সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তির একটা অন্যতম বড় কারণ আমাদের সোশ্যাল প্রোফাইল। ব্যাপারটা আগেই আমি বিস্তারিত লিখেছি। এই সোশ্যাল প্রোফাইল তৈরির জন্য আমাদের অনেক বেশি কন্টেন্ট তৈরি করতে হয়। অনেক বেশি পোস্ট, অনেক বেশি ছবি, অনেক বেশি ভিডিও পাবলিশ করতে হয়। অনেক বেশি কন্টেন্ট-মুখর হতে গিয়ে আমাদের অধিক সময় এখানে ব্যয় করতে হয় সাধারণত। ফলে, এটার জন্য আমাদের ভাবতেও হয় প্রচুর। সোশ্যাল মিডিয়ায় অত্যধিক অ্যাক্টিভিজমের যদি লাগাম টেনে ধরা যায়, তাহলে সাশ্রয় করা যাবে আমাদের অনেক সময়ের। যত কম কন্টেন্ট, তত কম সময় সোশ্যাল মিডিয়ায়।
অনেককে দেখবেন, যারা একদিনে ফেইসবুকে পাঁচ থেকে দশটা পর্যন্ত পোস্ট দেয় নিয়ম করে। সমপরিমাণ ছবি আর ভিডিও আপলোডও করে। তারা যখন দেখে যে, তাদের লেখাগুলো অধিক মানুষের কাছে পৌঁছাচ্ছে, ছবি আর ভিডিওগুলো অনেক মানুষ দেখছে, তখন তারা সারাক্ষণ ভাবতে থাকে পরের লেখাটা কোন বিষয়ে লেখা যায়, পরের ছবিটা কীসের ছবি দেওয়া যায়, পরের ভিডিওটা কোন বিষয়ের ওপর তৈরি করা যায়। এসব ভাবনা-চিন্তা সারাটা সময় তার মস্তিষ্কে কিলবিল করতে থাকে, যা তাকে বারংবার সোশ্যাল মিডিয়ায় ফিরে আসতে প্রলুব্ধ করে। ফলে যখনই সে সোশ্যাল মিডিয়ার বাইরে আসে, তার মনে হতে থাকে যে, সে বুঝি নিজের জগতের বাইরে চলে এসেছে।
সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি কমাতে আমরা আমাদের অ্যাক্টিভিটিজের আধিক্য কমিয়ে আনতে পারি।
‘Mr. X commented on your post’, ‘Mr. Y accepted your friend requesť, ‘You have a new message from Mr. Z’, ‘Mr. L sent you a friend request’–এই জাতীয় নোটিফিকেশনগুলো আমাদের সকলের খুব প্রিয়, তাই না? ফেইসবুক ব্যবহার করছে কিন্তু এসব নোটিফিকেশনে অভ্যস্ত নয়–এমন লোক খুঁজে পাওয়া বেশ দুরূহ বটে!
আপনি জেনে বিস্মিত হবেন–ফেইসবুকে আপনার অধিক সময় ব্যয়ের অন্যতম একটা নেপথ্য কারণ এসব নোটিফিকেশন। সর্বপ্রথম এসবই আপনাকে প্রলুব্ধ করে যে–’এসো, এখানে তোমার জন্য কী আয়োজন অপেক্ষা করছে দেখে যাও। আপনার পোস্টে কেউ লাইক করেছে, ছবিতে কেউ কমেন্ট করেছে, আপনাকে কেউ একজন ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছে, কেউ আপনার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করেছে–এসবে আপনি দারুণভাবে উদ্দীপ্ত হয়ে ওঠেন। এগুলো চেক না করে আপনি তখন থাকতে পারেন না। নোটিফিকেশনের ওপর ক্লিক করে আপনি মুহূর্তে চলে আসেন নীল শাদার সোশ্যাল মিডিয়ায় আর ডুবে যেতে থাকেন আপনার জন্য সাজানো আয়োজনে। আপনি এসেছেন কেবল একটা নোটিফিকেশন চেক করতে, কিন্তু এসে দেখলেন আপনার কোনো এক বন্ধু মালদ্বীপ ভ্রমণের ছবি পোেস্ট করেছে। সেই নয়নাভিরাম ছবিগুলো দেখার জন্য আপনার মন তখন আকুপাকু করবেই। আপনি দেখতে শুরু করলেন সেগুলো এবং পড়তে লাগলেন পোস্টের নিচে থাকা মন্তব্যগুলোও। সেখানে একটা মন্তব্যে আপনার চোখ আটকালো। কেউ একজন তার নেপাল ভ্রমণ সংক্রান্ত পোস্টের লিংক দিয়ে লিখলো, ‘নেপালও সুন্দর। দেখে আসতে পারেন এভারেস্টের এই দেশটাও।
সেই লিংকে ক্লিক করে মুহূর্তে আপনি চলে গেলেন অন্য এক প্রোফাইলে। একে একে দেখতে লাগলেন নেপালের বিভিন্ন মনোহর প্রাকৃতিক দৃশ্য। সেসব দেখা শেষে নতুন পোস্ট দেখবার আশায় যখন আপনি রিফ্রেশবারে ক্লিক করলেন, আপনার সামনে উপস্থিত হলো কারো দুঃসংবাদ সম্বলিত কোনো লেখা। মনটা একটু খারাপই হবে তখন। সেটাকে পাশ কাটিয়ে স্ক্রল করে আর কিছুদূর গেলে দেখতে পাবেন আপনার কোনো এক ভার্চুয়াল বন্ধু বিয়ে করে ফেলেছে। ব্যাপারটা একদিকে আপনাকে আনন্দ দেবে, অন্যদিকে যদি আপনি অবিবাহিত হন, তখন একটু কষ্ট লাগাটা স্বাভাবিক বটে। আপনি কখন বিয়ে করতে পারবেন, কখন আপনার পরিবার এই ব্যাপারে তৎপর হবে–এসব চিন্তার ঘোর খানিকটা আপনাকে আচ্ছন্ন করতে পারে। একটা আনন্দমাখা দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরেকটু সামনে গেলে দেশের রাজনৈতিক বা সামাজিক কোনো অবক্ষয়ের ঘটনা আপনার সামনে এসে পড়বে। আপনি যারপরনাই ত্যক্ত-বিরক্ত হয়ে ওঠবেন।
এ সবকিছুর শুরুটা কোথায় বলতে পারেন? ওই যে, আপনার ফোনে টুং করে আসা সেই নোটিফিকেশন। আপনি কিন্তু সেটা দেখার জন্যই মূলত ফেইসবুকে এসেছিলেন, কিন্তু মাঝখান দিয়ে কীভাবে কীভাবে যে ঘণ্টা দুই-তিন পার হয়ে গেলো, আপনি টেরই পেলেন না! হ্যাঁ, সোশ্যাল মিডিয়াগুলোর এলগরিদম ঠিক এভাবেই সাজানো। আপনি নানানভাবে এখানে আটকে যাবেন। আপনার ব্রেইনকে আপনার চাইতে তারা ভালো পড়তে পারে।
এই লাগামহীন স্ক্রলিং আরেকটা ক্ষতি করে। শুরুতে ভ্রমণ-সংক্রান্ত পোস্ট পড়ে আপনি আনন্দ পান। ঘুরতে যাওয়ার একটা বাসনা তৈরি হয় আপনার মনে। ঠিক এরপরেই হঠাৎ একটা দুর্ঘটনার সংবাদ এসে আপনার ভাবনায় জায়গা করে নেয় এবং আপনার মনকে ভরিয়ে তুলে বিষাদে। এরপর আরেকটা আনন্দ সংবাদ এবং তারপরে আরেকটা দুঃসংবাদ–এসব ঘটনা ঘন ঘন মুড সুইং করে দেয় আপনার, কিন্তু এত ঘন ঘন মুড সুইংয়ের জন্য আপনার মস্তিষ্ক কি প্রস্তুত? মেডিকেল সাইন্স জানাচ্ছে–মুডের বার কয়েক রদ-বদল মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে নিতে পারে, কিন্তু যদি সেটা লাগামহীনভাবে, প্রতিনিয়ত ঘটতে থাকে আমাদের সাথে, আস্তে আস্তে তা গুরুতর স্বাস্থ্য-সমস্যা তৈরি করে আমাদের শরীরে। হতাশা, মানসিক সমস্যা, অলসতা-সহ নানানভাবে তা ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে আমাদের জীবনকে।