- বইয়ের নামঃ কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ
- লেখকের নামঃ কাজী আবদুল ওদুদ
- বিভাগসমূহঃ কবিতা
কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ
কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ
কালিদাসপ্রীতি রবীন্দ্রনাথ লাভ করেছিলেন উত্তরাধিকার সূত্রে। মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথের ‘আত্মচরিতে’ কালিদাসের ভাষা মাঝে মাঝে উঁকি দিয়েছে, বিশেষ করে যেখানে তিনি হিমালয়ের শোভা-সৌন্দর্যের বর্ণনার চেষ্টা করেছেন।
মহর্ষির কালিদাসপ্রীতি তাঁর বিখ্যাত পুত্রদের প্রায় প্রত্যেকেই সংক্রামিত হয়েছিল। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের শকুন্তলার অনুবাদ কিঞ্চিৎ পরিবর্তিত করে রবীন্দ্রনাথ তাঁর শকুন্তলা’ প্রবন্ধে উদ্ধৃত করেছেন, আর নবমেঘোদয়ে দ্বিজেন্দ্রনাথের সানুরাগ ‘মেঘদূত’-আবৃত্তি কিশোর-রবীন্দ্রনাথের চিত্ত যে গভীরভাবে স্পর্শ করেছিল ‘জীবনস্মৃতি’র পাঠকরা তা জানেন।
কিন্তু প্রতিভার স্বধর্ম স্বীকরণ-অনুকরণ নয়। রবীন্দ্রনাথের গভীর কালিদাসপ্রীতিতে তাঁর সেই স্বীকরণ-বৃত্তি কার্যকরী হয়েছে। কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথের সম্পর্কের বিচার এক উপাদেয় সাহিত্যিক বিষয়, কিন্তু সহজসাধ্য নয় আদৌ, কেননা কালিদাস ও রবীন্দ্রনাথ দুই কালের দুই মহাভাবুক ও মহাশিল্পী। এ-বিষয়ে মাত্র কিছু কিছু ইঙ্গিত দিতে আমরা চেষ্টা করবো।
প্রথমেই চোখে পড়ে কালীদাসের সৌন্দর্য-বোধে ও রস-বোধে আর রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-বোধে ও রস-বোধে পার্থক্য। এ বিষয়ে মিলও তাঁদের মধ্যে যথেষ্ট। এই দুই কবিই পৃথিবীর শোভা-সৌন্দর্যের একান্ত অনুরাগী: কালিদাস ইন্দ্র সারথি মাতলির মুখে বলেছেন–অহহ উদাররমণীয়া পৃথিবী; তার সঙ্গে আত্মিক যোগ রয়েছে রবীন্দ্রনাথের এই ধরনের অগণিত উক্তির :
শ্যামলা বিপুলা এ ধরার পানে,
চেয়ে দেখি আমি মুগ্ধ নয়ানে…………(কবির পুরস্কার)
মাটির সুরে আমার সাধন–
আমার মনকে বেঁধেছে রে
এই ধরণীর মাটির বাঁধন। (গান)
বিশেষ লক্ষ্য করার বিষয় এই যে দুই কবির চোখেই পৃথিবীর মহিমা যেন অন্যনিরপেক্ষ–পৃথিবীর যিনি স্রষ্টা ও নিয়ন্তা তাঁর কথা অনেকখানি বিস্মৃত হয়ে এরা উপভোগ করেছেন পৃথিবীর শোভা-সৌন্দর্য। এক্ষেত্রে জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রকৃতপ্রেমিক ওয়ার্ডসোয়ার্থের সঙ্গে এঁদের পার্থক্য সুস্পষ্ট, কেননা, ওয়ার্ডসোয়ার্থ
প্রকৃতির অপরূপতার সঙ্গে অভিন্নভাবে দেখেছেন বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের নিয়ন্তার মহিমা। মায়াবাদী হিন্দুর কুলে এই দুই কবির জন্ম যেন অদ্ভুত। কিন্তু হিন্দুর মায়াবাদকে হিন্দু অহিন্দু উভয়েই অসঙ্গত-রকমে বড় করে দেখেছেন। প্রাচীন হিন্দু যে শুধু–এমনকি মুখ্যত–মায়াবাদী ছিলেন না তার প্রকৃষ্ট প্রমাণ বাৎস্যায়ন, চাণক্য আর বিশেষভাবে ব্যাস– তাঁর মহাভারতের সংখ্যাহীন নায়ক-নায়িকা দোষে গুণে এমন প্রাণবন্ত যে তেমন বিচিত্র প্রাণবন্ত নরনারী– সৃষ্টি জগতের খুব কম সাহিত্যেই সম্ভবপর হয়েছে। কিন্তু কালিদাসের ও রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-বোধে ও রস-বোধে এতখানি মিল সত্ত্বেও খুব বড় পার্থক্য ফুটে উঠেছে এইখানে যে কালিদাস যথেষ্ট ভোগবাদী– অবশ্য সবল সেই ভোগ তাই অসুন্দর নয় কিন্তু রবীন্দ্রনাথ আনন্দবাদী; কালিদাসের সৌন্দর্য-বোধ ও রস-বোধের চাইতে সূক্ষ্মতর রবীন্দ্রনাথের সৌন্দর্য-বোধ ও রস-বোধে। এ সম্পর্কে কয়েকটি চরণ উদ্ধৃত করছিঃ
বালেন্দুবক্ৰাণ্যবিকাশভাবাদভুঃ পলাশান্যতিলোহিনি।
সদ্যো বসন্তেন সমাগতানাং নক্ষতানীব বনস্থলীনামা।। [১]
আসোদ মিথিলাং স বেষ্টয়ন পীড়িতোপবন- পাদপাং বলৈঃ।
প্রতিরোধমসহিষ্ট সা পুরী স্ত্রীব কান্তপরিভোগমায়তমা।। [২]
জলপ্রান্তে ক্ষুদ্ধ ক্ষুব্ধ কম্পন রাখিয়া,
সজল চরণচিহ্ন আঁকিয়া আঁকিয়া
সোপানে সোপানে, তীরে উঠিলা রূপসী;
স্রস্ত কেশভার পৃষ্ঠে পড়ি গেল খসি।
অঙ্গে অঙ্গে যৌবনের তরঙ্গ উচ্ছল
লাবণ্যের মায়ামন্ত্রে স্থির অচঞ্চল
বন্দী হয়ে আছে–তারি শিখরে শিখরে
পড়িল মধ্যাহ্ন রৌদ্র………..
ঘিরি তার চারিপাশ
নিখিল বাতাস আর অনন্ত আকাশ
যেন এক ঠাই এসে আগ্রহে সন্নত
সর্বাঙ্গ চুম্বিল তার; সেবকের মতো
সিক্ত তনু মুছি নিল আতপ্ত অঞ্চলে
সযতনে, ছায়াখানি রক্ত পদতলে
চ্যুত বসনের মতো রহিল পড়িয়া।
অরণ্য রহিল স্তব্দ, বিস্ময়ে মরিয়া।
ত্যজিয়া বকুলমুল মৃদুমন্দ হাসি
উঠিল অনঙ্গদেব
সম্মুখেতে আসি
থমকিয়া দাঁড়াল সহসা। মুখপানে
চাহিল নিমেষহীন নিশ্চল নয়ানে
ক্ষণকাল তরে। পরক্ষণে ভূমি ’পরে
জানুপাতি বসি, নির্বাক বিস্ময়ভরে
নতশিরে পুষ্পধনু, পুষ্পশরভার
সমর্পিল পদপ্রান্তে পূজা-উপাচার
তৃণ শূন্য করি। নিরস্ত্র মদন পানে
চাহিলা সুন্দরী শান্ত প্রসন্ন বয়ানো (বিজয়িনী)
কালিদাসের ভোগবাদ রবীন্দ্রনাথ যেন সজাগ ভাবেই ‘শোধিত’ করে’ নিয়েছেন। ‘কুমারসম্ভবে’র শেষের অনেকগুলো সর্গ কালিদাসের রচনা নয় এই প্রচলিত মত তিনি অতি মনোজ্ঞ ভাবে সমর্থন করেছেন এই সনেটে–
যখন শুনালে কবি দেবদম্পতিরে
কুমারসম্ভবগান,–চারি দিকে ঘিরে
দাঁড়াল প্রথমগণ,–শিখরের ’পর
নামিল মন্থর শান্ত সন্ধ্যামেঘস্তর,–
স্থগিত বিদ্যলীলা, গর্জন বিরত,
কুমারের শিখী করি পুচ্ছ অবনত,
স্থির হয়ে দাঁড়াইল পার্বতীর পাশে
বাঁকায়ে উন্নত গ্রীবা! কভু স্মিত হাসে
কাঁপিল দেবীর ওষ্ঠ,–কভু দীর্ঘশ্বাস
অলক্ষ্যে বহিল,–কভু অশ্রুজলোচ্ছ্বাস
দেখা দিল আঁখি প্রান্তে–যবে অবশেষে
ব্যাকুল শরমখানি নয়ন নিমেষে
নামিল নীরবে,–কবি, চাহি দেবী পানে
সহসা থামিলে তুমি অসমাপ্ত গানে। (চৈতালি)