- বইয়ের নামঃ বাংলার জাগরণ
- লেখকের নামঃ কাজী আবদুল ওদুদ
- বিভাগসমূহঃ প্রবন্ধ
বাংলার জাগরণ
উৎসর্গ
বাংলা ভাষার দেশে যে অমর জনগণের মধ্য থেকে আত্মপ্রকাশ করেছিলেন রামমোহন রায়, রামগোপাল ঘোষ, অক্ষয়কুমার দত্ত, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, মধুসূদন দত্ত, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, কালীপ্রসন্ন ঘোষ, বিপিনচন্দ্র পাল, জগদীশচন্দ্র বসু, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদী, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, বেগম রোকেয়া, এস ওয়াজেদ আলি, মোহাম্মদ লুতফর রহমান, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, জসীমউদ্দীন, জয়নুল আবেদীন, শেখ মুহম্মদ সুলতান, চিত্তরঞ্জন দাশ, সুভাষচন্দ্র বসু, আবুল কাসেম ফজলুল হক, মওলানা ভাসানী, শেখ মুজিবুর রহমান প্রমুখ রেনেসাঁসের ও গণজাগরণের মনীষীরা–যে জনগণের উপর অপরিসীম আস্থা নিয়ে, সম্পূর্ণ আপনত্ত্বে বোধ নিয়ে কাজ করেছিলেন ডিরোজিও, ডেভিড হেয়ার-সেই জনগণের উদ্দেশে।– সম্পাদক
সম্পাদকের নিবেদন
অন্তর্গত চাহিদার তাগিদে আর ইউরোপের জ্ঞান-বিজ্ঞান ও সভ্যতা-সংস্কৃতির অভিঘাতে বাংলার চিন্তানায়ক ও কর্মনায়কদের মধ্যে উনিশ শতকের শুরুতেই এক মহান নবচেতনার প্রকাশ সূচিত হয়। এই নবচেতনা তাদের তাড়িত করে ধর্মসংস্কার ও সমাজসংস্কার প্রচেষ্টায়, জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চায় ও নতুন সাহিত্যসৃষ্টিতে। এ-উপলক্ষে কলকাতায় পর্যায়ক্রমে দেখা দেয় নতুন নতুন কর্মযজ্ঞ। রামমোহন-দেবেন্দ্রনাথ-কেশবচন্দ্রের চিন্তাধারা ও ব্রাহ্মসমাজের সংস্কারপ্রচেষ্টা, ডিরোজিও-ডেভিড হেয়ার ও ইয়ং বেঙ্গলদের বিচারপ্রবণতা আর উদ্দাম কর্মকাণ্ড, রাধাকান্ত-ভবানীচরণ ও ধর্মসভার প্রতিক্রিয়া, অক্ষয়কুমার-বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের কর্মমুখী বলিষ্ঠ চিন্তাধারা, রামকৃষ্ণ-বিবেকানন্দ-অরবিন্দের নতুন ধর্মোপলব্ধি ও প্রচারকার্য, ঈশ্বরগুপ্ত প্যারীচাঁদ-মধুসূদন-দীনবন্ধু-বঙ্কিমচন্দ্র-কালীপ্রসন্ন ঘোষ- গিরীশঘোষ দ্বিজেন্দ্রলাল-রবীন্দ্রনাথ-ত্রিবেদী-শরৎচন্দ্র প্রমুখের সাহিত্যকর্ম, জগদীশবসু প্রশান্তমহলানবিশ-মেঘনাদ সাহা-সত্যেনবসুর বিজ্ঞানসাধনা, গুরুদাস বন্দ্যোপাধ্যায়-আশুতোষ মুখোপাধ্যায়-দীনেশসেনের শিক্ষাব্রত, আবদুল লতিফ-আমির আলির চিন্তা ও কর্ম, বেগম রোকেয়া ও লুতফর রহমানের চিন্তাধারা ও সংস্কারপ্রচেষ্টা, নজরুলের সৃষ্টিপ্রয়াস, এস ওয়াজেদ আলি, মোহাম্মদ ওয়াজেদ আলী, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল হুসেন ও মুসলিম সাহিত্য সমাজের বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলন, ওদুদ-মোতাহার-মোতাহেরের সৃষ্টিসাধনা, প্রগতিশীল ও রক্ষণশীল ধারার সাময়িকপত্র ও সংবাদপত্র এবং আরো অনেক কিছুর মধ্য দিয়ে অভিব্যক্ত হয়েছে এই নবচেতনা। নবচেতনার অভিব্যক্তি ছিল জীবন-জগতনিষ্ঠ, বৈচিত্র্যময় ও বহুভঙ্গিম। এরই ধারাবাহিকতায় দেখা দেয় গণজাগরণ আধুনিক রাজনীতি।
রামমোহন-ডিরোজিওর কালে এই নবচেতনা ছিল বহুলাংশে স্বগত সত্তায় (an entity in itself), বিদ্যাসাগর-বঙ্কিমের কালে এসে তা উত্তীর্ণ হয় সচেতন সত্তায় (an entity for itself)। নবচেতনার ফলে প্রথমে ঘটে বৌদ্ধিক জাগরণ, তারপর গণজাগরণ। গণজাগরণের ধারায় দেখা দেয় রাজনৈতিক নেতৃত্ব–আত্মপ্রকাশ করেন সুরেন্দ্রনাথ, বিপিনপাল, চিত্তরঞ্জন, সুভাষবসু, খাজা সলিমুল্লাহ, আকরম খাঁ, নাজিমউদ্দিন, ফজলুল হক, ভাসানী, সোহরাওয়ার্দি, শেখ মুজিব। গোটা প্রক্রিয়ার মধ্যে হিন্দু-মুসলমান মিলনের প্রয়াস যেমন ছিল, তেমনি ছিল বিরোধ ও স্বাতন্ত্রেরও বিকাশ।
এই নবচেতনা ও জাগরণই বাংলার জাগরণ বা বাংলার রেনেসাঁস। আসলে তা বাঙালির জাগরণ বা বাঙালির রেনেসাঁস। বাঙালির আত্মশক্তি এবং চিন্তা ও কর্মের পরম্পরার (tradition) উপর ইউরোপীয় সভ্যতা সংস্কৃতির অভিঘাত ও সংশ্লেষণের (thesis-antithesis-syathesis) মধ্য দিয়ে বিকশিত হয়েছিল এই নবচেতনা। কার্ল মার্কস ১৮৫৩ সালে ‘ভারতে ব্রিটিশ শাসন’ প্রবন্ধে মন্তব্য করেছিলেন, “ব্রিটিশ-শাসিত ভারত তার সমস্ত অতীত ঐতিহ্য, তার সমগ্র অতীত ইতিহাস থেকে পৃথক হয়ে পড়েছে।” কথাটা তিনি বিশেষভাবে বাংলা বা বাঙালি সম্পর্কেই বলেছিলেন। এর আশি বছর পরে ‘কালান্তর’ প্রবন্ধে রবীন্দ্রনাথ মন্তব্য করেছিলেন : ইংরেজ এল কেবল মানুষ রূপে নয়, ‘নব্য-ইউরোপের চিত্তদূত’ রূপে। “ইউরোপীয় চিত্তের জঙ্গমশক্তি আমাদের স্থাবর মনের উপর আঘাত করল, যেমন দূর আকাশ থেকে আঘাত করে বৃষ্টিধারা মাটির পরে, ভূমিতলের নিশ্চেষ্ট অন্তরের মধ্যে প্রবেশ করে প্রাণের চেষ্টা সঞ্চার করে দেয়, সেই চেষ্টা বিচিত্র রূপে অঙ্কুরিত বিকশিত হতে থাকে।” দেশি-বিদেশি ভাবুকেরা মুগ্ধবিস্ময়ে ব্রিটিশ শাসিত বাংলার এই নবায়ন ও জাগরণ সম্পর্কে মত ব্যক্ত করে চলেছেন।
নানা ঐতিহাসিক কারণে বাংলার হিন্দু সম্প্রদায় বাংলার মুসলমান সম্প্রদায়ের তুলনায় অগ্রসর ছিল। জাগরণের ধারায় হিন্দু-মুসলমানের সাম্প্রদায়িক পার্থক্য ও ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের বিভেদনীতির (divide and rule) মধ্যে ক্রমেই প্রখর হয়ে ওঠে হিন্দু-মুসলমানের বিরোধ। এর ফলে এক পর্যায়ে রাজনীতিতে জাতীয়তাবাদের (nationalism) স্থলাভিষিক্ত হয় সাম্প্রদায়িকতাবাদ (communalism) উদ্ভাবিত হয় দ্বিজাতিতত্ত্ব (nations theory) তাতে ব্রিটিশ শাসন থেকে মুক্তি ও নিজেদের রাষ্ট্রগঠনের বেলায় ভারতবর্ষ ভাগ হয়, বাংলা ভাগ হয়, পাঞ্জাব ভাগ হয়-। জাগরণের প্রতিটি স্তরেই ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা অনেক লক্ষ করা যায়। ইউরোপের রেনেসাঁসের প্রতিটি স্তরেও ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতাও অনেক আছে। এক এক দেশের এক এক জাতির এক এক অবস্থা–মিল যেমন আছে তেমনি আছে অমিলও। সমস্ত ত্রুটি-বিচ্যুতি ও সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ব্রিটিশ-শাসিত বাংলার ইতিহাস উল্লিখিত নবচেতনা ও জাগরণের ধারা ধরেই এগিয়েছে। মানবীয় দুর্বলতার ফলে সৃষ্ট বিপর্যয়াদি অতিক্রম করে মানবীয় শক্তি আর নবচেতনা দ্বারাই নির্ধারিত হয়েছে ইতিহাসের গতি। অসাধারণ প্রতিভাবান ব্যক্তিদের এক মহামিছিলের সাক্ষাৎ মেলে ব্রিটিশ-শাসিত বাংলার জাগরণের ধারায়। গণজাগরণের সময়ে সাধারণ মানুষ ঔপনিবেশিক শাসন ও জমিদারতন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগ্রামে অসাধারণ বিক্রমে আত্মশক্তির জানান দিয়েছে।