি নই।’
হোসেনের কথা শুনে ছ্যাঁৎ করে উঠলো শাওন। সে নিজে কখনো সোজা কথার সোজা জবাব না দিলেও, অন্যজনের বাঁকা কথা সহ্য করতে সে একদম অনাগ্রহী। রাগে অগ্নিশর্মা হয়ে সে বললো, ‘হয়েছে জ্বালা! একটুখানি প্রশংসা পেলো, আর এখন এমন অভিনয় করছেন যেন ভাজা মাছটা উল্টে খেতে না জানবার মতোই কচি খোকা তিনি।
শাওনের অগ্নিবাণ নিক্ষেপে হস্তক্ষেপ করে মিজান আবার বলে উঠলো, ‘আমার পরিচিত এক কাকা আছেন ঢাকায়। ভালো একটা প্রেসে কাজ করেন। শেষবার ঢাকা থেকে কাকার সাথে সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নয়াদিন’-এর অফিসে গিয়েছিলাম। বেশ খাতির-যত্ন পেয়েছিলাম সেদিন আমরা। আমার ধারণা, কাকাকে বলা গেলে কাকা তোমার গল্পটা ছাপাবার একটা বন্দোবস্ত করে দিতে পারবেন।’
শাওনের স্পষ্ট গলা, ‘এতো ভালো গল্পটার জন্য কাকা-চাচার কাছে ধরনা দিতে হবে কেন? ওই পত্রিকার ঠিকানায় আমরা গল্পটা পাঠিয়ে দেখি। ভালো লাগলে ওরা ছাপাবে। ভালো না লাগলে বাদ। অন্য কোথাও দেওয়া যাবে তখন।’
নীরস স্পষ্টবাদী এবং লাগামহীন মুখের অধিকারী হলেও কথাটা খারাপ বলেনি শাওন। আর তা ছাড়া, অন্য কারও সহায়তায় নিজের যোগ্যতা প্রমাণে বাহাদুরি নেই–এ কথা হোসেন জানে। সকলের মতামতও তা-ই, আগে গল্পটা সাপ্তাহিক ‘নয়াদিন’-এ পাঠানো হোক, যা হয় হবে।
পরদিন সকালেই ডাকযোগে হোসেনের গল্পটা ঢাকার নামকরা সাপ্তাহিক পত্রিকা ‘নয়াদিন’-এর ঠিকানা বরাবর পাঠিয়ে দেওয়া গেলো। এরপর যাপিত জীবনের জাঁতাকলে সকলে যে যার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
বলা নেই, কওয়া নেই একদিন হোসেনের ঠিকানায় একটা চিঠি এসে হাজির। সম্প্রতি সাপ্তাহিক নয়াদিনের সম্পাদক ব্যতীত জীবনে সে কোনোদিন কাউকে কোনো চিঠি লেখেনি। ফলে পৃথিবীতেও এমন কেউ নেই যে হোসেনকে চিঠি লিখতে পারে। নিজের লেখা নিয়ে খুব বেশি আশাবাদী ছিলো না বলেই হয়তো, নয়াদিনে যে একটা গল্প পাঠানো হয়েছিলো এবং তার প্রত্যুত্তরও যে আসতে পারে–তা বেমালুম ভুলে বসেছিলো সে।
চিঠি হাতে নিয়ে যারপরনাই বিস্মিত হলো হোসেন। হলুদ খামের ওপর খুব স্পষ্ট করে, গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘আদিত্য আদি, সম্পাদক, সাপ্তাহিক নয়াদিন।’ প্রাপকের ঠিকানায় লেখা তার নাম। স্বপ্নও এতো সুন্দর আর এতো আকস্মিক হয় কি না জানে না হোসেন! এতো নামকরা একটা পত্রিকার সম্পাদক তার নামে চিঠি পাঠিয়েছে–তা যেন হোসেনের কাছে সেই মধুর স্বপ্নের মতো, চোখ খুললেই যা হাপিস হয়ে যায়। কিন্তু এই যে হোসেনের সামনে দিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে একটা অটো চলে গেলো, দর্জিবাড়ির উঠোনে ঐ যে ছেলেমেয়ের দল কী এক দারুণ খেলায় হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে, মাথার ওপর দিয়ে সাঁই করে চলে গেলো যে অ্যারোপ্লেন–এ সবকিছু একযোগে কীভাবে স্বপ্ন হতে পারে!
ওটা স্বপ্ন ছিলো না। হোসেন সত্যি সত্যিই নয়াদিন সম্পাদকের চিঠি পেয়েছে। চিঠিতে যা লেখা ছিলো তা হোসেনের এক জীবনে পাওয়া সবচেয়ে সেরা প্রাপ্তি।
সুহৃদ,
আপনার ‘ভিনগ্রহী আগন্তুক’ গল্পটা পড়ে শেষ করলাম। বহুদিন পর চোখ ডুবিয়ে এতো দুর্দান্ত একটা রহস্য গল্প পড়া হলো। গল্পভর্তি যেমন সাসপেন্স আছে, তেমনই আছে পাঠককে শেষ পর্যন্ত টেনে নিয়ে যাওয়ার অসম্ভব ক্ষমতা। আপনার গল্পটা ‘নয়াদিন’-এর আগামী সাময়িকীতে আমরা বিশেষভাবে ছাপাতে চাই। ‘নয়াদিন’-কে বেছে নেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ। ‘নয়াদিন’-এ নিয়মিত লিখবেন এই প্রত্যাশী। আপনার জন্যে ছোট্ট একটা উপহার পাঠানো হয়েছে। উপহারটা গ্রহণ করে আমাদের কৃতার্থ করবেন।
ধন্যবাদান্তে
আদিত্য আদি
সম্পাদক, সাপ্তাহিক নয়াদিন।
চিঠির ভেতরে অন্য একটা খামে মোড়ানো পাঁচ হাজার টাকা পাওয়া গেলো। মিজানের কথা বৃথা যায়নি মোটেও। পত্রিকা-অফিস গল্পটার জন্যে ভালো অঙ্কের সেলামিও পাঠিয়ে দিয়েছে। হোসেনের মনে ঈদের দিনের মতো আনন্দ! তার ইচ্ছে করছে দর্জিবাড়ির উঠোনে খেলাধুলোয় মজে থাকা ছেলেপিলের দলে মিশে গিয়ে হেসে লুটোপুটি খেতে। আহ, জীবন মাঝে মাঝে এতো সুন্দর কেন?
মাসখানেক পর হোসেনের ঠিকানায় আরও একটা চিঠি এসে হাজির। প্রেরক আগের জনই–নয়াদিনের সম্পাদক আদিত্য আদি।
সুহৃদ,
ভালোবাসা জানবেন। আপনি জেনে পুলকিত হবেন যে, আপনার ‘ভিনগ্রহী আগন্তুক’ গল্পটি ইতোমধ্যেই পত্রিকায় ছাপানো হয়েছে এবং তা আমাদের পাঠকদের বেশ ভালোবাসা কুড়িয়েছে। আপনার পরবর্তী গল্প পড়ার জন্য মুখিয়ে থাকা পাঠকদের অপেক্ষার প্রহর খুব বেশি দীর্ঘ হবে না_ এই প্রত্যাশা। আর হ্যাঁ, আপনার যদি সময় হয় তাহলে নয়াদিন অফিসে চায়ের নিমন্ত্রণ রইলো। কোনো এক হেমন্ত-সন্ধ্যায় আমরা ধোঁয়া ওঠা চায়ের কাপ হাতে দারুণ গল্প-আড্ডায় মেতে উঠবো।