তবে, আমাকে সাহস দিতে কার্পণ্য করলো না আমার স্ত্রী ফাতিমা। জাহিদের মৃত্যুতে সেও হতভম্ব এবং আমার মতোই শোকে বিহ্বল; কিন্তু এ বেলায় তার ধৈর্যশক্তি আমার চাইতে প্রবল এবং প্রচণ্ড। চেহারায় তার বিষণ্ণতার ছাপ, তবু সে পরম বিশ্বাসের সাথে আমার সামনে পাঠ করলো এই আয়াত, কুল্লু নাফসিন যা-ইকাতুল মাউত।
তাই তো! কি আশ্চর্য, সারাজীবন মানুষকে বলে আসা, পড়ে আসা এই অমোঘ সত্য-বাণীটা প্রয়োজনের সময়ে আমার মনে রেখাপাত করলো না কেন? আমি কেন বিস্মৃত হলাম, কেন ভুলে গেলাম এই নির্জলা সত্যটাকে?
আমার মনে পড়ে গেলো নবিজি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু-দিনের সেই ঘটনাটা যখন এমনিভাবেই মৃত্যুর মতো পরম নিশ্চিত ব্যাপারে বিস্মৃত হয়েছিলেন ধরণির একজন মহাপুরুষ–উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু৷ সেদিন তিনি বিশ্বাসই করতে পারছিলেন না যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাললাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের মৃত্যু হতে পারে! শুধু বিস্মৃতই নয়, এই মৃত্যু-সংবাদের বিরুদ্ধে গর্জে উঠেছিল তার সহজাত তেজ এবং তলোয়ার। যারাই বলবে নবিজির মৃত্যু হয়েছে, তাদের বিরুদ্ধেই তিনি জারি করে রাখলেন মৃত্যুর পরোয়ানা। প্রিয় মানুষের বিরহ এবং বিদায় যদি তার মতো মানুষকেও ভুললামনা বানাতে পারে, সেখানে আমি আবার কোন ছার?
পৃথিবীতে তিন ধরনের মানুষ আছে। একদল সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাস করে, আরেক দল করে না। আবার, এই দুই দলের মাঝামাঝি একটা দল আছে। তারা সৃষ্টিকর্তায় বিশ্বাসও করে না, আবার অবিশ্বাসও করে না। বিশ্বাসী, অবিশ্বাসী এবং সংশয়বাদী যা-ই হোক না কেন–সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব নিয়ে টানাটানি চললেও জগতের একটা ব্যাপার নিয়ে কারও মধ্যে কোনো বিরোধ কিংবা দ্বিমত নেই। সেটা হলো মৃত্যু। পৃথিবীর ইতিহাসে দম্ভভরে অনেকেই নিজেকে খোদা দাবি করবার দুঃসাহস দেখিয়েছে; কিন্তু নিজেকে খোদা বলে দাবি করা লোকটাও নিজের নশ্বর অস্তিত্বকে কোনোদিন একমুহূর্তের জন্য অস্বীকার করতে পারেনি। জনসম্মুখে না হোক, নির্জন নিরালায় তার মনে মৃত্যুর একটা তাগাদা থাকত ঠিকই। মৃত্যু বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ধার ধারে না। সে তার দম্ভের মতো অমোঘ, সে তার শক্তির মতো অবশ্যম্ভাবী।
জাহিদ আমার বাল্যকালের বন্ধু। আমরা একসাথে পড়াশোনা করেছি। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে আমি আমেরিকা চলে গেলেও শিকড়ের টানে দেশেই রয়ে যায় সে। জাহিদের ছিলো শিক্ষক হবার দুনিৰ্বার নেশা। দেশে এসে দেখি সে ব্যবসা করছে। সারাজীবন চিরকুমার থাকার পণ করে থাকা জাহিদকে আমি আবিষ্কার করলাম। একটি কন্যাসন্তানের বাবা হিসেবে। ছোটোবেলার কোনো কথাই সে রাখতে পারেনি। জীবনে সে যতো রকমের ওয়াদা করেছে তার সবটাই তাকে ভাঙতে হয়েছে। খুব ছোটোবেলায়, পাটোয়ারীদের পেয়ারা গাছে বসে, পা ঝুলাতে ঝুলাতে আমাকে ছেড়ে না যাওয়ার ওয়াদা করেছিলো সে। অথচ সেই ওয়াদাও রাখা হলো না তার। আজ সে আমাকে রেখেই চলে গেছে। কবির ভাষায়, ‘চলে যাওয়া মানে প্রস্থান নয়। সত্যি কি তা-ই? জাহিদ কি আর কখনোই ফিরে আসবে আমাদের মাঝে? আর কি কখনো আমরা একসাথে শাপলা তুলতে বেরুবো? ঝড়-বাদলের দিনে একসাথে আম কুড়ানো, স্কুল ফাঁকি দিয়ে মাঠ-তেপান্তর চষে বেড়ানো আমার সোনালি অতীতের বন্ধুটা কি আর কখনো এসে দরজায় কড়া নেড়ে বলবে, তাড়াতাড়ি আয়, নইলে কিন্তু তোকে রেখেই চললাম?’ বলবে না। মৃত্যু মানেই হলো নিশ্চিত প্রস্থান।
জাহিদকে একবার খুবই বিমর্ষ অবস্থায় পেলাম। মুখের কোণে সারাক্ষণ হাসি ধরে রাখা বন্ধুটাকে এমন অবস্থায় দেখে আমার মনটাও ভারি হয়ে উঠলো। জিগ্যেশ করলাম, কী ব্যাপার? তোকে এতোটা বিষণ্ণ দেখাচ্ছে কেন? কোনো সমস্যা?
মায়াভরা চোখে সে আমার দিকে তাকালো। চোখ তার জ্বলে টলমলো। ভারী বর্ষণের খানিক আগে আকাশ যেমন গুমোট আকার ধারণ করে–সেরকম। বুঝতে পারলাম কোনো সমস্যা হয়েছে এবং সমস্যাটা খুবই গুরুতর। রাগত গলায় আমি বললাম, ভারি আশ্চর্য! কী হয়েছে সেটা তো বলবি, নাকি? এমন বোবা হয়ে থাকলে বুঝবো কী করে?
আমার কথা শেষ হতে না হতেই ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল জাহিদ। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সে আমাকে জড়িয়ে ধরল। কোনোরকমে তাকে শান্ত করে বললাম, ‘জাহিদ, তুই না বড় সাহসী আর সংযমী? এভাবে ভেঙে পড়লে হয়? আমাকে বল না কী হয়েছে? আমি না তোর সবথেকে প্রিয় বন্ধু?’
তার চোখের জলের অবিরাম বর্ষণ তখনো বন্ধ হয়নি। অশ্রুসিক্ত নয়নে সে আমার হাত দুটো ধরে বললো, আমার মেয়েটার ব্রেইন টিউমার হয়েছে রে। চোখের সামনেই সে আস্তে আস্তে জটিল অবস্থার দিকে যাচ্ছে। বাবা হয়ে আমি ঠিকমতো তার চিকিৎসাও করাতে পারছি না। বিশ্বাস কর বন্ধু, মেয়েটার কিছু হলে আমি আর তোর ভাবি, আমাদের কেউই হয়তো বাঁচবো না’, বলতে বলতেই জাহিদ আবারও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলো। আমার শক্ত-সামর্থ্য মনের বন্ধুটাকে এভাবে ভেঙে পড়তে দেখে আমিও ভেতরে ভেতরে খান খান হয়ে যাচ্ছি।
আমাদের কোনো সন্তানাদি নেই। সন্তানের জন্য বাবা-মায়ের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা উপলদ্ধি করবার সুযোগও তাই মেলেনি কোনোদিন। মেয়ের জন্য জাহিদের এমন হৃদয়-নিংড়ানো আবেগ আর দরদ দেখে অনুধাবন করলাম এই অপার্থিব ভালোবাসা পৃথিবীর কোনো শব্দ-বন্ধনী, কোনো বাক্য-বিন্যাসে বর্ণনা করা সম্ভব নয়।